মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -২৯

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_২৯
জাওয়াদ জামী

মাঝরাতে তানিশার ঘুম ভাঙ্গলে প্রতিবারের ন্যায় নিজেকে সাদিফের বুকে আবিষ্কার করে। সাদিফের বাঁধন থেকে ছাড়া পেতে নড়তে থাকে।
” ঘুম ভেঙেছে, বউ। ” ঘুম জড়ানো সাদিফের গলা।
” হুম। একটু ওয়াশরুমে যাব। ”
সাদিফ সাবধানের সাথে তানিশাকে ছেড়ে উঠে বসে। এরপর তানিশাকে তুলে বসায়। তারপর নিয়ে যায় ওয়াশরুমে।
তানিশা ওয়াশরুম থেকে বের হলে ওকে ডিভানে বসিয়ে রেখে সাদিফ নিচে আসে। টেবিলে ঢেকে রাখা খাবারগুলো গরম করে রুমে আসে।
” বউ, আমি জানি তোমার ক্ষুধা লেগেছে। তাই তোমার জন্য খাবার আনলাম। ” সেন্টার টেবিলে খাবারের প্লেট রাখছে সাদিফ। সত্যিই তানিশার ভিষণ ক্ষুধা লেগেছিল। মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে না খেলে ও আর বাঁচবেনা। পেটের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়েছিল। মুহুর্তেই সাদিফের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তানিশার মন ছেয়ে যায়। মানুষটা ওর কত খেয়াল রাখে! কোন অযত্ন হতে দেয়না। রাতের পর রাত নিজের ঘুম কামাই করে তানিশার সুবিধা-অসুবিধা দেখছে। ভাগ্যে এত সুখও ছিল! সেই রা*গী, গম্ভীর মানুষটাকে এখন আর খুঁজলেও পাওয়া যায়না!
” আমি আপনাকে খুব জ্বালাচ্ছি তাই না? আপনার ঠিকঠাক ঘুম, খাওয়া কিছুই হচ্ছেনা। আবার অফিসেও আগের মত থাকছেননা। সন্ধ্যায়ই চলে আসছেন। ”
” মাঝরাতে এসব কি শুরু করলে বউ! আমি তোমার যত্ন না করলে কে করবে? আমার মত করে কে তোমার যত্ন নিতে পারবে! এই কথাটা আর যেন কখনোই না শুনি। ” সাদিফ ধীরেসুস্থে তানিশাকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়।
” শোন বউ, এখন ঘুমের ঔষধ খেয়েছ, সকালে উঠতে দেরি হবে। তখন আমি অফিসে থাকব। আমি তিয়াসাকে বলে রাখব। তুমি ঘুম থেকে উঠেই তিয়াসাকে ডাকবে। একা একা উঠতে যাবেনা কিন্তু। ” তানিশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।
সাদিফ তানিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে৷
একসময় তানিশা ঘুমিয়ে যায়। ওর ঘুমানোর পর সাদিফ ঘুমায়।

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে তিয়াসার অভ্যেস হয়েছে কিছুক্ষণ সাইফকে দেখার। ঘুমন্ত সাইফকে দেখতে ওর কাছে ভিষণ ভালো লাগে৷ ভয়, জড়তা কাটিয়ে এলোমেলো করে দেয় সাইফের চুলগুলো। মাঝেমধ্যে ছুঁয়ে দেয় সাইফের মুখমণ্ডল। তবে খুব কম সময়ের জন্য কাজগুলো করে সে। যদি সাইফ জেগে যায়! কিছুক্ষণ একতরফা দেখাদেখি শেষে উঠে পরে। অজু করে নামাজ আদায় করে। তারপর একে একে সাইফের প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের কাছে রেখে নিচে আসে।
রহিমা খালার সাথে মিলে সকালের নাস্তা তৈরী করতে শুরু করে।

সাইফ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখল প্রয়োজনীয় সব কিছু রাখা। মুচকি হেসে তৈরী হতে শুরু করে। তিয়াসা যে বেশ দ্বায়িত্বশীল তা এই কয়দিনে সাইফের বুঝতে বাকি নেই।

সাইফ সাদিফ নিচে আসলে টেবিলে খাবার দেয় তিয়াসা। টেবিলে সবার পছন্দের খাবারের সমাহার।
” তিয়াসা, তুমি একটু তানিশার দিকে লক্ষ্য রেখ। ও একা একা যেন কিছু না করতে যায়। খাবারটা ঠিকমত খাইয়ে দিও। কোন সমস্যা হলে আমাকে জানিও। ” নিজের সাথে তূর্ণাকেও খাওয়াচ্ছে সাদিফ।
” আপনার কোন চিন্তা করতে হবেনা, ভাইয়া৷ আমার যা যা করনীয় সবই করব। আপুর যত্নের কোনও ত্রুটি হবেনা। আর তাছাড়া মা ও আছেন। তিনিও আপুর যথেষ্ট খেয়াল রাখেন। আপনি নিশ্চিন্ত মনে অফিস করুন। ”
” ভাইয়া, ভাবিকে ডক্টরের কাছে নিবে কবে? এই কয়েকদিন তাকে নিয়মিত চেক-আপ করানো দরকার। ভাবির শারিরীক দেখে অবস্থা খুব একটা ভালো মনে হচ্ছেনা। ”
” আজ রাতে ডক্টরের সাথে অ্যাপোয়েনমেন্ট আছে। আমি সন্ধ্যায় এসে ওকে নিয়ে যাব। ”
খেতে দুই ভাইয়ের কথপোকথন চলতে থাকে। খাওয়া শেষে যে যার মত বেরিয়ে যায়।

তিয়াসা সব কাজ সেরে নিয়েছে। ও তানিশার পাশে বই হাতে নিয়ে বসে আছে। অনার্স ফাইনাল পরিক্ষার আর ছয়মাসও বাকি নেই। তূর্ণা ওর দাদুর সাথে সাইরার বাসায় গেছে। তিয়াসার সারাদিনের রান্না শেষ। শায়লা চৌধুরী বলে দিয়েছেন, যতদিন তানিশা সুস্থ না হবে ততদিন সকালেই সারাদিনের রান্না করতে। তিয়াসা শ্বাশুড়ির কথামত সকালে রান্না করে সারাদিন বোনের সাথে সাথে থাকে।
কিন্তু তানিশা এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিয়াসা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বোনের মাথায় হাত বুলাচ্ছে।
কত কষ্ট পাচ্ছে তার বোন, ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে আসে তিয়াসার।

কেটে যায় আরো পনের দিন। তানিশার শরীর আগের মতই আছে। ওর ডেলিভারির সময়ও এগিয়ে এসেছে। সাদিফ এখন প্রতিদিন অফিসে যাচ্ছেনা। বাসায় থেকেই কাজ করছে।
তিয়াসা, সাইফের সম্পর্কের সমীকরণ সেই এক জায়গায়ই থমকে আছে। সাইফ যতক্ষণ বাসায় থাকে তিয়াসা ততক্ষণই ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। কিন্তু সাইফ একটিবারও সেদিকে নজর দেয়না।

রাতে সাইফ রুমে বসে অফিসের কাজ করছে। তখনই তিয়াসা রুমে হনহনিয়ে প্রবেশ করে। সেন্টার টেবিলের উপর ঠক করে চায়ের কাপ রাখে।
” এই যে নিন আপনার চা। ” ওর গলায় বেশ ঝাঁঝ লক্ষ্য করল সাইফ।
” আমি কি চা চেয়েছি! তুমি নিজে থেকেই চা এনেছ আবার ঝাঁঝও দেখাচ্ছ। ”
” সবাইকে দিয়েছি তাই ভাবলাম আপনাকেও দিই। এতে আমার অপরাধ হয়েছে? ”
সাইফ তিয়াসার রাগের কারন খুঁজে পায়না।
” ধন্যবাদ। কিন্তু এত রা*গে*র কারন কি? ”
” আপনি জেনে কি করবেন? উদ্ধার করবেন আমাকে ? আপনি জানেন আমি কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি? সাবজেক্ট কি? আমি থাকি কোথায়? আসছে জনদরদী প্রানী। ”
তিয়াসার এমন কথায় সাইফ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। আসলেই তো, তিয়াসা কোন ভার্সিটিতে পড়ে, কোন সাবজেক্টে পড়ে তার কিছুই সে জানেনা! তাই আপাতত কোন প্রত্যুত্তর না করে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কারন এখন তার কিছু বলা মানেই তিয়াসার মুখ ঝামটা বাড়িয়ে দেয়া।
এদিকে তিয়াসা রুমে বসে গজগজ করছে আর কাউকে ম্যাসেজ দিচ্ছে।
সাইফ আড়চোখে তিয়াসার কাজকর্ম দেখছে। বলাবাহুল্য সে খুব মজা পাচ্ছে তিয়াসার মুখভঙ্গি দেখে। এই শান্ত মেয়েটা আবার রা*গ*তেও জানে!
এরইমধ্যে তিয়াসার ফোন বেজে ওঠে। তিয়াসা ফোন নিয়ে বারান্দায় আসে।
” পিহু, বল। ঐ হারাম….দা কই রে? তার ফোন বন্ধ কেন? কু*ত্তা*ডা*রে খালি একবার সামনে পাই, ওর চৌদ্দটা বাজিয়ে দিব। কত্তবড় সাহস এই তিয়াসারে নিয়ে রোমান্টিক স্ট্যাটাস দেয়! একজন বিবাহিতা নারীকে সামান্য সম্মানটুকু দিতে জানেনা! ” তিয়াসার কথা রুম থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সাইফ। সেই সাথে মুচকি মুচকি হাসছে। বাপরে রা*গ মেয়েটার।
তিয়াসা ফোনে আরও কিছুক্ষণ কারো পিন্ডি চটকিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়। রুমে এসে দেখল সাইফ হাসছে। আর তাতেই তিয়াসার রা*গ তড়তড় করে বেড়ে যায়। ধুপধাপ পা ফেলে বিছানায় উঠে তার আগে নিভিয়ে করে দেয় রুমের আলো। অন্ধকারে ডুবে যায় রুম। সাইফ অন্ধকারেই বসে থাকে। তিয়াসার বলা বিবাহিতা নারী কথাটা তার কানে বাজতে থাকে। তিয়াসাকে আর না ঘাটিয়ে চুপচাপ শুয়ে পরে।
তিয়াসার ঘুম আসছেনা। বারবার এপাশ-ওপাশ করছে। এদিকে সাইফও জেগে আছে।
” বিবাহিতা নারীর কি ঘুম আসছেনা? এত ছটফট করছে কেন? ”
সাইফের মুখে বিবাহিতা নারী কথাটা শুনে তিয়াসার বুক ধক করে উঠে। সে তো কিছুক্ষণ আগে কথাটা বলেছিল। তবে কি সাইফ ওকে খোঁ*চা দিচ্ছে! একটু লজ্জা পায় তিয়াসা।
” কথা না বলার পণ করেছ বোধকরি। ” সহজ গলায় আবার প্রশ্ন করে সাইফ।
” আমি ছাদে যাব। ”
” আমার প্রশ্নের উত্তর বুঝি এটা! ” সাইফ ব্যাঙ্গ করে জিজ্ঞেস করে।
” ঘুম আসছেনা জন্যই তো ছাদে যেতে চাইছি। ” এবার তিয়াসার গলা স্তিমিত।
” অনেক রাত হয়েছে, আজ আর ছাদে যেওনা। ”
” আচ্ছা। ”
আবারও চুপচাপ হয়ে যায় দুজন। তিয়াসা চাইছে আরেকটু কথা বলুক সাইফ। কিন্তু সাইফ বলার মত কোন কথা খুঁজে পায়না।
অভিমানে তিয়াসার দুচোখ ভাসে। সে সময় চেয়েছিল, তিয়াসাও তাতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এখনো সে তিয়াসার সাথে স্বাভাবিক হতে পারেনি৷ বিয়ের একমাস হতে চলল। আরও কত সময় নিবে সে! একটু একটু করে তিয়াসার অভিমানের পাল্লা ভারি হয়।
আর সাইফ চেষ্টা করছে তিয়াসার সাথে স্বাভাবিক হওয়ার। কিন্তু বারবার কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে সে। তিয়াসা ওর সামনে আসলেই মনে হয় সেই দু*র্বি*স*হ অতীত। খা*ম*চে ধরে বুকের বাঁ পাশ। হঠাৎই বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করছে। এই মুহুর্তে একটা সিগারেট ভিষণ প্রয়োজন। সিগারেটের জন্য হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু সে তো সিগারেট কবেই ছেড়েছে। অস্থির হয়ে বিছানা ছাড়ে। দরজা খুলে নিচে নামে। গন্তব্য দারোয়ানের ঘর। তাকে সিগারেট খেতে দেখেছে সাইফ।
সাইফকে এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে তিয়াসা অবাক হয়ে গেছে। সেও উঠে বসে। রুমের বাইরে এসে বুঝতে পারে সাইফ বাড়ির বাইরে গেছে। তিয়াসা দৌড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সাইফকে দেখল দারোয়ানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করছে। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে আবার বাড়ির ভেতর আসে৷
তিয়াসা বিছানায় বসে সাইফের অপেক্ষা করছে। কিন্তু সাইফ রুমে আসেনা। তিয়াসা আবার রুমের বাইরে আসে। নিচে নেমে দেখল দরজা বন্ধ আছে। তবে কি সে ছাদে গেছে! তিয়াসা এবার ছাদের দিকে পা বাড়ায়। গুটিগুটি পায়ে ছাদে আসে। ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই দেখতে পায় সাইফ সিগারেট খাচ্ছে। দপ করে তিয়াসার মাথায় আ*গু*ন ধরে যায়।
প্রায় দৌড়ে এসে সাইফের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে।
” আর একদিনও যদি দেখেছি আপনি সিগারেট খাচ্ছেন তবে ভাইয়াকে সাথে সাথে জানাব।” চিবিয়ে চিবিয়ে বলে তিয়াসা।
আর সাইফ হতভম্ব হয়ে গেছে তিয়াসার অধিকারবোধ দেখে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here