মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -৩১

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_৩১
জাওয়াদ জামী

সাদিফ কেবিনে প্রবেশ করতেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পায়। এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় সেদিকে। একটা ছোট্ট পুতুল আয়েশা খাতুনের কোলে! আয়েশা খাতুন সাদিফকে দেখে মৃদু হাসেন। পুতুলটাকে সাদিফের দিকে এগিয়ে দেন।
সাদিফ কাঁপা কাঁপা হাতে কোলে নেয় তাকে৷
” তোমার আরেকটা মা। ” আয়েশা খাতুনের মুখে হাসি লেগেই আছে।
সেই অনুভূতি হচ্ছে সাদিফের যা আরেকবার হয়েছিল পাঁচ বছর আগে যেদিন না জেনে তূর্ণাকে প্রথমবার কোলে নিয়েছিল!
তানিশার দু-চোখ আজ তৃপ্ত। সাদিফের মনে প্রথম সন্তানকে তার জন্মের পর ছুঁয়ে দেখার যে আফসোস ছিল তার কিছুটা হলেও দ্বিতীয় সন্তানকে দিয়ে পূরণ করতে পেরেছে।

তিয়াসা বাসায় এসেছে। শায়লা চৌধুরী সংসারের সমস্ত দ্বায়িত্ব ওর হাতে দিয়ে হসপিটালে ছোট নাতনির দেখাশোনা করছেন। তিয়াসা বাসায় এসে কোমড় বেঁধে রান্না করতে শুরু করেছে।
তিনদিন পর আজ অফিসে গেছে সাইফ, সাদিফ।
সাদিফের অফিসের কাজে মন বসছেনা। বারবার স্ত্রী-সন্তানের কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে নিরুপায়।
সাইফ সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখল তূর্ণা মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য জেদ করছে। সে দেরি না করে ঐ অবস্থায়ই তূর্ণাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
তিয়াসা যথাযথভাবে নিজের দ্বায়িত্ব পালন করছে। যদিও শায়লা চৌধুরী না থাকায় কাজের চাপ একটু বেশি তবুও হাসিমুখেই সে সবকিছু করছে। তবে এতকিছুর মাঝেও প্রতিদিন ভোরে সাইফের দিকে তাকিয়ে থাকা কিংবা ওর চুল, মুখমণ্ডল ছুঁয়ে দেয়ার লোভ সামলানোর চেষ্টা মোটেও করেনা।
শায়লা চৌধুরী, আয়েশা খাতুন দশদিন হসপিটালে কাটিয়ে তানিশাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে। নতুন অতিথির আগমন উপলক্ষে তিয়াসা জামিল চৌধুরীর সাথে মিলে পুরো বাড়ি সাজিয়েছে।
সাদিফ মেয়েকে কোলে নিয়ে বাসায় ঢুকতেই ফুলেল বর্ষনে সুবাসিত হয় চৌধুরী বাড়ি। ড্রয়িংরুমের মেঝেতে ফুল দিয়ে বড় করে লেখা রয়েছে ‘ স্বাগত ‘। সাইফ ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে আছে তিয়াসার পানে । মনে মনে ভাবছে, এই মেয়েটার এত শখ কোথায় থেকে আসে! কয়েকটা দিন কি খাটুনিটাই না গেল ! তারপরও শখের কমতি নেই!

সাদিফ ছোট মেয়ের নাম রেখেছে ‘ তিতিক্ষা ‘।
তিয়াসা খাবার নিয়ে তানিশার রুমে এসে দেখল সাদিফ তিতিক্ষাকে কোলে নিয়ে রুমেই হাঁটাহাঁটি করছে। আর ছোট দুটি চোখে তিতিক্ষা ড্যাবড্যাব করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে পুরে রেখেছে বাম হাতের তিনটা আঙুল। ওকে দেখতে বড্ড আদুরে লাগছে।
” ভাইয়া, ওকে আমার কাছে দিয়ে আপুকে খাইয়ে দিন। আমাকে তো আর আপনার বউকে খাওয়াতে দিবেননা। বাপরে প্রেম। ”
” তিয়াসা, সম্পর্কে আমি কিন্তু তোমার ভাসুর হই। সম্মানীয় সম্পর্ক, একটুতো লজ্জা কর। আমার দুর্ভাগ্য, তুমি ভাইয়ের বউ না হলে উত্তরটাও আমার জানা ছিল। ”
” কিসের ভাসুর হুম! আপনি আমার একমাত্র দুলাভাই। আমি আপনার সাথে মজা করতেই পারি এতে কোন ভেজাল নেই। কিন্তু আমি আপনার ছোট ভাইয়ের বউ এখানে আপনার ভেজাল লেগে গেছে। এবার সোনামণিকে আমার কাছে দিনতো। আপুকে খাইয়ে আপনিও নিচে আসুন। ”
” দুর্ভাগ্য তো বটেই। তা নাহলে তুমিই বা কেন সাইফের বউ হবে। ”
” ঐটা আমার গুন বুঝেছেন। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার গুন। ”
” হুম, তোমরা নানান গুনে গুণান্বিত। ”
” এখানে আমি থেকে আমরা হলাম কিভাবে? ” তিয়াসার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে হেসে উঠে সাদিফ।
” তোমরা মানে তুমি আর তোমার বড় বোন। আহা, কি ছিলাম আর কি হয়েছি। ”
” ভাসুরকর্তার কি আফসোস হচ্ছে! ”
” ভাসুর পর্যন্ত ঠিক ছিল তিয়াসা। এখন আবার কিসব বলছ! ”
” ভবিষ্যতে আরও কিছু শোনার অপেক্ষায় থাকুন ভাসুরজি। ” তিতিক্ষাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যায় তিয়াসা।
তানিশা ওদের দুজনের কথা শুনে হাসছে।
” বউ, তোমার বোন আমাকে বোকা বানিয়ে গেল আর তুমি হাসছ! কি বিচ্ছু মেয়েরে বাবা! ”
” বোকা বানাল কই! আমি তো দেখলাম দুলাভাইয়ের সাথে করল। একটামাত্র দুলাভাই হওয়ার সুবাদে এটুকু মজা করতেই পারে, বুঝেছেন। ”
” খুব বুঝেছি। এবার উঠে বস। খেতে হবে। ”
” শুনুন আমি কিন্তু কাল থেকে নিচে যেয়ে খাব। আপনি আর বাধা দিবেননা প্লিজ। কত মাস হয়ে গেছে নিচে সবার সাথে খাইনা। তাছাড়া শরীর আগের থেকে এখন অনেক ভালো। বলতে গেলে এখন ফিট আছি। ”
” কালকেরটা কাল দেখা যাবে। এখন খেয়ে নাও। ”
তানিশাকে খাইয়ে নিচে আসে সাদিফ। ওর জন্য খাবার টেবিলে জামিল চৌধুরী, সাইফ অপেক্ষা করছে। শায়লা চৌধুরী তিয়াসার কাছ থেকে নাতনিকে নিয়ে তানিশার কাছে যান। তিয়াসা ও আয়েশা খাতুন মিলে টেবিলে খাবার দেয়।
” ভাসুরকর্তা, ফটাফট খেয়ে নিন। আর খেয়ে জানান রান্না কেমন হয়েছে। নতুন আইটেম ট্রাই করেছি আজকে। ” তিয়াসার কথা শুনে সাদিফ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। আর সাইফ তো বিষমই খায়। জামিল চৌধুরী হাসছে।
সাদিফ ভাবছে, আড়ালে বললে সব ঠিক ছিল। কিন্তু বাবা,ভাইয়ের সামনে বলছে! আচ্ছা লজ্জায় পরলাম তো। সামনে না আর কি কি শুনতে হবে!
” ছোট বউমা, ডাকটা মন্দ লাগছেনা। এক সাথে দুই সম্পর্ক। সম্ভাষন পাল্টাতে কোন কারন লাগবেনা। ”
” ঠিক বলেছেন বাবা। ভাসুরকর্তা থেকে দুলাভাইয়ে রুপান্তরিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাইনা দুলাভাই? ”
” আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে তোমার কথার বিপরীতে যাব। ” সাদিফের স্পষ্ট জবাব।
” বেয়াই আপনাকে আরেক টুকরা মাংস দিই ? ” সাইফের দিকে তরকারি বাটি নিয়ে জিজ্ঞেস করল তিয়াসা। এবার সাইফ বেচারার অবস্থা দেখার মত হয়েছে। কাশতে কাশতে নাকেমুখে খাবার ঢুকে গেছে। জামিল চৌধুরী উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। আর আয়েশা খাতুন মেয়ের এমন রসিকতায় মুখ টিপে হাসছেন। সাদিফ ছোঠ ভাইয়ের দিকে অসহায় চোখে চেয়ে আছে।
” বউমা, একবারে ফাটিয়ে দিয়েছ। ” হাসির জন্য ঠিকমত কথা বলতে পারছেননা জামিল চৌধুরী।
” বাবা, এতদিন আপু অসুস্থ থাকায় আপনাদের সবার মন-মানসিকতা খারাপ ছিল তাই আমি সাইলেন্ট ছিলাম। কিন্তু এখন আপু সুস্থ তাই আমার আর সাইলেন্ট মোড থেকে নরমাল মোডে আসতে কোন বাধা নেই। ”
” আমি তোমার সাথে আছি বউমা। তুমি চালিয়ে যাও। ”
” আহা, তিয়াসা এখন কথা না বলে জামাইদের খেতে দে। ” আয়েশা খাতুনের ধমকে থেমে যায় তিয়াসা। বাকিটা সময় চুপচাপ সবাইকে খাবার পরিবেশনে মনোনিবেশ করে।

” এই যে আপনার ব্ল্যাক টি। ঠক করে চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে রাখে তিয়াসা। ”
সাইফ মৃদু হেসে কাপ হাতে নেয়। এই মেয়েকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে একপ্রকার ভয়ই পাচ্ছে সে। আবার কিনা কি বলে বসে।
তিয়াসা ফোন নিয়ে বিছানায় বসে। ফোন চাপছে আর মুচকি মচকি হাসছে। যা সাইফের নজর এড়ায়নি। বেশ কিছুক্ষণ নজর রাখে তিয়াসার উপর। তিয়াসা হেসে হেসে চ্যাটিংও ব্যস্ত। সাইফ একটু বিরক্ত হয়ে তিয়াসার হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয়।
” আজিব তো! আপনি আমার ফোন নিলেন কেন! দিন আমার ফোন আমাকে দিন। ”
সাইফ একটু অপ্রস্তুত হয়। কি জবাব দিবে সে। আর হঠাৎ কেনইবা সে তিয়াসার থেকে ফোন কেড়ে নিল!
” আ.. আরেক কাপ চা নিয়ে এ..এস। মাথা ধরেছে, এক কাপে চলবেনা। ”
” তোতলাচ্ছেন কেন! গরম চায়ে জিহবা পু*ড়ে*ছে নাকি! কই দেখান দেখি জিহবা। ”
তিয়াসা বিছানা থেকে নিচে নেমে সাইফের দিকে এগিয়ে আসে।
সাইফ এক লাফে পেছনে সরে যায়। কি ভ*য়ং*ক*র মেয়েরে বাবা! তিয়াসা সাইফের নাগাল না পেয়ে চা বানাতে যায়।
চা এনে সাইফের কাছে দেয়। এদিকে সাইফ পরেছে বিপদে। ওর চায়ের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাধ্য হয়ে চুমুক দেয়।
” এই যে শুনছেন? আপনি আমার আপুর মেয়ের মুখ দেখে কিছুই তো দেননি। কিপ্টা একটা। নিজের সাথে সাথে আমারও সম্মানও খোয়ানোর ধান্দা করছেন নাকি? ”
” এই কয়দিন টেনশনে কেটেছে তাই কিছু দেয়া হয়নি। তাই বলে আমি কিপ্টা হলাম! আমি টাকা দিব তোমার যা পছন্দ হয় কিনে দিও। ”
” আপনার ভাইয়ের মেয়েকে আপনি দিবেন এর ভেতর আমাকে জড়াচ্ছেন কেন! আমিতো দিব আমার আপুর মেয়েকে। আপনারটা আপনিই দিন।”
” তাহলে যে বললে আমার সাথে তোমার সম্মানও যাচ্ছে? ”
” সে তো বলেছি আপনি আমার বেয়াই বলে। বেয়াই-বেয়াইন সম্পর্কে কোন ধারনা আছে আপনার! ”
আবারও ভ্যাবাচ্যাকা খায় সাইফ। খানিকটা থিতু হয়ে জবাব দেয়, ” বেয়াইয়ের সাথে বেয়ানের এক রুমে থাকার কোন আইন বুঝি দেশে পাস হয়েছে? ”
” আমি কোথায় বেয়াইয়ের সাথে এক রুমে থাকছি! আমিতো থাকছি নিজের একমাত্র জামাইয়ের সাথে। কিন্তু সম্পর্কে আপনি আমার আপুর দেবর সেই হিসেবে বেয়াই। ”
” মাফ কর আমাকে। এখন বল তুমি তোমার আপুর মেয়েকে গিফ্ট দেয়ার টাকা পাবে কোথায়? ”
” কেন আমার জামাই দিবে। ”
” একটু আগেই যে বললে আমার গিফ্ট আমাকে কিনতে? ” সাইফ এবার পারলে কেঁদে দেয়।
” সেতো বলেছি আপনার ভাইয়ের মেয়ের জন্য কিনতে। আমার আপুর মেয়ের কথা তো বলিনি। ”
” আমার ভাইয়ের মেয়ে আর তোমার আপুর মেয়ে কি আলাদা! ”
” মেয়ে একটাই কিন্তু আপনার ভাই আর আমার আপু আলাদা। সে হিসেবে আমাদের সবার সম্পর্কও আলাদা। এবার আমার গিফ্টের টাকাটা দিয়ে দিন। ”
” কত টাকা দিতে হবে? ”
” সেটা আমি বলব কেন! নিজেকে কিপ্টে হিসেবে প্রমান করতে না চাইলে যা দেয়ার প্রয়োজন তাই দিন। ”
সাইফের ইচ্ছে করছে কপাল চাপড়াতে। কিন্তু সে ইচ্ছা মনেই চাপা দিয়ে নিজের ক্রেডিট কার্ড বাড়িয়ে দেয় তিয়াসার দিকে। সেই সাথে পাসওয়ার্ড ও দিয়ে দেয়।
” আমার ভাইয়ের মেয়ের সাথে নিজের জন্যও কিছু কিনে নিও। ”
” ধন্যবাদ বেয়াই। ”
” সব সময় বেয়াই বেয়াই করবেনা তো। ”
” তো কি বলব জামাই! ”
সাইফ তিয়াসার কথার উত্তর না দিয়ে বারান্দায় এসে বসে।
আর তিয়াসা মনে মনে অট্টহাসিতে ফেটে পরছে। লোকটাকে জ্বালাতে মন্দ লাগেনা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here