#মুহূর্তে
পর্ব-৩১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তুমি অফিসে যাও নি কেন?” সকাল সকাল আইদকে বাসায় দেখে মৃণা প্রশ্ন করে। আইদ মৃণার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছিলো। তা মৃণার সামনে রেখে একগাল হেসে বলল, “তুমি গতকাল অসুস্থ ছিলে, তাই আজ ছুটি নিয়েছি।”
“আমার অসুস্থতার সাথে তোমার ছুটির সম্পর্ক কী? গতসাপ্তাহে তো তুমি নিজে অসুস্থ ছিলে তখন ছুটি না নিলে এখন নেবার কী প্রয়োজন?”
আইদ ঠোঁটের কোণের হাসিটা বজায় রাখে। মৃণার গালে আলতো করে হাত রেখে বলে, “কারণ তুমি অসুস্থ। বিয়ের পর তোমার খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব। তোমার সম্ভবত মন খারাপ তাই তোমার মা বাবাকে আসতে বলেছি। আমি একটুপর তাদের যেয়ে নিয়ে আসবো।”
“আমি আপনাকে বলেছি আনতে?”
মৃণা রাগান্বিত স্বরে বলল। আজ সে ভেবেছিলো তীর্থের অফিসে যাবে। তীর্থ মোবাইল থেকে তাকে ব্লক করে রেখেছে তাই যেভাবেই হোক তার সাথে দেখা করে বাচ্চার খবরটা জানাতে হবে। কিন্তু এদিকে সবাই তার খুশির পিছনে পড়ে আছে যেন।
“তাদের দেখে তোমার মনও ভালো হয়ে যাবে সাথে তাদেরও।”
আইদ নরমসুরে বলল। মৃণার বেয়াদবির উওর দিলো না আর। কিন্তু মৃণা আবারও বলে, “আমার মা বাবাকে দেখা লাগবে না। আর আপনিও অফিসে যেতে পারেন। আমি এখন সুস্থ।”
“মৃণা,” এবার আইদ ধমক দিয়ে উঠে, “তুমি যখন চাও এভাবে জেদ করতে পারো না। তোমার মা বাবাকে আমি আসতে বলেছি। তোমার তাদের সাথে দেখা না লাগলেও, তাদের লাগবে। বিয়ের পর তুমি একদিন কেবল তাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছ। আমি তাদের জামাই হয়ে তাদের সাথে প্রতি সাপ্তাহে দেখা করে আসতে পারি কিন্তু তুমি যেতে পারো না? তুমি জানো উনারা একা থাকে। দুইজন বৃদ্ধ মানুষ। তাদের খোঁজ নেওয়া তো নেও না। আর এখন তারা আসছে এতেও তোমার সমস্যা? উনারা এসে দুইদিন তোমার সাথে থাকবে এটা আমার শেষ সিদ্ধান্ত। আর তোমাকে ক’দিনই অসুস্থ দেখাচ্ছে। আমি রাতে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”
ডাক্তারের কথা শুনতেই বুকের ভেতর কামড়ে উঠে মৃণার। সে ডাক্তারের কাছে গেলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সে যদি আসলেই গর্ভবতী হয়? আইদ একথা জানতে পারে না। মোটেও না।
সে এবার মিষ্টি করে বলে, “আমি বলতে চেয়েছিলাম যে
মা-বাবা যদি আমাকে এসে অসুস্থ শুনে তাহলে চিন্তা করবে।তুমি মা বাবাকে ডাকলে ডাকো। তারা আসলে আমার থেকে খুশি আর কে হতে পারে? কিন্তু আজ আমি ডাক্তারের কাছে যাব না। তাদের সামনে তো একদমই না।আরও দুইদিন দেখি, ভালো না লাগলে যাব।”
আইদের মন এবার উদাসীন হয়ে যায়৷ সে ভাবে, সে না বুঝে কত রুক্ষভাষী কথা বলে ফেলল মৃণাকে। নিজেকে সংযত করে সে মৃণার হাত ধরে সে বলল, “সরি আমার এমনভাবে কথা বলা উচিত হয় নি। আচ্ছা এখন ভালো মেয়ের মতো খাবার খেয়ে নেও, তোমার পছন্দের নাস্তা বানিয়ে এনেছি, ফ্রাঞ্চ টোস্ট। ওয়েট আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তুমি বলো কেমন হয়েছে। এই প্রথম বানিয়েছি।”
আইদ নিজ হাতে খাইয়ে দিলো মৃণাকে। মৃণাও কিছু বলে না। আপাতত সে এমন কিছু করতে চায় না যেন কোনো কারণে আইদের তাকে নিয়ে সন্দেহ হয়। সে বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নেয়।
আইদের উপর তার মাঝেমধ্যে রাগ উঠে। অহেতুক রাগ। এই রাগের কারণটাও সে জানে না। সম্ভবত লোকটা একটু বেশিই ভালো তাই। সে ছোট বেলা থেকেই দেখতে আইদ তার মা বাবাকে তার থেকে বেশি যত্ন করে, তার বেয়াদবিগুলোকে মুখ বুঝে সহ্য করে, তার যত্ন নেয়। সে ভেবেছিলো এসবের একটাই কারণ তাকে পাওয়া। কত লোকরা তো এমন ভালো সাজার নাটক এই কারণেই করে, তার স্বার্থের জন্য। স্বার্থ পূরণের পর সব যত্ন শেষ হয়ে যায়। পৃথিবীটা কী এভাবেই চলে না? সবাই-ই তো নিজের স্বার্থের জন্য জীবন কাটায়। সব নামের ভালো কাজের পিছনেও থাকে নিজের স্বার্থ।
কিন্তু আইদকে নিয়ে সে অবাক। আজ বিয়ের একমাস হয়ে এলো, আইদ তাকে শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে জোর তো দূরের কথা, বাসররাতে তাকে দূরে সরানোর পর দ্বিতীয়বার কাছে আসার কথা বলেও নি। এখন সে তার এবং তার মা-বাবার আরও বেশি যত্ন নেয়। এর পিছনে আইদের কী স্বার্থ থাকতে পারে বুঝে না সে।
“আপনি আমাকে বিয়ে কেন করেছেন?” হঠাৎ মৃণার এমন প্রশ্ন করায় আইদ একটু চমকে উঠে।
“হঠাৎ করে এই প্রশ্ন করছ যে?”
“আমি কখনো আপনার সাথে ঠিক মতো কথাও বলি নি। আপনি আমাকে বিয়ের আগে পছন্দ করতেন এই কারণে আমাকে বিয়ে করেছেন আপনি?”
ব্যাপারটা নিয়ে কিছু মুহূর্ত চিন্তা করে বলে আইদ, “বিয়ের আগে পছন্দ করতাম এটা একদম সত্যি না, তবে আমাদের বিয়ের কথা অফিসিয়ালি শুরু হবার পর থেকে তোমার কথাই সবসময় চিন্তা করতাম। তুমি যেহেতু আমার স্ত্রী হবে তাই শুধু তোমার কথাই ভাবতাম। একসময় ভালোলাগাটাও হয়ে যায়।”
“তাহলে আমাকে বিয়ে কেন করেছ?”
“কারণ আমাদের মা বাবা চাইতো। বিশেষ করে আংকেল আন্টি। তারা সবসময়ই আমাকে নিজের ছেলের মতো আদর করেছেন। আর সমসময় চাইতেন যেন তোমার বিয়ে আমার সাথে হয়। এই কারণেই।”
উওরটা শুনে মৃণার কপাল কুঁচকে যায়। সে কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারে না। সে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি বিয়ের আগে কাওকে ভালোবাসো নি?”
আইদ মাথা নাড়ায়। উওর ‘না’ ছিলো।
“এটা কীভাবে সম্ভব? সবার-ই কোনো না কোনো অতীত থাকে।”
“কিন্তু আমি ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। যেহেতু আমি জানতাম আমার বিয়ে তোমার সাথে হবে তাই অন্যকারো প্রতি দুর্বল হবার পূর্বেই নিজেকে সংযত করে রেখেছি। জীবনে একজনকেই ভালোবাসতে চেয়েছি। আমার স্ত্রীকে। এখন আমার সব ভালোবাসা শুধু তোমার জন্য।”
মৃণা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ আইদের দিকে। অপরাধভাব তার দেহের অঙ্গে অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। হৃদয়ে কোনো এক অদ্ভুত অনুভূতির বিস্ফোরণ ঘটে। সে আর তাকিয়ে থাকতে পারে না আইদের দিকে। চোখ সরিয় নেয়। কেন যেন চোখ তুলে আইদের দিকে তাকানোর সাহস হয় না তার।
.
.
কবিতা রান্না শেষে খাবারগুলো টেবিলে রাখছিলো। এমন সময় টেবিলে একগুচ্ছ গোলাপ দেখলো সে। সে আশেপাশে তাকায়। কে এখানে রাখতে পারে এই ফুলের গুচ্ছ? আশেপাশে কারও দেখা পায় না সে। ফুলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ফুলের সৌন্দর্যের পরখ করতে থাকে। সে নাকের কাছে নিয়ে গভীর নিশ্বাস নেয়। আচমকায় কেউ এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
“তোমার ভালো লেগেছে?”
কবিতা প্রথমে চমকে উঠে তীর্থের কন্ঠ শুনে, তবে সে শান্ত নিজেকে শান্ত করে। আবার পরের মুহূর্তে তার রাগ উঠে যায়। সে তীর্থ থেকে দূরে সরে বলে, “আমি বলেছিলাম আমার কাছে আসতে না। সমস্যা কী তোমার?”
“কবিতা আর কত? একমাস কেটে গেল। আমি বলেছি তো আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।”
কবিতা কিছু না বলে রান্নাঘরে যেতে নিলেই তীর্থ তার হাত ধরে নেয়, “কথা না বললে আমাদের মাঝে ঝামেলার সমাধান কীভাবে হবে?”
“কেন? সমাধান করার প্রয়োজন কী? বলেছি তো তুমি তোমার মতো থাকো, আমি আমার মতো থাকবো। তোমার তো আরো খুশি হওয়া উচিত, তোমার কাজে কেউ তোমাকে জ্বালাবে না।”
“কবিতা প্লিজ। তুমি আমাকে এভাবে অবহেলা করলে কষ্ট হয় আমায়?”
“কষ্ট হয়? কেন? এমন তো নয় যে তুমি আমার সাথে আগে সারাক্ষণ বসে বসে গল্প করতে। আমার জন্য সময়ও হতো না তোমার কাছে। এখনও সব একই থাকবে একেবারে আগের মতো। আমাকে যেমন শপিজের মতো ঘরে রেখে ভুলে গিয়েছিলে ঠিক তেমন। আর আমি তো চরিত্রহীন তাই না? আমার মতো চরিত্রহীন মেয়ের সাথে কথা বলে তোমার মান কমে যাবে না?”
কবিতা ঝাড়ন দিয়ে তীর্থের হাত সরাতেই নিলেই তীর্থ তাকে কাছে টেনে নেয়। তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমার ভুল হয়ে গেছে কবিতা। আই এম সরি। আমি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে নিবো। তুমি যেমন চাইবে তেমনই হবে। প্লিজ এমন ব্যবহার করো না, আই লাভ ইউ সো মাচ। প্লিজ।”
কবিতা তীর্থের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইল। কিন্তু তীর্থের শক্তির কাছ থেকে পেরে উঠলো না।
কলিংবেল বাজলো। কলিংবেল বাজতেই তীর্থ কবিতাকে ছেড়ে দেয়। তারপর হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখ মুছে। কবিতা একটু অবাক হয়। তীর্থ কাঁদছিলো? তার বুকের ভেতর কামড়ে উঠে। সে যতই নারাজ হোক না কেন, আজও তীর্থের কোনো দুঃখ তার সহ্য হয় না। কিছুতেই সহ্য হয় না।
তীর্থ রুমে যাবার পর আবারও কলিংবেল বেজে উঠে। কবিতার ঘোর ভাঙ্গে। সে যে দরজা খুলে দেখে একটি যুবক ছেলে দাঁড়ানো। ছেলেটাকে সে চিনে না তাই জিজ্ঞেস করল, “আপনার কাকে লাগবে?”
“এটা কি মি.তীর্থের বাসা?”
“জ্বি।”
ছেলেটা একটি খাম এগিয়ে দিলো কবিতার দিকে, “একমাস আগে আমার বাবার এক্সিডেন্ট হয়ে গিয়েছিলো। এতজন দেখলো কেউ তার সাহায্য করল না তীর্থ স্যার ছাড়া। ওদিন না’কি তার ছেলেও খুব অসুস্থ ছিলো তাও আমার বাবার সাহায্য করলো। আমাদের কাছে তখন চিকিৎসার টাকা ছিল না তাই হাস্পাতালে পেমেন্টও করেছিলেন উনি। উনি বাসার ঠিকানা দিয়ে গিয়েছিলো তাই তার থেকে ঋণ নেওয়া টাকা ফেরত দিতে এলাম।”
কবিতা একটু হকচকিয়ে যায়। অর্থাৎ কাব্য যেদিন অসুস্থ ছিলো সেদিন তীর্থ একজনকে হাস্পাতালে নিয়ে গিয়েছে তাই দেরি করেছিলো?
“তোমার বাবার এখন কী অবস্থা?”
“অনেকটা সুস্থ।”
ছেলেটা টাকা দিয়েই বিদায় হয়ে যায়। কবিতা রুমে যেয়ে দেখে তীর্থ বিছানায় বসে আছে। চুপ করে। কবিতা যেয়ে তার পাশে টাকার খামটি রেখে বলল, “একটি ছেলে এসে টাকার খামটি দিয়ে বলল তুমি তার বাবা হাস্পাতালে নিয়ে তার জন্য পেমেন্ট করেছিলে সে টাকা দিয়ে গেল। তুমি আমাকে বলো নি কেন সেদিন তুমি লোকটাকে হাস্পাতালে নিয়ে যাওয়ার কারণে দেরি করেছ?”
“বললে কী তুমি আমায় ক্ষমা করে দিতে?”
কবিতা কিছুক্ষণ নীরব থাকলো। তারপর সেখান থেকে যেতে চাইলো। এর পূর্বেই তীর্থ তাকে জড়িয়ে ধরে। তার কোমরটা হাত দিয়ে আবদ্ধ করে পেটে মুখ গুঁজে বলল, “তুমি কী আমাকে ক্ষমা করবে না। প্লিজ কবিতা আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”
“তাহলে আমি কীভাবে সহ্য করেছি তা ভাবো। তোমার এই এক দেড় মাসের অবহেলা সহ্য হচ্ছে না। তুই কত বছর ধরে আমাকে অবহেলা করছো হিসেব আছে তোমার? আমি আজ তোমার সাথে কথা বলছি না বলে তুমি কষ্ট পাচ্ছো, যখন তোমার মা’য়ের জন্য আমার সাথে তোমার ঝগড়া হতো তখন কতদিন ধরে তুমি আমার সাথে কথা বলতে না একবার বুঝো কেমন লাগে। আর শেষ দুইবছরে তো আমি তোমাকে চিনতেও পারছি না। এতটা বদলে গেছ তুমি। আমি সব ক্ষমা করেছি। কিন্তু সেদিন তুমি আমার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুললে। তোমার বুক কাঁপে নি একটিবারও? যদি কারও অবহেলা সহ্য করতে না পারো তাহলে অবহেলা করো কেন?”
“আমি ভুল করেছি। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি এখন তা বুঝতে পারছি। আমাকে আরেকটা সুযোগ দেও কবিতা। আমাদের ভালোবাসার খাতিরে হলেও আরেকটা সুযোগ দেও। আমি সব ঠিক করে দিব।”
বুকের ভেতর কম্পন জাগে কবিতার। তীর্থের জন্য মায়া হয় তার। কিন্তু সে তীর্থের সামনে সম্পূর্ণভাবে নরম পড়ে না। সে বলে, “ঠিকাছে ঠিক করে দেখাও। আমিও দেখতে চাই তুমি কীভাবে এই সাত বছরের এলোমেলো হয়ে যাওয়া সংসারটা গোছাবে। যা আমি এত বছরেও পাড়লাম না।”
কবিতা কাঁপা কাঁপা হাতে তীর্থের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “গোসল করে নেও, আমি খাবার দিচ্ছি।”
তবুও সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো কবিতা। তীর্থ যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে ছাড়লো। তার মনে যতই ক্রোধ থাকুক না কেন, তা তীর্থের কষ্ট থেকে বড় নয়। সে জানে, তীর্থ চেষ্টা করলে এই সংসার আবার গুছিয়ে যাবে। সে কখনোই তীর্থকে ছাড়া থাকার কথা চিন্তাও করতে পারে না। তার ভালোবাসার কাছে একসময় তার সকল রাগ হাওয়ায় মিশে যাবে। মনের সিন্দুকে বন্দী থেকে যাবে কষ্টগুলো। সে একবার তীর্থকে বলেছিলো, “তোমার সকল ভুল আমি ক্ষমা করে দিব, কেবল আমার বিশ্বাস ভাঙবে না।”
কবিতা জানে তীর্থ তাকে হাজার অবহেলা করুক, সে কখনো তার বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না।
তীর্থ তাকে ছেড়ে বলল, “দেখে নিও আমি সব ঠিক করে দিব।”
তীর্থ ছাড়তেই কবিতা সেখান থেকে চলে গেল।
কবিতা যাবার পর তীর্থ গভীর নিশ্বাস ফেলে। অবশেষে কবিতার মন একটু হলেও গলে গেল। ধ্রুব ঠিক বলেছিলো, সর্বপ্রথম একটি মা’য়ের মন গলাতে হবে, তারপর একটি নারীর, অবশেষে স্ত্রীর। আজ সে একটি মিথ্যা কাহিনী বানিয়ে মা’য়ের মন তো গলিয়ে দিলো কিন্তু
কবিতা তার চরিত্রের উপর তোলা প্রশ্ন সহজে ভুলবে না।
এখন যেমন করেই হোক কবিতাকে তার মানাতে হবেই।
ফোনটা বেজে উঠে তীর্থের। আননোওন নাম্বার। ফোনটা তুলেই সে জিজ্ঞেস করে, “হ্যালো কে?”
“তীর্থ প্লিজ ফোন কাটবে না। আমার জরুরী এক কথা আছে। অনেক জরুরী।”
মৃণার কন্ঠ শুনে তীর্থ ফোন কাটতে নিয়েছিলো কিন্তু মৃণার জরুরী তলবের কথায় সে আর ফোন কাটে না। ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কী জরুরি কথা?”
“আমি সম্ভবত প্রেগন্যান্ট। তোমার বাচ্চা আমার গর্ভে।”
স্তব্ধ হয়ে গেল তীর্থ। এই কথা শোনার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না।
“ফাইজলামি করো? দেখ মৃণা এসব ফাজলামো আমার পছন্দ না। তুমি যাই করো না কেন আমি তোমার কাছে ফিরে আসবো না। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, সুখে থাকো তুমি। আমাকেও শান্তিতে থাকতে দেও।”
“প্রেগন্যান্সির সকল লক্ষ্মণ খেয়াল করেছি।”
“তোমার বিয়ে হয়েছে বাচ্চাটা তোমার স্বামীরও হতে পারে।”
“আইদের সাথে এখনো আমার শারীরিক সম্পর্ক হয় নি।”
কথাটা শুনে আর কিছু বলতে পারলো না তীর্থ। চিন্তায় পড়ে গেল সে। তার জীবনে শান্তি থাকতে পারে না কেন? কবিতার সাথে যখনই সব ঠিক করতে চাইলো তখনই এমন মুশকিলে পড়তে হলো তাকে?
তীর্থ মাথায় হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “আগামীকাল সন্ধ্যায় আমার সাথে হাস্পাতালে দেখা করো। আমি হাস্পাতালের এড্রেস পাঠিয়ে দিব।”
“আচ্ছা আর এই নাম্বারে কল দিও না। এটা আইদের নাম্বার। আমাকে তুমি ব্লক করে রেখেছিলে বলে আইদ গোসলে যাবার পর ওর নাম্বার দিয়ে কল করেছি।”
“আচ্ছা।”
তীর্থ কল কেটে দিলো। ফোন কাটার পর মৃণা জলদি করে তীর্থের নাম্বার ফোন থেকে ডিলিট করতে যাবে তখনই আইদের কন্ঠ শুনে সে, “মৃণা, আমার ফোনে কার সাথে কথা বলছ তুমি?”
আইদের কন্ঠ শুনতেই ঘাবড়ে যায় মৃণা। তার হাতের থেকে ফোন পড়ে যায়। আইদ তার কথা শুনে নেয় নি তো?
#মুহূর্তে
পর্ব-৩২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
ফোন কাটার পর মৃণা জলদি করে তীর্থের নাম্বার ফোন থেকে ডিলিট করতে যাবে তখনই আইদের কন্ঠ শুনে সে, “মৃণা, আমার ফোনে কার সাথে কথা বলছ তুমি?”
আইদের কন্ঠ শুনতেই ঘাবড়ে যায় মৃণা। তার হাতের থেকে ফোন পড়ে যায়। আইদ তার কথা শুনে নেয় নি তো?
মৃণা জলদি করে ফোনটা উঠিয়ে বলল, “আমার ফোনে টাকা শেষ হয়ে গেছিলো তাই রূপাকে কল করার জন্য তোমার ফোন নিলাম।”
আইদ হাসে, “ঠিকাছে। এখানে এত ঘাবড়ে যাবার কী আছে?”
তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছচ্ছিলো আইদ। মৃণা নিজে যেয়ে আইদের হাতের থেকে তোয়ালে নিয়ে তার মাথা মুছতে শুরু করে।
আইদ হতবাক।
সে কী ঠিক দেখছে? যে মৃণা আজ পর্যন্ত নিজ থেকে তার সাথে কথা বলতে আসে নি সে এসে তার চুল মুছে দিচ্ছে?
“তোমার আজ হঠাৎ কী হলো মৃণা?”
“কেন আমি আমার স্বামীর মাথা মুছে দিতে পারি না?”
মৃণা জোরপূর্বক হাসি তার ঠোঁটের কোণে রেখে বলল। যেমন করেই হোক কয়দিন তার সবার সাথে ভালোভাবে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে আইদের সাথে। যেন কেউ তাকে নিয়ে কোনো ধরনের সন্দেহ না করে। আইদকে কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে তাদের সম্পর্কে কোনো সমস্যা আছে।
পায়ের পাতায় ভর করে উঁচু হয়ে আইদের মাথা মুছে দেবার শেষে সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সে দেখে আইদের ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভালো কিছু হয়েছে? এভাবে হাসছ যে?”
“হয়েছে তো। তুমি মাত্র এত আদর করে আমার মাথা মুছে দিলে, আমার কাছে এলে। এটা অনেক বড় ব্যাপার নয়?”
মৃণা কি বলবে বুঝতে পারে না। কিন্তু তার আবারও কেন যেন রাগ উঠে আইদের উপর। আইদের এইসব কথা শুনে তার মনে হয় সে নিজে অনেক খারাপ। তার চিন্তাভাবনা খারাপ। সে নিজে মানুষটা খারাপ। সে যা করছে সব ভুল। আইদের কারণে তার মনে অপরাধ ভাবটা বিরাজ করে। কিন্তু সে জানে সে যা করছে তা ভুল না। নিজের জন্য ভাবাটা কখনোই ভুল হতে পারে না। উচ্চাকাঙ্খী হওয়া খারাপ তো কিছু না। তাই না? উল্টো যেসব মানুষরা ভাবে অহরহ ধন-সম্পদ ছাড়াও সুখে থাকা যায় তারা বোকা। আর আইদ সে বোকাদলের মাঝে একজন। বোকা না হলে এতদিনে সে তার কোম্পানি থেকে অনেক টাকা সরাতে পারতো। কিন্তু নীতিই তার কাছে সর্বোপরি। কিন্তু নীতি কখনো বিলাসিতা দেয় না।
আইদ যদি আজ তার সকল ইচ্ছা পূরণ করতো তাহলে হয়তো তীর্থের প্রতি তার ভালোবাসাটাও ভুলে যেত সে, ভুলে যাবার চেষ্টা করতো আইদের কুদর্শন বাহ্যিক গঠন। কিন্তু না, সে তো তা করবে না। সবশেষে দেখা গেলে তার তীর্থের কাছে যাবার আরেকটা কারণ আইদ নিজে।
আইদ মৃণার গালে হাত রেখে বলল, “আমার ভালো লাগছে যে তুমি আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছো। অনেক খুশি লাগছে আমার। আমি জানি তুমি মুখে কিছু না বললেও আমাদের বিয়েতে তুমি সন্তুষ্ট না। আমি আমার সব দিয়ে চেষ্টা করব সারাজীবন তোমাকে সুখে রাখার।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃণা, “তোমার পক্ষে এই জনমে তা সম্ভব না।” মনে মনে বলল সে।
.
.
পরেরদিন সন্ধ্যায়,
মৃণার বুক কাঁপছে। গতকালই সে প্রেগন্যান্সি কিট দিয়ে টেস্ট করেছে। রেসাল্ট পজিটিভ। সে নিজে বুঝতে পারছে না সে কী চায়? প্রেগন্যান্ট হলে কী সে খুশি হবে, না দুঃখী? যদি প্রেগন্যান্ট হবার সত্ত্বেও তীর্থ তাকে আপন না করে? আর আইদকেই কী বলবে সে? আইদ এসব জানলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আজব দ্বিধায় পড়ে গেল সে।
অন্যদিকে আজ সকালে সে একা এসে টেস্ট করিয়েছিলো। তীর্থ আসেও নি। শুধু একজনকে দিয়ে সব ব্যবস্থা করে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন তার আসার কথা। ডাক্তারের সাথে দেখা করার কথা কিন্তু এখনো তার আসাতে দেরি। দুইবার তার নাম ডাকা হয়েছে, সে যায় নি। তৃতীয়বার ডাকার পরপরই তীর্থ এলো। তীর্থকে দেখেই খুশিতে তার মন নেচে উঠে। সে উঠে যেয়ে তীর্থকে বলে, “তোমাকে আমি কতদিন পর দেখছি। তুমি জানো আমি কতটা মিস করেছি তোমাকে?”
কথাগুলো যেন তীর্থের কানেও গেল না। সে রুক্ষভাবে বলল, “ডাক্তারের কাছে চলো।”
মনটা খারাপ হয়ে গেল মৃণার। এতদিন পর দেখা হবার পরেও কেউ এভাবে কথা বলে? কিন্তু আপাতত সে কিছুই বলল না। চুপচাপ গেল ডাক্তারের কাছে। প্রেগন্যান্সি পজিটিভ আসলো। তিনমাসের প্রেগন্যান্ট সে। ডাক্তার কতগুলো পরামর্শ দিলো মৃণাকে। সাথে কিছু ঔষধও লিখে দিলো।
তীর্থ কেবিনেও তার সাথে কোনো কথা বলল না। বের হবার পরও না। মৃণা তার সাথে কথা বলতে চাইলে তীর্থ বলে, “গাড়িতে উঠে কথা হবে।”
মৃণা চুপ করে যায়। পিছু নেয় তীর্থের। গাড়িতে উঠার পরই তীর্থের রাগ বর্ষে পড়ে তার উপর, “তোমাকে আমি বলেছিলাম বার্থ কন্ট্রোল পিল নিতে তুমি নেও নি কেন?”
কেঁপে উঠে মৃণা। সে সংকোচিত হয়ে যায়। আমতা-আমতা করে বলে, “নিয়েছিলাম তো। কিন্তু হয়ে গেছে, আমার কী দোষ?”
তীর্থ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর হঠাৎ করে গাড়ির স্টারিং-এ ঘুষি মেরে বলে, “আমি যখনই ভাবি সব ঠিক করে দিব তখনই ঝামেলায় পড়তে হয়। ভাল্লাগে না এসব আর।”
মৃণা এখনো চুপ।
তীর্থ তাকায় মৃণার দিকে। শান্ত গলায় বলে, “যা হওয়ার হয়ে গেছে। অবরশন করিয়ে নেও।”
আঁতকে উঠে মৃণা, “কী বলছো এসব? এটা আমাদের ভালোবাসার অংশ।”
ভ্রু কুঁচকে যায় তীর্থের, “ভালোবাসার? আমাদের অবৈধ সম্পর্কের চিহ্ন। মৃণা এটা তোমার আমার দুইজনের জন্যই শ্রেয়। তোমার কী মনে হয় বাচ্চাটার কথা যদি তোমার পরিবার জানে তাহলে তারা তোমাকে আপন করে নিবে? আর আমি এক কথা বলে দিচ্ছি, যতদিন আমার সাথে কবিতার সংসার ঠিক আছে ততদিন আমি তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করবো কিন্তু যদি তোমার কারণে আমার এবং কবিতার সম্পর্কে কোনো সমস্যা হয়, তাহলে তোমার দিকে। ফিরেও তাকাব না আমি।”
“আমি তোমার জন্য সবাইকে ছেড়ে আসতে রাজি। আর তুমি আমাকে আপন করতে রাজি না? প্রয়োজনে আমরা অন্যকোথাও যেয়ে থাকবো। কবিতা কিছুতেই আমাদের সম্পর্কে জানবে না আমি বলছি তো। তারপরও তুমি…. ”
মৃণার কথা শেষ হওয়ার আগেই তীর্থ বলল, “এই বাচ্চাটা অবরশন করিয়ে নেও, আমি তোমার স্বামীর জন্য ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিব। তোমার সংসারে আর কোনো অভাব থাকবে না। সাথে তোমার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য তো আমি আছিই।”
“তীর্থ একটা প্রশ্ন করি?”
“হুঁ”
“তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”
কিছুক্ষণ চুপ থাকে তীর্থ। কিন্তু আজ প্রশ্নটা এড়িয়ে যায় না।
“ভালোবাসি। কিন্তু যতটা কবিতাকে ভালোবাসি তার আনাচে-কানাচেতেও তোমার জায়গা নেই।”
কথাটা শুনে শরীর জ্বলে উঠে মৃণার। কিন্তু সে জানে এই মুহূর্তে সে তীর্থকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। তাই সে বলে, “ঠিকাছে তুমি যা বলবে তেমনই হবে। কিন্তু তুমি আগের মতো আমাকে অবহেলা করতে পারবে না। আমার খুব কষ্ট হয় তুমি এমন অবহেলা করলে।”
তীর্থ হাসে। তার ধ্রুবর কথা মনে পড়ে, ” মৃণা কেবল তোর সাথে কেবল টাকার জন্য আছে। ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তোর টাকাকে।”
আজ ধ্রুবর কথার প্রমাণ পেল তীর্থ। এতক্ষণ ধরে বাচ্চাটা অবরশন করার বিরোধ করছিলো, অথচ এখন তার স্বামীর জন্য ভালো চাকরি ও তার সকল ইচ্ছা পূরণের অফার দেবার পরই সে তার কথা মেনে গেল?
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ধ্রুব ভুল বলে নি তাহলে।”
“কী বললে?”
“কিছু না।”
তীর্থ গাড়ি স্টার্ট দিলো।
.
.
মৃণা বাসায় এসে দেখে আইদ আগেই অফিস থেকে এসে পড়েছে। সে আসতেই তাকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় গিয়েছিলে?”
মৃণা একটু অবাকই হয়। আইদ কখনো তাকে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না। কখনো জানতে চায় না সে কোথায় গেছে। কিন্তু সে স্বাভাবিকভাবেই উওর দেয়, “রূপার সাথে দেখা করতে গিয়েছি।”
“ওহ।”
আইদকে গভীর চিন্তায় দেখা গেল। আইদ কী কোনোভাবে তাকে সন্দেহ করছে? না, এমনটা করতে দেওয়া যাবে না। তার বুকের ভেতর ভয় কাজ করলেও তা সে মুখে বুঝতে দেয় না।
মৃণা মিষ্টি করে হেসে আইদকে বলে, “আচ্ছা আগামীকাল তো তোমার ছুটি। চলো না আমরা কোথাও ঘুরতে যাই। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয় নি।”
“তুমি যেহেতু চাইছ যাব।”
“তুমি যে আমাকে একটা শাড়ি উপহার দিয়েছিলে ওই শাড়িটা পরবো। তুমি বলো তো তোমার কেমন সাজ পছন্দ, তোমার মন মতো সাজবো আগামীকাল।”
মৃণার এমন কথা শুনে আইদের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এঁকে এলো। সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।
মৃণা বলে, “আমি একটু ক্লান্ত। আমি গোসল করে আসি।”
মৃণা চলে গেল।
কিছুক্ষণ আগে আইদকে তার এক কলিগ ফোন করেছিলো। সে গর্ভবতী বলে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলো। গাইনি ডাক্তার। সেখানে না’কি সে মৃণাকে দেখেছে অন্য এক পুরুষের সাথে। আইদ বলেছিলো সম্ভবত সে ভুল দেখেছে। বলার পরও তার মনে খুঁতখুঁত লেগেই ছিলো। সম্ভবত মৃণার ব্যবহারে। এখন তা ভাবলেও নিজের উপর রাগ উঠে। কীভাবে এমনটা ভাবতে পারে সে? লজ্জা লাগা উচিত তার। মৃণা এদিকে তাদের সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে আর সে মৃণাকেই সন্দেহ করছে। আইদ নিজের চিন্তার উপর ধিক্কার জানালো।
.
.
পরেরদিন সারা বিকেল ঘুরাঘুরি করে আইদ ও মৃণা। প্রথমে হাতিরঝিলে যেয়ে ঘুরে আসে। তারপর সেখান থেকে যায় রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে খেয়ে দেয়ে দুইজনের মা বাবার জন্য খাবার নিয়ে বাসায় ফিরে তারা। বাসায় ফেরার পর আজব কান্ড ঘটলো। তারা দুইজন ঘরে প্রবেশ করতেই মৃণা এবং আইদের মা বাবা তাদের জড়িয়ে ধরে। যেন তাদেরই অপেক্ষা ছিলো। আইদের মা তো মৃণাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে, “তুই এতবড় খুশির খবর আমার থেকে লুকালি কেন হ্যাঁ? এসব খবর কেউ মা বাবার থেকে লুকায়? আমি কত খুশি বুঝাতে পারব না। আমি…আমি কি বলব তাও বুঝছি না। আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুক।”
মৃণা হতবাক। কি হচ্ছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
আইদের মা এবার মৃণাকে ড্রইংরুমে নিয়ে আরামে বসিয়ে যেয়ে একটা মিষ্টির প্লেট নিয়ে আসে। মৃণাকে মিষ্টি খাইয়ে আইদকে মিষ্টি দেয়। আইদ তো মিষ্টি পেয়ে একটা হাতে তুলে নেয়। তারপর জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কীসের জন্য এত খুশি তা তো বলো।”
আইদ মিষ্টিটা মুখে দিতে নিবে তখনই তার মা বলে, “তোর বাবা হবার মিষ্টি আর আমার দাদী হবার।”
আইদ থেমে যায়। তার মনে হলো সে ভুল শুনছে। আইদের মা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাদের ঘরে আবার একটি রাজকন্যা বা রাজপুত্র আসবে। আমাকে ‘দাদি’ বলে ডাকবে। আমার তো ভেবেই সুখ সইছে না।”
আইদের যেন মাথায় কাজ করছিল না। তার এবং মৃণার মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক এখনো তৈরি হয় নি। তাহলে মৃণা প্রেগন্যান্ট হয় কীভাবে? সে কিছু বলল না। শুধু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মৃণার দিকে।
মৃণা যেন পাথর হয়ে গেছে। তারা কীভাবে জানলো মৃণা প্রেগন্যান্ট। ভয়ে তার জান বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। সে আমতা-আমতা করে বলে, “আপনাদের কোথাও ভুল হয়েছে। আমি তো প্রেগন্যান্ট না।”
কথাটি শুনার সাথে সাথে হৈ-হুল্লোড়ের পরিবেশটি থমথমে হয়ে গেল।
তখনই মৃণার মা বলে, “আমি আজ তোর আলমারিতে তোদের বিয়ের এলবাম খুঁজতে যেয়ে প্রেগ্ন্যাসি কিটের প্যাকেট পেলাম।”
“টেস্ট করেছিলাম, নেগেটিভ এসেছে মা। তোমার সবাইকে বলার আগে আমার সাথে কথা বলা উচিত ছিলো।”
আইদ দ্রুত তার রুমে চলে গেল। তার পিছু গেল মৃণাও।।
মৃণার মা অসহায় গলায় বলে, “আসলেই দোষ আমারই। অযথা আমি সবার মনে খুশি জাগিয়ে দিলাম।”
আইদের মা তার বান্ধবীর মন খারাপ দেখে বললেন, “আরে এখানে মন খারপের কিছু নেই। ওদের বিয়ে হয়েছে কয়মাস। বাচ্চা তো পরে নেওয়া যাবে। এখন সবাই বসে মিষ্টি খাও। বাচ্চার খুশি না হলে কি হবে, আমাদের ছেলে বউ আজ প্রথম ঘুরতে গেল এই খুশিতে মিষ্টি নেও।”
মৃণা রুমের ভেতর যেতেই আইদ আর্তনাদ করে উঠে, “আমাদের মাঝে কিছু হয় নি তাহলে তোমার টেস্ট করবারই কী দরকার ছিলো?”
কেঁপে উঠে মৃণা। শঙ্কিত হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না কি উওর দিবে। সে জলদি করে একটি বাহানা বানাল, “ও…ওটা রূপার জন্য এনেছিলাম। ও ভাবছে যে…ও সম্ভবত প্রেগন্যান্ট। অনেক ভয়ে ছিলো তাই আমাকে বলে।”
বাহানাটার পরেও মৃণার বুকের ভেতর ভয় কমছিলো না। আইদ তার এই মিথ্যাটা বিশ্বাস করবে কি’না সে বুঝতে পারছে না।
“ওহ, সরি আমি অকারণে তোমার উপর সাথে উঁচু স্বরে কথা বললাম। না বুঝে এমনভাবে কথা বলাটা উচিত হয় নি।”
মৃণার জানে জান আসে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে হেসে বলল, “না, সমস্যা নেই। যাস্ট ভুল বুঝাবুঝি ছিলো।”
“আচ্ছা শুনো, আমার একটা কল করতে হবে অফিসের কাজে আসছি আমি।”
আইদ যাবার পর মৃণা একটু আগের ঘটনা মনে পড়ে। সবাই কত খুশি ছিল তাদের নিয়ে। একটি প্রাণ যে জন্ম নেয় নি সেও মানুষকে এতটা খুশি দিতে পারে? মৃণা তার পেটের উপর হাত রাখল। অদ্ভুত অনুভুতি হলো তার। এই পেটের ভেতর তার অংশ আছে। বুকটা কেঁপে উঠে তার। আর কেবল কয়দিন আছে এই অংশটা তার মাঝে। আগামীকাল অবরশনের জন্য ডাক্তারের সাথে কথা বলতে যাবে সে এবং তীর্থ আর ক’দিনে অবরশন করানো হবে। তার এই অংশটা এই পৃথিবীতে আসার আগেই চলে যাবে।
.
.
কবিতা গুণগুণ করে গান গেয়ে বেড়াচ্ছিলো। তার মনটা আজ ফুরফুরে। কেননা তীর্থ তার ওয়াদা রাখছে। সে আসলেই তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছে তাদেরকে খুশি রাখার। সব ঠিক করার। এর থেকে বেশি কী চাই তার? গতকালও তারা ফ্যান্টাসি কিনডমে যেয়ে ঘুরে আসে বাচ্চাদের সাথে। বাচ্চাদের খুশি দেখে তার মনটাও খুশিতে ভরে গেল।
আজ রাতেও তাদের বাহিরে যাবার কথা। রাতের খাবার বাহিরে খাবে সবাই মিলে। কুহু হবার পর এমনভাবে তারা ডিনারে হয়তো কখনো যায় নি। এই ছোট ছোট প্রচেষ্টাই তার মনে হাজারো সুখ বেঁধে দেয়। তীর্থের প্রতি সকল রাগ একপাশে রেখে কবিতা আজ তীর্থের মন মতো তৈরি হয়ে নিলো। তার পছন্দের সাদা শাড়ি পরেছে কবিতা। তার গোল নয়ন দুটোয় ভরেছে কৃষ্ণ কাজল। ঠোঁটে এঁকেছে গাঢ় লাল রঙের লিপ্সটিক। দুইহাত ভর্তি শুভ্র রঙের কাঁচের চুড়ি। আর কানে রূপালী কানেরদুল। একটউ বেলির মালা আনিয়ে খোঁপাতেও বেঁধেছে সে।
কলিংবেল বেজে উঠে। তীর্থ এসেছে ভেবে সে ছুটে গেল দরজার দিকে। যাবার পূর্বে একটিবার আয়নাতে নিজের দর্শন করে নিলো। ভালোই দেখাচ্ছে তাকে। একদম তীর্থের মন মতো সেজেছে সে।
দরজা খুলে তীর্থকে পেল না সে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আইদ। তাহিরার কলিগ। তার সাথে এর আগে পাঁচ ছয়বার দেখা হয়েছে কবিতার। কিন্তু সে হঠাৎ তার বাসায় কেন এলো সে বুঝতে পারলো না। সে নম্রভাবে বলল, “আরে আইদ তুমি? ভেতরে আসো।”
“সরি আপনাকে এই সময়ে ডিস্টার্ব করলাম। কোথাও বাহিরে যাচ্ছিলেন?”
“একটু পর তীর্থ আসলে যাব। ফ্যামিলি ডিনারে যাবার কথা।”
আইদ এইবার কিছু বললো না। কবিতার পিছনে ড্রয়িংরুমে গেল সে। কবিতা তাকে বসিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে এলো।
“চা খাবে?”
“না আপু। একটু বসবেন, কথা আছে।”
আইদ বসলো। বিনয়ীভাবে জিজ্ঞেস করল, “তাহিরা আপুকে নিয়ে কিছু?”
আইদ মাথা নাড়ায়। তার অস্বস্তি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তার মুখে। সে গ্লাসটা উঠিয়ে একবারেই পানি শেষ করলো। তারপর আমতা-আমতা করে বলল, “আপু জানেন, তাহিরা আপু আমার সিনিয়র হলেও উনি আমাকে ছোটভাইয়ের মতো আদর করে। সে সুবাদে পরিবারের অনেক কথা আমাকে বলেছে। আপনার কথাও বলেছে।”
কবিতা হাসে, “তোমার কথাও বলেছে। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার ছোট যেভাবে আপু করে ডাকতে। তারপর জানলাম আমরা সেইম এইজ। তাও আপু বলে ডাকছ।”
“এমনিতেই ডাকতে ইচ্ছা করলো। আশা করি রাগ করবেন না।”
“রাগ করবো কেন? তুমি বলো।”
“তাহিরা আপুর কাছ থেকে আপনার আর তীর্থের কথাও শুনেছি। আপনি না’কি তাকে অনেক ভালোবাসেন। অনেক বেশি।”
“হঠাৎ করে এসে এই কথা জিজ্ঞেস করছো যে?”
ব্যাপারটা খুবই আজব লাগলো কবিতার কাছে তাই না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারলো না।
“আপনি কী আজ উনার জন্যই সেজেছেন?”
“হ্যাঁ, একটু বেশি সাজ হয়ে গেছে কিন্তু প্রথমবার আমাকে শাড়িতে এভাবে দেখেই প্রশংসা করেছিলো ও। জানো ও নিজের মনের কথা খুব কম বলে। আমি প্রথমদিন ওর মুখ থেকে প্রশংসা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমার থেকে ওর বন্ধুরা বেশি হয়েছে। যেন এটা অসম্ভব কিছু।”
আইদ ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করে, “উনি আপনাকে ভালোবাসে।”
“অনেক বেশি।”
বুক চিরে আফসোসের নিশ্বাস বেরিয়ে আসে আইদের।
“আপু আমার মৃণার সাথে বিয়ে হয়েছে। ওকে চিনেন?”
“মৃণা? ও হ্যাঁ, তীর্থের অফিসে কাজ করে ও?”
“ও প্রেগন্যান্ট।”
কবিতা উৎসুক হয়ে বলে, “বলো কী? কনগ্রেটস। ওকেও আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিও।”
আইদ কবিতার সামনে একটি কাগজ বের করে বলল, “আমি আপনার খুশিতে আগুন লাগাতে চাই না কিন্তু আপনার একথা জানা উচিত।”
“তোমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট তা আমার জানা উচিত? খুশিতে আগুন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“আমার আপনার কষ্টের কথা আন্দাজও করার মতো সামর্থ্য নেই। কিন্তু আপনার এটা দেখা উচিত। এই বিষয়ে আপনি না জানলে আপনার নিজের প্রতি অন্যায় হবে। আর আমি এই অন্যায় করতে চাই না।”
কবিতা আইদের কথা কিছুই বুঝতে পারে না। সে কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে মৃণার প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট।
“তুমি আমাকে এই রিপোর্ট কেন দিচ্ছো?”
“স্বামীর স্থানে নামটা দেখুন।”
কবিতা চোখ বুলায় কাগজটিতে। তীর্থের নাম দেখে সে চমকে উঠে। তখনই আইদ বলে,
“মৃণার গর্ভের সন্তানই আমার না। আমাদের এখনো এমন কোনো সম্পর্ক হয় নি যে মৃণা আমার সন্তান তার গর্ভে ধারণ করতে পারবে।”
কবিতার শরীর কাঁপতে শুরু হয় রিপোর্টটা দেখে কিন্তু সে বিশ্বাস করতে নারাজ যে তীর্থ এমন কিছু করতে পারে। সে উঠে আর্তনাদ করে উঠে, “এটা ভুল, মিথ্যা। আমি…আমি জানি তীর্থ এমন কিছু করতে পারে না। বাংলাদেশে আর তীর্থ হাসান থাকতে পারে না?”
আইদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। তার ফোন বের করে বলে, “আমার এক কলিগ ক’দিন আগে আপনার স্বামীর সাথে মৃণাকে গাইনি বিশেষজ্ঞ এর কেবিন থেকে বের হতে দেখেছে। ও আমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিলো আমি বুঝে গেলাম। নিজেকে ধিক্কার দিলাম ওর জন্য এতটা খারাপ ভাবতেও। গতকাল মৃণার মা আলমারি থেকে প্রেগ্ন্যাসির কিট পেয়ে, তাও ভুল বুঝিয়ে দিলো। কিন্তু এবার আমি খোঁজ নিলাম। রাতে আমার কলিগকে কল দিয়ে ডাক্তারের খোঁজ নিয়ে আজ তার সাথে দেখা করতে যাই। তারাও না’কি আজ দেখা করতে গিয়েছে তার সাথে। বাচ্চা অবরশন করার জন্য। ডাক্তারকে আমি সব বুঝানোর পর তিনি আমাকে এই কপিটা দিলো। আর আমি আপনাকে দেখাতে চাই আমি কি দেখেছি আসার সময়।”
আইদ একটি ছবি দেখলো। গ্যারাজে নেওয়া ছবিটি। ছবিটিতে একটি মেয়ে তীর্থকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
ছবিটি দেখে নিশ্বাস আটকে গেল কবিতার। সে এক পা পিছাতেই সোফার সাথে পা লেগে বসে পড়ে সে। পাথর হয়ে গেছে সে। বহুকষ্টে কাঁপা-কাঁপা নিশ্বাস ফালায় সে।
বুকের ভেতর অঝোরে তুফান বয়ে গেল। সে নিশ্চিত এটা কোনো স্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন। তীর্থ কখনো তার সাথে এমন করতে পারে না। তার মনে হলো। এই স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
কিন্তু আফসোস!
এই দুঃস্বপ্ন থেকে সে আর জাগলো না।
চলবে…