মুখোশের আড়ালে পর্ব ১৮

#মুখোশের_আড়ালে
#পর্ব_১৮
#Saji_Afroz
.
.
প্রথম এই বাড়িতে তিশানীর সাথে পা রেখেছিলো উষ্ণ । তিশানী তার মামা-মামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য উষ্ণকে নিয়ে এসেছিলো । এই সোফাটায় বসেছিলো সে ।
তিশানীর মামা গম্ভীর একজন মানুষ । কথা কম বলতে পছন্দ করেন তিনি । যা বলে সোজা সাপ্টাই বলতে পছন্দ করেন । উষ্ণ এত মতো একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিকে দেখেও তার কোনো প্রতিক্রিয়া ছিলোনা । বরং উষ্ণের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে তিনি বলেছিলেন-
ছেলে হিসেবে দেখতে ভালো তুমি!
.
তার কথা শুনে উষ্ণ হেসে ফেলেছিলো ।
তিশানীর মামা তার গম্ভীর গলায় বলেছিলেন-
তুমি দেখতে ভালো, এটা কি বলার মতো কিছু নয় বলে হাসছো?
-তা নয় । খুশি হয়ে হাসলাম ।
-বেশ! তা তুমি তিশানীর মতো একজন সাধারণ মেয়েকে পছন্দ করেছো কেনো? তুমি উষ্ণ মাহমুদ! অসাধারণ কাউকে পেতে ।
-তিশা আমার কাছে সাধারণের মাঝেই অসাধারণ । ভালোবাসি কেনো তা জানিনা! তবে অনেক বেশিই ভালোবাসি । আর সারাজীবন বাসতে চাই ।
.
উষ্ণের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেছিলেন-
তোমাদের জীবন সিদ্ধান্ত তোমাদের ৷ আমি আর কি বলবো! তবে দ্রুত বিয়েটা হয়ে গেলেই উত্তম । আমরা দেশের বাইরে যাবো । এর আগেই তিশানীর দায়িত্ব তুমি নিলে ভালো হয় ।
.
– উষ্ণ?
.
পৌষীর ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো উষ্ণ । হালকা স্বরে বললো-
হু বলো?
-কিছু লুকোচ্ছো আমার কাছে?
-নাতো ।
-সিউর?
.
এরইমাঝে ট্রে হাতে হাজির হলো ফাহাদ । টেবিলের উপরে ট্রে রেখে বললো-
চা নিন ।
.
উষ্ণ চায়ে চুমুক দিয়ে বললো-
ভালোই চা বানাতে পারেন দেখছি ।
-ধন্যবাদ । আচ্ছা আপনারা গল্প করুন । আমি আছি ভেতরে ।
.
ফাহাদ উঠে পাশের রুমে চলে গেলো ।
উষ্ণ ও পৌষীর কথার শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে । অনেক বেশিই অবাক লাগছে পৌষীর ব্যবহার তার কাছে । এই কি সেই পৌষী? যাকে সহজ সরল মেয়ের কাতারে বলা যেতো!
এইতো প্রায় চারমাস আগে ফাহাদ যখন গ্রামে যায়, তার মা বাবার কথায় তাদের সাথে পৌষীদের বাসায় যেতে হয় তাকে ।
সেদিন পৌষীদের বাড়িভর্তি মানুষ ছিলো । ফাহাদকে তারা এমনভাবে স্বাগতম জানালো যেনো কোনো রাজা এসেছে!
সেই দিনটার কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায় তার ।
মা বাবার সাথে বসে আছে ফাহাদ । তার ঠিক সামনেই বসে আছে পৌষীর মা বাবা । হঠাৎ একদল মেয়ে পৌষীকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো । শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আছে পৌষী । সেজেছেও সে । ফাহাদদের সামনে এভাবে আসার কারণ কি তার মাথায় আসছেনা ।
পৌষী মায়ের কথামতো সবাইকে চা এর কাপ বাড়িয়ে দিলো ।
ফাহাদের ঠিক পাশে পৌষীকে বসানো হলো । অন্যান্য মেয়েরা তাদের দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে । ফাহাদের ভীষণ অস্বস্থি হচ্ছে । এমন সময় ফাহাদের বাবা বললেন-
ওদের কিছু সময় একা কথা বলতে দেয়া হোক ।
.
ফাহাদ বললো-
কাদের?
-তোকে আর পৌষীকে ।
-কিন্তু কেনো?
.
তার বাবা কিছু বলার আগেই অন্যান্য মেয়েরা এসে ফাহাদ ও পৌষীর হাত ধরে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে এলো তাদের ।
দুজনকে একা রেখে নিচে নেমে গেলো তারা ।
ফাহাদ অবাক হয়ে বললো-
আজ সবাই এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে কেনো?
.
পৌষীর দিকে তাকাতেই সে খেয়াল করলো, পৌষী কাঁপছে ।
ফাহাদ বললো-
এই মেয়ে, এভাবে কাঁপছো কেনো তুমি?
.
পৌষী লজ্জায় কোনো কথা বলতে পারছেনা । ফাহাদ তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
আমার কেনো যেনো মনেহচ্ছে তুমি লজ্জা পাচ্ছো?
.
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো পৌষী । ফাহাদ বললো-
কেনো! এই প্রথম আমাকে দেখছো তুমি? এমন ভাব করছো যেনো আমাদের প্রথম দেখা ।
.
এবার মুখে কথা ফুটলো পৌষীর-
এভাবে তো প্রথমই তাইনা?
-কিভাবে? ওহ শাড়ি পরে? শাড়ি পরতে কে বলেছে তোমাকে?
-আম্মা ।
-কেনো?
-আমার লজ্জা করছে বলতে ।
.
কথাটি বলে পৌষী দ্রুতবেগে নিচের দিকে চলে গেলো । ফাহাদ তার পথের দিকে তাকিয়ে বললো-
কি অদ্ভুত!
.
নিজের বাড়িতে এসেই মা বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো ফাহাদ-
আজ পৌষীদের বাসার সবাই এমন অদ্ভুত আচরণ কেনো করলো? ফুল দিয়ে বরণ করা, এতো খাবারের আয়োজন করা, বাসায় এতো মেহমান আর পৌষী..
.
ফাহাদের মা বললেন-
কি পৌষী?
-শাড়ি পরে ঘুরঘুর করা । এমন ভাব করেছে ওখানের সবাই, যেনো আমি তাদের মেয়ের জামাই!
-জামাই না তবে ভবিষ্যৎ জামাই ।
-মানে?
-পৌষীকে তোর ভালো লাগেনা? আমরা চাই তোদের বিয়ে হোক ।
.
কথাটি শুনে যেনো থমকে গেলো ফাহাদ । কি বলছে তার মা তাকে! তার মা এসে কাঁধে হাত রেখে বললেন-
কি হলো?
-তোমাদের মাথা ঠিক আছে? আমি এতো পড়াশোনা করলাম এই মেয়েকে বিয়ে করতে! কখনো না । আমি ওকে বিয়ে করতে পারবোনা ।
.
এই নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেলো ফাহাদ ও তার বাবার মাঝে । একপর্যায়ে ফাহাদ নিজের রুমে এসে ব্যাগ গোছানো শুরু করলো ।
তার মা এসে বললো-
ব্যাগ কেনো গোছাচ্ছিস? আমরা কি তোর সাথে কথাও বলতে পারবোনা?
.
জবাব না দিয়ে ফাহাদ তার কাজে ব্যস্ত । তার মা বিছানার উপরে বসতে বসতে বললেন-
আমি কিছু কথা বলবো তুই শুনবি । এর পরে কি সিদ্ধান্ত নিবি তোর ইচ্ছে । প্লিজ শুন?
.
মায়ের দিকে তাকিয়ে ফাহাদ বললো-
হুম বলো ।
-পৌষীর সৎ মা তার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে । তার সংসারে তিনি আর পৌষীকে রাখতে চান না । ভালো খারাপ না দেখেই কেউ প্রস্তাব পাঠালে রাজী হয়ে যাচ্ছে । মেয়েটার কি এসব প্রাপ্য বল? কতো সুন্দরী একটা মেয়ে । মাশাআল্লাহ কতো পটুও সে! শুধু পড়ালেখাটায় কম । বিয়ের পরে নাহয় পড়াবি ।
-পড়ালেখা ছেড়েছে তিন বা চার বছর হতে চললো । এখন পড়াবো! এই বয়সে ক্লাস এইটে ভর্তি করাবো ওকে?
-শিক্ষিত ছেলে হয়ে এসব বলিস কিভাবে! পড়াশোনার কি কোনো বয়স আছে? আমি আমার ঘরের বউ হিসেবে পৌষীকেই চাই ।
.
পেছন থেকে ফাহাদের বাবা বলে উঠলেন-
আমিও ।
.
এখানেই শেষ নয়! ফাহাদের মা শেষবারের মতো তার কথা শুনতে বললেও তিনি ছিলেন নাছোড়বান্দা! তারা একপ্রকার বাধ্য করে ফাহাদকে বিয়েটা করতে । জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটে আল্লাহ এর ইচ্ছেতে হয়ে থাকে, এমনটা শুনেছিলো সে । এখন চোখেও দেখে নিলো । তার সাথেই ঘটলো এই ঘটনা । কেনো, কিভাবে সে বিয়েতে রাজী হয়েছিলো এই সম্পর্কে সে নিজেই অবগত নয় । না চায়তেও তার সাথে পৌষীর বিয়েটা হয়েই গেলো!
.
-শুনছেন?
.
পৌষীর ডাকে ঘোর কাটলো ফাহাদের । দাঁড়িয়ে বললো সে-
হ্যাঁ বলো?
-বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে ।
-এই শীতে বৃষ্টি!
-আপনি খেয়াল করেননি?
-নাহ ।
-ওহ যেটা বলছিলাম, উষ্ণ আজ এখানে থাকবে ।
-কেনো?
-এই বৃষ্টির মাঝে কষ্ট করে বাড়িতে যাবার কি দরকার? আমাদের বেশ কয়েকটা রুম আছে ।
-হুম ।
-উনি ডিনার করেন নি । আমি রান্না করতে যাচ্ছি উনার জন্য ।
.
পৌষীর পিছু নিলো ফাহাদ ।
এদিকে উষ্ণ হেঁটে হেঁটে বাড়িটা ঘুরে দেখছে ।
তিশানীর রুমের কাছে আসতেই তার বুকটা ধুকধুক করে উঠলো ।
না চায়তেও পা বাড়ালো সে । ভেতরে আসতেই চোখ জোড়া ছলছলে হয়ে উঠলো তার । এই সেই রুম! যেখানে তিশানীর নিথর দেহটা পাওয়া গিয়েছিলো, সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায়!
.
.
পৌষী রান্না করছে । তার পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাহাদ । পৌষী তা খেয়াল করে বললো-
কিছু বলবেন?
-আমাকে তুমি করে বলোনা, তাকে কেনো বলো?
.
পৌষী কোনো ভণিতা না করে উত্তর দিলো-
সে আমার আপনজন তাই ।
-আমি নই?
-মেহমানের সামনে ঝামেলা করার ইচ্ছে আছে?
-আমি ঝামেলা করতে চাইছি?
-মনেহচ্ছে ।
-ঠিক আছে, তুমি উষ্ণের জন্য ভালোভালো রান্না করো । আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি ।
.
.
রাত তিনটে….
দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভাঙলো উষ্ণের । এতো রাতে বিকট শব্দে কে দরজা খুলেছে, তা দেখার জন্য উঠে পড়লো সে ।
ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখলো, পৌষী বেরিয়ে যাচ্ছে ।
উষ্ণ চেঁচিয়ে বললো-
এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো?
.
পৌষী থামলোনা । তার পিছু নিলো উষ্ণ ।
.
ছাদের রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে পৌষী । বৃষ্টি না থাকলেও চারদিকে বাতাস বইছে । সেই বাতাসে তার কোমর সমান লম্বা খোলা চুলগুলো উড়ছে । আর উদাসীনভাবে সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে ।
উষ্ণ এসে বললো-
পৌষী? এটা ছাদে আসার সময় নয় । নিচে চলো ।
.
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার । বেশ কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিলোনা সে ।
কিছুক্ষণ থেমে উষ্ণ বললো-
শুনছো তিশানী?
.
এপর্যায়ে তার দিকে ফিরে তাকালো পৌষী । সাথে সাথেই উষ্ণের বুকে উতালপাতাল শুরু হলো । তাহলে সে যা ভেবেছে তা ঠিক? পৌষীর মাঝেই আছে তিশানী!
.
এদিকে পৌষী ও উষ্ণকে এতোরাতে ছাদে দেখে ফাহাদ যেনো থমকে গেলো । বিড়বিড়িয়ে বললো সে-
এই মাসটি রহস্যময় পৌষমাস!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here