#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_৩২
জাওয়াদ জামী
সকাল হতেই তানিশা নিচে এসেছে। সারারাত সাদিফকে বলে কয়ে রাজি করিয়েছে। সাদিফ রাজি হলেও কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। তানিশা সব শর্ত মেনে নিয়েছে।
” তিয়াসা তুই আর খালা মিলে আমাকে সব জোগাড় করে দে আমি রান্না করছি। ”
” দেখ আপু, তোমার কিছু হলে ভাসুরকর্তা আমাকে ছেড়ে কথা বলবে মনে করেছ! সে একজন বউ পাগলা ব্যাডা। ”
” এই তুই চুপ করবি। কথা কম বলে আমাকে সাহায্য কর। ”
” সুস্থ হতে না হতেই বড় জায়ের মত আচরণ করছ! তিয়াসা তোর দুর্ভাগ্য রে। তুই বোন হয়েও জায়ের মত ট্রিট পাচ্ছিস! কি দিন দুনিয়া আসল ভালো মানুষের ভাত নেই। ” কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ন্যাকা কান্না কাঁদছে তিয়াসা।
তানিশা কিছু না বলে মৃদু হাসে।
” হয়েছে আমার বোন এবার ক্ষান্ত দে। কান্নার আরও সময় পাবি। এখন কাজ শুরু কর। বাবুনি ঘুমিয়ে থাকতেই রান্না শেষ করতে হবে। আবার তুইও তো তূর্ণাকে নিয়ে স্কুলে যাবি। এখন তারাতারি কর। ”
” তুমি সত্যিই পারবেতো আপু? ”
” না পারলে তোরা তো আছিস। ”
দুই বোন কোমর বেঁধে কাজে লেগে পরে।
সন্ধ্যায় তিয়াসা নিজের রুমে তূর্ণাকে পড়াচ্ছে সাথে নিজেও পড়ছে। তূর্ণা একটু আধটু ফাঁকিবাজি করার চেষ্টা করতেই তিয়াসা কঠিন হস্তে তা দমন করছে। একারনে তূর্ণার মুখ ভার হয়ে আছে। তিয়াসা সেটা দেখেও দেখছেনা।
সন্ধ্যার অনেকক্ষণ পরে সাইফ বাসায় এসে প্রতিদিনের ন্যায় তূর্ণাকে রুমে দেখল। চাচ্চুকে দেখেই তূর্ণা পড়াশোনা লাটে উঠিয়ে সাইফের কোলে উঠল। সাইফ ওর জন্য আনা চকলেট, আইসক্রিমের বক্সগুলো হাতেই দিতেই ধুমধাম কয়েকটা চুমু খেয়ে বসে। বিনিময়ে সাইফও ভাতিজীকে আদর ভরিয়ে দেয়। তিয়াসা কিছু না বলে শুধু দেখছে।
” চাচ্চু আমি এগুলো দাদুকে দেখিয়ে আনছি কেমন? ”
” ওকে আম্মা। তবে এগুলো খাওয়ার পর পড়তে বসতে হবে কিন্তু। ভুলে যেওনা যেন। ”
” ভুলবনা চাচ্চু। আমি একটু পর এসে আবার পড়তে বসব। ”
তূর্ণা কোল থেকে নামলে সাইফ টি শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। তিয়াসা নিচে যেয়ে সাইফের জন্য হালকা খাবার আর কফি নিয়ে আসে। সাইফ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখল টেবিলে খাবার রাখা।
” এইযে জামাই, আপনার নাস্তা। এগুল খেয়ে আমাকে ধন্য করুন৷ ”
“গতকাল ছিলাম বেয়াই আর আজ হলাম জামাই এই মেয়ে পারেও। ” আপন মনে বলে সাইফ।
” কি হল জামাই, কি ভাবছেন? আপনার জন্য হাত পু*ড়ি*য়ে রান্না করলাম আর আপনি এমন খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছেন যে! ”
” আর কোন সম্ভাষণ তোমার ঝুলিতে আছে? না, মানে বলতে চাচ্ছিলাম ভবিষ্যতের জন্য আরও কিছু স্টকে রেখছ নিশ্চয়ই? ”
” অনেএএএএক সম্ভাষণ অনলি ফর আপনার জন্য আমার স্টকে ডাউনলোড দিয়ে রেখেছি। প্রতিদিনই নতুন নতুন ডাকের ডেলিভারি হবে। আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকুন। ”
সাইফ ভেবে পায়না একজন ভার্সিটি পড়ুয়া কিভাবে এমন বাচ্চামো করতে পারে। বিয়ের কয় মাসেই সাইফকে নাজেহাল করে ছেড়েছে এই মেয়ে। বাকি জীবনের কথা ভাবলে ওর বুকের ভিতর থেকে কলিজা বের হওয়ার জন্য লাফালাফি করে।
নিস্তব্ধ রাত,আকাশ আর চাঁদের আলোর মাখামাখি এই ধরনীর বুক থেকে অবলোকনে ব্যস্ত তিয়াসা। আকাশ আর চাঁদনীর প্রনয়ের এই মহাকাব্য যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসছে। এ যেন
এক মহাপ্রনয় গাঁথা। তিয়াসা আজ সাক্ষী হয়েছে অনন্তকালের এই অবধারিত সৌন্দর্যের। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মহাকালের এই সৌন্দর্য উপভোগের ফাঁকে থেকে থেকেই ওর চোখ যাচ্ছে রুমের ভেতর বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকা তার নিজস্ব পুরুষের দিকে। যে ভুল করে একটিবারও ফিরে তাকায়না ওর দিকে৷ তিয়াসা বুকের ভিতর চিনচিনে একটা ব্যথার অস্তিত্ব টের পায়। এমন কেন এই মানুষটা! এত লুকোচুরি খেলে কেন বারবার! একটাবারও বুঝতে চেষ্টা করেনা তিয়াসা তাকে কত ভালোবাসে। ভালোবাসা কেন এত কাঁদায়। বুকের ভিতর জ্ব*লে পু*ড়ে ছাই হয়ে গেলেও দেখানো যায়না। আরও কতদিন অপেক্ষা করবে তিয়াসা? অপেক্ষা করতে করতে প্রহরগুলোও যে আজ ক্লান্ত। তারাও একটু বিশ্রাম চায়। টুপ করে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরে দুচোখ বেয়ে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামাল দিতে চায় তিয়াসা কিন্তু ব্যর্থ হয়। হুহু করে কেঁদে উঠে। হঠাৎই শনশন করে বাতাস বইতে শুরু করে। বাতাসেরাও আজ যেন তিয়াসার সাথে সঙ্গ দিতে প্রস্তুত। ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে তিয়াসার তনু-মন। বাতাসের দাপটে এলোমেলো হয়ে গেছে ঘন চুলরাশি। কাঁদতে কাঁদতে বসে পরে মেঝেতে৷
” তিয়াসা, বাইরে ঝড় বইছে আর তুমি এখানে, এভাবে বসে আছ! তুমি এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কেন বলত !”
” বাইরের ঝড় সবাই দেখে। ভেতরের ঝড় কয়জন দেখে। ঝড়ে ভেতরের সব তোলপাড় হলেও কয়জন এর খোঁজ রাখে। ” তিয়াসা তখনও কাঁদছে।
” এই তিয়াসা, তুমি ঠিক আছো? কি হয়েছে তোমার? ” সাইফ ঝুঁকে বসে তিয়াসার দু কাঁধে হাত রাখে।
তিয়াসা তৎক্ষনাৎ চোখের পানি মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হয়৷
” আমার কিছুই হয়নি, জামাই মশাই। একটু বাতাস বিলাস করছিলাম। আপনিও কি আমার সাথে বাতাস বিলাস করবেন? ”
” বাতাস বিলাস না বলে বল ঝড় বিলাস। তোমার এমন অদ্ভুত শখ কোথায় থেকে আসে বলত! ”
” আমি গোটা মানুষটাই তো অদ্ভুত বেয়াই সাহেব। অদ্ভুত না হলে কি আপনার মত রসকষহীন ঢেঁড়সকে বিয়ে করি। ”
সাইফ এবার পরেছে বিপদে। এখানে আসল কেন আর শুনতে হচ্ছে কি! শেষ পর্যন্ত ঢেঁড়স বানিয়ে ছাড়ল!
” এই মেয়ে এসব উল্টাপাল্টা সম্মোধন আর করবেনা বলে দিচ্ছি। ঢেঁড়স কাকে বলছ তুমি? ”
” ওমা, এখানে তো আপনিই আছেন! ঢেঁড়স বলি আর কদুই বলি সবইতো আপনাকেই বলব। ”
” আল্লাহ মাফ কর। ঢেঁড়স থেকে এখন আবার কদুতে নেমেছে। ” দুপদাপ পা ফেলে সাইফ ভেতরে চলে যায়।
” আপনি এমন কেন? আমাকে একা রেখেই চলে গেলেন!” এই ক্ষন আজ তিয়াসার অশ্রু বিসর্জনের ক্ষন৷ অশ্রুদলের সাথে সন্ধির এই ক্ষনে তিয়াসা খুব করে বুক ভাসাবে। কেউ জানবেনা অশ্রুদলের সাথে তার এই গোপন অভিসারের কথা।
বেশ রাত করেই বিছানায় আসে তিয়াসা। ততক্ষণে সাইফ ঘুমে বিভোর। বিছানায় শুয়ে একমনে তাকিয়ে থাকে সাইফের দিকে। ছুঁয়ে দেয় সাইফের ললাট এরপর আস্তে আস্তে ভ্রু, আঁখি দ্বয়, নাসিকা এবং সবশেষে অধরযুগলে। তিয়াসার ছোঁয়ায় ঘুমন্ত সাইফ নড়ে উঠে কিন্তু পরক্ষণেই আবার ঘুমে মগ্ন হয়ে যায়।
” আরও কত প্রহর আমায় ভালোবাসাহীনতার সাগরে ভাসাবেন আনরোমান্টিক ভূত? আরও কত হাহাকার করব আমি? কি হয় আমাকে একটু ভালোবাসা দিলে। আমিতো বেশি কিছু চাইনি, শুধু একটু ভালোবাসাই চেয়েছি। আপনার ভালোবাসার মূল্য বুঝি আকাশসম! আমি সেই মূল্য চুকাতে বুঝি অক্ষম! একবার ভালোবেসেই দেখুননা, আপনি যেটুকু ভালোবাসা দিবেন আমি তার হাজার গুন ফিরিয়ে দিব। তখন আপনি আফসোস করবেন আমাকে আগে কেন ভালোবাসেননি ভেবে। ” সাইফ পাশ ফিরে শুতেই তিয়াসা আবারও কেঁদে উঠে।
ছুটির দিন হওয়ায় আজ সবাই জমপেশ ঘুম দিচ্ছে। তানিশাও দেরিতে উঠেছে। আর তিয়াসা সারারাত জেগে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। তাই ওর উঠতে দেরি হয়েছে।
ওদের নামতে দেরি হচ্ছে দেখে রহিমা খালা সব জোগাড় করে রেখেছে। তানিশা নিচে আসতেই তিনি একে একে সব এগিয়ে দেন৷
তিয়াসা আরও কিছুক্ষণ পর নিচে আসে। ওর চোখমুখ ফোলা দেখে তানিশার মনে একটু সন্দেহ উঁকি দেয়।
” তিয়ু, তোর কি হয়েছে? তোর চোখমুখ এমন লাগছে কেন? ” তানিশার গলায় অস্থিরতা টের পায় তিয়াসা।
” আমার কিছুই হয়নি আপু। রাতে মাথা ব্যথা করছিল তাই ঘুমাতে পারিনি। একবেলা ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
” তিয়াসা, ভুলে যাসনা আমি তোর বড় বোন। তাই এমন কোন কথা বলিসনা যেটা আমি অবিশ্বাস করব। আমি জানি কাঁদার আর মাথা ব্যথার কারনে চোখমুখের পার্থক্য কেমন হয়। আর যাই হোক আমাকে অন্তত বোকা বানাতে আসিসনা। ” এইটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল তিয়াসাকে দুর্বল করতে। তানিশাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
” আপু ও আমাকে একটুও ভালোবাসেনা। আমার খুব কষ্ট হয়। ” ফোঁপাচ্ছে তিয়াসা।
তানিশা আশেপাশে তাকিয়ে দেখল রহিমা খালা নেই। তানিশা কি শান্তনা দিবে তিয়াসাকে ভেবে পায়না। একদিকে নিজের বোন অপরদিকে দেবর। আবার তারা দুজনে এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ। একজনকে সাপোর্ট দিয়ে অপরজনকে কষ্ট দিতে চায়না সে। তানিশা জানে সাইফ পরিস্থিতির স্বীকার। আর তিয়াসা সব জেনেশুনেই গরলকে অমৃতরূপে গ্রহন করেছে।
” তুই জেনেশুনে বি*ষে*র সুধা পান করেছিস তিয়াসা। এখন বি’ষে’র জ্বা-লা সইতেই হবে। দেখবি যখন সব বি*ষ অমৃতের রূপ ধারণ করবে তখন তুই সব পেয়ে যাবি। ভালোবাসা এত সহজ নয়। যে ভালোবাসায় কষ্ট বেশি থাকে সে ভালোবাসা ততই খাঁটি হয়। তোর খাঁটি ভালোবাসার স্বাদ আগে সাইফকে বুঝতে দে তবেইনা তুই ওর খাঁটি ভালোবাসার স্বাদ গ্রহন করতে পারবি। ”
” আমি সবকিছুর বিনিময়ে শুধু ওর ভালোবাসা পেতে চাই আপু। আর কিছুই চাইনা আমি। ”
” ধৈর্য্য ধর। ধৈর্য্যই পারে ঘৃ*ণা*কে ভালোবাসায় মোড়াতে। ভেঙে পড়িসনা। আমি সব সময়ই তোর পাশে আছি। ” রহিমা খালাকে আসতে দেখে ওরা দু বোন নিজেদের সামলে নেয়।
কাজে হাত লাগায় দুজনেই। তানিশা নিজেকে তিয়াসার সামনে যতই শান্ত দেখাক না কেন। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে তিয়াসার জন্য। যেহেতু এই বিষয়ে সাদিফকে কিছু জানানো যাবেনা তাই সিদ্ধান্ত নেয় সাইফের সাথে কথা বলার।
চলবে…