#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#Ipshita_Shikdar
#পর্বঃ১৫
৪৪।
আরিজ রাগে চোখমুখ শক্ত করে, রক্তিম চোখে নাক লাল করে বাড়ি ফিরছে। তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন রাগে টগবগ করছে। ড্রইংরুমে বিদ্যমান দুই মধ্যবয়স্ক বোন ছেলেকে এভাবে আসতে দেখে ভড়কে যায়। চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,
“কীরে তুই এভাবে…? আর পক্ষী কোথায়? তুই না ওকে নিতে গিয়েছিলি!”
কিন্তু যুবক এতোটাই রাগে তা কানেই যেন যায়নি তার। সে হনহন করে হেঁটে নিজের শয্যাগারে প্রবেশ করে। বলা বাহুল্য, সে পক্ষীকে ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু ফিরত আসে এভাবে।
নয়ন্তিনী বেগম চিন্তিত গলায় বললেন,
“বুবু, আমাদের কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? পক্ষী আর আরিজকে এভাবে… আমরা ভালো করতে যেয়ে খারাপ করছি না তো ছেলেটার?”
“দেখ, আল্লাহ বান্দার ভালো ছাড়া খারাপ চায় না। তাছাড়া আমি সবদিক ভেবেচিন্তেই করছি… ”
“কিন্তু…”
“দেখ, আমি যা করছি সবার ভালোর জন্যই করছি। বিশেষ করে আরিজের, কারণ সম্পর্ক তো আমার ওর সাথেই, তাই ভাবনাটা ওরই বেশি। প্রিয়া আর আরিজ একটা নামমাত্র সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। যার ভবিষ্যৎ তো ওরা দেখছে, পূরণও করতে পারবে হয়তো… কিন্তু তাদের সম্পর্কের যাত্রাপথ অত্যন্তই ক্ষুদ্র হবে। কারণ সম্পর্কের মাঝে শুধুই ভালোবাসা থাকলেই হয় না, ভালো বোঝাপড়া থাকা লাগে, পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকা লাগে।”
নয়ন্তিনী এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচু গলায় বললেন,
“যাই বলিস বুবু, প্রিয়া মেয়েটা কিন্তু সত্যিই আরিজকে ভালোবাসে।”
“তোর ছেলে তো ভালোবাসে না, রূপ দেখে পাগল হয়েছে মাত্র। তোর মনে আছে একবার যখন আরিজ প্রিয়াকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, মেয়েটা সখ করে ওকে ঘুরতে যাওয়ার জন্য নিজের পছন্দ করা পোশাক পড়তে জোর করার জন্য কী চেঁচামেচিই না করেছিল! আর সেখানে এখন রোজ রোজ পক্ষীর পছন্দ করা সবকিছু করে। ”
নয়না কথাগুলো বলে থেমে নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পুনরায় বলেন,
“জীবনের সাথে অনেক মানুষকেই জড়ানো যায়, আমরা জড়াইও। তাই বলে সবাইকেই অধিকার দেওয়া যায় না, তা শুধু অতি বিশেষ ক্ষুদ্রাংশের জন্যই থাকে।”
নয়ন্তিনীর কাছে বোনের যুক্তির বিপরীতে কিছু বলার নেই। তবুও দ্বিধা নিয়ে বলে উঠে,
“তবে প্রিয়া…?”
“প্রিয়ার সাথে আরিজের সম্পর্ক পূর্ণতা পেলেও টিকার সম্ভাবনা অতি ক্ষুদ্রই বলা চলে। পক্ষী তোর সংসারের দায় যেভাবে হাতে নিয়েছে, যেভাবে তোকে বা আমাকে আপন মায়ের মতো মান্য করে; সেভাবে প্রিয়া করবে? প্রিয়া প্রচণ্ড ক্যারিয়ার নিয়ে পড়ে থাকা মেয়ে, আল্লাহ না করুক কোনো সময় যদি এমন পরিস্থিতি আসে যখন প্রিয়াকে কোনো এক কারণে বাড়ির টেক করতে ক্যারিয়ার থেকে ব্রেক নেওয়া লাগে তখন পরিবার ও ক্যারিয়ারের মধ্যে ও কাকে চুজ করবে মনে হয় তোর? যখন প্রিয়া কলেজের চাকরি পায়নি একটা লেট নাইট ডিউটির কলসেন্টারের চাকরির প্রস্তাব এসেছিল, তখন আরিজ জাস্ট সাজেস্ট করেছিল এটা সেফ না, না করতে। সেটা নিয়ে ওদের কত বড় ঝগড়া…!”
নয়না ছোটবোনের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“দেখ, আমি বলছি না প্রিয়া মন্দ বা পক্ষী ভালো। আমি শুধুমাত্র বলতে চাই, আরিজ প্রিয়ার জন্য সঠিক নয়। বিবাহ সম্পর্ক এমন, কোনো পরিস্থিতিতে একজন আগুন হলে আরেকজনকে পানি হতেই হয় ব্যালেন্স রাখার জন্য। কখনো রাগ দিয়ে, তো কখনো আবার কেঁদে বা হেসে অপরজনকে বুঝাতে হয়, মানাতে হয়। কিন্তু যদি দুজনই কোনো ঝগড়াফ্যাসাদে বা সাংসারিক ঝামেলায় আগুন হয় তাহলে সম্পর্ক ছারখার হয়ে যায়, আরিজ আর প্রিয়া তেমনই। তবুও মেনে নিতাম এই তাদের বিয়ে হওয়াটা যদি দুজন একে অপরকে ভালোবাসতো। কিন্তু প্রিয়ার মাঝে যাও আছে, তোর ছেলের মাঝে তার নাম-লক্ষণও নেই। নাহলে তুই চিন্তা কর এত তাড়াতাড়ি পক্ষীকে কী করে মেনে নিতো?”
নয়ন্তিনীও এখন বড়বোনের কথায় সায় জানিয়ে বলেন,
“তাও ঠিক, আমরা বিষয়টা পরীক্ষা করার জন্যই তো আরিজের অপছন্দের কাজগুলো মানে ওর ব্যক্তিগত জীবনে পক্ষীকে জড়ালাম। কিন্তু ও এত সহজে সব মেনে নিলো যে…”
নয়না কিশোরীর ন্যায় উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“আবার সেদিনের ঘটনা মনে আছে। আমার তো সেদিনের ঘটনার পরই মনে হয়েছিল, এই মেয়েই আমার রাজপুত্রলে মায়ার কারাগারে টিকিয়ে রাখতে পারবে।”
নয়ন্তিনী বেগম কনফিউজ হওয়ার ভঙ্গিমায় বলে উঠেন,
“কোনদিনের ঘটনার কথা বলছো বুবু?”
অতঃপর নয়না নিজের বোনকে সঙ্গিনী করে পাড়ি জমালেন নয়নার সাথে পক্ষীর প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাতে। (মনে আছে কত পর্বের ঘটনা এবং ঘটনাটি?)
অতীত,
কটূক্তি সহ্য করতে না পেরে পক্ষী কিছু না বলে দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়। নয়না সেদিকে তাকিয়ে ভেঙচি কেটে বলেন,
“দেখছিস! দেখছিস! কেমন ভাব দেখিয়ে চলে গেল! এজন্যই বুড়োবুড়ি খাটো মেয়ে বাড়িতে না আনতে বলে গেছে, এরা স্বভাবগতই কুটনি হয়।”
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরিজ পক্ষীর পক্ষ নিয়ে বলে,
“আহা, এভাবে বলছো কেন বড় খালা? মেয়েটা সেই কখন থেকে সিক, সিকনেস নিয় ভার্সিটি গেল, আর আসতে না আসতেই… তুমি ওর কথা বাদ দাও তো খালা। এত দূর থেকে এসেছো রেস্ট নাও।”
বর্তমানে,
নয়না ও নয়ন্তিনী ঘটনাটা মনে করতে করতেই মিটমিট করে হেসে উঠেন , যেন দুই কিশোরী বিটিভিতে আসা এক রোমাঞ্চকর চলচিত্রের নায়ক ও নায়িকাকে নিয়ে আলোচনা করছেন। নয়ন্তিনী উৎফুল্ল গলায় বলতে লাগেন,
“হ্যা বুবু, আমিও তো দেখে অবাক। যেই ছেলে কোনোদিন কারো ব্যাপারে নাক গলায় না, সে এমন বিষয়ে নাক গলিয়ে এমন একজনের সাপোর্ট করলো যাকে ওর পছন্দ করার কথাও না। ”
“জানিস, আমি ইচ্ছে করে আরিজকে ৫ ফুট আট বলেছিলাম যেখানে ওর হাইট ছয় ফুট এক। আর ওর হাইট নিয়ে ওর কত গর্ব ওর জানিস না, কেউ যদি এক ইঞ্চিও কম বলে তাকে দশবার মনে করায় দেয়। কারণ ছেলেটার ছোটোবেলা এই হাইট, চেহারার জন্য কতোই না…”
নয়না কথাটা বলে মনটা বিষণ্ণ করেই ফেলছিলেন, তখনই নয়ন্তিনী হাতে হাত রেখে তাকে থামায়।
“বুবু, ছেলেটা তো আমার। ওসব কথা মনে পড়লেও কলিজা ফেটে যায় আমার। ছেলেটা কত কিছুই না দেখেছে জীবনের ওটুকু বয়সে। তারপর থেকেই তো ওমন, কাউকে নিজের কাছাকাছি আসতে দেয় না, মন থেকে ভালোবাসে না, কেমন এক দেয়াল তৈরি করে নিয়েছে।”
“আমরা সবাই সবসময় ভাবি আর বলি, নিজের ছেলের জন্য লাল টুকটুক, পঞ্চগুণ সম্পন্না বউ আনবো! আদৌ কী সব বাঙালি নারী এতোই লাল টুকটুকে সুন্দরী হয়! আবার আদরের মেয়েকে বকি তোর জন্য এক রাজকুমার ঘোড়া চড়ে আসবে যে সুন্দর হবে, বিত্তবান হবে। আদৌ কী ইতিহাসের রাজকুমারগণ এত সুন্দর ছিল! তবুও আমরা কেন এই স্বপ দেখতে হয়, আর নিজের বাচ্চাদের দেখাতে হয়!”
চোখের কোণঘেঁষে মুক্তোদানার মতো জমে উঠা অশ্রুকণাদের আলতো স্পর্শ মুছে নেয় নয়ন্তিনী। মৃদু গলায় বলেন,
” একই ব্যথায় কাতর দুজনেই, একজনের বর্তমান কোনোদিন একজনের অতীত ছিল। এমন মানুষরা একে অপরের কাছে ভরসা পাবে এটাই স্বাভাবিক।”
“তাই তো বুবু, তোমার সাথে সায় দিয়ে চলছি। কিন্তু তারপরও আরিজ আর প্রিয়ার সম্পর্ক…”
নয়নার কণ্ঠস্বর এবার কিছুটা গম্ভীর ও শক্ত করেই বললেন,
“আজকাল রিলেশন শব্দটা সস্তা এক চুক্তি বৈকি আর কিছুই না। এর চোখ ভালো লাগলে ভালোবাসি, এর গলা ভালোবাসি, এ সব কথা শুনে ভালোবাসি; এতসব ক্ষণিকের মুগ্ধতা নামক মিথ্যে ভালোবাসায় এই তথাকথিত ক্ষুদ্র যাত্রার রিলেশন হয়, সারাজীবনের জন্য এক সুতোয় বাধা বিয়ে না।”
৪৫।
বেডরুমের এদিকওদিক পাগলের মতো ছন্নছাড়া ভাব ধরে হাঁটছে আরিজ, তার মাঝে যেন অনুভূতি শূণ্য হয়ে উঠেছে। ব্যথায় যেন কাতর হয়ে কাঁদছে হৃদয়মহলের প্রতিটি দেয়াল। এতো যন্ত্রণা কী সহ্য করার মতো! একটু পর পর জোরে শব্দ তুলে লাথি মারছে আলমারি, খাটকে। মোটা সেগুন কাঠ না হলে এতক্ষণে ভেঙ্গেই যেতো, তার আক্রোশে।
চলবে…
আজকে ছোট পর্ব দিয়েছি, তবে নয়না ও নয়ন্তিনীর কথাগুলো খুব গভীর। তাই বেশ ভেবে ভেবে লিখতে হয়েছে। আবার স্যারের পড়াও শেষ করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।