মুহুর্তে পর্ব -৩৩+৩৪

#মুহূর্তে
পর্ব-৩৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ছবিটি দেখে নিশ্বাস আটকে গেল কবিতার। সে এক পা পিছাতেই সোফার সাথে পা লেগে বসে পড়ে সে। পাথর হয়ে গেছে সে। বহুকষ্টে কাঁপা-কাঁপা নিশ্বাস ফালায় সে।
বুকের ভেতর অঝোরে তুফান বয়ে গেল। সে নিশ্চিত এটা কোনো স্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন। তীর্থ কখনো তার সাথে এমন করতে পারে না। তার মনে হলো। এই স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
কিন্তু আফসোস!
এই দুঃস্বপ্ন থেকে সে আর জাগলো না।

আইদ চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “আপু ঠিক আছেন আপনি?”

কবিতা এক ঢোক গিলে। তার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে একবিন্দু জল। সে হাতের উল্টোপাশ দিয়ে গাল মুছে নিশ্বাস আটকে রাখে। চেষ্টা করে না কান্না করার। কান্নাভেজা গলায় উওর দেয় আইদের প্রশ্নের, “ঠিক আছি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইদ, “আমি জানি এই মুহূর্তে এমন প্রশ্ন করাটা অহেতুক। যেখানে আমি মৃণার বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করতে পারছি না সেখানে আপনি এতবছরের ভালোবাসার পর, সংসার করার পর….। আমি ভাবতেও পাড়ছি না আপনার উপর কি যাচ্ছে এই সময়। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো এইকথা জানার পর আপনি এত বড় ধাক্কা সহ্য করতে পারবেন না। কিন্তু না জানিয়েও থাকতে পারলাম না। এই লোকটা আপনার যোগ্য না, আপনার এই চোখের পানিরও যোগ্য না। স্ত্রী ঘরে থাকতে সে কীভাবে অন্যকোনো নারী সাথে…” এক মুহূর্ত সময় নেয় আইদ। নাক ছিটকে আবার বলে, “ছিঃ! আমার ভাবতেও ঘৃণা লাগছে। আপু যদি আমি ভুল করি, আমাকে ক্ষমা করবেন।”

কবিতা উঠে দাঁড়ায়। মাথা নাড়িয়ে বলে, “না, ভুল করো নি। হয়তো তুমি না জানালে আমি কিছু জানতাম না। আগের মতোই বাঁচতাম। কিন্তু জানতাম না যার সাথে বাঁচতাম সে কত সুন্দর করে ধোঁকা দিতে জানে। জানো, আমি অন্ধভাবে বিশ্বাস করতাম তাকে। আমার বিশ্বাস ছিলো আমাদের মাঝে যতই দূরত্ব হোক, সে আমাকে ভালোবাসে। সব নাটক ছিলো। আমাদের ভালোবাসা, আমাদের সম্পর্ক, সব, সবটা। তুমি না দেখালে হয়তো সারাজীবনই এই মিথ্যাতেই আমি বাঁচতাম।”
“এখন কী করবেন আপু?”

কবিতা তাচ্ছিল্য হাসে। তার চোখদুটো ঝরাতে থাকে অবাধ্য জল। সে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, “সেটাই তো। কী করব? কী করব আমি? মুহূর্তের মাঝে আমার জীবনটা কি হয়ে গেল? আমার সুন্দর সংসারের স্বপ্নটা এত নিঁখুতভাবে চুরমার হয়ে গেল?”
আইদ কিছু সময় নিরবতা পালন করে বলে, “আমি কি বলব জানি না। এতটুকুই বলব, আপনার যা ঠিক মনে হয় তা করুন। আমি কোনো উপদেশ দিবে না। আমি জানি আপনি ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন না। আপনার সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কিছু একাকিত্ব সময় প্রয়োজন। আমি যাই।”
কবিতা কিছু বলল না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।

আইদ যাবার পর কবিতা প্রথমে যেয়ে বাচ্চাদের রুমে যেয়ে তাদের বুঝিয়ে বলে সে রুম থেকে বের হতে না এবং কাব্যকে বলে কুহুর খেয়াল রাখতে। দুইজনকে আদর করে দিয়ে বের হয়ে দরজা বাহির লাগিয়ে দেয় সে। তারপর নিজের রুমে যেয়ে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে থাকে। প্রথমে কিছুক্ষণ নিশ্বাস আটকে রাখে, তারপর গভীর নিশ্বাস ফেলতে শুরু করে। কাঁপানো নিশ্বাস। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে সে। নিজের চোখের জল আটকানোর চেষ্টা। রাগে, কষ্টে, ঘৃণায় তার শরীর কাঁপছে।

চোখের জল আটকানোর চেষ্টা ব্যর্থ গেল। তার গাল বয়ে ঝরতে থাকে একের পর এক জলের বিন্দু। তার বুকের ভেতর দাবিয়ে থাকা কষ্ট আর্তনাদ হয়ে বের হয়। হাহাকারে মেতে উঠে চারপাশ। কবিতা ড্রেসিংটেবিলের থেকে একটি কাঠের বাক্স নিয়ে আয়নার দিকে ছুঁড়ে মারে। মুহূর্তে কাঁচগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কয়েকটি কাঁচ এসে লাগেও কবিতার দেহে। কেঁটে যায়। রক্ত ঝরে। তবুও যেন তার এই আঘাতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না। সে একটানে তার খোঁপার ফুল খুলে ছুঁড়ে মারে কক্ষের অপরপাশে। তার হাঁতের কাঁচের চুড়ি আক্রমণাত্মকভাবে খুলতে যেয়ে কতগুলো চুড়ি ভেঙে তার হাত কেটে যায়। নিজের চুল আঁকড়ে ধরে ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সে বসে পড়ে মেঝেতে।

কবিতার চোখের সামনে ভেসে উঠে তীর্থের ছবি। তার বুকে অন্যকোনো মেয়ে ছিলো। যে তীর্থ তাকে বিয়ের আগে ছুঁয়ে দেখে নি সে তীর্থ আজ অন্যকারো সাথে সম্পর্ক করেছে? বিশ্বাস হচ্ছে না তার, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু নিজের চোখে দেখা মুহূর্তটাও সম্পূর্ণ নির্ভুল হতে পারে না। এই কারণেই কী তীর্থ তার থেকে এতটা দূর হয়ে গেছে? অচেনা হয়ে গেছে সে?
এতটা বোকা কীভাবে হলো সে?
তীর্থের অবহেলা, সময় না দেওয়া সব তার সামনে ছিলো তবুও সে একটুখানিও সন্দেহ করতে পারলো না? কবিতার হঠাৎ মনে পড়ে সেদিন যখন মৃণার জন্য তাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিলো তীর্থ। সেদিনও কীভাবে বিষয়টা স্বাভাবিক নিলো কবিতা? যেখানে তীর্থ তার জন্য সব কাজ ছেড়ে দিতো, সেখানে তীর্থ তাকে এভাবে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল অথচ সে কিছু ধরতে পাড়লো না?
কত বছরের সম্পর্ক দুইজনের?
একবছর? দুইবছর? তিনবছর? চারবছর? না এর থেকেও বেশি?
ভাবতেই দম আটকে এলো তার।
তীর্থ অন্যনারীকে ছুঁয়ে এসে তাকে স্পর্শ করতো ভেবেই তার শরীরটা ঘিনঘিন করতে শুরু করে।
.
.
প্রায় একঘন্টা পর অফিসের কিছু কাজ সেরে তীর্থ বাসায় এসে দরজা খোলা পায়। আশেপাশে কাওকে দেখতে পায় না সে। আজ তাদের বাহিরে খেতে যাবার কথা। সবাই কোথায়? কেউ তৈরি হয় নি?

তীর্থ আজ এতদিন পর শান্ত মাথায় বাসায় ফিরলো। ডাক্তারের সাথে কথা বলে এসেছে সে। দুইদিন পর মৃণার অবরশন করানো হবে। সব কাজ শেষ। বাচ্চাটা না থাকলে কোনো ঝামেলাও থাকবে না। মৃণাকে সে সামলে নিতে পারবে। তার সাথে সাপ্তাহে একবার দেখা করলে এবং তার পছন্দের জিনিসপত্র কিনে দিলেই যথেষ্ট। এছাড়া আইদের ভালো জায়গায় চাকরি করিয়ে দিলে মৃণা আর তাকে জ্বলাবেও না। সে এখন নিজের ভুলটা ধরতে পারছে। মৃণার প্রতি সে একটু বেশিই দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। তাই কবিতাকে সময় দেয় নি সে। ধ্রুবর কথা ঠিক, জীবনে ব্যালেন্স রাখা জরুরী। সে যদি কবিতা এবং তার পরিবারকে সময় দেয় তাহলে মৃণার সাথে একটু সময় ব্যয় করলেও কখনো সে ধরা পড়বে না। এমন করে দুইদিকেই সব ঠিক রাখতে পারবে সে। ভেবেই কেমন শান্ত হয়ে গেল তার মন। বহুদিন পর চিন্তামুক্ত হলো।সে। এখন কেবল কবিতার অভিমান ভাঙাতে হবে। ব্যাপারটা এতটা কঠিনও না।

তীর্থ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “কবিতা তোমরা কোথায়? দরজা খুলে রেখেছ কেন? আর তৈরি হয়েছ তুমি? আমরা দশমিনিটেই বের…. ”
রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই থমকে যায় তীর্থ। সম্পূর্ণ রুম এলোমেলো। মেঝেতে ভাঙা কাঁচ ভরা। জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আছে। বিছানায় বসে আছে কবিতা। নিরব। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে তার। সে দৌড়ে যেয়ে কবিতার সামনে বসে। দুইহাত দিয়ে কবিতার চুল মুখ থেকে সরিয়ে অস্থির হয়ে বলে, “কবিতা…কবিতা কী হয়েছে? ঘরের এই অবস্থা কেন? তোমার কী হয়েছে?”

কবিতা চোখ তুলে তাকাল। অগ্নি দৃষ্টি। সে দৃষ্টি দেখেই বুকের ভেতর কামড়ে উঠে তীর্থের। কবিতা তীর্থের বুকে হাত রেখে এক ধাক্কা দিলো। তীর্থ মেঝেতে পড়ে যায়। কাঁচ হাতে লেগে খানিকটা কেটে যায় তার হাত। সে মেজাজ খারাপ করে তাকায় কবিতার দিকে, “তোমার মাথা ঠিক আছে? কী করছো তুমি?”

কবিতা উঠে দাঁড়ায়। শান্ত গলায় উওর দেয়, “না, আমার মাথা ঠিক নেই। একদম ঠিক নেই। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
“তোমার কান্ড দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।”
তীর্থ বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাতের থেকে কাঁচ বের করে কবিতার দিকে তাকায়। সে মাত্র খেয়াল করে কবিতার হাত পায়ের অনেক অংশ কেটে গেছে। সে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে হাত কবিতার কাছে। চিন্তিতসুরে বলে, “তোমার কী অবস্থা হয়েছে? নিজের কী অবস্থা করেছ তুমি? শরীরের কতগুলো জায়গায় কেটে গেছে তোমার।”

তীর্থ যত্ন করে কবিতার হাত থেকে কাঁচ বের করতে জুটে গেল। কবিতা তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তার এমন অস্থিরতা, এমন যত্ন, তার দৃষ্টি দেখেই সে একসময় চিন্তা করেছিলো এই লোকটার মতো এই পৃথিবীতে হয়তো অন্যকোনো পুরুষ তাকে ভালোবাসতে পারবে না। ভালোবাসা?
শব্দটা শুনেই তার ঘৃণা হলো।
ধিক্কার দিতে মন চাইলো তার এই ভালোবাসা শব্দটাকে।

কবিতা ভেজা দৃষ্টি নিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো তীর্থের দিকে। দেখতে থাকলো তার যত্নসহকারে তার হাতের কাঁচ বের করাটা। একসময় সে শান্ত গলায় বলল, “শুনো।”
“বলো শুনছি।”
“তোমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।”
“প্রয়োজন নেই? নিজের কী অবস্থা করেছ তুমি? তোমার শরীরের এই ক্ষত কী যাবে সহজে?”
তাচ্ছিল্য হাসে কবিতা, “এতে তোমার চিন্তা করার প্রয়োজন কোথায়? আমাকে ছুঁতে না পারলে রাতে অন্য এক নারীর বিছানায় চলে যাবে তুমি।”

চমকে উঠে তীর্থ। আচমকায় তাকায় কবিতার দিকে। বিস্ময় নিয়ে কিছু সময় তাকিয়েই থাকে। তার চোখদুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে এক ঢোক গিলে, “কী…এসব কী বলছো তুমি? মাথাতো ঠি..ঠিক আছে তোমার?”

কবিতা তীর্থের হাত এক ঝাড়ন দিয়ে সরিয়ে দেয়। চিৎকার করে উঠে সে, “আমার মাথা কোথা থেকে ঠিক থাকবে? আমি যাকে নিজের সম্পূর্ণ পৃথিবী মেনে নিয়েছিলাম সে মানুষটাকে আজ আমি অন্য নারীর বাহুতে দেখেছি। কোথা থেকে মাথা ঠিক থাকবে আমার?”
কবিতা এবার তীর্থের কলার চেপে ধরে বলে, “লজ্জা লাগে নি তোর? আমার কথা একবারও মাথায় আসে নি তোর। তুই না আমাকে ভালোবাসিস? এই ভালোবাসা তোর? আমাকে এই জীবনে তুই কষ্ট ছাড়া কিছু দেস নি। আমি সব সহ্য করেছি, ভেবেছিলাম আর যাই হোক না কেন, তুই আমাকে ভালোবাসিস।”

তীর্থ স্তব্ধ হয়ে রইল কতক্ষণ। আর যখন মৃণা তাকে জড়িয়ে ধরেছিলো তখন দেখেছে কবিতা? কিন্তু কীভাবে? তার তো হাস্পাতালে যাওয়ার কথা না।
কী সর্বনাশ হয়ে গেল!
আপাতত এসব ভেবে লাভ নেই কবিতাকে যেভাবেই হোক বুঝাতে হবে তার। সে কবিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি ভুল ভাবছো কবিতা। ওই…ওইটা মৃণা ছিলো। ওর স্বামী ওর উপর অনেক অত্যাচার করে। মারধর করায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আসার সময় হঠাৎ ও কান্না করতে করতে জড়িয়ে ধরে। প্লিজ তুমি আমাকে এভাবে বলো না। শান্ত হও প্লিজ।”

“তো ওকে এভাবে সান্ত্বনা দিতে দিতেই ওর গর্ভ তোমার সন্তান এসে পড়েছে।” আকস্মিকভাবে কবিতার মুখে এই কথা শুনে তীর্থ তাকে ছেড়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়। তার কাঁপুনি ধরে যায়। ভয়ে তার জান যেন গলায় আটকে আসছে। সে কাঁপানো গলায় বলল, “কবিতা আমার কথা শুনো…”

কবিতার তীর্থের মুখ থেকে একটা শব্দ শুনতেও ইচ্ছা হলো না। সে এক ধাক্কায় তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “কী শুনব? কত নিঁখুতভাবে আমার বিশ্বাস ভেঙে দিলে তুমি? আচ্ছা তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে তাই না? একে ভালোবাসা বলে? আচ্ছা যখন তুমি ওই মেয়ে ছুঁয়ে এসে আমাকে ছুঁতে তখন কী তোমার একবারও মনে হতো না তুমি ভুল করছো? এক মুহূর্তের জন্যও না? তোমার মনে হতো না আমার প্রতি তুমি কত বড় অন্যায় করছ? তোমার এই সত্যিটা জানার পর আমি যদি তোমাকে ছেড়ে দেয়, তোমার সংসার আর না করি, আমি যদি নিজেকে কিছু করে ফেলি তাহলে? তোমার এতে কিছু আসে যায় না? আমার রাগ, কষ্ট, আঘাত, আমি মরে গেলেও তোমার কিছু আসবে যাবে না, তাই না? উওর দেও। উওর দেও আমার প্রশ্নের।”

কবিতার দম আটকে এলো কথাগুলো বলতে বলতে। সে ঘন নিশ্বাস নিতে শুরু করে। হঠাৎ করে তার নিজেকে খুব দুর্বল লাগতে শুরু করে। অবশ হয়ে আসে তার শরীরটা। তবুও সে তার প্রশ্নের উওর নিয়েই ছাড়বে। সে তীর্থের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে জিজ্ঞেস করে, “তোমার লজ্জা লাগে নি আমার সাথে এমন কিছু করতে? অন্য একটা মেয়ের গর্ভে তোমার সন্তান…..ছিঃ! তুমি একবারও আমার এবং আমাদের বাচ্চার কথা চিন্তা করো নি?” কবিতার এমন প্রশ্নে শুনে কিছু বলতে পারলো না তীর্থ। আজ হঠাৎ বাসায় এসেই এমন একটা পরিস্থিতির সামনে পড়তে হবে এই কথা সে ভাবতেও পারে নি। আতঙ্কে, অপরাধে, শঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে গেছে। কবিতা এমন প্রশ্নে কী উওর দিবে সে? সে যে সত্য বলছে।

তীর্থ কবিতার সাথে দৃষ্টি মিলাতে পারছে না। তবুও সে চোখ উঠিয়ে লুকিয়ে একবার কবিতার দিকে তাকাল। কান্নায় তার চোখ দুটো ফুলে গেছে। চোখ এবং চোখের আশেপাশে সবটা লালচে হয়ে গেছে। রাগে তার দাঁত কাঁপছে। তার ঠোঁট কেটে রক্ত ঝড়ছে। তার ফর্সা মিষ্টি মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। তার ডান হাতটাও সম্পূর্ণ রক্তাক্ত। সমানে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। সে আবারও আর্তনাদ করে প্রশ্ন করে, “আমি উওর চেয়েছি, উওর দেও আমাকে।”
কবিতা বিছানা থেকে উঠিয়ে তার হাতের রিপোর্টটা তীর্থের মুখের উপর ছুঁড়ে মারে, “এই রিপোর্টের মানে কী? এই রিপোর্টটা কী সত্যি?”

তীর্থ নিথর দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। তার দৃষ্টি নিচে পরা কাগজের উপর। সে এতক্ষণ খেয়াল করে নি কিন্তু আইদের নতুন চাকরির পেপারস সেখানে। মৃণার সাথে গতমাসে বাংলাদেশ থেকে বাহিরে ঘুরতে যাবার প্লান ছিলো তার। এই সুবাদে সে তাদের টিকিট কিনে রেখেছিলো। কিন্তু এসব ঝামেলার কারণে কিছু হলো না। তার এই টিকিটেরর কথা মনেও ছিলো না। আলমারির ড্রয়েরে লুকিয়ে রেখেছিলো সে। তার ড্রয়ের কখনো কবিতা ধরে নি। তাই নিশ্চিন্তে ছিলো সে। কবিতার কাছে আরেকটা চাবি আছে বলেও সে জানতো না। এখন কী বলবে সে? কী উওর দিবে? আরেকটা মিথ্যা? সব সত্যি কবিতার সামনে। সে এসব আর লুকাতে পারবে না। তাই মিথ্যা বলে কবিতার রাগ আর বাড়ানোটা উচিত হবে বলেই ভাবলো সে। তাই সে উওর দিলো “হুম সত্যি।”

উওরটা শুনতেই কবিতার আটকে থাকা নিশ্বাস গভীর ভাবে বেরিয়ে আসে। তার নিশ্বাসটা কাঁপা-কাঁপা। দৃষ্টি ঘোলা। নিজেকে সামলাতে না পেরে কবিতা মেঝেতে বসে বসে। সারা কক্ষে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে ছিলো ভাঙা কাঁচ। কবিতা বসতেই তার হাতে পায়ে ঢুকে পড়ে কিছু কাঁচের টুকরো। কিন্তু সে ‘টু’ শব্দও করে না।

তীর্থ তার দিকে এগিয়ে এসে তাকে ছুঁতে নিলেই কবিতা কঠিন গলায় বলে, “আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টাও করবে না। আমি তোমার চেহেরা দেখতে চাই না। চলে যাও এইখান থেকে।”
তীর্থ কি মনে করে তবুও সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর চলে গেল।

কবিতা সেখানেই বসে ছিলো। রুমের বাহিরে থেকে কুহু ও কাব্যের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবুও কবিতা দৌড়ে যেয়ে তাদের কান্না থামাচ্ছে না। এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ পৃথিবীটা মিথ্যে লাগছে তার। যে মানুষটার জন্য সে তার জীবনের এত বড় ত্যাগ করলো অবশেষে সে মানুষটাই তার সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলো? আচ্ছা সে অতীতে সে অন্য সিদ্ধান্ত নিলেও আজ কি তার সাথে এমন হতো?

সে যদি তার পরিবারকে ছেড়ে তীর্থের কাছে না আসতো তাহলে কী তার আজও আফসোস হতো?
সে যদি তীর্থের দৃষ্টিতে ডুবে তাকে ভালো না বাসতো তাহলে কী আজ এমন বেদনা সহ্য করতে হতো তার?
সে যদি তীর্থের মন মতো থাকতো তাহলেও কী আজ তীর্থ তার সাথে এমন প্রতারণা করতো?
সব কী তার দোষ? তার ভুল? তার জীবনের সকল সিদ্ধান্তই কী ভুল?

কবিতা মাথায়টা ঠেকাল আলমারিতে। তার চোখের কোণে দিকে বয়ে পড়লো কিছু বিন্দু দুঃখ।
.
.
তীর্থ রুম থেকে বাহির হয়ে পাশের রুম থেকে শব্দ পায়। কান্নার শব্দ। রুমে যেয়ে দেখে কুহু কাঁদছে। খিদায় কাঁদছিলো সে। সে কুহুর কান্না থামিয়ে গেল সবার জন্য খাবার আনতে। আধাঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসে সে। ঘরের ভেতর ঢুকেই দেখে অনুকে। সে কাব্যকে নিয়ে বাহিরে যাচ্ছিলো। ভয়ে তীর্থের জান গলায় আটকে এলো। সে হাতের খাবারের প্যাকেট সেখানে ফালিয়ে দৌড়ে গেল অনুর কাছে। কাব্যকে তার হাত থেকে ছাড়িয়ে আতঙ্কিত স্বরে বলে, “আমার বাচ্চাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো তুমি?”
অনু তাকে উপেক্ষা করে কাব্যকে আবার নিজের কাছে টেনে বলল, “আপনাকে জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। আর আপনি যা করেছেন কোন মুখে প্রশ্ন করছেন আপনি?”

“অনু,” কবিতা দরজার কাছে এসে ডাকে তাকে। তার কোলে কুহু এবং পাশে লাগেজ। সে কুহুকে অনুর কোলে দিয়ে বলল, “বাচ্চাদের নিয়ে বাহিরে যা। আমি আসছি। ওদের সামনে এসব কথা বলিস না।”

তীর্থ অনুর যাওয়ার অপেক্ষা করলো। কবিতা লাগেজ নিয়ে এগোতে নিলেই তীর্থ তাকে ধরে নেয়।
“কবিতা…কবিতা দেখ আমি জানি আমি ভুল করেছি। কিন্তু প্লিজ আরেকবার সুযোগ দেও। আমি সব ঠিক করে দিব। সব। আর কখনো ভুল হবে না কবিতা, আর কখনো না।”
“ভুল? তোমার মনে হয়েছে তুমি যা করেছ তা ভুল? ওটা ভুল না তীর্থ। অপরাধ, গুনাহ, পাপ। আর গুনাহের ক্ষমা হয় না। ভুল মানুষ না বুঝে করে। যখন তুমি পরকীয়া করছিলে তখন তুমি বুঝো নি তুমি আমার বিশ্বাস ভাঙছো? তোমার জন্য কী করি নি আমি? তোমার মায়ের সকল অত্যাচার সহ্য করেছি। এত বড় একটা ঘরে উনি আমাকে একজন সাহায্য করার জন্য রাখতে দেয় নি, সব কাজ আমি একা করেছে, সকাল ছয়টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত একটানা খেটেছি এই সংসারে। কোনো ভুল না থাকলেও উনি কোনো না কোনো বাহানায় আমাকে জ্বালাতো। কুহু হবার সময় আমাকে ঠিক মতো খাওয়া দেয় নি উনি, এমনও হতো সারাদিন একবেলা খেয়ে খাটাতাম আমি। এমন না যে অভাব ছিলো, উনার মনে খোঁট ছিলো। সব জানার পর তুমি আমার জন্য লুকিয়ে খাবার এনে দিতে কিন্তু একদিনও আমার জন্য কথা বলো নি তুমি। একবারও বলো নি উনি অন্যায় করছে আমার উপর। যাক, আমি সহ্য করেছি। তুমি উনার কারণে আমার সাথে ঝগড়া করতে, আমি সহ্য করলাম। তুমি আমাকে অবহেলা শুরু করলে, আমি তা এড়িয়ে গেলাম। আমার অপমান করলে, আমি ক্ষমা করলাম। আমি সব সহ্য করেছি। আচ্ছা তীর্থ তোমার মনে আছে আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমি তোমার সব ভুল ক্ষমা করতে পারবো কিন্তু আমার বিশ্বাস ভাঙলে সে বিশ্বাস ভাঙার ক্ষমা তুমি কখনো পাবে না। কখনোই না।”

তীর্থ কবিতার দুইকাঁধ ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমাদের ভালোবাসার দোহাই দিলাম কবিতা। একটিবার আমাকে সুযোগ দেখ। আমি মরে যাব তোমাকে ছাড়া।”
“ভালোবাসা?” তাচ্ছিল্যের সাথে কবিতা বলল, “ভালোবাসা বলতে এই পৃথিবীতে কিছু নেই। থাকলে একটিবার হলেও তো তোমার বুক কাঁপতো আমার জন্য। আচ্ছা তীর্থ তোমার মনে আছে মিদুলের মা’য়ের কথা? তোমার সামনেই তো তার আত্নহত্যার ঘটনা ঘটেছিলো। তার মতো যদি আমিও মরে যেতে চাইতাম?”

কথাটা শুনতেই বুক কেঁপে উঠে তীর্থের। সে দৃশ্যটা সে কল্পনাও করতে পারে না।

কবিতা নম্র চোখে তাকাল তীর্থের দিকে। কাঁপানো গলায় বলল, “তুমি আমাদের সম্পর্কের সাথে সাথে আমাকেও ভেঙে দিলে। তোমার এতে কিছু হয় নি। শুধু আমার মনে হচ্ছে আমার ভেতরটা শূন্য হয়ে গেছে। আমার হৃদয়ের হাজারো টুকরো হয়ে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছি আমি। যে মানুষটার জন্য আমি আমার পৃথিবী ছেড়ে এলাম সে মানুষটার কাছে আমার কোনো মূল্যই ছিলো না। জানো তীর্থ? আমার তোমার থেকে বেশি নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। এই ভেবে যে আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।”
#মুহূর্তে
পর্ব-৩৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“আমার তোমার থেকে বেশি নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। এই ভেবে যে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি।”

তীর্থ অস্থির হয়ে বলল, “আমার সত্যি ভুল হয়ে গেছে কবিতা। আমি ইচ্ছা করে কিছু করি নি। আমি সাজেকে গিয়েছিলাম মনে আছে? ধ্রুব জোর করে নেশা করালো আমায়। সেদিন ভুলে…ভুলে আমি মৃণার সাথে…”
কথাটা সেখানেই থামিয়ে দেয় কবিতা, “সিরিয়াসলি আমাকে এতটা বোকা মনে হয় তোমার? তুমি সাজেক গেছো প্রায় দুইবছর হবে। তুমি আমাকে বলতে চাইছো তোমার দুই বছর আগে হওয়া ভুলে এখন মৃণা প্রেগন্যান্ট?”

তীর্থ আবারও কাঁপানো গলায় বলে “না… না। আমি ওটা বলতে চাইছি না। এরপর থেকে ওর জন্য খারাপ লাগতো এই ভেবে যে ওর জীবন আমি নষ্ট করে দিয়েছি। এর উপর ঘরের এত অশান্তি আমার সহ্য হচ্ছিলো না। আমার দম আটকে আসছিলো। তাই ধ্রুবর কথায় এসে পড়েছিলাম আমি। ও বলেছিলো বাহিরে অন্যমেয়ের সাথে সম্পর্ক করলে এই অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। বিশ্বাস করো আমি ওর কথা কানে নেই নি। তারপর আমার সিলেটে ধ্রুবর সাথে যাবার কথা ছিলো সেখানে ধ্রুব মৃণাকে পাঠিয়ে দেয় নিজের জায়গায়। আর সেখানে এক রাতে মৃণা আমার কাছে আসে….কবিতা সেরাতে ওকে অনেকটা ওকে তোমার মতো দেখাচ্ছিলো। ঠিক তোমাকে আমি যেদিন প্রথম দেখেছিলাম। আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম।” তীর্থ কবিতার গালে হাত রেখে বলল, ” বিশ্বাস করো, যতবার আমি ওর কাছে গিয়েছি কেবল তোমাকেই মনে করেছি।”

কবিতার শরীর ঘিনঘিন করে উঠে। সে পিছিয়ে যায় সাথে সাথে। চিৎকার করে বলে, “আমাকে স্পর্শ করবে না খবরদার। তোমার ছোঁয়াতেও আমার ঘৃণা পায়। তুমি আমাকে মনে করে ওই মেয়ের কাছে যেতে? আর ইউ ফাকিং কিডিং মি? আমি তো মরে গিয়েছিলাম তাই না তাই তুই আমাকে মনে করে ওই মেয়ের কাছে যাইতি। এইখানে আমাকে কষ্ট দিয়ে ওর কাছ থেকে শান্তি খুঁজছিলি তুই?” রাগে, ক্ষোভে কবিতার শরীর কাঁপছিলো কবিতার। সে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। তারপর বলে, “কত সুন্দর বাহানা তাই না? তুমি এই অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পরকীয়া করেছ। সে হিসেবে তো আমার দশটা পুরুষের সাথে শোয়া উচিত ছিলো।”
“কবিতা!” চিৎকার করে উঠে তীর্থ। কথাটা যেন তার শরীরে সূঁচের মতো লাগলো।

কবিতা তিথির মুখের সামনে আঙুল তুলে কঠিন গলায় বলে, “চুপ। আমার সামনে উঁচু গলায় কথা বলার চেষ্টাও করবে না। তোমার কথাটা শুনে খারাপ লাগছে, যখন নিজে করেছিল তখন কি? আমার থেকে বেশি অশান্তিতে ছিলে তুমি? আমি তো ঘর থেকে বের হলেই অশান্তি থেকে দূরে চলে যেতে। কিন্তু আমি? আমার সারাক্ষণ এই ঘরে বন্দী হয়ে অশান্তি সহ্য করতে হতো। তারপরও তো আমার মাথায় এসব খেয়ালও আসে নি। কোন ঘরে অশান্তি হয় না? সবাই কি তোমার মত শান্তি খুঁজতে অন্য মেয়ের পিছনে চলে যায়? এটা নিয়তের বিষয়। বিশ্বাসের বিষয়। ভালোবাসার বিষয়। তোমার নিয়তে নিয়তে খোঁট ছিলো তাই তুমি ওই মেয়ের কাছে গেছ। এখনও ওর কাছেই যাও। আজ, এইখানেই আমাদের মাঝের সকল সম্পর্কের অবসান ঘটালাম আমি।”
“কবিতা তোমার মাথা এখন ঠিক নেই। রুমে যাও, আমরা পরে কথা বলব এ বিষয়ে।”
“তোমার মনে হয় এখনো কথা বলার কিছু বাকি আছে? তুমি কী করেছ তুমি বুঝতে পাড়ছো?”
“আমি জানি আমি ভুল করেছি, আমি মানছি। কিন্তু এই বলে তুমি আমাদের সম্পর্ক শেষ করতে পাড়ো না।”
“আমি এই সম্পর্ক শেষ করছি? তুমি করেছ। তুমি যেই মুহূর্তে ওই মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করেছ সেই মুহূর্তেই আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে তীর্থ। তখনই শেষ হয়ে গেছে। আমার অন্যপুরুষের সাথে আমার কথা বলাতেই তুমি রাগে ফেটে পড়লে। এন্ড ইউ স্লেপ্টড ইউথ হার। আর তোমার ইচ্ছা আমি সব ভুলে যাব? ভুলে যাব যে তুমি আমার বিশ্বাস কীভাবে ভেঙেছ? তুমি চাইছ আমি তোমার মতো একটা মানুষের সাথে জীবন কাটাই? তোমার মতো একটা কাপুরুষের সাথে?”

তীর্থ কর্কশ গলায় বলল, “কাটাতে হবে কবিতা, কাটাতে হবে । কারণ এছাড়া তোমার কাছে কোনো উপায় নেই। তোমার পরিবার তোমাকে আপন করে নিবে না, তোমার এমন যোগ্যতা নেই যে তুমি কাজ করে নিজের এবং আমার বাচ্চাদের সামলাবে। আর তোমার বান্ধবী কয়দিন পালবে তোমায়? শেষ পর্যন্ত তোমার আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে।”

কবিতার বুক চিরে বেরিয়ে আসে আফসোসের দীর্ঘশ্বাস, “তোমার বাচ্চা বলছো? টাকা দেওয়া ছাড়া কোন দায়িত্ব পালন করেছ বাবার? আমি তোমার কাছ থেকে ওদের নিয়ে গেলেও হয়তো তারা তোমার কথা মনেও করবে না। তোমার নিজের টাকার উপর খুব অহংকার তাই না? একদিন তোমার এই অহংকারের পতন ঘটবে।” কবিতা সামনে যেয়ে দাঁড়ায় তীর্থের। চোখে চোখ রাখে। তার চোখ নম্র কিন্তু কন্ঠ দৃঢ়, “তোমার মধ্যে তোমার করণীয় আফসোস নেই। তোমার জন্য আমি সব ছেড়ে এসেছিলাম, অথচ তুমি আজ মুহূর্তে আমার ভেতরের সবটা শূন্য করে দিলে। আজ আমি তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আমি তোমাকে ওয়াদা করছি তোমার ভবিষ্যতে আফসোস হবে। এই আফসোস তোমার ভেতরটা শেষ করে দিবে।”
“অভিশাপ দিচ্ছো?”
“সত্য বলছি।”
“তোমার মনে হয় তুমি আমাকে ধ্বংস করতে পারবে?”

কবিতা হাসে, “আমি কিছু করব না। আমার আল্লাহ করবে। তুমি আমাকে যত কষ্ট দিয়েছ, যত আঘাত দিয়েছ তার সব হিসাব তোমাকে দিতে হবে।” বলে কবিতা যেতে নিলেই তীর্থ বলে, “তুমি আজ যাচ্ছো। দুইদিন পর আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে তোমার।”
“তোমার মতো মানুষের সাথে থাকার চেয়ে আমি মৃত্যু স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করব।”
তীর্থ চমকে তাকায় কবিতার দিকে। কবিতা আসলেই চলে যাচ্ছে। সে একবার ফিরেও তাকাল না তার দিকে। একবারও না। শরীর কাঁপছে তীর্থের। সে তার পাশে থাকা কাঁচের টেবিলটা লাত্থি মেরে ভেঙে ফেলে।
না, কবিতা এভাবে তাকে ছেড়ে যেয়ে পারে না। যেভাবেই হোক কবিতাকে সে ফিরিয়েই আনবে।

বুকের ভেতর তীব্র জ্বালাতন করতে শুরু করে তীর্থের। ভীষণ। তার চোখে ভেসে আসে কবিতার সাথে কতগুলো স্মৃতি, তার হাসিমাখা চেহেরা। সে হঠাৎ খেয়াল করব তার চোখ ভিজে গেছে। কাঁপতে থাকে সে। সে নিজেকেই বলল, “তোমাকে আমার কাছে ফিরে আসতেই হবে। যেমন করেই হোক। তোমাকে না দেখে আমি বাঁচতে পারবো না। তুমি বুঝতে পারছো না কেন আমি কতটা ভালোবাসি তোমাকে? আমি ভুল করেছি। তাই বলে কী আমি দ্বিতীয় সুযোগ পেতে পারি না? তুমি আমার এবং তুমি আমার কাছেই থাকবে। আমাকে ভালোবেসেই তোমার জীবন কাটাতে হবে।”
.
.
আইদ বাসায় এসে দেখে মৃণা তার মা’য়ের সাথে গল্প করছে। দৃশ্যটা দেখেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল। গত এক মাসের মৃণা তার পরিবারের সাথে ঠিকমতো কোনো কথা বলে না। হঠাৎ যখন দুইদিন ধরে মৃণাকে এত সুন্দর করে তার মায়ের সাথে গল্প করত দেখেছিল, তখন সে ভেবেছিলো হয়তো সে এতদিনে তাদের বিয়ে মেনে নিতে পেড়েছে। এই ঘরের সকলকে আপন করে নিতে চাইছে।
কত ভুল ভাবনা ছিল তার!
মৃণা তোকে বল নিজের স্বার্থের জন্য সব করেছিল। যেন কেউ তার উপর সন্দেহ না করে। প্রেগন্যান্সির খবর জানার পরই হয়তো তার এই নাটক শুরু হয়েছে। এত মিথ্যা, এত অভিনয় করতে পারে মানুষ সাধারণ জীবনে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আইদ। সে মৃণাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “একটু রুমে আসো, কথা আছে।”
“এখন তোমার সাথে গল্প করছি। একটু পড়ে আসি?”
মৃণার অভিনয় দেখে গা জ্বলে উঠলো আইদের।
সে কিছু বলার পূর্বেই মা বলল, “আরে গল্প তো পরেও হতে পাড়বে। তুমি যাও, একটু সময় কাটাও একসাথে দুইজন মিলে।”
“আচ্ছা মা।”

আইদের পিছনে এলো মৃণা। রুমের দরজা বন্ধ করে আইদ একটি প্যাকেট এগিয়ে দিলো মৃণার দিকে। প্যাকেটটা দেখেই মৃণা জিজ্ঞেস করে, “এখানে কী?”
“বিয়ের দিনে তোমাকে কি উপহার দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তৈরি না হওয়ার কারণে আজ দিচ্ছি।”
মৃণা জোরপূর্বক হেসে উপহারটি হাতে নিলো। মনে মনে ভাবলো, “স্বর্ণ, হীরা তো দেবার সামর্থ্য নেই। দিবে কোনো কমদামী একটি শাড়ি অথবা সিটি গোল্ডের হয়না।”
ভাবনাটি সে মুখে আনলো না। প্যাকেটটা খুলে দেখে একটি গয়নার বাক্স। সে অবাক হয়। বাক্সতে ছিলো একটি হীরার ছোট পেইডেন্ট এবং কানেরদুল। আর একটি ছোট নাকের ফুল। উপহার পেয়ে তার চোখেমুখে খুশির ঝলক ফুটে উঠে। সে উৎসুক গলায় বলে, “এটা…এটা তো অনেক সুন্দর। অনেক বেশি। আমার উপর অনেক ভালো লাগবে।”
“তুমি আমাদের বাগদানে এটা কিনতে চেয়েছিলে। কিন্তু আংকেল আন্টি তোমাকে কিনে দিতে পারে নি বলে অনেক ঝগড়া করে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলে মনে আছে? আমি তিনবছর ধরে টাকা জমিয়ে তোমার জন্য কিনেছি।”
“সত্যি?”

মৃণা খুশিতে জড়িয়ে ধরল আইদকে। বলল, “আমি অনেক খুশি। অনেক পছন্দ হয়েছে আমার।”
আইদ তখনই বলল, “কিন্তু ভাবছি এটা এখন মা’কে দিয়ে দিব। উনি পেলে খুশি হবে তাই না? ”

মৃণা একটু চমকে উঠে। তার হাসিটি সাথে সাথে মুখ থেকে উড়ে যায়। সে আইদকে ছেড়ে মলিন মুখে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে দেওয়া উপহার তুমি তোমার মা’কে কেন দিবে?”
“একটু আগে না তুমি উনার কাছ থেকে আসতে চাইছিলে না। আমিতো ভেবেছি উনাকে দিললে তুমি আরও বেশি খুশি হবে।”
মৃণা আমতা আমতা করে বলল, “না মানে তুমি আমার জন্য উপহার এনেছিলে তো তাই বললাম আর কি।”
আইদ হাসে। মৃণার হাত থেকে উপহারটি নিয়ে আরেকটি প্যাকেট উপহার দেয়। বলে, “তোমার জন্য এখানে আরও বড় উপহার আছে।”
প্যাকেটে আগের থেকে বেশি বড় গহনার বাক্স। তা দেখে মৃণা আরও উৎসুক হয়ে যায়। সে মনে মনে ভাবল, আগের মত একটি ছোটো হীরার পেন্ডেন্ট ছিল, এটায় নিশ্চিত হীরার হার হবে।

সে খুশিমনে গয়নার বাক্সটা খুলে। বড়সড় একটা ঝটকা খায় সে। বাক্সতে তার প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট। প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট দেখেই কেঁপে উঠে সে। চমকে চোখ তুলে তাকায় আইদের দিকে।
আইদ বল, “কী হলো? ভালো লাগে নি উপহার?”
“আ…আইদ এটা… ”
“এটাও তোমার বান্ধবী রূপার তাইতো? অবশ্যই ওরই হবে। তুমি তো দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা। তুমি তো এমন কিছু করতে পারো না তাই না? তোমার হাস্পাতালের গ্যারেজেও তো মনে হয় রূপা জাদু করে তোমার রূপ ধারণ তীর্থকে জড়িয়ে ধরেছিলো। বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার? দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”
আইদ তার ফোনটা বের করে তীর্থের আর মৃণার ছবি দেখাতেই মৃণা জলদি করে ফোনটা আইদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু পাড়লো না। আইদ ফোনটা তার পকেটে ঢুকিয়ে ক্রুদ্ধ গলায় বলে, “তোমার কী মনে হয় এই ছবি ডিলিট করলে তোমার নোংরামির প্রমাণ শেষ হয়ে যাবে?”
“দেখ আইদ তোমার সাথে এই বিয়ে…বিয়েটা আমার ইচ্ছায় হয় নি। আমি আগের থেকে তীর্থকে ভালোবাসতাম। ”

মৃণার মুখে কথাটা শুনে আইদের চোখ কুঁচকে গেল। যেন ঘিনঘিন করে উঠেছে তার সারা দেহ, “তুমি? তুমি কাউকে ভালোবেসেছ? মজা করছো তুমি আমার সাথে?”
মৃণা জোর গলায় বলল, “মজা করছি না। তোমার কী মনে হয় আমাকে জোর না করলে আমি তোমার মতো একজনকে বিয়ে করতাম? তুমি বুঝো না? কোন দিক থেকে তোমার আমার সাথে যায়?”
আইদ এবার শক্ত করে মৃণার এক বাহু ধরে শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করে, “তাহলে আমাকে বলো নি কেন তুমি? আমাকে বললে আমি তোমার সাথে বিয়ে করতাম? আমি কখনো তোমার সাথে কোনো কিছু নিয়ে জোর করি নি। আমি ভেবেছিলাম তোমার শুধু মুখ দিকে কটু কথা বের হয়, কিন্তু তোমার মন ভীষণ ভালো। তোমার আমাদের সম্পর্ক মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু না, যার মন কালো তার থেকে আর কি আশা করা যায়। আর তোমার সাথে আমার যায় না’কি? তোমার মতো একটি চরিত্রহীন মেয়ের সাথে আমার যায়?”
“মুখ সামলে কথা বলবে আইদ নিজের সীমানা পাড় করলে তোমাকে আমি….”
মৃণাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে দেয় না আইদ, “কী করবে তুমি? কী করবে শুনি? আমি যদি এই মুহূর্তে এই রিপোর্ট যেয়ে সবাইকে দেখাই তাহলে তুমি কী করতে পারবে?”
কথাটা শুনে ঘাবড়ে যায় মৃণা। আসলেই তো আইদ চাইলেই সবাইকে সত্য জানাতে পারে। ভয়ে এক ঢোক গিলে। সে কাঁপানো গলায় বলে, “তুমি এমন করতে পাড়বে না।”
“একশোবার পাড়বো।”
“দেখ আইদ, আমি আগের থেকে তীর্থকে ভালোবাসতাম। মা বাবার খাতিরে আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। বিয়ের পর আর তার সাথে আমার সম্পর্কও নেই। অর্থাৎ আমি তোমার সাথে কোনো ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করি নি। আমি যা করেছি নিজের মা বাবার জন্য করেছি। তাদের ভালোবাসি তাই।”
“তোমার মা-বাবার জন্য করেছ? তাদের ভালোবাসো তাই?”
“হ্যাঁ।”
“মিথ্যা কথা,” আইদের কথায় বিস্ময় নিয়ে মৃণা তাকিয়ে রয় তার দিকে। আইদ তার কথা সম্পূর্ণ করে, “যে নারীর হৃদয়ে তার সন্তানের জন্য মমতা নেই সে কখনোই অন্যকাওকে ভালোবাসতে পারে না। একটি নারীর সম্মান কোন সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা পায় জানো? মাতৃত্বে
অনেকে একটি সন্তানের জন্য কত দোয়া করে, কত কাঁদে এবং অন্যদিকে তোমার এই সন্তান মারার সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে একটিবার বুক কাঁপে নি। আমি শুনেছি মা থেকে বেশি একটি মানুষকে কেউ ভালোবাসতে পারে না। অথচ তুমি দুইদিন হলো জানতে পাড়লে তোমার গর্ভে একটি অস্তিত্ব আছে আর তুমি তাকে মারার জন্য ছুটে পড়লে? তোমার হৃদয় আছে কি’না?
“তো কী করার ছিলো আমার? তুমি মেনে নিতে আমায় এই অবস্থায়? বলো আইদ মেনে নিতে?”

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here