#মুহূর্তে
পর্ব-২৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“মৃণা, ঢাকা আসলে আমার সাথে দেখা করো। গতরাতের ব্যাপারে কিছু কথা ক্লিয়ার করা দরকার।
~তীর্থ”
মৃণা মেসেজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। এক মুহূর্তে তার সকল পপরিকল্পনা কীভাবে পানিতে মিশে যেতে পারে? কী কত স্বপ্ন সাজিয়েছিলো, তীর্থকে নিয়ে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কল্পনা করে নিয়েছিলো সে। আর এক মুহূর্তেই কীভাবে তার সকল স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকায় মৃণা। আজ তার মন ভালো নেই। ভীষণ উদাসীন তার মন। আজ সকাল থেকেই তার কিছু ভালো লাগছে না। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা তার ভাগ্য তার সাথে না করলেই পারতো। তার মন ভালো করার উদ্দেশ্যে সে একা এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। অসম্ভব সুন্দর আকাশ। হাত বাড়ালেই যেন মেঘ তার কোমল হাতে এসে ছুঁয়ে যাবে, আকাশ এতটা কাছে মনে হচ্ছিলো মৃণার। আঁধারের রাজ্যটা ভালোই লাগছে তার। হঠাৎ-ই তার ফোন বেজে উঠে। আইদ কল দিচ্ছে তাকে। আইদ মৃণার বাগদত্তা। লোকটাকে কেন যেন মৃণার দুইচোখে সহ্য হয় না। সে মৃণার মা’য়ের বান্ধবীর ছেলে। এই সুবাদে তাকে ছোট থেকেই চিনে মৃণা। লোকটা বোকাসোকা ধরনের, দেখতেও আহামরি না এবং পোশাক পরনের ধরন দেখতেই তো মৃণার শরীর জ্বলে।
এককালে বান্ধবীদের সাথে তার চেহেরা, স্টাইল, বোকামি নিয়ে মজা নিতো সে। আর আজ তার সাথেই বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে মৃণার মা বাবা। এই নিয়ে ঘরে অনেক ঝগড়াও গেছে। মৃণার মা-বাবা তার সকল কথায় একবারে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু এই বিয়ের ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত অটল। তাদের মতে আইদের মতো ছেলে কোটিতে একটাও পাওয়া যাবে। তার সাথে বিয়ে করা হবে মৃণার ভাগ্য। কিন্তু মৃণার তো এমন ভাগ্যের ইচ্ছাই নেই যেখানে সে তার স্বামীকে অন্যদের সাথে পরিচয় করাতেও লজ্জা পাবে। এই লোকটার জন্য সে তার পুরনো সকল বন্ধুদের ছেড়ে নতুন ভার্সিটি ভর্তি হয়েছে। মৃণা মাঝেমধ্যে বুঝতে পারে না তার মা-বাবা আইদের সাথে বিয়ে দেবার জন্য এমন পাগল কেন হয়েছ? এমনও না যে আহমরি ধন-সম্পদ আছে। সাধারণ একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে সে। ব্যাস, এতটুকুই!
মৃণার এমন জীবন বাঁচার ইচ্ছা নেই। বাবার বাড়িতে সে নিজের অনেক ইচ্ছা ত্যাগ করেছে, স্বামীর বাড়িতেও সে একই জীবন বাঁচতে চায় না সে।
বারবার ফোন বাজতে থাকায় শেষমেশ ফোন উঠিয়েই নেয় মৃণা। বিরক্তির স্বরে বলে, “এত রাতে কল দিচ্ছেন কেন?”
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে? তোমার কথা অনেক মনে পড়ছিলো তাই কল দিলাম। তুমি কী রাগ করেছ?”
“উঁহু, বলেন।”
“কেমন মজা করছ বান্ধবীর বাড়িতে?”
“ভালো।”
“রাতে খেয়েছ?”
“হুম।”
ওপাশ থেকে আর কোনো প্রশ্ন আসে না। মৃণাও আগ বাড়িয়ে কোন প্রশ্ন করে না। আইদ আবারও বলে, “শুনো, আগামীকাল আংকেলকে একটা কল দিও। আজ তার শরীর খারাপ ছিলো। এখন অবশ্য ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“কী হয়েছে বাবার?” আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করে মৃণা।
“প্রেশার খুবই লো হয়ে গিয়েছিলো। অফিসে ছিলাম, আন্টির কল পেয়ে যেয়ে দেখি আংকেলের অবস্থা খারাও। তারপর তাকে হাস্পাতালে নিয়ে গেলাম। আংকেল এখন সুস্থ আছে। তুমি নেই দেখে আজ তোমার বাসাতেই থেকে গেলাম। রাতে কোনো সমস্যা হলে যেন থাকতে পারি।”
মৃণা বুকে হাত দিকে গভীর নিশ্বাস ফেলে, “যাক, বাবা ঠিক আছে।”
“মৃণা অফিসের একটা কাজের জন্য নাম্বার লিখতে হতো। তাই।তোমার ডায়েরিতে লিখেছিলাম। এইখানে কিছু কবিতা লেখা দেখলাম। শেষ কয়েকটা প্রেমের ছন্দ। কাওকে চিন্তা করে লিখেছিলে তুমি?”
মৃণার বুকের ভিতর চিনচিন ব্যাথা শুরু হল। ছন্দগুলো তীর্থের জন্য লিখা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “না।”
“ওহ আচ্ছা, ভেবেছিলাম আমার জন্য লিখেছ। আচ্ছা শুনো, আগামী সাপ্তাহে আমার একটা কলিগের বিয়ে। আমার সিনিয়র হয়। তুমি আমার সাথে আসবে প্লিজ। ওহ তোমার জন্য আমি একটা শাড়িও কিনেছি, দাঁড়াও ছবি দিচ্ছি।”
আইদ হোয়াটসঅ্যাপে মৃণাকে ছবি দিয়ে বলে, “জানো এই শুক্রবারে সারাদিন খুঁজে তোমার জন্য এই শাড়িটা বাছাই করেছি। আমি জীবনে প্রথমবার এতক্ষণ ধরে কারও জন্য শপিং করলাম। ভালো লেগেছে তোমার?”
মৃণা শাড়ির ছবিটা দেখে মুখ বানাল। সে ফোনে বলল, “সুন্দর আছে কিন্তু আপনার সিনিয়রের বিয়ে হলে তো বড় অনুষ্ঠান হবে। এইখানে আমি এই শাড়ি পরে গেলে আমাকে সবাই কী ভাববে? আমি যদি যাই আমার বান্ধবীর শাড়ি ধার নিয়ে পরে যাব। আর এখন আমার ঘুম পাচ্ছে আমি রাখলাম।”
আইদের কোনো কথাও শুনে না মৃণা। ফোন কেটে দেয়।
মৃণা চোখমুখ কুঁচকে আবার সে ছবিটার দিকে তাকায়। তারপর ভাবে, সে এমনভাবে তার জীবন কাটাতে পারবে না। কোনো চেষ্টা না করে সে তার জীবন এমন নষ্ট হতে দিতে পারে না।
.
.
পরেরদিন ঢাকা আসে ধ্রুবরা ট্রিপ থেকে। একদিন পরেই মৃণা তৈরি হয়ে আসে তীর্থের কাছে। একটি সাদা ড্রেস পরেছে সে। খুব সুন্দর করে সেজে এসেছে আজ। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে না নিজের ইচ্ছার বিসর্জন দিবে, আর না নিজের ভালোবাসার। না চেষ্টা করে কীভাবে ছেড়ে দেয় সে তীর্থকে।
তীর্থের কেবিনের সামনে এসে দরজায় নক দেয় মৃণা, “মে আই কাম ইন?”
“কাম ইন।” তীর্থের কথা শুনে ভেতরে ঢুকে মৃণা। তীর্থ চেয়ারে বসে কাজ করছিলো। সে মুখ তুলে মৃণাকে দেখে প্রথম মুহূর্তে চমকে উঠে, পরের মুহূর্তে ঘাবড়ে যায় সে। তবুও নিজেকে সামনে বলে, “আসো, ভিতরে আসো।”
মৃণা একটুখানি দ্বিধা নিয়ে এসে তীর্থের সামনের চেয়ারে বসে। জিজ্ঞেস করে, “আপনি ডেকেছিলেন?”
“ও…ওদিনের কথা বাকি রয়ে গিয়েছিলো। আমি সে মুহূর্তে বুঝতে পারছিলাম না কি করব। সরি এভাবে এসে পড়েছি।”
মাথা নাড়ায় মৃণা, “অসুবিধা নেই।”
“আমার সোজাসুজি কথা বলা পছন্দ। তাই সরাসরিই জিজ্ঞেস করছি, ওদিন তুমি বলেছিলে নেশার ঘোরে আমি তোমার সাথে জোর জবরদস্তি করি নি, তাহলে তুমি ওদিন এমন প্রতিক্রিয়া দেখালে কেন?”
“আসলে ওদিন…. এমন কথা কীভাবে বলব? ওদিন…” মৃণা আমতা-আমতা করে তার মনের কথাগুলো বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু চেয়েও বলতে পারছিলো না কিছু। তার মুখে অস্বস্তি স্পষ্ট ভাসছিলো। তবুও যখন সে বলতে নিলো তখনই দরজা খোলার শব্দে চুপ হয়ে যায়। ঘুরে তাকায় দরজার দিকে। দরজায় দাঁড়ানো একটি সাদা রঙের শাড়ি পরা মেয়ে। চুলগুলো খোলা, চোখে কালো রঙের কাজল এবং ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি রঙের লিপ্সটিক। হাতে পরা কয়েকটা কাঁচের চুড়ি। আর হাতে একটি টিফিনবাক্স। মৃণার মনে প্রশ্ন উঠে, তীর্থের কেবিনে কোনো মেয়ে এভাবে সেজে আসলো কেন? আর এভাবে নক না করে কেউ রুমে ঢুকে? মেয়েটি এই অফিসেও কাজ করে না। এর আগে সে মেয়েটিকে দেখে নি।
মেয়েটি মৃণাকে দেখে বলে, “ওহ কাজ চলছে? সরি সরি। আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।”
তীর্থ উঠে দাঁড়ায় মেয়েটিকে দেখে। মৃণা খেয়াল করে তীর্থের মুখের রং উড়ে গেছে মেয়েটিকে দেখে। তবুও সে জোর করে হেসে বলে, “না, কাজ চলছে না। তুমি ভেতরে আসো।”
মেয়েটি ভেতরে এলো। একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “দুপুরের খাবার এনেছিলাম।” তারপর মৃণার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ওকে চিনলাম না।”
তীর্থকে শঙ্কিত দেখায়। সে উঠে মেয়েটির কাছে যেয়ে বলে, “তোমাকে বলেছিলাম না দুইজন স্টুডেন্ট তাদের এসাইনমেন্টের জন্য যে আমাদের বিজনেস সম্পর্কে লিখতে চায় তার মধ্যে একজন ও।”
মেয়েটি চোখদুটো বড় বড় করে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় মৃণার দিকে, “তুমি তীর্থের সাফল্য নিয়ে লিখছ? সমস্যা না হলে আমাকে দেখাবে।”
মৃণা অবাক হয়। এতক্ষণেও সে জানতে পারে না মেয়েটি কে? সে জোর করে হাসার চেষ্টা করে, “এখনো লিখি নি।”
তীর্থ বলে, “ঐ’যে কবিতা, আমি ব্যস্ত ছিলাম তাই সময় দিতে পারি নি। এইজন্য লেখা হয় নি।”
কবিতা তীর্থের বাহু ধরে হেসে মৃণাকে বলে, “ও আপনাকে ঘুরালে মাইন্ডে নিবেন না। কাজ তার প্রথম প্রেমিকা বুঝলেন? আমার তো মাঝেমধ্যে তার এই বিজনেসকে সতীন মনে হয়।” বলে মিটিমিটি হাসে কবিতা।
মৃণা এখন বুঝে মেয়েটি তীর্থের স্ত্রী, কবিতা। সে কিভাবে তো ধরতে পারল না এভাবেই অবাক লাগছে। ধ্রুব স্পষ্ট বলেছিল কবিতা কিছুটা দেখতে তার মতো। অনেকখানি নয়, কিন্তু কিছুটা দেখতে আসলেই মিল আছে। মৃণার দৃষ্টি আটকে রইল কবিতা যে তীর্থের হাত ধরে রেখেছিলো সেদিকে। এই মেয়েটাকে তার প্রথম দর্শনেই অপছন্দ হলো। এতটা অপছন্দ সে কাওকে করেছে বলে সন্দেহ।
তীর্থ মৃণাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তুমি একটু বাহিরে যেয়ে বসতে পারবে? আমি কিছুক্ষণ পর তোমাকে ডাকছি।”
মৃণা অপমানিতবোধ করে। কিন্তু কিছু বলে না। মাথা নিচু করে উঠে চলে যায়। সে যাওয়ার পর কবিতার জিজ্ঞেস করে, “ও কী মনে করবে, এভাবে বের করে দিলে যে?”
“তুমি এসেছ এ-কারণে। আজ হঠাৎ করে?”
“সাহেব আপনি সে ঝগড়ার পর থেকে মুখ ফুলিয়ে আছেন, এখন কোনোভাবে তো আপনার মুড ভালো করতে হবে। আজ অনুর অফিস ছিলো না তাই কুহুকে ওর কাছে রেখে এসেছি। আপনার মুড এখন ভালো?”
তীর্থ হাসে, “ভালো।”
“আসো খাবার দেই। বেশিক্ষণ থাকতেও পারব না। কাব্যের স্কুল ছুটি হয়ে যাবে।”
তীর্থ যেয়ে বসে চেয়ারে। কবিতা টিফিনবাটি খোলার সময় হঠাৎ করেই তীর্থ প্রশ্ন করে, “তুমি কী আমাদের এই বিয়েতে খুশি না?”
থেমে যায় কবিতা। পিছনে ফিরে একবার তাকায় তীর্থের দিকে। সে যেয়ে বসে পড়ে তার কোলে। আর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “হঠাৎ এই কথা কেন বলছ?”
তীর্থ কোমর জড়িয়ে ধরে কবিতার। তার গলায় মুখ ডুবিয়ে বলে, “সেদিন তোমার কি আমাদের বিয়ে নিয়ে আফসোস হচ্ছিলো?”
“তুমি কী আমাকে ভালোবাসো তীর্থ?” প্রশ্নের পিঠে এমন পালটা প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে তীর্থ। বিস্মিত কন্ঠে বলে, “এ কেমন প্রশ্ন? তুমি জানো আমি মনেপ্রাণে তোমাকে ভালোবাসি?”
“আগের মতো করে ভালোবাসো?”
“একদম।”
“উঁহু, মিথ্যা কথা। তুমি আগের মতো আমায় ভালোবাসতে পারো না। কারণ তুমি আগের মতো নেই, আমি আগের মতো নেই, আমাদের জীবন আগের মতো আর নেই। আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগের মতো কয়েকঘন্টার মুঠোফোনের আলাপ এবং দু’একঘন্টা দেখা পর্যন্তই তা সীমাবদ্ধ নেই। দুইজন এখন এত বছর ধরে একসাথে তাই ভালোবাসায় সে নতুনত্বটাও নেই। গত পাঁচ বছর ধরে আমরা প্রতিদিন একে অপরকে দেখি, কথা বলি, ভালোবাসি। আমাদের ভালোবাসার মধ্যে এখন কেবল আমরা দুইজন নেই, অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যুক্ত হয়েছে। তোমার মা এবং আমাদের বাচ্চারা। তারা আমাদের কাছে আমাদের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বয়সের সাথে সাথে আমাদের বুঝ, মন, মেজাজ সব পরিবর্তন হচ্ছে। তাই সমস্যা হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার এভাবে সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার পছন্দ না। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। আগের থেকে অনেক বেশি ভালোবাসো। কিন্তু আমি চাই তুমি আমার সম্মানও একইভাবে রক্ষা করো।আমি বলছি না তুমি তোমার মায়ের সাথে ঝগড়া করো, তোমার মা’য়ের সাথে বেয়াদবি করলে তা আমারও সহ্য হবে না।কিন্তু উনাকে বুঝাতে তো পারো। তোমার নিজের মা’য়ের প্রতি যেমন ভালোবাসা আছে, তেমন আমারও আছে। এই’যে তুমি আমার কথা শুনছ?”
তীর্থ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কবিতার নয়নের দিকে। কবিতার কথায় তার ঘোর ভাঙে, “তুমি কী শুনছ?”
তীর্থ কবিতার গালে হাত বুলিয়ে বলে, “তোমায় শাড়িতে এত সুন্দর লাগে কেন? ইচ্ছে করে সে দৃষ্টিতে ঢুবে যাই।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতা, “এতক্ষণ ধরে যা বুঝালাম সবই বৃথা, তাইতো?”
“শাড়িটা বিয়ের পর প্রথম উপহার দিয়েছিলাম তোমায় তাই না?”
“তোমার মনে আছে?”
“থাকবেই তো। অসম্ভব মানায় তোমাকে।”
তীর্থের কবিতার উন্মুক্ত পেটে হাত রাখতেই কেঁপে উঠে কবিতা। তীর্থ তাকে নিজের কাছে টেনে আনতেই কবিতা কুঁকড়ে যায়। তীর্থের উষ্ণ নিশ্বাসের ছোঁয়ায় সে লজ্জার রঙে ডুবে যায়। চোখ নামিয়ে বলে, “কেউ এসে পড়লে?”
“আমার অনুমতি ছাড়া কেউ আসবে না?”
এমন সময়ই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে মৃণা। দুইজনকে এভাবে একসাথে দেখতেই তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। মুহূর্তে তার মেজাজও বিগড়ে যায়। তবুও সে জানে এই সময় সে কিছু বলার অবস্থাতে নেই। তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
দরজা খোলার শব্দতেই চমকে উঠে কবিতা ও তীর্থ। সাথে সাথে কবিতা উঠে পড়ে তীর্থের কোলের থেকে। কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়। এমনটা হওয়ায় লজ্জায় পড়ে যায় সে। তীর্থ কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, “দরজায় নক করে আসা যায় না? তুমি কী জানো না কারও রুমে আসার সময় নক করতে হয়।”
“স…সরি… ভুলে ফোন রেখে গিয়েছিলাম।”
কবিতা বলে, “বকা দিও না তো মেয়েটাকে। ভুলে করে ফেলেছে।” আবার সে মৃণাকে বলে,” তুমি ফোন নিয়ে যাও।”
মৃণা ফোন নিয়ে যাওয়ার পর তীর্থ আবারও বলল, “আজব তো। নক তো করে আসবে।”
“বাদ দেও তো। আসো আজ আমি তোমাকে খাইয়ে দেই।”
তীর্থ কবিতার হাত ধরে বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল, “আর আমাদের রোমেন্স?”
“এই ঘটনার পর এইখানে তো ভুলেও না। রাতে আইস্ক্রিম নিয়ে আসলে রোমেন্স করতে দিব।”
“ঘুষ নিয়ে রোমেন্স করবা?”
“তো কি? তোমার বাচ্চাদের পিছনে দৌড়ে তাদের খাইয়ে ঘুম পরাতে হয়। কত কষ্ট জানো?”
“তখনও শাড়ি পরে থাকবে?”
“তাহলে আইস্ক্রিমের সাথে চকোলেটও লাগবে কিন্তু। এখন জলদি করে এসে খেয়ে নেও।”
কবিতার যেতে যেতে আরও পঁচিশ মিনিট লাগলো। কিন্তু মৃণা বসে রইলো রিসিপশনে। কবিতাকে যেতে দেখেই সে দৌড়ে আসে তীর্থের রুমে। এইবার দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকে। তীর্থ মৃণাকে দেখে কঠিন মুখ করে রাখে। নিশ্চয়ই একটু আগের ঘটনায় তীর্থের মেজাজ খারাপ। সে বলে, “কারও কেবিনে নক করে ঢোকা উচিত। এটা ভদ্রতা।”
মৃণা মাথা তুলে তাকায় না তীর্থের দিকে। বলে, “ওই’যে উনি বলে আসে নি। তাই আমিও ভেবেছিলাম….”
“ও আমার স্ত্রী। পিওন ওকে বলেছে যে আমি বিজনেস মিটিং এ নেই তাই ও এসেছে। তুমি জানতে যে কবিতা এসেছে তাও এভাবে আসলে। এটা কী ঠিক? তুমি আর কবিতা তো এক না।”
মৃণা মুখ লটকিয়ে রাখে। তারপর হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে। চমকে যায় তীর্থ, “তুমি কাঁদছ কেন?”
মৃণা কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, “আপনি আমার সাথে এমন করলেন কেন? কেন করলেন এমনটা? আমাকে কেন মিথ্যা বলা হলো যে কবিতা আপনার প্রাক্তন? আপনি বিবাহিন কেন জানালেন না আমায়? আপনি অন্য কাওকে ভালোবাসলে সে রাতে কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করলেন?”
বুকের ভেতর ধক করে উঠে তীর্থের। ভয়ে তার যেন হৃদসম্পনও বন্ধ হয়ে গেছে। সে ভয়ে ভয়ে বলে, “তুমি বলেছিলে আমি সে রাতে তোমার সাথে কোনো জোর জবরদস্তি করি নি।”
“কারণ আমি সব আপনাকে ভালোবেসে করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আপনিও আমাকে ভালোবাসেন তাই….” দুইহাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে মৃণা।
তীর্থ মেঝের দিকে তাকাল। একটু আগের কবিতার মুখটা ভেসে উঠে তার চোখের সামনে। কবিতা এই ব্যাপারে কিছু জানলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তার সংসারে ভারী প্রভাব পড়বে। না, সে কোনো মতে কবিতাকে হারাতে পারে না। কোনো ভাবেই না। কবিতাকে ছাড়া বাঁচবে কীভাবে সে? কবিতাকে সহ হাজারো অশান্তিতে সে থাকতে রাজি কিন্তু কবিতাকে ছাড়া বাঁচার কথা সে সহ্যও করতে পারে না। কবিতা তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
তীর্থ অনেক সময় চুপ রইলো। সে তাকায় মৃণার দিকে। সে কেঁদেই যাচ্ছে। তার প্রতিও একটুখানি মায়া হলো তীর্থের। তারপর জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমাকে ভালোবাসি এই ধারণা কীভাবে হলো তোমার? আমি কখনো এমন কোনো ইশারা দেই নি তোমাকে। আর তুমি-ই বা আমাকে কীভাবে ভালোবাসতে পারো? আমাদের দেখা হবার সবে পনেরোদিন হয়েছে। এমনও না যে আমি তোমার সাথে কথা বলেছি যে, আমার কথা তোমার ভালো লেগেছে অথবা আমাদের মাঝে বিশেষ কোনো ঘটনাও ঘটে নি। তাহলে কীভাবে?”
“আপনাকে প্রথম দিন থেকেই আকর্ষণীয় লেগেছিলো আমার। এরপর ধ্রুব ভাইয়া আমাকে বলেছিলো যে আপনি কবিতাকে ভালোবাসতেন কিন্তু সে আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে থেকে মায়া হয় আপনার প্রতি। আপনার কবিতার প্রতি ভালোবাসার কথা শুনে আপনার প্রতি সে মায়াটা বাড়ে। মায়াটা কখন ভালোবাসায় পরিবর্তন হলো আমি নিজেও বুঝতে পারি নি।”
“তাই বলে এক অচেনা মানুষের সাথে রাত কাটাবে তুমি। আমি তো হুঁশে ছিলাম না কিন্তু তুমি বুঝে শুনে এমনটা কীভাবে করতে পারো?”
“আমি তো জানতাম না আপনি নেশায় ছিলেন। আপনি আমাকে যে ভালোবাসার কথাগুলো বলেছিলেন তা শুনে আমি ভেবেছি….” আবারও শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে মৃণা। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, “এখন আমার কী হবে? আমার মা বাবাকে কি উওর দিব আমি?”
তীর্থও মাথায় হাত রেখে দেয়। সে নিজেও বুঝতে পারছে না কি হবে! মৃণার প্রতি তার যতটা রাগ উঠছে ততটা মায়াও লাগছে। তীর্থ যতই বাহানা দিক ভুল তারও হয়েছে। হঠাৎ তার মাথায় এলো ধ্রুবর কথা। সে চমকে তাকায় মৃণার দিকে, “ধ্রুব তোমাকে বলেছে কবিতা আমার প্রাক্তন?”
“হ্যাঁ, এই কারণেই তো আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম আমি। উনি…উনি আমাকে বলে আপনার সংসারে শান্তি নেই তাই আমাকে দিয়ে আপনার মন ভোলাতে চেয়েছে। আমি কোনো জিনিস যে আমাকে এভাবে ব্যবহার করেছে উনি? এখন আমার জীবন নষ্ট করে দিলো উনি।”
মৃণার কান্না আরও বাড়ে।
তীর্থ উঠে দাঁড়িয়েই টেবিলে মুঠো হাতে ঘুষি মারে। রাগে তার শরীর জ্বলছে। সে এক মুহূর্তেও দাঁড়িয়ে রইল না সেখানে। একরাশ ক্রোধ নিয়ে করতে বেরিয়ে গেল।
তীর্থ যাওয়ার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছে মৃণা। চেয়ারে যেয়ে আরামে বসে ব্যাগ থেকে পানি বের করে পান করে একটু।
.
.
“I know that dress is karma, perfume regret
You got me thinking ’bout when you were mine, oh…
And now I’m all up on ya, what you expect?
But you’re not coming home with me tonight
You just want attention, you don’t want my heart
Maybe you just hate the thought of me with someone new….”
গান শুনতে শুনতে আজ নিজের হাতে বিশেষ খাবার বানাচ্ছিলো ধ্রুব। ফ্রাইড রাইস এবং চিংড়ি মাছের গ্রেভি। দুইটা তাহিরার পছন্দের খাবার। তার জন্য কেকও আনিয়ে রেখেছে ধ্রুব। আজ কয়েকদিন পর দেখা হবে তার তাহিরার সাথে। বিশেষ কিছু না করলে হয়?
কলিংবেল বাজতেই সে গান বন্ধ করে উৎসুক হয়ে যায় দরজা খুলতে। সে ভেবেছিল তাহিরাকে দেখতেই জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু দরজা খুলে সে দেখতে পায় তীর্থকে। মনটাই খারাপ হয়ে গেল তার, “ওহ তুই? কই ভেবেছিলাম আমার তাহিরা আসবে আর এইখানে তুই…..”
ধ্রুব সম্পন্ন কথা শেষও করতে পাড়ল না, এর পূর্বেই তীর্থ তার শার্টের কলার চেপে তাকে টেনে বাসার ভেতরে নিয়ে মারতে শুরু করে।
ধ্রুব হতবাক। হঠাৎ কি হল সে বুঝতে পারল না। তীর্থের দৃষ্টি রক্তিম। সে দৃষ্টি দেখেই ভয় পেয়ে যায় ধ্রুব। সে তীর্থকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করে, “কী হয়েছে বলবি তো?”
তীর্থ থামে না। সে মারতেই থাকে ধ্রুবকে। ক্ষোভে মারতে মারতে কাঁচে হাত লেগে ধ্রুবর হাতও কেটে যায়। তীর্থ জঘন্য একটি গালি দিয়ে বলে, ” তুই কী বলেছিল কী বলেছিলি মৃণাকে হ্যাঁ? কবিতা আমার প্রাক্তন? আমি আমার সংসারে খুশি থাকি না’কি অখুশি এতে তোর কি শালা?”
“আমি যাস্ট তোকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।”
“সাহায্য? কীভাবে? আমার সংসার ভেঙে?”
“আজব সংসার ভাঙ্গবে কেন? কবিতা তো সারাদিন বাসায় ব্যস্ত থাকে, ও কীভাবে জানবে তুই কোথায় কি করছিস? আমি যাস্ট তোর মন অন্যকোথাও লাগাতে চেয়েছি। তোকে এভাবে মন মরা হয়ে বসে থাকতে দেখে আমার ভালো লাগে?”
এই কথা শুনে আরও জোরে মারতে থাকলো তাকে তীর্থ। ধ্রুবও এইবার থামে না। সেও নিজেকে রক্ষা করার জন্য তীর্থকে ক’টা মারে।
এমন সময় তাহিরার কন্ঠ শোনা যায় দরজা থেকে, “ধ্রুব দরজা খোলা কেন?”
তাহিরার কণ্ঠ শুনেই বুক কেঁপে উঠলো ধ্রুবর।
তীর্থ ধ্রুবকে ছেড়ে বলে, “দাঁড়া আমি এখনই তোর কাণ্ডকারখানা সবকিছু তাহিরাকে বলছি। তুই যে ওর ওয়াদা ভেঙে রূপার সাথে এত সুন্দরভাবে কথা বলছিলি তাও বলব। তার সাথে ঘুরছিলি তাও বলব। তারপর দেখব নিজের সম্পর্ক কীভাবে বাঁচাতে পারিস তুই।”
#মুহূর্তে
পর্ব-২৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
তাহিরার কণ্ঠ শুনেই বুক কেঁপে উঠলো ধ্রুবর।
তীর্থ ধ্রুবকে ছেড়ে বলে, “দাঁড়া আমি এখনই তোর কাণ্ডকারখানা সবকিছু তাহিরাকে বলছি। তুই যে ওর ওয়াদা ভেঙে রূপার সাথে এত সুন্দরভাবে কথা বলছিলি তাও বলব। তার সাথে ঘুরছিলি তাও বলব। তারপর দেখব নিজের সম্পর্ক কীভাবে বাঁচাতে পারিস তুই।”
ধ্রুব তীর্থের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়, “তুই আমার বন্ধু হয়ে এমনটা বলতে পারিস না।”
“আর তুই আমার বন্ধু হয়ে আমার সংসার ভাঙতে গিয়েছিলি তার কি?”
“আমি যাস্ট তোকে…..” ধ্রুব কথাটা বলতে যেয়েও থেমে গেল। বিরক্ত নিয়ে তাকাল তীর্থের দিকে। তাহিরার দূরত্ব তাদের থেকে বেশি, এমন সময় সে তীর্থকে বুঝাতে বসতে পারে না। তাই সে বলল, “তুই যদি তাহিরাকে কিছু বলিস তাহলে আমিও কবিতাকে জানিয়ে দিব যে মৃণা একরাত তোর রুমে কাটিয়েছে।”
কথাটা শুনে যেন আকাশ ভেঙে পড়ে তীর্থের মাথায়। ধ্রুব এই কথা জানলো কীভাবে?
ধ্রুব আবারও বলল, “রূপা আমাকে বলেছে মৃণা এবং তুই তোর রুমে ঢুকেছিস। সেরাতে মৃণা আর নিজের রুমে ফিরে নি। আমিও তো সাহস করে এমন কিছু করতে পারলাম না। আর তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস? আমি তাহিরাকে বুঝাতে পারব যে রুপা আমার বন্ধুর মতো। তাই কথা বলি। তোর কান্ডের পর তুই কী বলবি?”
তীর্থ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় ধ্রুবর দিকে, “সেদিন তুই আমাকে জোর করে আরও বিয়ার খাইয়েছিলি তাই আমার হুঁশ ছিলো না।”
“এই কথা কবিতা বিশ্বাস করবে?” ধ্রুব তাচ্ছিল্য হাসে।
এতক্ষণে তাহিরা রুমে এসে বলে, “তোমরা দুইজন কী কুস্তি খেলছ না’কি? ঘরে এই অবস্থা কেন?”
ধ্রুব তীর্থকে ছেড়ে তাহিরার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়, “আরে জান কোম্পানির বড় প্রজেক্টে একটা ভুল করে ফেলেছিলাম তাই তীর্থ চেতে গিয়েছিলো। তাই না তীর্থ?”
তীর্থ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে কি বলবে প্রথমে বুঝতে পারে না। কিন্তু সে ভুলেও কবিতাকে এই ব্যাপারটা জানতে দিতে পারে না তাই সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় ধ্রুবর কথায়।
তাহিরা মাথা নাড়িয়ে বলে, “দুইটাই পাগল। তোমরা বসো, আমি ঘরটা পরিষ্কার করে নেই।”
“না, তীর্থ এখন চলে যাচ্ছে। ওর কাজ আছে। এগিয়ে দিয়ে আসি। তারপর তোর সাথে টাইম স্পেন্ড করব।”
ধ্রুব তীর্থের কাঁধে হাত রেখে তাকে বাহিরে নিয়ে আসে। বাহিরে নিয়ে আসতেই তার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। তারপর ক্রোধিত গলায় বলে, “তোর লজ্জা করে নাই আমার সাথে এমন করতে? দশ বছরের বন্ধুত্ব আমাদের। কলেজ, ভার্সিটি, ব্যবসা সব একসাথে করলাম আর তুই….” ধ্রুব তীর্থকে থামিয়ে বলে, “আহা, সেন্টি খাচ্ছিস কেন ভাই? আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি। আমি বুঝতে পারছি না তোর সমস্যাটা কোথায়? কী নিয়ে এত ভয় পাচ্ছিস? তোর জীবনটা একঘেমিয়ে হয়ে গেছে। সংসার এবং বিজনেস নিয়ে থেকে নিজের জীবনই ইনজয় করতে পারলি না। তোকে দেখে মাঝেমধ্যে আমারই আফসোস হয়, সারাক্ষণ মন মরা হয়ে থাকতে হয় তোর। সারাদিন অফিসে কাজ করে বাসায় যেয়েও একটু শান্তি পাস না। আমি বলছি জীবন একটু নতুনত্ব এনে দেখ, ভালো লাগতে শুরু করবে। এমন তো না যে, মৃণাকে ভালোবাসতে বলছি তোকে। যাস্ট কথা-বার্তা বলে দেখ। ভালো লাগবে। আর ভাই ভয়ের কি আছে, কবিতা সংসার এবং তোর বাচ্চাদের থেকে সময় পাইলেই না কিছু জানবে। আর জানতে পারলে কি দিবে না’কি? নিজের সংসার কোন মেয়ে ছেড়ে যায়?নিজের জন্য না ভাবলেও নিজের বাচ্চাদের জন্য তো ভাববে। তোকে ছেড়ে দিয়ে নিজের বাচ্চাদের জীবন নষ্ট করবে না’কি? এর উপর কবিতা যাওয়ার মতো কোন জায়গা নেই বাবার বাড়ি থেকে তো ওর সম্পর্ক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। তুই ছাড়া ওর আছে কে? আর সবচেয়ে বড় কথা ও তোকে ভালোবাসে, দুই একদিন থাকলেও পরে তোর কাছে ফিরে আসবে। এই’যে আমার দ্বারা যে ভুল হলো কিন্তু তাহিরাকে আমার থেকে দূরে থাকতে পেড়েছে? না। শুধু একটু সাবধানে থাকলেই ধরা পড়বি না। ভালো উপদেশ দিচ্ছি। চেষ্টা করে দেখতে পারিস। না করলেও তোর ইচ্ছা।”
কথাগুলো একরাশ বিরক্তি নিয়ে শুনলো তীর্থ কিন্তু কিছু বলল না। রাগে হনহনিয়ে সে বেরিয়ে গেলে সেখান থেকে।
অবশ্যই এতে ধ্রুবর কিছু আসলো গেল না। সে স্বাভাবিকভাবেই বাসায় যেয়ে তাহিরা কে খুঁজতে থাকে। সারা বাড়ি খুঁজে তাকে পায় রান্নাঘরে। চুলায় কিছু করছিল তাহিরা। ধ্রুব যে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মুখ গুঁজে বলে, “আমাকে মিস করেছিস?”
ধ্রুবর স্পর্শে কেঁপে উঠে তাহিরা, “এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে হঠাৎ করে? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তো। আর চুলায় রান্না বসিয়ে তোরা বক্সিং খেলছিলি তাই না? রান্না তো জ্বলে গেল।”
“আসতে না আসতেই বকা শুরু করে দিলি, একটু আদর করে কথা বললেও তো হয়।” কেমন বাচ্চাদের মত করে বলল ধ্রুব।
তাহিরা হেসে ধ্রুবর দিকে ফিরে তাকায়। তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “আমাকে ছেড়ে এত ঘুরে এসে এখন আমাকে বলা হচ্ছে এসব?”
ধ্রুব তাহিরার কোমরে হাত রেখে একটানে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,”আর দশদিন পর আমাদের বিয়ে। এরপর কোথাও তোকে ছেড়ে যেতে তো বুক জ্বলবে তাই আগেই শখ মিটিয়ে নিলাম।”
“তাই না?”
“একদম। না আমি কোথাও যাব, না তোকে কোথাও যেতে দিব। শুধু বুকে জড়িয়ে ধরে রাখব তোকে। আর আদর করবো।”
মুচকি হাসে তাহিরা। লজ্জায় সে চোখ নামিয়ে নিলো। গালদুটো ভারী হয়ে এলো তার। সে লজ্জামাখা গলায় জিজ্ঞেস করে, “তাহলে আমার কাজ আর তোর কাজ কে করবে শুনি?”
“জাহান্নামে যাক সব। তুই শুধু আমার কাছে থাকলেই হবে।”
তাহিরা হেসে নিজের হাত উঁচু করে ধ্রুবর চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। বলল, “এত পাগলামি কোথায় পাস তুই?”
“তোর প্রশ্ন আসলে পাগলামি করতে মন চায়।”
তাহিরা কিছু বলে না, জড়িয়ে ধরে ধ্রুবকে। এত সুন্দর মুহূর্ত হাতছাড়া করবে না’কি ধ্রুব? সুযোগ পেয়েই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার তাহিরাকে।
.
.
তীর্থ রাতে বাসায় যেয়ে দেখে বাচ্চারা এখনও ঘুমায়নি। কবিতাকে শাড়ি পড়তে বলেছিলো সে, তাও পারিনি। তাকে দেখতেই কবিতা বাহানা দিল, “সরি ওরা ঘুমাচ্ছিলোই না। আমি ওদের ঘুম পাড়িয়ে পছন্দের একটা শাড়ি পরে আসবো।”
“প্রয়োজন নেই। আজ আর ভালো লাগছে না।”
বলেই তীর্থ চলে গেল তার রুমে। ফ্রেশ হয়ে এসে দাঁড়াল একটু বারান্দায়। আজকের সকাল থেকে মৃণার কথাগুলো তার মাথায় ঘুরঘুর করছে। তার বিশ্বাস হচ্ছেনা সে একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারে। আর কবিতা কথাটা জানলে? না অসম্ভব, কবিতা এই ব্যাপারে কিছুই জানতে পারে না। কোনমতে জানতে পারেনা।
ভাবতে ভাবতেই হাতে কবিতার স্পর্শ পায় সে। কবিতা তার হাতটা আলতো করে ধরে পিঠে মাথা রাখে। আলতো সুরে জিজ্ঞেস করে, “কোন কিছুর চিন্তায় আছো?”
“এমনিতেই মাথা ব্যথা করছে।”
“সরি তোমার কথা রাখতে পারলাম না ওরা….” তীর্থ কবিতার কথা কেটে বলে, “এটা তো নতুন কিছু না। আমার জন্য তোমার সময়ই হয় না।”
পরের মুহূর্তেই সে বুঝতে পারে তার কথা বলার ধরণ টা রুক্ষ হয়ে গেছে। আবার মৃণার কথাটা তার মাথায় আসে। ভয় পেয়ে যায় সে। কবিতা আলতো করে তার যে হাত ছুঁয়েছিল সে হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল সে। বলল, “অসুবিধা নেই একদিন ওদেরকে কারও কাছে রেখে আমরা দুজন ঘুরতে যাব ঠিক আছে?”
কবিতাকে খুশি মনে হলো। সে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি রাগ করেছ। কুহু একটু বড় হোক, তারপরেই যাব। আজ অনুর কাছে শুধু একঘন্টা রেখে গিয়েছিলাম আমার যেন জান চলে যাচ্ছিল। এবার আসো, খাবার খেয়ে নাও।”
তীর্থ কবিতার সাথে যাবার পূর্বে কবিতাকে কিছু কাপড়ের নমুনা ও ডিজাইন দিয়ে গেল। কবিতার এইসব বিষয়ে ভালো রুচি আছে। আজও তীর্থ বেশিরভাগ কবিতা থেকে পরামর্শ নিয়ে বাজারে নতুন পণ্য বের করে। কেননা, কবিতার অন্যরকম ডিজাইনের কারণেই তাদের ব্যবসার উন্নতি হয়েছে প্রথম দিকে।
তারপর সে খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষণ বসে টিভি দেখে কাব্যের সাথে। কুহু ঘুমিয়ে ছিলো, তার মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে যায় বাহিরে। দোকানে যেয়ে একটি সিগারেট ও চুইঙ্গাম নেয়। আজ বহুবছর পর সে সিগারেট খেল।
কবিতাকে ওয়াদা করার পর সিগারেট ধরেও নি।
কিন্তু আজ তার সিগারেটটা প্রয়োজন। একটি সিগারেট খেলে কিছু হয় না। চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। হঠাৎ তার জীবন এমন ওলট-পালট হয়ে গেল কেন সে বুঝতে পারছে না।
.
.
সকাল সকাল মৃণাকে অফিসে দেখে একটু একটু হকচকিয়ে যায় তীর্থ একটু হকচকিয়ে যায়। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। মৃণা দ্রুত এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে বলে, “আপনি গতকাল কোথায় চলে গিয়েছিলেন হঠাৎ করে? আপনি কী আমার উপর রাগ করেছেন? আমি কী আপনাকে ক্রোধিত করেছি?”
তীর্থ একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে মৃণাকে রুমে নিয়ে এসে তাকে অসহায় গলায় বলে, “না, ভুল আমারও ছিলো। এমন সিচুয়েশনে কখনো পড়তে হবে আমি কল্পনাও করি নি। দেখো মৃণা, আমি আমার পরিবারকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আমার স্ত্রী আমার জন্য কি তা তোমাকে আমি শব্দে বুঝাতে পারব না। তুমি যা চাইবে আমি দিব, কিন্তু প্লিজ এই কথা কাওকে জানিও না। আমার পরিবার, সংসার সম্মান সব নষ্ট হয়ে যাবে।”
“আমি আপনাকে কোনোভাবে কষ্ট দেবার কথা ভাবতেও পারি না। আপনি যেভাবে বলবেন আমি সেভাবেই করব। আপনার কাছে সেরাতটা কেবল একটি ভুল হতে পারে কিন্তু আমি কি হারিয়েছি তা আপনি বুঝবেন না। একটি মেয়ের জন্য তার সম্মান কতটুকু তা আপনার কল্পনার বাহিরে।” মৃণার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করে। সে কাঁপানো গলায় বলে, “তবে আপনার কথামতো আমি সব করতে রাজি। তবে আমার কেবল একটা শর্ত আছে। প্লিজ আপনি না করবেন না। আমি কেবল যখন আপনাকে দেখতে চাইব অথবা কথা বলতে চাইব আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। আমি আপনাকে নিজের করে পেতে পারব না আমি জানি কিন্তু আপনাকে দেখেই শান্ত করতে পারব আমার মন। আমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।”
তীর্থের বেশ মায়া হলো মৃণার জন্য। তার মনে পড়ে গেল অতীতের স্মৃতি, যখন সে ভালোবেসেছিল কবিতাকে। কবিতার জন্য তার বুক ব্যাথা করতো, তাকে বারবার দেখতে ভালো লাগতো, তার কন্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেত তীর্থ, সারাক্ষণ এই মন কেবল কবিতা কবিতা করতো। তার হৃদয় কেবল খুঁজতো কবিতাকে।
এই অনুভূতি সে ভালো করেই জানে।
তীর্থের ভাগ্য ভালো, সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়েছে। সকলের ভাগ্য এতটা ভালো হয় না। সে জানে ভালোবাসার মানুষটিকে না পাওয়ার পীড়ন। এই অনুভূতিতে পুড়েছে সে। কিন্তু তার ও মৃণার অবস্থা এক নয়। সে বিবাহিত। তাকে ভালোবাসলেও তাকে পাবার কোনো সুযোগ নেই মৃণার। তাই সে মৃণাকে বুঝিয়ে বলে, “এমনটা হয় না মৃণা, তুমি আমাকে যত দেখবে ততই কষ্টে ভুগবে।”
“আমি রাজি। তবুও আমাকে দূরে থাকতে বলবেন না। আপনি যা বলবেন আমি সব করব। তবুও আমাকে দূরে ঠেলে দিবেন না প্লিজ।”
অপরাধবোধ, বিরক্তি ও মায়ার দ্বিধায় ফেঁসে যায় তীর্থ। সে কি করবে বুঝতে পারে না। অবশেষে সে কোনো উওরই দেয় না মৃণাকে। যা হবে দেখা যাবে।
.
.
নয়দিন পর,
কবিতা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তাহিরার দিকে। বধূবেশে তাকে অপ্সরীদের থেকে কম লাগছে না। আজ তাহিরা ও ধ্রুবর বিয়ে। একটিমাত্র অনুষ্ঠান হচ্ছে তাদের। কবিতার ইচ্ছা ছিল যেহেতু তার বিয়েতে কোন অনুষ্ঠান হয়নি, তাই তোর বোনের বিয়েতে সব শখ মিটাবে সে। কিন্তু তাহিরা নাছরবান্দা। সবার বলার পরও সে একটির বেশি অনুষ্ঠানে রাজি হয় নি।
তাহিরা ও অনু পার্লার থেকে সেন্টারে এসেছিলো। কবিতা খবর পেতেই দৌড়ে আসে। এসে তাহিরাকে দেখেই সে লাফিয়ে উঁচু কন্ঠে বলে উঠে, “আপু ধ্রুব ভাইয়া তো পাগল হয়ে যাবে তোমাকে দেখে। এত সুন্দর লাগছে কেন তোমাকে?”
তাহিরা ফিক করে হেসে দেয় কবিতার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে। পরের মুহূর্তেই বিয়ের আয়োজন দেখে তার ফুরফুরে মনটা ঢেকে যায় কালো মেঘেতে। তার বিশেষ কোনো আয়োজন করার মোটেও ইচ্ছা ছিল না। তার দাদী বলতো, তাহিরার মা বাবা অনেক স্বপ্ন দেখতো তার বিয়ে নিয়ে। বিশেষ করে তার মা। হাজারো চিন্তা করে রেখেছিলো তাহিরার বিয়ে নিয়ে। অনেক কিছু বানানোর চিন্তা ছিলো তাদের। আর আজ তারা কেউ-ই নেই তার সাথে। তাদের স্বপ্নগুলো অসমাপ্ত থেকে। আজ তাদের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। বউ সেজেছে আজ তাহিরা অথচ তার পাশে নেই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো মানুষ। তার মা-বাবা। এত মানুষের মাঝেও তার একাকী অনুভব হচ্ছে। খুব কান্না আসছে তার। কিন্তু সে সকলের সামনে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে চায় না। আজ তার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন হবার কথা তবে এত কষ্ট অনুভব হচ্ছে কেন তার?
তাহিরার পলকে এসে জমলো জল। চারপাশের আনন্দময় হৈ-হুল্লোড় শুনে তার মনে হলো দম বন্ধ হয়ে আসবে তার এই মহলে। এমন সময় তার হাতে কারও হাতের স্পর্শ পেল সে।
ধ্রুব তাহিরার পিছনে এসে দাঁড়ায়। তাহিরাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তাহিরার আঁখিতে আঁখি মিলালো। দুইহাত তাহিরার গালে রেখে বলে, “তোর এবং আমার দুইজনের মা বাবা আমাদের দূর থেকে দেখছে। তারা তোকে এত সুন্দর দিনে কাঁদতে দেখলে খুশি হবে না’কি? এত সুন্দর বউয়ের চোখে জল মানায় না’কি? আমার বউয়ের চোখের জল আমি সহ্য করতে পারি না, কথাটা জানিস না?”
তাহিরার কান্না আরও বাড়ে। সে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে এইবার। ঝাপিয়ে পড়ে ধ্রুবর বুকেতে। এই বুকের ভেতর এই পৃথিবীর সকল শান্তি সে খুঁজে পায়। একই সাথে সুখ এবং কষ্টের অনুভূতি হলো তাহিরার। আজ তার মা বাবার জন্য যেমন তীব্র কষ্ট হচ্ছে তার, তেমন ধ্রুবকে পাওয়ার সুখও হচ্ছে তার। আজ সে সম্পূর্ণভাবে ধ্রুবর হতে যাচ্ছে এবং ধ্রুব তার। ধ্রুবর উপর অনুভূতির অধিকার তো তার আগের থেকেই ছিলো। আজ আইনগত এবং ধর্মগত ভাবেও সে সকল অধিকার পাবে। আজকের পর থেকে সে বলতে পারবে, তার এমন কেউ আছে যে সম্পূর্ণভাবে তার। কেবল তার।
চলবে….
[