মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -৩০

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী

তিয়াসার হুমকি ভালোই কাজে দিয়েছে। সেদিনের পর থেকে সাইফের মন মাঝে মাঝে সিগারেটের জন্য হাঁসফাঁস করলেও সাদিফের কানে যাবার ভয়ে খাওয়ার সাহস হয়নি। তিয়াসাও এতে বেশ স্বস্তি পায়।

তানিশা বিছানায় আধাশোয়া হয়ে তূর্ণাকে পড়াচ্ছে। পাশেই সাদিফ ল্যাপটপে কাজ করছে।
পড়ানোর মাঝে হঠাৎ তানিশা গুঙিয়ে উঠে। সাদিফ চমকে উঠে তানিশার দিকে তাকায়।
” বউ, কি হয়েছে তোমার? কষ্ট হচ্ছে খুব? ” চোখেমুখে উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে।
” কিক মারছে ভেতর থেকে। হাডুডু, কাবাডি যত রকমের খেলা আছে খেলছে। কিন্তু ও বুঝেইনা ওর মাম্মার কষ্ট হয়। ” সাদিফের হাত নিজের পেটে রেখে অস্ফুট স্বরে বলে তানিশা। ব্যথায় ওর চোখমুখ নীল রং ধারন করেছে।
সাদিফের হাত তানিশার পেটে রাখা মাত্রই সে নড়াচড়া অনুভব করে। অনবরত নড়েই চলেছে। আনন্দে সাদিফের চোখে পানি এসে গেছে। ও তূর্ণার সময় এমন সুখ অনুভব করতে পারেনি বলে বারবার আফসোস করেছে। কিন্তু এখন সব পুষিয়ে নিচ্ছে। সাদিফ আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় তানিশার পেটে।
” প্রিন্সেস, মাম্মাকে আর কষ্ট দিওনা। এত নড়াচড়া করলে মাম্মার ভিষন কষ্ট হয় যে। তুমি না আমার গুড প্রিন্সেস। ”
” এই, আপনি কি প্রিন্সেস, প্রিন্সেস করছেন! আপনার একটা প্রিন্সেস অলরেডি আছে। আবারো কিসের প্রিন্সেস হুম! আমি এবার জুনিয়র সাদিফ চাই। ”
” সেটাতো হচ্ছেনা, বউ। আমার আরোকটা প্রিন্সস প্রয়োজন। তারপর জুনিয়র সাদিফের কথা ভাবব। ”
” কি বলছেন এসব! আরেকটা প্রিন্সেস তারপর আবার জুনিয়র সাদিফ! আল্লাহ এবার আমি শেষ। ”
” আমার কতদিনের ইচ্ছে আট-দশটা ছেলেমেয়ে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াবে। আমার রুমটা বাচ্চাদের দিয়ে ভরে থাকবে। বাচ্চাদের কিচিরমিচির শব্দে মনটা শীতল হবে। আর সেই প্রত্যেকটা বাচ্চার পৃথিবীতে আগমনের কারন হব আমি। আর তুমি কি শেষ শেষ করছ বলত বউ।” সাদিফের কথায় তানিশা হাসবে না কাঁদবে তা ভেবে পায়না।
” মাম্মা, বলতো তুমি কি চাও আপু না ভাইয়া? ” সাদিফ গলা উঁচিয়ে তূর্ণাকে জিজ্ঞেস করে।
” আমি একটা পুতুল পুতুল আপু চাই, পাপাই। ” তানিশা জানত এই উত্তরই আসবে। কারন তার মেয়েটা একদম বাপের ন্যাওটা। বাপের সুরেই সুর মেলাতে অভ্যস্ত সে।

সাদিফ অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছে। তানিশা ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে গেছে। বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখছে। কতদিন পর এখানে এসে দাঁড়িয়েছে সে। কিন্তু আজ প্রকৃতির রুপ তাকে মোহিত করতে পারছেনা। ভোর থেকেই চিনচিনে একটা ব্যথা পেট থেকে শুরু হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পরছে৷ কখনও ব্যথাটা একটু বেশি হচ্ছে আবার কখনও তার অস্তিত্বটুকুও টের পাচ্ছেনা। তানিশা চিন্তা করছে সাদিফকে কিছু বলবে কি না। সাদিফ শুনলে আর অফিসেই যাবেনা।
তানিশা যখন ভাবনায় মগ্ন ঠিক তখনই তলপেটে ব্যথার কুন্ডলী মোচড় দিয়ে ক্রমশই সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পরে। এবার সেই ব্যথার স্থায়িত্ব দীর্ঘক্ষণ হয়। এবং কমার বদলে বাড়তে থাকে। তানিশার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারায়। ভয়ে আঁকড়ে ধরে বারান্দার গ্রীল। অনেক কষ্টে ফ্যাসফ্যাসে গলায় সাদিফকে ডাক দেয়। ডাক শুনেই সাদিফ দৌড়ে বারান্দায় এসে তানিশাকে দেখে দ্বিকবিদিক হারিয়ে ফেলে। ততক্ষণে বারান্দার মেঝে র*ক্তে ভেসে গেছে। সাদিফ চিৎকার করে তিয়াসাকে ডাকে। সাইফও তখন বাসায়। সাদিফের ডাক শুনে সবাই ছুটে আসে। দুর্বল শরীরে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারায় তানিশা। সাদিফ ওকে বুকে আঁকড়ে ধরে পাগলের ন্যায় করছে। সাইফ দেখে অবস্থা বেগতিক। তাই অ্যাম্বুলেন্স না ডেকে নিজেদের গাড়িতে করে তানিশাকে হসপিটালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সাদিফকে জানায় এখনই তানিশাকে এখনই হসপিটালে নিতে হবে। দুই ভাই মিলে ধরাধরি করে তানিশাকে গাড়িতে উঠায়।
হসপিটালের করিডোরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে সাদিফ। সাইফ র*ক্তে*র জন্য এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে আবার কখনোবা ফোনে যোগাযোগ করছে। কয়েক ব্যাগ র*ক্ত দরকার। রক্তের জোগাড় হলেই তবে অপারেশন শুরু হবে৷ জামিল চৌধুরী তার ভাই-বোন, আত্নীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করছে। গ্রুপ মিল থাকায় কয়েকজন র*ক্ত দিতে রাজি হয়েছে।
এদিক সাদিফ চিন্তায় পাগলপ্রায়। কখনো আবোলতাবোল বকছে আবার কখনো ডক্টরদের সাথে চেঁচামেচি করছে। শায়লা চৌধুরী ছেলেকে শান্তনা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিছুতেই সাদিফকে মানাতে পারছেননা। ছেলের এই অবস্থা দেখে তানিশার চেয়েও সাদিফের জন্য বেশি চিন্তা করছেন।
জামিল চৌধুরী এমনিতেই পুত্রবধূর চিন্তায় শেষ তারউপর ছেলের এহেন অবস্থা দেখে ফাঁপড়ে পড়েছেন। বারবার তিনি সাদিফকে বলছেন স্থীর হয়ে বসতে কিন্তু সাদিফ তার কথা কানে নিলে তো! কয়েকজন র*ক্তদাতা হসপিটালে পৌঁছেছে। অপারেশন থিয়েটার রেডি করা হয়েছে সেই কখন। র*ক্তে*র জোগাড় হলেই অপারেশন শুরু হয়।
সাদিফ আর টেনশন করতে পারছেনা। ভেতরে কি চলছে জানার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে একজন ওয়ার্ড বয়ের সাথে চেঁচামেচি করছে। এদিকে সে বেচারাও পরেছে বিপদে। না পারছে সাদিফকে কিছু বলতে আর না পারছে ওকে ভেতরে যেতে দিতে। সাইফ অনেক কষ্টে সাদিফকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। সাদিফের পাগলামি দেখে আগত রক্তদাতারা আশ্চর্য হয়ে গেছে। একজন মানুষ স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসলে তার জন্য এত পাগলামি করতে পারে!
আর জামিল চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এই ছেলেকে নিয়ে কি করবেন ভেবে পাচ্ছেননা। একে তো বউমার জন্য চিন্তা তারউপর এই ছেলের প্যারা আর নিতে পারছেননা৷
সাইফ বর্তমানে সাদিফকে সামলাচ্ছে।
” ভাইয়া, তুমি এত টেনশন করনা। ভাবি ঠিক হয়ে যাবে দেখ। তুমি এভাবে ভেঙে পরলে কিভাবে চলবে! এখন তোমার নিজেকে শক্ত রাখা প্রয়োজন। ”
” আমি পারছিনা ধৈর্য্য ধরতে। তানিশা, এমনিতেই অসুস্থ তারউপর সে এই ধকল সামাল দিবে কেমন করে! আমি জাষ্ট পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার সন্তানের কোন প্রয়োজন নেই, আমার শুধু ওকেই চাই। ”
” ভাইয়া এভাবে বলছ কেন! অনাগত সন্তানও তোমার। এই কথাটা আর কারো সামনে বলোনা। ভাবি শুনলে খুব কষ্ট পাবে। ওরা দুজনেই ঠিক থাকবে তুমি দেখে নিও। ”
” আমি জানি আমি ভুল বলেছি কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এরথেকে বেশি কিছু ভাবতে পারছিনা। দিনের পর দিন তানিশার কষ্ট আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তুই আমাকে ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবি? একটু দেখনা, প্লিজ। ”
” ভাইয়া, তুমি সেখানে গেলে সমস্যা না কমিয়ে বরং আরো বাড়িয়ে দিবে। আর সেটা ভাবির জন্য ক্ষতিকর। তুমি ধৈর্য্য ধরো। আমরা সবাই আছি তো। দেখ আমাদের দোয়া বিফলে যাবেনা। ”
সাদিফ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কিছুতেই শান্ত হতে পারছেনা। টেনশন করতে করতে এক পর্যায়ে জ্ঞান হারায়। এবার হসপিটালে উপস্থিত সকলের অবাক হওয়ার পালা৷ শায়লা চৌধুরী ছেলের এরুপ অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন। জামিল চৌধুরী স্তব্ধ। তিয়াসার অবস্থা আরো করুন। একে তো বোনের চিন্তা, তূর্ণা কাঁদছে ওকে সামাল দিতে হচ্ছে, আবার সাদিফের এখন এই অবস্থা দেখে কষ্টে পারলে মাথার চুল ছিঁড়ে। আর বেচারা সাইফ ওর এক কাজিনের কাছে সাদিফের দ্বায়িত্ব দিয়ে ছুটে যায় সেখানের কর্তব্যরত ডক্টরের কাছে।

দীর্ঘ তিন ঘন্টা পর তানিশার অপারেশন শেষ হয়। ডক্টর এসে জানায় মেয়ে হয়েছে। মা-সন্তান দুজনেই ভালো আছে। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তবে তানিশার অবস্থা একটু খারাপ হওয়ায় এখন কেবিনে দেয়া যাবেনা৷ আপাতত বারো ঘন্টা নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখা হয়েছে। একজন নার্স এসে ছোট্ট একটা পুতুলকে শায়লা চৌধুরীর কাছে দেয়। যে পিটপিটিয়ে তাকাচ্ছে। শায়লা চৌধুরী আনন্দে কেঁদে দেন। এ এক অবর্ননীয় অনুভূতি। তিয়াসা হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে পুতুলটার দিকে৷ একটু পর বাবা-মাকে ফোন করে জানায়।

পনেরো ঘন্টা পর তানিশার জ্ঞান ফিরে। চোখ খুলে দেখল চারপাশে সবাই আছে শুধু সাদিফ ছাড়া। তিয়াসা কোলে বাচ্চা নিয়ে ওর পাশে বসে আছে। তানিশার মা তূর্ণাকে নিয়ে বসে আছে। সাদিফকে না দেখে তানিশার মন খারাপ হয়ে যায়। লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছেনা সাদিফের কথা৷ এদিকে সাদিফকে না দেখেও ওর মন আনচান করছে। শেষমেশ লজ্জার মাথা খেয়ে তিয়াসাকে জিজ্ঞেস করে সাদিফের কথা। তানিশার কথায় তিয়াসা জোরে হেসে ফেলে। একি সবাই যে দেখি মুচকি মুচকি হাসছে! তানিশা শুধু ড্যাবডেবিয়ে সবাইকে দেখছে।
” বুঝলে আপু, তোমার জামাই পুরাই বউ পাগল। অপারেশন তো তোমার হয়নি যেন তার হয়েছে। সে কি ছটফটানি! শেষে জ্ঞানই হারাল। তারপর থেকেই তাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে রেখেছে ডক্টর। হসপিটালের সবাইকে যা জ্বালিয়েছে না। এমন জামাই যদি বাংলার ঘরে ঘরে থাকত তাহলে প্রেগন্যান্ট বউরা না হয়ে জামাইরাই বোধকরি এই মহান এই দ্বায়িত্ব পালন করত। ” তিয়াসা হাসি থামাতেই পারছেনা।
তিয়াসার এমন লাগামছাড়া কথায় জামিল চৌধুরী হেসে কেবিন ত্যাগ করে যান সাদিফের কাছে। সাইফ বিস্মিত হয়ে তিয়াসার কথা শুনে। এ কি মেয়েরে বাবা! বাবা-মা, শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির সামনে এ কেমনতর কথা বলছে সে! তানিশার মা মেয়ের কাছে এসে মাথায় হাত রাখে। এদিকে তানিশা লজ্জায় পরেছে তিয়াসার কথা শুনে।
এ কি কান্ড করেছে লোকটা! লজ্জায় মায়ের দিকে তাকাতে পারছেনা।
” বউমা, আমার বাড়িতে আরেকটা নাতনি এসেছে। এত খুশি কোথায় রাখি বলতো! ”
শ্বাশুড়ির কথায় ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে৷ তাহলে সাদিফের চাওয়াই পূরণ হল! কিন্তু এত ব্যাকুল থাকা সত্বেও মেয়ের মুখ এখন পর্যন্ত দেখতে পারলনা!
সবাই মিলে হাসাহাসি করে কাটায় কিছু সময়৷

ঘুম ভাঙ্গলে নিজেকে হসপিটালের বিছানায় আবিষ্কার করল সাদিফ৷ মাথা কেমন ভার হয়ে আছে। ওর পাশে সাইফ বসে আছে।
“কি হয়েছিল আমার! ” আপনমনেই নিজেকে প্রশ্ন করে। তারপরই হঠাৎ মনে হয় তানিশাকে নিয়ে এখানে এসেছিল। কথাটা মাথায় আসতেই তড়াক করে উঠে বসে। হাতে থাকা স্যালাইনের নলের দিকে নজর যেতেই খুলে ফেলতে যায়। সাথে সাথে সাইফ বাধা দেয়।
” ভাইয়া এসব কি করছো! পাগল হয়ে গেছ নাকি! ”
” তানিশা কোথায়? ও কেমন আছে? আমি এখানে কি করছি? ” উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চায় সাদিফ।
” রিল্যাক্স ভাইয়া, ভাবি ভালো আছে। আমাদের আরেকটা প্রিন্সেস এসেছে। আর তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে তাই তোমার ট্রিটমেন্টের জন্যই এখানে রাখতে হয়েছে। ”
” আমাকে তারাতারি এখান থেকে নিয়ে চল। দুই মিনিট সময় আছে তোর কাছে। কুইক। ”
সাইফ একজন নার্সকে ডেকে সাদিফের হাতের ক্যানুলা খুলে দেয়৷ সাইফ সাদিফকে নিয়ে যায় তানিশার কাছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here