#মুগ্ধতায়_তুমি
#পর্বঃ১৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“আমি কানাডা চলে যাচ্ছি অনন্যা তোমাকে ভুলবো না তবে নতুন ভাবে বাঁচবো তোমার কথা মতো।”
মেসেজটা দেখে স্থির চোখে তাকিয়ে আছি মোবাইলে স্কিনের দিকে। সবেমাত্র গোসল করে রেডি হচ্ছিলাম ওনার সাথে দেখতে যাবো তাই। কিন্তু তার আগেই এমন একটা মেসেজ পাবো ভাবিনি। আমার জীবনটা কেমন যেন অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে ভরে যাচ্ছে। যা কখনো ভাবিনি সেই পরিস্থিতি গুলোর মুখোমুখিই বার বার হচ্ছি। অপ্রত্যাশিত কিছু মানুষ আসছে আবার নিজের ইচ্ছায় চলে যাচ্ছে না বলেই। কোনো কিছুতেই আমার নিয়ন্ত্রণ নেই এটাই হয়তো নিয়তি। আবার মোবাইলে মেসেজের টুং করে একটা শব্দ কানে ভেসে আসলো। ফোনের লক খুলে আবারও স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি স্কিনের দিকে।
“আহনাফের প্রেয়সীর জায়গায় তার মনে সব সময়ই আগের মতো থাকবে শুধু পাশে থাকবে না এতোটুকুই। তুমি আমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য কতো চেষ্টা করলে, চোখেরজল ফেলে প্রার্থনা করলে সেই জীবন আমি নষ্ট করি কি করে বলো!! হ্যাঁ আমি ভালো থাকবো আর তোমাদের বিয়েতে অবশ্যই আসবো। সত্যিই ভালোবাসি তোমায় প্রেয়সী।”
এই মানুষটাকে আমি কখনো বুঝতে পারলাম না। দোয়া করি তার জীবনে আমার থেকেও ভালো একজন আসুক। আবার নতুন করে যেন তাকে ভালোবাসতে শেখায়। হঠাৎ করেই শুভ্র ভাই রুমে এসে দরজা সামনে দাঁড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে বলছে-
—” অনন্য আর কতো সময় নিবি রেডি হতে! আহনাফদের বাসায় যেতে যেতে মনে হচ্ছে রাত করে ফেলবি তুই।”
আমি তার দিকে ফিরে ভাবলেশহীন ভাবে বললাম-
—”আমরা যাচ্ছি না আহনাফের বাসায়।”
শুভ্র ভাই রেগে উঠলেন আমার কথায় শক্ত গলায় বললেন-
—” যাবো না মানে কি!! আহনাফ অসুস্থ ওকে দেখতে যাবো না এটা কেমন কথা বললি অনন্য?? ”
আমি কিছু না বলে আমার ফোনটা শুভ্র ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলাম। শুভ্র ভাই ফোনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললেন-
—” উফফ কি শুরু করেছিস ফোন দিয়ে কি.. ”
আর কিছু বললেন না ফোনটা হাতে নিয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুটা সময় নিস্তব্ধ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন-
—”তোর খারাপ লাগছে না অনন্য?”
আমি বিছানায় বসে ওনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম-
—”খারাপ আর ভালো দুইটা লাগছে।”
আমার কথা শুনে শুভ্র ভাই খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে আবার বললাম-
—” প্রথমে খারাপ লেগেছে ওনার লেখা ডায়েরি টা পড়ে উনি অনেক কষ্ট পাচ্ছে আমার জন্য। তারপর আবার আমাকে বাচাতেই এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হলো। কিন্তু যখন উনি বললেন আমার কথা মতো নতুন করে জীবন শুরু করবে, ভালো থাকবে এটা শুনেই ভালো লাগছে। আহনাফ ওনার জীবনে এগিয়ে যাবে এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে শুভ্র ভাই!!”
শুভ্র ভাই কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে আছে হয়তো এমন কিছু আশা করেনি। আমি কথা পাল্টানোর জন্য স্বাভাবিক হয়ে বললাম-
—”আচ্ছা চলুন মিমশি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে ওকে তো এখনো বলা হয়নি আমার আহনাফের বাসায় যাবো না। আচ্ছা চলুন আমরা না হয় অন্য কোথাও ঘুরে আসি।”
শুভ্র ভাই ভ্রু কুচকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-
—”অন্য কোথাও মানে!!”
আমি বিছানা থেকে উঠে ব্যাগ হাতে নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম-
—”উফফ চলুন তো এখন। পরে না হয় ভেবে দেখবো কোথায় যাওয়া যায়।”
শুভ্র ভাইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি বেরিয়ে পরলাম। শুভ্র ভাই কোনো উপায় না পেয়ে আমার পিছু পিছু আসছে।
———————
মিমশি আর আমি ফুচকার জন্য অপেক্ষা করছি আর শুভ্র ভাই আমাদের সাথেই নাক মুখ কুচকে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এইসব রাস্তার খাবার তার কাছে আপত্তিকর কিছু। আমি মজা করে শুভ্র ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মিমশির কানে একটু জোরে জোরেই বললাম-
—” দেখ মিমশি বিদেশি বিড়ালটা কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে কোনো ভিনগ্রহে এসেছে।”
এই কথা বলেই আমি আর মিমশি হাসিতে ফেটে পরলাম। শুভ্র আমাকে কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-
—”বিদেশি বিড়াল মানে!! কি বলছিস তুই?”
শুভ্র ভাইয়ের এমন প্রশ্ন শুনে আমি আর মিমশি একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে আমি চোখ টিপ দিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললাম-
—” আরে ওখানে একটা সাদা বিদেশি বিড়াল কিভাবে যেন নাক মুখ কুচকে দাঁড়িয়ে ছিলো তাকেই বললাম।”
শুভ্র ভাই কিছুটা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি কিছুটা গম্ভীরমুখে বললাম-
—” জানেন শুভ্র ভাই বিড়ালটার না হাল্কা হাল্কা দাড়িও আছে। খুবই অসভ্য একটা বিড়াল সারাদিন শুধু মানুষদের বিনা কারনে ধমকায়। তাই নারে মিমশি?”
মিমশি সাথে সাথেই নিজের মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। শুভ্র ভাই এবার বেশ অবাক হয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-
—”বিড়াল মানুষদের ধমকায় কিভাবে?? আর বিড়ালদের দাঁড়ি থাকে?? আমি তো কখনো খেয়াল করিনি।”
শুভ্র ভাইয়ের এমন কথা শুনে আমরা নিজেদের হাসি আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না। আমরা দুজনেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলাম। আর শুভ্র ভাই আহাম্মকের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের হাসির কারন বুঝতে না পেরে বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে আমাদেরকে বললেন-
—”শুধু এভাবে পাগলের মতো হাসছিস কেন দুজন? হাসার তো কোন কারন দেখছি না আমি।”
আমি হাসি থামিয়ে বললাম-
—” কারন বলবো তবে একটা শর্ত আছে যদি আপনি রাজি থাকেন তাহলে বলে দিবো।”
—”কি শর্ত বল”
—”কঠিন কিছু না আমাদের সাথে ফুচকা খেতে হবে তাহলেই বলবো আমাদের হাসির কারন।”
শুভ্র ভাই বেশ কিছুক্ষন ভাবার পর রাজি হয়ে যায়। ফুচকা খাওয়ার সময় ওনার অবস্থা দেখে আমি আর মিমশি হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। আমি হাসতে হাসতেই শুভ্র ভাইকে বললাম-
—”এভাবে নাক মুখ কুচকে রাখার কি আছে শুভ্র ভাই! ”
শুভ্র ভাই বেশ বিরক্তি ভাব নিয়ে বললেন-
—”এসব রাস্তার ঝাল খাবার তুই খা….
কথা পুরোপুরি বলার মাঝেই হঠাৎ করে শুভ্র ভাই থেমে গেলেন কিছু একটা ভেবে মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে শক্ত গলায় বলে উঠলেন উনি-
—”বিড়ালটা বিনাকারণে শুধু ধমকায় তাই না অনন্য!! বিদেশি সাদা বিড়াল আবার দাঁড়িও আছে বাহহ!! আচ্ছা বিড়ালটা কি কামড়ায় না? খামছি দেয় না?? ”
শুভ্র ভাইয়ের কথা শুনে আমি আর মিমশি চুপ হয়ে গেলাম শুভ্র ভাই তাহলে বুঝে গেল! আমি ভয়ে একটা কিছুটা ইতস্ততভাবে বললাম-
—”আসলে ভাইয়া ওটা তো মিমশি আমাকে বলেছে।”
একথা বলার সাথে সাথেই পাশ থেকে মিমশি আমার কোমরে এক চিমটি দিলো আমি জোরপূর্বক হেসে মিমশির কাধে হাত দিয়ে ওর মাথাটা কাছে এনে কানে কানে ফিসফিস করে বললাম-
—”দোস্ত এবারের মতো বাচিয়ে দে। তুই তো জানিস শুভ্র ভাই আমাকে আস্ত গিলে খাবে বাসায় যাওয়ার পর।”
মিমশি কিছুক্ষন চুপ থেকে হুট করেই আমার হাত ধরে বললো-
—”অনু আজ তুই আমার বাসায় থাকবি আম্মু তোকে নিয়ে যেতে বলছে। তাড়াতাড়ি চল আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ভাইয়া আপনি বাসায় গিয়ে অনুর আম্মু কে বলে দিয়েন যেন চিন্তা না করে।”
একথা বলেই মিমশি আমার হাত ধরে হাটা শুরু করলো আর আমিও শুভ্র ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে কিছু না বলেই চলে গেলাম।
———————
রাত প্রায় ১১ টা মিমশির সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম তখনই ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্কিনে তাকিয়ে শুভ্র ভাইয়ের নাম দেখে আর রিসিভ করলাম না। পরপর ৩বার ফোন বেজে এখন শান্ত হয়ে গেছে। মিমশি আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভয়ার্ত চেহারা করে বললো-
—”অনু তুই যে ফোন রিসিভ করলি না এখন যদি ভাইয়া এখানে এসে এক থাপ্পড় দিয়ে তোর গাল লাল করে দেয় তখন কি করবি?”
মিমশি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এমন কথা বলছে বুঝতে পেরে ওর পিঠে এক থাপ্পড় মেরে বললাম-
—”এতো রাতে শুভ্র ভাই এখানে আসবে তা-ও আবার আমাকে থাপ্পড় দিতে??? তুই বললি আর আমি তোর কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম এতোটা বোকা এই অনন্যা না। ”
আমার কথায় মিমশি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমার ফোনে মেসেজের টুং করে একটা শব্দ হলো। আমি ফোন হাতে নিয়ে মেসেজটার দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার মিমশির দিকে তাকালাম। চোখ কোচলে স্থির চোখে ফোনের দিকে আবার তাকিয়ে দেখলাম নাহ সত্যি সত্যিই শুভ্র ভাই মেসেজ দিয়েছে। উনি ঠান্ডা মাথায় একটা হুমকিস্বরূপ মেসেজ লিখে পাঠিয়েছেন-
“দশ মিনিটের মধ্যে বাহিরে আসবি আর না হয় আমি ভিতরে এসে এখনই তোকে বাসায় নিয়ে যাবো।”
ফোনটা মিমশির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম-
—”তুই এমন কালমুখি হলি কিভাবে মিমশি!!”
মিমশি মেসেজটা পড়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে বললো-
—”আরে অনু চিল ভয় পাচ্ছিস কেন? ভাইয়া হয়তো কোনো কারনে এসেছেন তুই যা গিয়ে দেখ।”
আমি মিমশির দিকে সন্দেহর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম-
—”বাই এনি চান্স তুই কি শুভ্র ভাইয়ের সাথে মিলে আছিস?”
—”এতো বড় মিথ্যা অপবাদ দিস না দোস্ত। এই দেখ তোর মাথা ছুয়ে বলছি আমি তো এমনিতেও বলেছিলাম তোকে ভয় দেখানোর জন্য। আমার দুষ্টামি করে বলা কথা সত্যি হয়ে যাবে আমি কি জানতাম নাকি। আমি তো তোকে বাচানোর জন্যই আমার বাসায় নিয়ে এসেছিলাম।”
মিমশির হাত আমার মাথা থেকে সরিয়ে আমি মুখ গোমড়া করে বললাম-
—”তা না হয় বুঝলাম কিন্তু এখন কি করবো সেটা বল।”
মিমশির কিছু বলার আগেই আবার মেসেজের শব্দ কানে ভেসে আসলো। আমরা দুজনই তাকিয়ে দেখলাম –
“পাঁচ মিনিট বাকি অনন্য জলদি আয়।”
মেসেজ দেখে আমরা একে অপরের তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষন পর ঠিক করলাম বাহিরে যাবো। কারন এই অসভ্য লোকটার কোনো ভরসা নেই এতো রাতেই আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে পারে। অবশেষে বুকে সাহস জুগিয়ে গেইটের বাহিরে পা রাখলাম। আশেপাশে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পেলাম না। জনমানবহীন রাস্তায় কেমন যেন নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে পরিবেশ। শুভ্র ভাইকে না দেখে ভয়ে ভিতরে পা বাড়াবো তখনই পেছন থেকে কেউ হাতে হেচকা টান দিয়ে আমার মাথার পিছনের চুল গুলো খামচে ধরলো। আচমকা এমন হওয়ায় ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললাম। পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম শুভ্র ভাই তাকিয়ে আছে এখনও আমার চুল শক্ত করে ধরে আছে। ওনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি এই মুহূর্তে প্রচন্ডভাবে রেগে আছে। কিন্তু রাগের কারন কি!!
শুভ্র ভাই আমার চুল আরও শক্ত করে ধরে রাগী কন্ঠে বললেন-
—”তিন মিনিট দেরি করে এসেছিস এখন বল তোকে কি শাস্তি দেওয়া যায়?”
চলবে…
(গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষা রইলাম। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️)