#মিথু
#সাহেদা_আক্তার
#পর্ব_৩
ইহান অবাক হয়ে বলল, কি বলছো ইশুবু?
– ঠিকই বলছি। আমি তো অফিসে নিয়ে যেতে পারব না। মেয়েটাও বিরক্ত হবে। তোর সাথে গেলে অন্তত কিছু শিখতে পারবে। যতটুক বুঝেছি ও তোকে জ্বালাবে না।
– কিন্তু সবাইকে কি বলব?
– বলবি তোর আত্মীয়। পড়তে এসেছে। এখন আয় খাবি। ওকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে আয়।
– আমি!?
– হ্যাঁ, আজ থেকে তোর দায়িত্বে ওকে দিলাম। তুই ওর যত্ন করবি।
বলে ইশিতা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইহান মিথিলার দিকে তাকিয়ে রইল। বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে। বোনের কথা কখনো ফেলতে পারে না ইহান। ইশিতা সেটা খুব ভালো করে জানে। সামনে পরীক্ষা। মন দিয়ে পড়তে হবে। তার মাঝে কি করে যত্ন নেবে ওর! ভেবে পেল না ইহান।
.
.
.
.
পরদিন ঠিকই মিথিলাকে নিয়ে হাজির হতে হলো কোচিংয়ে। বাসায় গতকাল যে কান্ড করেছে ও নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আজও চিরকুট লিখে রেখে গেছে ইশিতা নাস্তার সাথে। মনে করিয়ে দিয়েছে ওকে কোচিংয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। এক সমস্যা।
মিথিলা বসেছে ইহানের সাথে ছেলেদের সিটে। ওকে মেয়েদের সিটে যেতে বলেও লাভ হয়নি। সে মাথা নাড়িয়ে সাফ জানিয়ে দিল সে ইহানের সাথেই বসবে। তা দেখে সবাই ফিসফিস করছে। ইহানের বন্ধু ফারাবী ব্যাগ রেখে বলল, কি রে? কে এটা?
– আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ে।
– যেভাবে চিপকে আছে মনে তো হচ্ছে জিএফ।
ইহান হাসল। মিথিলা একহাতে ওর হাতার শার্ট ধরে আছে আর পা নাড়াতে নাড়াতে আশপাশ দেখছে। কে কি বলছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
একটু পরই স্যার চলে এল। সবাই উঠে দাঁড়াল। কিন্তু মিথিলার সেদিকে হুশ নেই। ইহান থেকে একটা খাতা নিয়েছিল। সে বসে বসে ছবি আঁকছে। বসেছে ফার্স্ট বেঞ্চে তাই স্যারের নজরও পড়ল ওর দিকে আগে। ধমক দিয়ে বলল, এই মেয়ে, দাঁড়াও। ধমক শুনে মিথিলার হাত থেকে পেন্সিল পড়ে গেল। সে পেন্সিল খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। স্যার আবার কিছু বলার আগেই ইহান বলল, স্যার ওর একটু মানসিক সমস্যা আছে। আপনি কিছু মনে করবেন না।
– মানসিক সমস্যা থাকলে এখানে কেন? তাদের আলাদা জায়গা আছে। ওখানে না দিয়ে এখানে দিয়েছে কেন?
– স্যার ও আমার সাথে এসেছে। বাসায় কেউ থাকে না তো। একলা থাকবে তাই নিয়ে এসেছি।
স্যার ইহানের কথায় একটু নরম হল। ইহান বরাবরই ভালো স্টুডেন্ট তাই সবাই কম বেশি পছন্দ করে। তাই নরম হয়ে বলল, ঠিক আছে। কিন্তু সামনে যেন এমন না করে৷ ইহান বলল, জ্বি স্যার আমি বুঝিয়ে বলব। বলে বসে পড়ল। মিথিলা পেন্সিল খুঁজে আবার মনযোগ দিয়েছে আঁকায়। কি যে হল সেটা সে খেয়ালও করেনি। ইহান মনে মনে বলল, আজকেই এর একটা বিহিত করতে হবে ইশুবুর সাথে। না হলে প্রত্যেকদিন কথা শুনতে হবে।
টানা চার ঘন্টা ক্লাস হলো। ইহানের কি যে টায়ার্ড লাগছে। আবার ভালোও লাগছে কারণ একটা ম্যাথ অনেকদিন বুঝতে পারছিল না। আজ ক্লাসে বুঝে নিতে পেরেছে। ক্লাস শেষে মিথিলার দিকে তাকাল। সে আপন মনে খাতার দিকে তাকিয়ে এঁকে চলেছে। কি এমন আঁকছে? ইহান উঁকি দিবে এমন সময় রাইসা এসে হাজির।
– কেমন আছো ইহান?
– ভালো।
ইহানের মোটেই পছন্দ না এ মেয়েকে। বড়লোকের মেয়ে, গায়েপড়া স্বভাব। প্রত্যেকদিন এটা ওটার ছুতোয় কথা বলতে আসে৷ সহজ সহজ অঙ্কও বুঝেনি বলে বুঝতে আসে ওর কাছে। ইহানের ভালো লাগে না। কিন্তু কি করা। যদি বুঝে না থাকে তো বুঝিয়ে দেওয়া তো লাগবে। দুর্বলদের সাহায্য করা উচিত। এখন কি নিয়ে এসেছে কে জানে। রাইসা বলল, ইহান, দেখো না এই জায়গাটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে দাও৷ বলেই ইহানের পাশে বসে গেল। এবার খেয়াল পড়ল মিথিলার। কেন যেনো ডান হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ইহানের। ও মিথিলার দিকে তাকাতেই দেখল মুখটা কালো করে তাকিয়ে আছে রাইসার দিকে। রাইসা আরো কাছে এসে বসল ইহানের। বলল, ইহান দেখো তো আমার চোখে কি পড়েছে। না পারতে ওর দিকে হাত বাড়াতে মিথিলা খাতা বন্ধ করে উঠে বাইরে চলে গেল। ইহান তাড়াতাড়ি বই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। রামিসা বলল, ইহান, আমাকে ম্যাথাটা বোঝাবে না?
– আরেকদিন।
– ইহান…
ইহান বেরিয়ে গেল। মিথিলা বেরিয়ে কোথায় চলে গেছে। সবাইকে জিজ্ঞেস করতে করতে বুঝতে পারল মিথিলা বাসায় যাওয়ার উল্টো পথ ধরেছে। ও দ্রুত পা চালালো৷ কিছুদূর যাওয়ার পর দেখল মিথিলা রাস্তায় পা ভাঁজ করে বসে আছে। ইহান কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হঠাৎ এভাবে বেরিয়ে এলে কেন? মিথিলা কিছু না বলে একটা কাঠি নিয়ে রাস্তায় আঁকতে লাগল।
– আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি।
এখনো কোনো সাড়া না পেয়ে ইহান ওকে উঠে দাঁড় করালো। মিথিলা কাঁদছে। ইহান একটু নরম হওয়ার চেষ্টা করে বলল, কি হয়েছে বলো আমাকে। মিথিলা মাথা নাড়িয়ে বলল, বাসা যাবো। এর বাইরে আর একটা বর্ণও বলল না। রিক্সা নিতে হবে৷ ওরা অনেকদূর চলে এসেছে। একটা খালি রিক্সা পেয়ে উঠে বসল। সারা রাস্তা মিথিলা ইহানের শার্ট ধরে মাথা নিচু করে বসেছিল।
আজকে অনেক টায়ার্ড লাগছে। টানা চার ঘন্টা ক্লাস শেষে খুব ক্লান্ত লাগছে। এখন ভাতও রান্না করতে হবে। কোনোমতে ভাত চুলায় তুলে দিয়ে বাংলা বইটা নিয়ে শুয়ে পড়ল সোফায়। মাথাটা হাতলে রেখে বইটা মেলে ধরল সামনে। একঘন্টা পড়ল এভাবে। ভাতটাও হয়ে এসেছে। মিথিলার কোনো খবর নেই। এসেই ওয়াশরুমে চলে গেছে। এই একঘন্টা কোনো সাড়া শব্দ নেই। ইহান কি করবে বুঝতে পারল না। শেষে না থাকতে পেরে দরজায় নক করল। কেউ উত্তর দিলো না। অনেকবার নক করার পর ভয় হলো। ইহান জোরে জোরে বাড়ি দেওয়ার পরও যখন মিথিলা দরজা খুলল না তখন দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল। জোরে ধাক্কা দিয়ে লক ভেঙে ফেলল। দরজা খুলে দেখল ঝর্ণার ছাড়া। মিথিলা নিচে মেঝেতে পড়ে আছে। পানিতে ভিজেচুপসে গেছে। ও তাড়াতাড়ি ওকে তুলে আনল। ভেজা থাকায় বিছানায় রাখতে পারল না। চেয়ারে বসিয়ে টাওয়াল মুড়ি দিয়ে দিল।
আধা ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরল মিথিলার। গায়ে অনেক জ্বর এসেছে। ইহান কাছেই ছিল। জ্ঞান ফেরার পর হাত দিয়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে বলল, মাকড়শা। অনেক ভয় মাকড়শা।
– মাকড়শা কেউ এত ভয় পায়? তাও আবার ভয়ে বেহুশ হয়ে যায়?
মিথিলা কিছু না বলে নিস্তেজ হয়ে রইল। ইহান খাবার এনে ওকে খাইয়ে জ্বরের ওষুধ দিয়ে দিল। তারপর ইশিতার একটা জামা বের করে দিয়ে বলল, এটা পরে নাও। তখন থেকে ভেজা জামা পরে আছো। ইহান বেরিয়ে এসে খেতে বসল। ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। এ নিয়ে দুইবার মাকড়শার কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। আজকে ইশুবু আসলে বলতে হবে।
দশটায় ইশিতা বাসায় ফিরল। ঢুকেই বলল, ইনু, এক গ্লাস পানি দে তো। ও পানি দিতেই ঢকঢক করে খেয়ে নিল। ইহান বলল, ইশুবু একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলা লাগবে। ইশিতা পানির গ্লাস রাখতে রাখতে বলল, ফ্যানটা জোরে দে তো। যা গরম বাইরে! এবার বল কি?
– আজকে মেয়েটা……
– মেয়েটা কি? মিথু বলবি।
– ঐ হলো। ও আজকে ওয়াশরুমে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।
– কি বলছিস? কোথায় এখন? কেমন আছে?
– ভালো আছে। জ্বর এসেছিল। ওষুধ খেয়েছে, এখন জ্বর নেমে গেছে।
– বাব্বা আমার ভাইটা তো অনেক বড়ো হয়ে গেছে!
ইশিতার কথার ধরণ দেখে ইহান হাসল। ইশিতা জিজ্ঞেস করল, এমন হচ্ছে কেন কিছু বলতে পারবি? ইহান বলল, ও মাকড়শা দেখে ভয় পেয়েছে অনেক। দুইবারই একই কথা বলেছে।
– তাহলে মেবি মাকড়শায় ফোবিয়া আছে ওর।
– সেটা কি?
– আমরা বিভিন্ন জিনিস ভয় পাই। ভয় হচ্ছে আমাদের মনের অবচেতন স্তরের একটি বিশেষ মানসিক অবস্থা। ফোবিয়া ভয়েরই একটা মাত্রাতিরিক্ত অবস্থা। কোনো বিশেষ বস্তু, বিষয় কিংবা কোনো ঘটনা বা অবস্থায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় আতঙ্কিত হওয়া, অস্বস্তিবোধ করা বা অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া অথবা সেই ব্যাপাটাকেই অহেতুক এড়িয়ে চলার প্রবণতাটাই ফোবিয়া।
– এখন কি করতে হবে?
– আমাদের আরো সাবধান হতে হবে যাতে মাকড়শা চোখে না পড়ে ওর। খেয়াল রাখবি।
– ইশুবু… তুমি কি আমাকে পরীক্ষায় পাশ করতে দেবে না?
– তুই না পড়ে পরীক্ষা দিলেও ডায়মন্ড এ প্লাস পাবি।
ইশিতা হাসল। মিথিলা রুম থেকে চোখ ঢলতে ঢলতে বের হলো। প্রথমে ইহানের দিকে তাকিয়ে তারপর ইশিতাকে দিকে ফিরে প্রথম বলল, ই শু বু!?
চলবে…