মায়াবতী পর্ব ১৩

#মায়াবতী
#পর্ব_১৩
#সুলতানা_পারভীন

রাহাতের হুঁশ ফিরতে নিজেও তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। একান্তে কথা বলার জন্য মায়াকে নিজের ফার্ম হাউজে নিয়ে এসেছিল রাহাত। জায়গাটা শহর থেকে বেশ অনেকটাই দূরে। পথ ভুল করে কোন দিকে চলে যাবে এই মেয়েটা কে জানে! ভাবতে ভাবতেই মায়াকে ফার্ম হাউজের গেইটের সামনে দাঁড়ানো দেখতে পেল রাহাত। নিজে নিজেই হেসে ফেললো রাহাত। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত মায়া। রাহাত গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে মায়ার কাছাকাছি এসে হর্ন বাজালো। মায়ার আঁতকে উঠে চোখ খোলা দেখে জোরেই হেসে ফেললো। মায়া রাগ করে হাঁটা শুরু করলো। ভাবটা এমন যে সে একাই চলে যাবে। তবু রাহাতের সাথে যাবে না। রাহাতও মায়ার পিছন পিছন ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে আর একটু পর পর হর্ন বাজাচ্ছে। আর শব্দ করে হাসছে৷ মায়া বিরক্ত হয়ে রাহাতের গাড়ির জানালার কাছে আসলো।

-কি সমস্যা?

-একা একা কোথায় যাওয়া হচ্ছে মায়াবতী?

-আমি একাই চলে যাবো বাসায়–। হুহ।

-তাই? তো একা একা এতোদূর থেকে শহরে ফিরতে পারবেন ম্যাডাম?

-মানে!

-গাড়িতে উঠে এসো–। আমরা শহর থেকে বেশ অনেকটাই দূরে আছি মায়াবতী–। হারিয়ে গিয়ে আমাকে কষ্ট দিতে হবে না। এসো না?

আশেপাশে তাকিয়ে মায়াও ভয় পেয়ে ঢোক গিললো। আসলেই এই জায়গাটা ওর পরিচিত নয়। তাড়াতাড়ি তাই গাড়িতে উঠে বসলো। আর মায়ার তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে আসা দেখে রাহাত আবার হাসতে লাগলো। রাহাতের হাসি দেখে মায়া অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। এই লোকটা বেশি খারাপ। এত্তোগুলা খারাপ। একে তো ভয় পাইয়ে দেয় সারাক্ষণ। তারপর এভাবে হেসে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। খারাপ খারাপ। খুবই খারাপ লোক একটা! এসব ভাবতে ভাবতেই হাতে রাহাতের হাতের স্পর্শ পেল মায়া। মুখ ঘুরিয়েই রাহাতকে দেখতে পেল। রাহাত মায়ার একটা হাত ধরে রেখে সামনের দিকে তাকিয়েই ড্রাইভ করছে।

-এই খারাপ লোকটার সাথেই আজীবন থাকার জন্য রেডি হয়ে যাও মাই ডিয়ার মিসেস মায়াবতী–। তোমাকে আমার সুখে থাকার কারণ হয়ে এভাবেই পাশে থাকতে হবে সারাজীবন—।

মায়া মুগ্ধ হয়ে রাহাতকে দেখছে। লোকটা ওর প্রত্যেকটা মনের কথা পড়ে ফেলে কেমন করে? কখনো কি ওকে মুখ ফুটে কিছু বলতে দিবে না এই মানুষটা?

সাত দিন পর।

আজ রাহাত আর তার মায়াবতীর বিয়ে। গত সাতদিন আগেই বিয়ের কথা হয়েছে। বিয়ের সব এরেন্জমেন্ট, কেনাকাটা, অফিস-সব মিলিয়ে ভিষণ ব্যস্ত সময় কেটেছে রাহাতের। মায়াবতীকে একটা বারের জন্যও চোখের দেখাটাও দেখতে পায় নি। আলাদা বাড়িতে হলুদ আর মেহেদীর অনুষ্ঠান হয়েছে। তাই হলুদে পরী হয়ে মায়াবতীকে কেমন লেগেছে সেটা না দেখেও কল্পনা করে নিয়েছে রাহাত। বিয়ের স্টেজটাও দুজনের আলাদা। বিয়ের সব ফরমালিজি শেষ হবার আগে দেখা হবে না মায়াবতীকে ভাবতেই প্রচন্ড রাগ হচ্ছে রাহাতের। সে যে তার মায়াবতীকে একটা নজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে এটা কি মানুষগুলো বুঝতে পারে না?

বিয়ের কবুল আর রেজেস্ট্রির পর মায়াকে পাশে পেল রাহাত। লাল টুকটুকে পরী হয়ে বসে আছে মায়া। মাথায় পাতলা কনে ওড়নায় মুখ ঢাকা। মুখটা তুলে তাকাচ্ছেই না। মাথা এমন ভাবে নিচু করে রেখেছে মন হচ্ছে না আর মুখ তুলে চাইবে রাহাতের দিকে। রাহাতও তাই ভালো করে দেখতে পারছে না বলে একটু পর পর তাকাচ্ছে মায়ার দিকে। আর সবাই সেটা নিয়ে হাসাহাসি করছে দেখে নিজেও হালকা হেসে ফেললো রাহাত। মেয়েটা রাহাতকে কতোটা বদলে দিয়েছে সে কি জানে!

সন্ধ্যায় আত্মীয়রা মুখ দেখার অনুষ্ঠানে নিয়ে বসালো রাহাত আর মায়াকে। একে অন্যকে সরাসরি দেখতে পারবে না। আয়নায় দেখে বলতে হবে কে কি দেখছে। সেই মতো করেই মায়া আর রাহাতকে স্টেজে পাশাপাশি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এতোক্ষণে মায়ার ঘোমটা সরিয়ে সেই পাতলা ওড়না দিয়ে রাহাত আর মায়া দুজনকেই আবার ঢেকে দেয়া হল। সামনে ইয়া বিশাল এক আয়না।

আয়নার ভিতর দিয়েই রাহাত তার মায়াবতীকে দেখতে পাচ্ছে। টকটকে লাল গোলাপ ফুল আঁকা বেনারসি পড়নে মায়ার। গা ভর্তি গয়না, চোখে কালো মোটা করে আইলাইনারের টান, আর চোখের নিচে মোটা কালো কাজলের ছোঁয়া, কপালে-মুখে কুমকুম টিপের ফোঁটা, নাকে চেইন টানা নথ, আর ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। সব মিলিয়ে মায়াকে কোন অংশে রাজরাণী থেকে কম লাগছে না। রাহাতের হা করে তাকিয়ে মায়াকে দেখা দেখে সবাই দুষ্টুমিতে মেতেছে।

-ভাইয়া? বাকিটা সারা রাত ভরে দেখিয়েন—। এখন বলুন তো আয়নায় কাকে দেখা যায়?

-আয়নায় আমার মায়াবতীকে দেখা যায়—-।

-ওহো—–। মায়াবতী!

এবার মায়ার পালা৷ মায়া দুরুদুরু বুকে চোখ তুলে আয়নার দিকে তাকালো। আয়নার মধ্য দিয়েই দুজনের চোখাচোখি হতেই মায়া একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল। একটা শীতল স্রোত যেন একেবারে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল মায়াকে। মানুষটাকে একেবারে সাদামাটাভাবে দেখলেই যে কোন মেয়ের একটা হার্টবিট মিস হয়ে যাবে। আর বিয়ের পাগড়ী শেরওয়ানিতে দেখে তাহলে মায়ার কি অবস্থা বোঝার কথা। গাঢ় খয়েরী রঙে সেজেছে রাহাত। শেরওয়ানীর খয়েরী রঙের সাথে সোনালী রঙের পাজামা আর পাগড়ী। পাগড়ি, শেরওয়ানী, বর ওড়না সব কিছুতেই সাদা পার্লের কাজ করা। সব মিলিয়ে কমপ্লিট রাজকুমার।

-এই যে নতুন বউ? আয়নায় কাকে দেখা যায়?

———-মায়াবতীর স্বপ্নের রাজ্যের রাজাকে দেখা যায়—।

রাত দশটায় খাওয়া দাওয়া শেষ করে মায়াকে নিয়ে রাহাতদের বেলী আর গোলাপ ফুলে সাজানো গাড়িটা রওনা দিলো। এর আগে মায়ার মা আর ভাই মিহান রাহাতকে ধরে কেঁদে ফেললেন। এই চুপচাপ মেয়েটা নিজের মনের কষ্টটা কাউকে দেখাতে চায় না, বুঝতে দিতে চায় না। ওকে যেন রাহাত আগলে রাখে সেটাই বারবার করে বললেন। রাহাতও তাদেরকে আশ্বস্ত করলো, সে তার মায়াবতীকে কখনো কষ্ট পেতে দিবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়িতে পাশে বসা মায়াকে দেখছে রাহাত। মেয়েটা অন্ধকার শহরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা থমথমে করে বসে আছে। রাহাত কিছু না বলে মায়ার ডান হাতটা নিজের বাম হাতে চেপে ধরতেই মায়া তাকালো রাহাতের দিকে। একটু হাতটা টেনে কাছে টেনে নিয়ে নিজের কাঁধে মায়ার মাথাটা রাখলো রাহাত।

-আমার মায়াবতীটার মন খারাপ?

-উঁহু ———–।

-বিয়ের পরে নাকি মেয়েগুলো কেঁদে কেটে একেবারে মিনি পেত্নী হয়ে যায়–। তা তুমি দেখছি গুম হয়ে বসে আছো—। কাহিনী কি?

-কিসের কাহিনী?

-মেকাপ নষ্ট হওয়ার ভয় পাচ্ছ? তেমন হলে পার্লার থেকে আবার সাজিয়ে আনবো–। তবু একটু কেঁদে হলেও ঠোঁটে আগের সেই হাসিটা ফিরিয়ে আনো–। প্লিজ?

মায়া রাহাতের কথায় হেসে ফেললো। এই লোকটার পাগলামি কথায় সবসময়ই ওর মনটা হালকা হয়ে যায়। মায়া কাঁধে মাথা রেখেই রাহাতের মুখের দিকে তাকালো। রাহাত অপলকে মায়াকে দেখছে। মায়াবতীটার ঠোঁটের কোণের হাসিটা দেখতে ভালো লাগছে রাহাতের। মায়ার হাতটা আবার একবার আলতো করে চেপে ধরে ভাবছে রাহাত। আজ থেকে নতুন একটা জীবন শুরু করবে সে তার মায়াবতীকে নিয়ে। ফেলে আসা জীবনের সমস্ত ভুলগুলোকে বাদ দিয়ে নতুন এক পথচলা শুরু হবে রাহাতের। শুধু তার মায়াবতীটাকে নিয়ে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here