মুখোশের আড়ালে পর্ব ১৩

#মুখোশের_আড়ালে
#পর্ব_১৩
#Saji_Afroz
.
.
সকাল ঘুম ভাঙতেই পৌষী ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে নিলো । ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ফুল হাতে ফাহাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো সে ।
পৌষী বললো-
কি উপলক্ষে?
.
পৌষীকে নিজের কাছে টেনে এনে ফাহাদ বললো-
প্রিয়জনকে উপহার দিতে কোনো উপলক্ষের প্রয়োজন হয়?
.
ফাহাদের হাত থেকে ফুলগুলো নিলো পৌষী ।
ফুলগুলো ড্রেসিংটেবিলের উপরে রেখে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে চলেছে পৌষী ।
ফাহাদ এসে তার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে বললো-
দাও, আমি মুছে দিই ।
-আজ এতো সকালে ঘুম থেকে উঠলেন কেনো?
.
পৌষীর চুল মুছতে মুছতে জবাব দিলো সে-
তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে ।
-সারপ্রাইজ কেনো?
-আজ তোমার জন্মদিন । শুভ জন্মদিন পৌষী ।
.
ফাহাদের কথা শুনে চমকালো পৌষী । আসলেই তার মনে ছিলোনা । আজ তার জন্মদিন!
.
ফাহাদের দিকে তাকিয়ে সে বললো-
আসলেই তো! আমার নিজেরি মনে ছিলোনা ।
.
পৌষীর কপালে চুমু এঁকে ফাহাদ বললো-
আমার মনে থাকলেই হলো । এবার বলো কি চায় তোমার?
.
পরক্ষণেই মুখটা ফ্যাকাশে করে পৌষী বললো-
আমি যা চাই তা আজ সম্ভব না হয়তো ।
.
তোয়ালেটা একপাশে রেখে ফাহাদ বললো-
আমি জানি তুমি কি চাও ।
-তাই! বলুন শুনি?
-সময় । প্রিয়জনের দেয়া সেরা উপহার হলো সময় ।
-কিন্তু আজ আপনার অফিসে যেতে হবে ।
.
ড্রয়ার টেনে নিজের কাপড়চোপড় বের করতে করতে ফাহাদ বললো-
উহু না!
-আপনার না ছুটি শেষ?
-কাল থেকে যেতে হবে ।
-তবে যে আজ থেকে বলেছিলেন?
-এটাও সারপ্রাইজ ।
.
ফাহাদের কথা শুনে দ্রুতবেগে এগিয়ে এসে, পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো পৌষী ।
দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে ফাহাদ বললো-
আবার গোসল করার ইচ্ছে আছে নাকি?
-যাহ দুষ্টু!
.
.
সকালের নাস্তা সেরে রিমোট হাতে বসে পড়লো পৌষী ।
ফাহাস এসে তার হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে ফেললো ।
পৌষী তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই সে বললো-
এখন কি উষ্ণ মাহমুদের অনুষ্ঠান চলছে নাকি?
-তার অনুষ্ঠান চললে কি সমস্যা?
-তুমি আবার উষ্ণ মাহমুদের অনুষ্ঠান দেখার সময় কোনো বিরক্তি পছন্দ করোনা ।
.
পৌষী চোখ জোড়া বড় করে বললো-
মোটেও না! হ্যাঁ আমার উনাকে ভালো লাগে । তবে এতোটাও না ।
.
টিভি বন্ধ করে পৌষীর পাশে ঘেঁষে বসে ফাহাদ বললো-
ঠিক তো?
-কি যা তা বলছেন আপনি! আমি সিনেমা দেখতে বসেছি ।
-উহু ৷ আজ এসব বাদ ।
-তাহলে কি করবো?
-আজ আমরা বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবো ।
-সত্যি?
-একদম । বলো কোথায় যাবে?
-আপনি যেখানে নিয়ে যান । আমি তো ভাবতেই পারছিনা, আমরা ঘুরতে যাবো!
-তোমাকে আগেও বলেছিলাম । তুমিই বের হওনি ।
-আমাকে! স্বপ্নে বলেছেন নিশ্চয় । আপনি আমাকে ঘুরতে যেতে বলবেন আর আমি রাজি হবোনা? এমনটা হতেই পারেনা ।
.
এই বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে ফাহাদ বললো-
নওয়াব বাড়ি দেখেছো তুমি?
-না । নাম শুনেছিলাম মনেহচ্ছে ।
-কি বলছো!
.
মুখটা ফ্যাকাসে করে পৌষী বললো-
সত্যিই ।
-কুমিল্লার মেয়ে হয়ে তুমি এটা বলছো! লোকে জানলে কি বলবে পৌষী?
-আমি কি করে জানবো? বাইরে কোথাও ঘুরাই হয়নি আমার ।
-আচ্ছা শুনো । এই নওয়াব বাড়ি হলো ফয়জুন্নেসার বাড়ি । নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মুসলিম নারী নওয়াব । তিনি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁওয়ে ১৮৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন । বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার জমিদারি লাভ করেন । নারী শিক্ষার প্রসারে একই বছরে তিনি স্থাপন করেন বালিকা বিদ্যালয় । তার প্রতিষ্ঠিত অবৈতনিক মাদ্রাসা এখন নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে ।
-এই কলেজটির নামও শুনেছিলাম । আমার এক বোন পড়তো এখানে ।
-তিনি নারীদের সুচিকিৎসার জন্য কুমিল্লায় স্থাপন করেন ফয়জুন্নেসা হাসপাতাল । শুধু তাই নয়, টুকটাক লেখালিখিও করতেন তিনি ।
-তাই!
-হ্যাঁ । ১৮৭৬ সালে ঢাকা গিরিশচন্দ্র মুদ্রণযন্ত্র থেকে প্রকাশিত হয় তার রূপজালাল নামক গ্রন্থ । খুব অল্প পরিমাণে লেখালেখি করলেও তার লেখাকে বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক ধরা হয় ।
বাই দ্যা ওয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে চিনেছো তো?
.
পৌষী হেসে বললো-
হ্যাঁ ।
-গুড । যাও এবার তৈরী হয়ে এসো । আজ আমরা নওয়াব বাড়ি দেখতে যাবো ।
.
.
কালো রঙের জামদানী একটি শাড়ি পরে, খোপা করেছে পৌষী । সেই খোপাতে দিয়েছে ফাহাদের দেয়া ফুল । কালো শাড়ি, খোপায় লাল গোলাপ এমন অবস্থায় পৌষীকে দেখে ফাহাদ বলে উঠলো-
হায়! ইচ্ছে করছে বাইরে আজ না যাই । আজকের প্ল্যান ক্যান্সেল করি?
.
দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পৌষী বললো-
চুপচাপ তালা লাগিয়ে নিচে নামুন । আমি অপেক্ষা করছি । আজ ফয়জুন্নেসা খালার বাড়ি আমি দেখবোই ।
-তোমার মায়ের বোন হোন উনি?
.
মুখ বাঁকিয়ে জবাব দিলো-
সম্মান করলে অসুবিধে আছে? শুধু মায়ের বোনকেই খালা ডাকা যাবে কথা আছে?
-ওরে বাপ ভুল হয়ে গিয়েছে । আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুমি আর পিচ্চি নেই । বড় হয়ে গিয়েছো ।
.
পৌষী থেমে বললো-
বড় হয়েছি?
-হ্যাঁ । আমাদের বাসর হয়েছে না! বাসর মানে বড় হওয়া ।
.
পৌষী হেসে বললো-
আসুন তো!
.
.
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর বাড়িতে পৌঁছায় ফাহাদ ও পৌষী । গেট পেরুতেই একটি সবুজ মাঠ চোখে পড়লো তাদের । মাঠের দু’পাশে দুটি বড় বাড়ি দেখতে পেলো তারা । একটি একতলা আরেকটি দুতলা বিশিষ্ট । একতলা বাড়ির দরজায় তালা লাগানো আছে । তাই ফাহাদ ও পৌষী দুই তলা বাড়িটায় প্রবেশ করতে থাকলো । বেশ বড় বাড়িটি । বাড়ির ওপর খোদাই করে লেখা-
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ভবন ।
বাড়ির মাঝখানে এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়ার সোজা রাস্তা । বাড়ির ভেতরে পা দিয়ে একটু ভেতরের দিকে যেতেই পৌষীর শরীরটা ছমছম করে উঠলো । অনেকটায় অন্ধকার এখানে । ফাহাদের হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে বললো সে-
মনেহচ্ছে ভুতুড়ে কোনো বাড়িতে এসেছি ।
-তোমার খালাম্মার বাসায় এসেছো । ভুতুড়ে বাড়ি বলছো শুনলে তিনি রাগ করবেন । রেগে গেলে আবার…
.
ফাহাদকে থামিয়ে পৌষী বললো-
ধ্যাত চুপ করেন । মৃত মানুষদের নিয়ে মজা করতে নেই ।
.
মুচকি হাসলো ফাহাদ । তারা এগিয়ে যেতে থাকলো । ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে । পা ফেলে একটু ভেতরে যেতেই পাওয়া গেল দুইতলায় উঠার সিঁড়ি । তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে তারা ।
উপরে উঠার পরেই পৌষীর মুখ দেখে ফাহাদ হেসে বললো-
ভয় নেই । এখানে কলেজের কিছু স্টুডেন্ট থাকে । আর হোস্টেলের বুয়ারাও ।
.
ফাহাদের কথা শুনে ভয় কেটে গেলো । মনে লেশমাত্র ভয় নেই ।
গলার স্বরটা গম্ভীর করে বললো-
এতোক্ষণ বলেন নি কেনো?
-ভয় পেলে কেমন লাগে তোমায় দেখার জন্য ।
.
নিশ্চুপ পৌষী । মনেহচ্ছে রাগে ফুলছে । তার হাত ধরে টানতে টানতে ফাহাদ বললো-
চলো তোমার ফয়জুন্নেসা খালার রুম দেখবে ।
.
.
এদিকে পৌষীর কোনো খবর না পেয়ে চিন্তিত উষ্ণ । যদিও মিয়াজ শেখের কাছে শুনেছে সে ভালোই আছে । তবুও উষ্ণের মনে কেমন যেনো অস্থিরতা বিরাজ করছে । পৌষীর মাঝে একজনকে খুঁজে পেয়েছিলো সে । তার জন্যই হয়তো এই অস্থিরতা । ভালোই তো লাগতো উষ্ণের তার সঙ্গ । এক্সিডেন্টের পরে এমন কি হলো? পৌষী কোনো খবর নিলোনা, ফেইসবুকে এলোনা, এমন কি ফোন পর্যন্ত বন্ধ রেখেছে!
উষ্ণের যে অনেককিছু জানার বাকি ।
.
.
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ফাহাদ ও পৌষী । নবাব ফয়জুন্নেসার জমিদার বাড়ির সাথেই রয়েছে ১০ গম্বুজ বিশিষ্ট ‘নবাব ফয়জুন্নেছা জামে মসজিদ’ ।
পৌষী তা দেখে বললো-
মসজিদটাও অনেক সুন্দর ।
-হুম । নান্দনিক এই মসজিদটিতে পুরুষদের সাথে সাথে মেয়েদেরও নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে ।
-হুম।
.
ফাহাদ মসজিদের পাশে দেখিয়ে বললো-
এখানেই শায়িত আছেন, নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ও তাঁর পরিবারের সদস্যগণ ।
-আচ্ছা!
-চলো আরেকটা জমিদার বাড়ি দেখোবো তোমাকে ।
-দূরে?
-না এখান থেকে কাছে । এই মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়ে দীঘির পাড় ধরে মিনিট পাঁচেক লাগবে হেঁটে যেতেই ।
.
হাঁটতে হাঁটতে পৌষী বললো-
এই বাড়িটির নাম কি?
– বাগিচা বাড়ি । এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন জমিদার বাড়ি ।
-ধ্বংসপ্রাপ্ত কেনো?
-সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে স্থাপত্যশিল্পের এই প্রাচীন নিদর্শনগুলি ।
.
.
উষ্ণ রুমের মাঝে পায়চারী করছিলো । তখনি ফোন এলো মিয়াজ শেখের ।
-কি অবস্থা উষ্ণ?
-ভালো আছি । আপনি?
-আমিও ভালো । কাল কুমিল্লা চলে যাবো । যদিও মুহিত আর তোমার আন্টি এখানেই থাকবে । আমি আবার এতোদিন ঢাকা শহরে থাকতে পারিনা ।
.
কথাটি বলে হাসতে থাকলেন মিয়াজ শেখ ।
উষ্ণ বললো-
আমিও যাবো কুমিল্লায়?
-সে কি! মাত্রই এলে ঢাকায় । তাছাড়া তুমি তো ঢাকাতেই থাকো । কোনো কাজে যাবে?
-ঢাকায় আপাতত কাজ নেই কোনো । বাড়িতেই থেকে আসি আরো কয়েকটা দিন ।
-মন্দ বলোনি । নিজের জন্মস্থানে থাকার মতো শান্তি আর কোথাও পাওয়া যায়না । কেনো যে মুহিত বুঝেনা!
.
কিছুক্ষণ মিয়াজ শেখের সাথে কথা বলে ফোন রাখলো উষ্ণ ।
মূলত পৌষীর জন্যই কুমিল্লায় যাবে সে । রহস্যময়ীর থেকে দূরে থাকলে রহস্যের উদঘাটন করবে কি করে?
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here