মুহুর্তে পর্ব -৩৫+৩৬

#মুহূর্তে
পর্ব-৩৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“তো কী করার ছিলো আমার? তুমি মেনে নিতে আমায় এই অবস্থায়? বলো আইদ মেনে নিতে?”

আইদ তাচ্ছিল্য হেসে ভ্রু কুঁচকে বলে, “কেন তোমার ভালোবাসা মানুষটার র কি হলো? সে মেনে নেয় নি তোমাকে?”
মৃণার ভীষণ বিরক্ত লাগলো। অপমানজনক। সে নাক ফুলিয়ে বলল, “দেখেন আপনার সাথে আমার টিটকারি করার কোনো ইচ্ছা নেই।”
“আমারও নেই। তাই সুন্দরমত আমার ঘর থেকে বের হও।”
মৃণার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আইদের কথায়, “আপনি এমন করতে পারেন না। আপনে তো ভালো মানুষ কিভাবে এত রাতে আমাকে বের করে দিতে পারেন?”
“যে মেয়ে অন্যপুরুষের সাথে রাত কাটিয়ে আসে তার এই সন্ধ্যারাতে ঘর থেকে বের হতে ভয় লাগছে? যাই হোক তুমি যেমনই হও না কেন আমার মধ্যে এখনো মনুষ্যত্বটা আছে তাই আমি আগে দিয়েই এক বন্ধুকে বলে রেখেছি, ও তোমায় বাবার বাড়িতে দিয়ে আসবে। তোমার একজন পর পুরুষের সাথে এক রুমে থাকতে লজ্জা নাও লাগতে পারে, কিন্তু আমার লাজ শরম আছে। আমি যে-কোনো নারীকে নিজের বাসায় জায়গা দিতে পারিনা।”
“আমি আপনার স্ত্রী আইদ।” একটুখানি উচ্চ স্বরে বলল মৃণা।
“না, তুমি আমার স্ত্রী না। আমাদের বিয়ের এক মাস হয়েছে অথচ তুমি গর্ভবতী আড়াই মাস। কোনো গর্ভবতী মহিলার বিবাহ অথবা তালাক হয় না। অতএব আমাদের বিয়ে খারিজ হয়েছে। তোমাকে আমি দশ মিনিট দিচ্ছি, নিজের বাসা থেকে যায় নিয়ে এসেছিলে তা নিয়ে ফেরত যাও।”
মৃণা স্তব্ধ হয়ে রইলো আইদের কথায়। সে কি করে, না করবে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

আইদ আলমারি থেকে তার গেঞ্জি নিয়ে বাথরুমে যাওয়ার সময় বলল, “আমি যেন গোসল করে এসে দেখি তুমি তোমার সব কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিয়েছ।”
আইদ যেতে নিলেই মৃণা দৌড়ে এসে তার হাত চেপে ধরে। অস্থির হয়ে বলে, “প্লিজ, প্লিজ আইদ এমন করো না। আমি জানি তোমার মন অনেক ভালো। তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। আমার কথা না ভাবলেও একবার আমার বাচ্চার কথা ভাবো।”

“যে বাচ্চার কথা তার বাবা ভাবেনি, তার কথা আমি ভাববো?” কতটুকু বলেই আইদের মনে হলো সে রাগে বড় কোন ভুল কিছু বলে ফেলেছে। যা দোষ, তা কেবল মৃণা এবং তীর্থের। সে মাসুম জানের তো কোনো দোষ নেই। সে তো নিষ্পাপ। তাই আইদ আবারও বলে, “যদি বাচ্চার কোন প্রয়োজন হয় সে খরচ আমি দিব। কিন্তু কেবল বাচ্চার, তোমার বিলাসিতার জন্য আমার কাছে টাকা নেই। এছাড়া বাচ্চা হলে তার দত্তক আমি খুঁজে দিব। ওর জন্যই তোমাকে আমি দুইদিন দিলাম। দুইদিন দিলাম তোমার মা বাবাকে সত্য কথা বলার। কিন্তু তুমি এখনই আমার চোখের সামনের থেকে চলে যাও। আমি খুবই কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। আমি চাইনা আমি রাগের বশে আমার মা বাবার দেওয়া শিক্ষা ভুলে যাই অথবা আমার জন্য তোমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হোক। আমার চোখের সামনের থেকে তুমি চলে যাও, ঘৃণা হয় তোমাকে দেখলে। এই ভেবে যে আমি এমন এক মেয়ের মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম যে অন্যকারও সংসার ভাঙতে একটুখানিও দ্বিধাবোধ করে নি। সে ঘরে দুটো বাচ্চা যে আছে তাদের কথা চিন্তা করেনি। ওহ, আমি কার কথা বলছি যার নিজের গর্ভে পালিত অংশের জন্যও একটুও মায়া হয় নি।”
আইদ মৃণার হাত ছাড়িয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

ঝর্ণা ছেড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো আইদ। তার মনে পড়ে পুরনো দিনগুলো।
কী মিষ্টি ছিলো মৃণা!
সারাদিন ঘুরে বেড়াতো, দুষ্টুমি করতো, তার সাথে এসে সুন্দরভাবে কথা বলতো। কৈশোরের দিনগুলোতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে মিষ্টি মেয়েটা।

তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে চার বছর হবে। এর পূর্বে কখনো মৃণার প্রতি আলাদা আকর্ষণ ছিল না আইদের। এমন না যে মৃণা সুন্দর না। তার সৌন্দর্যের গুণগান তার এলাকায় সবার মুখে ছিলো। কিন্তু আইদ কখনো এইসবে ধ্যানই দেয় নি। তার সব সময় পড়াশোনার প্রতি বেশি ধ্যান ছিলো, তাই অন্য মেয়েদের প্রতি দুর্বল হতে চায় নি সে। এছাড়া সে ভেবেছিলো জীবন তো একটাই, মনটাও সে একজনকেই দিবে।

মৃণার সাথে যেদিন প্রথম তার বিয়ে ঠিক হয় সেদিন মৃণাকে খুব মনোযোগ সহকারে দেখেছিলো সে, চোখ মেঝেতে আটকে ছিলো তার। আইদ ভেবেছিলো মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে। না, সে লজ্জা পাচ্ছিলো না। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করছিলো। আস্তে-ধীরে কীভাবে যেন সেই মেয়েটার প্রতি টান বাড়তে থাকে। তারপর বিয়ে হয় তাদের। বিয়েতে যে মুহূর্তে সে কবুল বলেছিলো সে মুহূর্ত থেকেই মন থেকে কেবল মৃণাকে আপন করে নিয়েছিলো। সেদিন নিজের সাথে ওয়াদা করেছিলো সে, এই জীবনে অন্যকাওকে সে ভালোবাসবে না।
হায় ভালোবাসা!
ওখানেই তো হেরে গেল সে। যাকে ভালোবাসলো, সে কোনোভাবেই তার ভালোবাসার যোগ্য না। এই একটা মন সে একজনের নামেই লিখিত করেছিলো, আজ সে কতটা দ্বিধাহীনভাবে তার হৃদয়টা ভেঙে চুরমার করে দিলো। অথচ এই হৃদয় ভাঙার কোনো আফসোস নেই তার।

আইদ বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে মৃণা এখনো বিছানায় বসে আছে। কাঁদছে সে। ক’দিন আগে হলেও তার বুকটা কেঁপে উঠতো মৃণার চোখে জল দেখে। অথচ আজ তার মাঝে রাগ ছাড়া কোন অনুভূতি নেই মৃণার জন্যে।

সে নিজেই আলমারি থেকে একটি ব্যাগ বের করে সেখানে কাপড়-চোপড় ঢুকাতে শুরু করে। মৃণার কিছু জিনিস ব্যাগে ভরে মৃণাকে আদেশের সুরে বলে, “আসো।”
মৃণা নম্র দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। কান্নাভেজা গলায় বলে, “দয়া করে আমাকে বের করে দিও না। আমার মা বাবা জানলে কি হবে একবার ভাবো। উনারা সহ্য করতে পারবে না।”
আইদ ভ্রু কুঁচকে নিলো, “এই কথা তোমার মাথায় পাপ করার আগে আসে নি?”
“আমি কেবল ওকে ভালোবেসেছিলাম। কীভাবে এসব হয়ে গেল বুঝতে পারি নি আমি।”
“ভআলোবাসার পূর্বে সে বিবাহিত তুমি জানতে না?”
এই প্রশ্নের চুপ হয়ে যায় মৃণা। আইদ আবার বলে, “তুমি জানতে। তুমি জেনেশুনে একটা পরিবার নষ্ট করেছ। আজ আমি যখন কবিতা আপুকে সত্যটা বলছি। উনার চোখের মাঝে আমি যে বেদনা দেখেছি আমি এরপর তোমার উপর আমার বিন্দুমাত্র দয়া হচ্ছে না।”
মৃণা চমকে উঠে, “তুমি কবিতাকে বলেছ?”
মৃণা প্রথম এই ভেবে খুশি হয়েছে এখন সে তীর্থকে পেতে পারবে, যদি কবিতা তাকে ছেড়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণে ভয়ও লাগে তীর্থের রাগের কথা ভেবে। এর উপর যদি কবিতা থেকে ছেড়ে না যায় তাহলে তীর্থ ভুলেও তার দিকে ধ্যানও দিবে না। তাকে আশেপাশেও আসতে দিবে না সে।

ভয়ে শরীর কেঁপে উঠে মৃণার। সে উঠে আইদকে চিন্তিত সুরে বলে, “তোমার মাথা ঠিক আছে? কি করেছ তুমি? তীর্থ যদি জানতে পারে এসব তুমি করেছ তাহলে তোমার চাকরি তো রাখতেই দিবে না, এর উপর আমাকেও….”
এতটুকু বলেই চুপ হয়ে গেল মৃণা। তার মনে হলো এই কথাটা বলা উচিত হবে না। কিন্তু আইদ ঠিকই তার কথা ধরতে পাড়লো। সে মৃণার কথা সম্পূর্ণ করে বলল, “তোমাকেও কাছে সাথে দেবে না তাইতো? আমি বহুত নিলজ্জ দেখেছি, তোমার মত নিলজ্জ দেখিনি। আর তুমি চাও তোমার মত মেয়ের সাথে আমি এক ঘরে থাকব? তাও তোমাকে নিজের বউ করে? ছিঃ আমার ভাবতেও ঘিন লাগে। চলো, তোমার যাবার সময় হয়ে গেছে।”

মৃণার এবার যেতে রাজি হতেই হলো। সে বুঝতে পেড়েছে এখন আর আইদকে সে কথা দিয়ে ঘোরাতে পারবে না। তাই সে আইদের মা বাবাকে বলে রওনা দিলো। বাড়ির সামনে আইদের এক বন্ধু ছিলো বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে। আইদ তাকে রিক্সায় উঠিয়ে দেবার পর বাইকটা তার পিছু নেয়।

আইদ বাসায় ফিরতেই তার মা জিজ্ঞেস করে, “হঠাৎ মৃণা এত রাতে গেল কেন? তোদের মত কিছু হয়েছে?”
আইদ কিছু মুহূর্ত চিন্তা করে উত্তর দেয়, “না মা, কিছু হয়নি। ওর আংকেল আন্টির কথা মনে পড়ছিলো। সকালে বলল। তাই আজ পাঠালাম। আলমকে বলেছি বাইক নিয়ে ওর পিছে যেতে, বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসবে।”
“ওহ তা বল। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম তোদের মধ্যে কেবল ঝগড়াঝাঁটি চলছে না’কি? তোদের রুম থেকে শব্দ শুনে মনে হলো তোরা ঝগড়া করছিস।”
“মা শুনো, দুইদিন পর আমরা নুরু আংকেলদের বাসায় যেও। বাবা, তুমি, আমরা সবাই।”
“মৃণাকে আনতে? যাকগে তাও ভালো। সবার একত্রে ভালো সময় কাটাবো।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আইদ। সে মা’কে কীভাবে বলবে যে মৃণা কি করেছে! কত বড় নাটক খেলেছে তাদের সাথে। আর সে কীভাবে এসব মৃণার মা বাবাকে জানাবে সব? তারা এই ধাক্কাটা কী সহ্য করতে পারবে? ভীষণ মাথা ধরে গেল আইদের এইসব চিন্তায়। সে সোফায় মা’য়ের পাশে বসে বলল, “মা একটু তোমার কোলে মাথা রাখি?”
“আরে এসব জিজ্ঞেস করা লাগে? আমার পাগল ছেলেটা। আয়।”
আইদ তার মা’য়ের কোলে মাথা রাখে। মা বলে, “শুন বাবা, আমি জানি কিন্তু যথেষ্ট বিবেকবান মানুষ। তুই যা করিস বুঝেশুনে করিস। কিন্তু মৃণার এখনো এতটা পরিপক্ক হয়ে উঠে নি। তাই ওর ভালোভাবে খেয়াল রাখবি বুঝলি? আর তোরা জলদি করে আমাকে একটা নাতি বা নাতনি দিবি। বয়স হয়ে যাচ্ছে আর কয়দিন বাঁচবো বল? নাতি নাতনির চেহেরা দেখে মরলেও শান্তি পাব। শুনছিস তুই?”
“হুম।”
আইদের হঠাৎ করে খুব করে কান্না পেল। বুক ব্যাথা করতে শুরু হলো তার। এর পূর্বে কারও জন্য তার এতটা বুক জ্বলে নি। যার সাথে তার মা এত স্বপ্ন সাজানোর কথা বলছে সে মানুষটা তাকে ছলনা ছাড়া কিছুই দেয় নি। কষ্টে মা’য়ের শাড়ির আঁচলটা শক্ত করে ধরে নিলো সে। না চাওয়া সত্ত্বেও চোখ দিয়ে ঝরে পড়লো এক বিন্দু দুঃখ।
.
.
ভোরের সূর্য উঁকি দিয়েছে। কবিতা বসে আছে জানালার পাশের বিছানায়। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জানালার ওপাড়ে। বাহিরের নরম রোদ্দুর তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার পাশে ঘুমিয়ে আছে কুহু এবং কাব্য। মধ্যরাতে ঘুমিয়েছে তারা।

এত সকালেই অনু দুইকাপ চা এবং বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে এলো। এসে বসলো কবিতার পাশে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কবিতার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “কিছু খেয়ে নে। গতরাত থেকে না খাওয়া। এর উপর এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাস নি।”
কবিতা নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে। আর বলল, “বলে ফেল।”
“বলব? কী বলব?”
“যা মনে আছে কিন্তু আমাকে কষ্ট দেবার জন্য বলতে চাচ্ছিস না। তোর এত মানা করা সত্ত্বেও আমি তীর্থের সাথে সম্পর্কে জড়ালাম, আমার পড়াশোনা শেষ করলাম না, আরও কত কি! তোর কথা শুনলে হয়তো আমার এমন সময় দেখতে হতো না। তুই এসব কথা বলতে চাইছিস কিন্তু আমার কথা ভেবে বলছিস না তাইতো?”
“আপাতত এসব বলে লাভও নেই। যা হয়ে গেছে তা পালটানো সম্ভব না।”
“জানিস আমি গতরাত থেকে ভাবছিলাম, যদি আমি কবির ভাইয়ার বাধ্য হয়ে তীর্থের সাথে সম্পর্ক না এগোতাম অথবা এই কটু সত্যটা আমার না জানা থাকলে কতটা ভালো হতো। না আমি কষ্ট পেতাম, আর না আজ আমার এই অবস্থা হতো। অতীতের সিদ্ধান্ত নিয়ে খুবই প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছিলো আমার। তারপর মাথায় এলো,
ঘটনাগুলো যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন তার জীবনের প্রয়োজন ছিলো। আপন মানুষদের আসল চেহেরা দেখার জন্য হলেও প্রয়োজন ছিলো। যে মানুষগুলোকে আমি অন্ধ হয়ে বিশ্বাস করতাম তাদের সত্যটা সামনে আসার প্রয়োজন ছিলো। আমার অতীতের সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো না। আমি যদি লুকিয়ে প্রেম করে ভুল করে থাকি তাহলে তারাও আমাকে নিজের লাভের জন্য অন্য কাউকে দিয়ে দিতে চেয়েছিলো। তখন পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত না নিলে হয়তো আমার সারা জীবন মনে হতো যদি আমি তীর্থকে বিয়ে করতাম তাহলে হয়তো আরো সুখে থাকতাম। আমাদের জীবনের অনেক ঘটনাই অন্যরকম হতে পারতো কিন্তু সকল ঘটনার এক কারণ থাকে। হয়তো আজ এত বড় ধাক্কা খাওয়ারও হয়তো বড় কোনো কারণ আছে।”
“আজ এত বড় ধাক্কা না খেলে তীর্থের সত্যটা সামনে আসতো কীভাবে তোর? এমনিতেও সংসার তো কোনদিন সুখে ছিলি না। হয়তো ভবিষ্যতে তোর জন্য তোর ভাগ্যের সুখ অপেক্ষা করছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতা। গতকাল অনেক কেঁদেছে সে। কিন্তু আজ তার কান্না আসছে না। চোখে জলও ভাসছে না। মনে হচ্ছে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।

সকালে কুহু এবং কাব্য উঠার পর অনু তাদের জন্য নাস্তা নিয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর অনুর ভাই ভাবি এসে তার খবর নিয়ে যায়। তার কিছুটা অস্বস্তি লাগে। হঠাৎ এভাবে তাদের বাসায় আসাটা কেমন যেন লাগে তার। তীর্থের কথা ও জিজ্ঞেস করে অনুর ভাবি। এমন নয় যে সে জানে না কবিতা ঘর ছেড়ে এসেছে। গতকালে অনু ওদেরকে জানিয়েছে কবিতার সমস্যা আছে। জানা সত্ত্বেও সে জিজ্ঞেস করলো।

শেষ বিকেলে জ্বর এলো কাব্যের। কিন্তু তার ঔষধ বাসায়। অনু তা জেনে কবিতাকে জিজ্ঞেস করে, “ঔষধের নাম মনে থাকলে বল। আমি যেয়ে নিয়ে আসি।”
“গত মাসে ওষুধ চেঞ্জ করেছিলো, এইজন্য নাম মনে নেই।”
“তাহলে এখন?”
” এখন আর কি বাসায় নিয়ে আসছি। এমনিতেও আরও কয়েকটা জিনিস লাগবে বাচ্চাদের জন্য। ওদের স্কুলের বই খাতাও আনা হয় নি। সাথে আমার এস এস সি এবং এইচ এস সি এর সার্টিফিকেটও নিয়ে আসব। যদি কোনো কাজ পেয়ে যাই।”
“তোর যাওয়া লাগবে না। আমি নিয়ে আসছি। আমি চাই না তোর আবার ওই লোককে ফেস করতে হোক।”
কপাল কুঁচকে গেল কবিতার, “কেন? আমি কোনো ভুল করেছি যে আমার তার সামনে যেতে অস্বস্তিবোধ করতে হবে। উনার আমার সামনে আসতে লজ্জা লাগা উচিত। আমি এমন কিছু করি নি যে আমার উনার সামনে যেতে ভাবতে হবে।”
“উনি যদি তোকে কিছু করে ফেলে?”
“এত সাহস তার নেই। তুই কাব্য এবং কুহুর খেয়াল রাখ, আমি আসছি। আমি আসার আগে তাহিরা আপুর বাসায়ও যাব। তাকেও কিছু সত্য বলা বাকি আছে।”
.
.
মৃণা তীর্থের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভয়ে কলিংবেলে চাপ দিচ্ছে না।
তীর্থ কিছুতেই তোর ফোন ধরছিলো না গতকাল থেকে। কিন্তু আইদ সবাইকে সত্য বলার পূর্বে যেমন করেই হোক তার তীর্থের সাথে কথা বলতে হবে। তীর্থকে খুঁজতে সে অফিসে গিয়েছিলো। সেখানে যেয়ে জানলো তীর্থ অফিসে আসে নি। এমনকি ফোনও ধরছে না। আর কোনো উপায় ছিলো না মৃণার কাছে। তার আসতেই হলো তীর্থের বাসায়।

ভয়ে কাঁপছিলো মৃণা। তীর্থের রাগ সম্পর্কে তার ধারণা আছে। এর উপর সত্য জানার পর কবিতার সামনে সে পড়লে অনেক বড় সমস্যা হবে। তবুও বহুকষ্টে সাহস জোগাড় করে কলিংবেলটা টিপ দিল সে। দোয়া করতে থাকলো যে তীর্থ ছাড়া কেউ দরজা না খুলে।

তীর্থ দরজা খুলে। তাকে কেমন মনমরা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে। তীর্থের পিছন থেকে ঘরের অবস্থা দেখতে পেল মৃণা। সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। অর্থাৎ গতকাল বড় কোনো তামাশা হয়েছে এ বাসায় নিশ্চিত। এসব দেখেই ভয়ে মৃণার গলা শুকিয়ে গেল।

মৃণাকে দেখেই তীর্থের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সে মৃণার হাতে শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমার সংসার শেষ করে তুমি আমার বাসার সামনে কী করছ?”
ঢোক গিলে মৃণা। কাঁপানো গলায় বলে, “অনেক বড় সমস্যা হয়ে গেছে তীর্থ। আইদ সব জেনে গেছে। ও আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। বলেছে মা-বাবাকেও জানাবে। আমি কী করবো? আমার কাছে এখানে আসা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না।”
তীর্থ কিছু বলতে যাবে তখন নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে কারও পায়ের শব্দ পেল। তাই সে মৃণাকে ভেতরে নিয়ে আসে। ক্রোধিত গলায় জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমার সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখে আগ্রহী না। তোমার কারণে আজ আমার কবিতা আমাকে ছেড়ে গেছে।”
“এভাবে বলো না তীর্থ তোমার সন্তান আমার গর্ভে৷ তুমি চাইলে কিন্তু আমি একটা নতুন সংসার তৈরি করতে পারি।”
তাচ্ছিল্য হাসে তীর্থ, “তোমার মতো মেয়ের সাথে আমি সংসার করবো? যে টাকার জন্য অন্যের বিছানায় যেতে দ্বিধাবোধ করে না অথবা লোভে নিজের সন্তানকে মারতে রাজি হয়ে যায়।”

মৃণা তীর্থকে জড়িয়ে ধরে উন্মাদের মতো ব্যবহার করে, “প্লিজ তীর্থ এবং আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না। কবিতা হাজারোবার তোমাকে ছেড়ে চলে যাক, কিন্তু আমি সবসময় তোমার সাথে থাকব। তোমার পাশে।”
তীর্থ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় মৃণাকে, “তোমার এসব মিষ্টি কথায় এসেই তো আমি নিজের বৈবাহিক জীবন নষ্ট করেছি। এখন আর তোমার চেহেরাও দেখতে চাই না আমি।”
“প্লিজ তীর্থ আমার সাথে এমন করো না। আমার আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আইদ যদি মা বাবাকে সত্যি বলে দেয় তাহলে আমার চেহারা দেখতে চাইবো না।”
“আইদ…ওই আইদকে তো আমি কি করব নিজেও জানি না। সাহস কত বড় ওর কবিতাকে আমাদের ব্যাপারে জানানোর। আমার সংসার নষ্ট করার শাস্তি ওর পেতেই হবে।

কলিংবেল বাজলো। তীর্থ রুক্ষ গলায় মৃণাকে বলল, “এখান থেকে নড়বে না তুমি।”
তীর্থ যেয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পায় কবিতাকে। তার যেন প্রাণ ফিরে আসে কবিতার সাথে। সে উৎসুক গলায় বলে, “আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে। আমার কাছে তুমি ফিরে আসবে আমি জানতাম।”
সে কিছু না ভেবেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে নেয় কবিতাকে কিন্তু কবিতা তাকে থামিয়ে দেয়। গম্ভীরমুখে বলে, “আমি এখানে কেবল কিছু জিনিসপত্র নিতে এসেছি।” বলেই তীর্থের পাশ কাটিয়ে যায় কবিতা।

“ওহ শীট!” তীর্থ দৌড় দেয় কবিতার পিছনে।
এতক্ষণে তীর্থের মৃণার কথা মনে পড়ে। কবিতা মৃণাকে এই মুহূর্তে তাদের বাসায় দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
#মুহূর্তে
পর্ব-৩৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“ওহ শীট!” তীর্থ দৌড় দেয় কবিতার পিছনে।
এতক্ষণে তীর্থের মৃণার কথা মনে পড়ে। কবিতা মৃণাকে এই মুহূর্তে তাদের বাসায় দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

কবিতার পিছে গেল তীর্থ। ডাইনিং রুমে যাবার পূর্বেই সে কবিতার হাত ধরে উচ্চ স্বরে বলল, “কবিতা, আমি জানি তুমি আমাকে দেখতে এসেছ। আমি ঠিক আছি কিনা তা যাচাই করতে এসেছ। আমি জানি আজও তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমার কবিতা আমাকে এভাবে ভুলে যেতে পারে না।”
তার এভাবে উচ্চস্বরে কথা বলার কারণ হলো যেন মৃণা যেয়ে লুকিয়ে যায় কোথাও।

কবিতার আজব লাগলো তার ব্যবহার। সে ঝাড়ন দিয়ে তার হাত সরিয়ে বলল, “আমি তোমাকে শেষ রাতেও বলেছিলাম, আমি তোমার স্পর্শও সহ্য করতে পারছি না। আমার ছেলে মেয়ের কিছু জিনিস প্রয়োজন, আমি তা নিতে এসেছি। আর কিছু না।”
এই বলে কবিতা ঘরের ভিতরে ঢুকে যায়। তার পিছনে যায় তীর্থও। বারবার তাকে আটকাতে চায়। কিন্তু কবিতা থামে না। ডাইনিং রুমে যেয়ে তীর্থের প্রাণ ফিরে আসে। মৃণা নেই সেখানে।

কবিতা ভিতরের রুমে যাওয়ার পর তীর্থ মৃণাকে খুঁজে। তাকে পায় ডাইনিং টেবিলের পিছনে লুকানো। সে মৃণার কাছে যেয়ে আদেশের সুরে বলে, “জলদি আমার ঘর থেকে বের হও। কবিতা যেন তোমাকে না দেখতে পারে।”
বলে সে চলে গেল কবিতার পিছনে।

মৃণা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। তীর্থের কথা অনুযায়ী সে যেতে নেয়। কিন্তু দরজার কাছে আবার থেমে যায় সে। সে মনে মনে ভাবলো,, “এক মিনিট, আমি তীর্থকে কবিতাকে মানানোর জন্য এত ভালো সুযোগ কেন দিব? যদি কবিতা আসলে তাকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে আমার সুযোগ আছে। এই সুযোগে আমি এমনি হাতছাড়া করতে পারিনা। কবিতার তাকে ছেড়ে গেলে তীর্থের কাছে কোন পরিবার নেই। আমার গর্ভে যেহেতু তীর্থের সন্তান সে আজ না হয় কাল আমাকে মেনে নিবে। এছাড়া কবিতা সব জেনে গেছে, এখন আর তীর্থের তার জানার ভয় থাকবে না। অর্থাৎ তীর্থ ভয়ে না আমার সাথে দেখা করবে, না আমি ওকে কাছে পাব আর না আমার ইচ্ছাগুলো পূরণ করবে। এছাড়া সব ঠিক হয়ে গেলে কবিতা কিছুতেই তীর্থের সাথে আমার সম্পর্ক রাখতে দিবে না।”
এই ব্যাপারে প্রচুর ভাবল মৃণা। অবশেষে একটি সিদ্ধান্ত নিলো সে। সে আর লুকাবে না। যা তার চাই, সে জিনিসের জন্য লড়াই করবে।
.
.
কবিতা আলমারিতে তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস খুঁজছিলো। হঠাৎ করে তীর্থ এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, “কবিতা…প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। আমার তোমাকে ছাড়া অনেক কষ্ট হয়।”
কবিতা যেন সে কথা কানে গেল না। সেখান থেকে সরে যেয়ে সে বিছানার পাশের সাইডবক্সে ঔষধের বাক্স খুঁজতে থাকে।

তীর্থ আবারো তার পিছু যায়, “আমি কিছু বলছি। আমার কথা তো শুনো।”
কবিতা উওর দিলো না। সে ঔষধ খুঁজে ব্যাগে ঢুকিয়ে আবারও আলমারির কাছে গেল। কাব্যের স্কুলের ব্যাগ এবং তার সার্টিফিকেট গুলো নিলো।

কবিতার এমন ব্যবহারে তীর্থের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে কবিতার পিছনে এসে তার বাহু ধরে এক টানে তাকে পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকাল। হাত মুঠোবন্দী করে শক্ত করে কবিতার কাঁধের পাশের দেয়ালে ঘুষি মারলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুমি আমার সাথে রাগ করে আছো আমি জানি। আমাকে তুমি বকা দেও, ঝগড়া করো, যা ইচ্ছা করো তবুও এভাবে চুপ থেকো না। কথা বলো। কথা বললে সব ঠিক হয়ে যাবে কবিতা।”
তীর্থ কবিতার দুই গালে হাত রেখে আহত দৃষ্টিতে তার চোখে তাকায়, “প্লিজ কবিতা আমার ভুল হয়ে গেছে। তুমি আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার তা আমার সাথে থেকে দেও। তবুও এভাবে আমাকে অবহেলা করো না। আমার কাছ থেকে দূরে যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।”

“তাহলে মরে যাও।” নির্দ্বিধায় বলে কবিতা, “লাগলে হাত কাটার জন্য ছুরি অথবা খাওয়া জন্য বিষ এনে দিব?”
কবিতা বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে তীর্থকে সরিয়ে চলে যায়। রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিংরুমে যেয়ে সে দেখতে পায় মৃণাকে। সে বিশ্বাস করতে পাড়ছিলো না তার যাবার পরেরদিনই তীর্থ মেয়েটাকে ঘরে এনে তুলেছে। তার প্রচন্ড রাগ উঠলো। কিন্তু সে কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করে।

তীর্থ ড্রইংরুমে এসে মৃণাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। সে দৌড়ে যায় কবিতার পিছনে। তার সামনে যে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে বলে, “কবিতা তুমি যা ভাবছো এমন কিছুই না। আ… আমি ওকে ডাকি নি। ও নিজে এসেছে। আমি ওকে দেখার সাথে সাথে যেতে বলেছিলাম।”

কবিতা একপলক মৃণার দিকে তাকালো। তারপর আবার বিরক্তি নিয়ে তীর্থের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি যা ইচ্ছা তাই করো। এমন তো না এমন নষ্টামি আজ নতুন করছো। আগে লুকিয়ে করতে, আর এখন খোলামেলা ভাবে করো। এছাড়া আগে তো আমি তোমার জীবনে ছিলাম তাই ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু এখন আমিও নেই, তোমার যা মন চায় তা করো। এই মেয়ের সাথে করো অথবা অন্য দশটা মেয়ের সাথে। আমার বিশ্বাস এবং সম্পর্ক আগেই শেষ, এখন আমার তোমার জন্য কোনো অনুভূতি হয় না।”
“কবিতা প্লিজ এমন করে বলো না।” তীর্থ কবিতা গালে হাত রেখে অহসায় গলায় বলে, “আই লাভ ইউ।”
“তাই? তাহলে ওর সাথে যা ছিলো তা কী ছিলো?”
“ভুল ছিলো। কেবল ভুল।”

মৃণা কথাটা শুনে আর্তনাদ করে উঠে, “তুমি এমন কথা কিভাবে বলতে পারো তীর্থ? দুইবছরের সম্পর্ক আমাদের। আমি তোমাকে আমার সবটা দিয়ে ভালোবেসেছি। আমাদের সম্পর্ককে তুমি কীভাবে ভুল বলতে পারো?”
“যাস্ট সাট ইউর মাউথ।”
“কেন?” কবিতা স্বাভাবিকভাবেই মৃণার সামনে যেয়ে তাকে বলো, “তুমি বলো। কি বলছিলে? ভালোবেসে তুমি এসব করেছিলে? তীর্থ আমাকে বলেছিল সিলেট যাবারর পর না’কি তুমি ওর কাছে এসেছিলে। এটা কি সত্যি?”
মৃণা উত্তর দিলো না। মাথা নামিয়ে চুপ করে রইলো।
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।”
“আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”
“ওহ তুমি এটা ভাবো? তুমি আসলেই বাধ্য। তোমার আসলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা উচিত আমি এখনো তোমার করণীয় শাস্তি তোমায় দেই নি। এখনো জানাই নি কাওকে। তোমার কান্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ জগৎকে জানাতে আমার এক মুহূর্তও লাগবে না। তুমি জানো তো তোমার মতো মেয়েকে কী বলে? দুশ্চরিত্রা।জঘন্য মেয়ে তুমি। তোমার মতে, একটি বিবাহিত পুরুষদের শরীর বিলিয়ে বেড়ানোকে ভালোবাসা বলে? কারণ আমি যতটুকু জানি শরীর বিলিয়ে ভালোবাসা হয় না। আর তুমি তো শরীর বিলিয়েই ওকে পেতে চেয়েছিলে তাই না? যদি তোমার কাছে এটাই ভালোবাসা হয় তাহলে দিনে কয়টা পুরুষকে এভাবে ভালোবাসো তুমি?”

“আপনি এখন নিজের সীমানা পাড় করছেন।” চিৎকার করে উঠে মৃণা। সাথে সাথে কবিতা তার গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। চমকে উঠে মৃণা। এর পূর্বে কেউ তার উপর হাত তুলে নি। তার বাবা মাও তার উপর কবে তার তুলেছিলো তার মনে নেই। কবিতাকে খুব কঠিন একটি উওর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো সে। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে তার অগ্নিদৃষ্টিতে একটু দেবে যায় মৃণা। কবিতা মৃণার মুখের সামনে আঙুল তুলে বলে, “আমার সংসার ভেঙে বলছিস আমি সীমানা পাড় করছি? এখন এই মুহূর্তে আমি চিল্লিয়ে বিল্ডিংয়ের সকলকে ডাকলে অথবা সবাইকে সত্যটা বলে বেড়ালে তোর কোন সম্মানের কোন সীমানা থাকবে শুনি? তোর মতো নিচুলোকের সাথে কথা বলে আমার মুখ নষ্ট করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। আমার তো আফসোস আর তোর মা বাবা এবং আইদের জন্য। আইদের মতো ভালো ছেলের সাথে এমন করতে বুক কাঁপে নি? সরি, আমিও কার সাথে কথা বলছি। তোমার মধ্যে এত অক্কল থাকলে তো এভাবে নিজের জীবন নিয়ে খেলা করতে না। কিন্তু থ্যাঙ্কিউ, তুমি না হলে আমি জানতামও না যে আমি যাকে এত ভালোবাসতাম, যাকে এতটা বিশ্বাস করতাম সে এভাবে আমার জীবন নষ্ট করতে পারে।”
“কবিতা প্লিজ….” তীর্থ কিছু বলতে যাবে তখনই কবিতা হাতের ইশারায় তাকে থামায়। নিজের কথা সম্পূর্ণ করে সে, “এই জন্য আমি নিজেকে পরিবর্তন করেছিলাম। নিজের সারাজীবন ওর নামে লিখেছিলাম। নিজের সম্পর্ক, শান্তি, স্বপ্ন সব বিসর্জন দিয়েছি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি।”

তীর্থ আবার বলল, “আমার ভুল হয়ে গেছে কবিতা। আমি নিজের ভুল স্বীকার করছি তো।”
কবিতা তীর্থের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “ভুল? তুমি দুই বছরের বাচ্চা না যে না বুঝে ভুল করে ফেলবে। পরকীয়া কি ঠিক না বেঠিক জ্ঞান যদি তোমার না থাকে তাহলে তোমার থেকে অধম আর কেউ হতে পারে না।”
কবিতা চলে গেলে সেখান থেকে।

তীর্থ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো মৃণার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুমি এখানে কি করছ? আমি তোমাকে যেতে বলেছিলাম না?”
মৃণা আমতা আমতা করে বলল, “আমি…আমি ব্যাগ ভুলে গিয়েছিলাম তা নিতে এসেছি।”
“তাহলে নেও এবং আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও। এখনই। তোমার জন্য কবিতা আরও বেশি রাগ হয়ে গেছে আমার উপর। আমি ওকে কিভাবে মানাবো আমি নিজেও জানিনা। আর ওকে আমি যদি ফিরে না পাই, তাহলে তোমার কি অবস্থা করব তাও আমি জানি
না।”
মৃণা ছুটে এসে দিক থেকে জড়িয়ে ধরে, “প্লিজ এভাবে বলো না তীর্থ, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”
তীর্থ মৃণাকে সরিয়ে এক ধাক্কায় তাকে নিচে ফালিয়ে দিলো। বিরক্তি নিয়ে বলল, “গেট লস্ট। আমার মাথা এখন ঠিক না, আমি কি করব তোমার সাথে আমি নিজেও জানি না। এখনই আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাও।”
তীর্থ মৃণাকে এক ধাক্কায় মেঝেতে ফেলে দেয়।

মৃণা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তীর্থের রাগ আসলেই এ মুহূর্তে অনেক বেশি। তাই সে সেখান থেকে যাওয়াই ঠিক মনে করল। সে উঠে দৌড়ে সেখান থেকে পালায়।

কবিতা অনুর বাসায় যেয়ে তার ছেলে মেয়েকে খাইয়ে সোজা রওনা দেয় তাহিরার বাসার উদ্দেশ্যে। তাহিরাকে কল করে জলদি বাসায় আসতে বলেছিলো সে।
.
.
হাস্পাতাল থেকে আজ একটু জলদিই বাসায় এলো কথন। তাকে জলদি বাসায় আসার আদেশ দেওয়া হয়েছিলো। সে এসে দেখে তার মা বাবা কোথাও যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। তার বোন জবা এবং তার দুলাভাই আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। জবা জোর করে তৈরি করে কথনকে। তারা কোথায় এবং কেন যাচ্ছে সে জানে না। তাকে কিছুই বলা হয়নি। গন্তব্যে পৌঁছে সে জানতে পারে সেখানে মেয়ে দেখতে তাকে নিয়ে এসেছে। কথনের বেশ রাগ উঠলো। সে তার মা’কে মানা করেছিলো। সে এখন কোনোমতেই বিয়ে করতে চায় না। সে এখন প্রস্তুত নয়। কিন্তু সবার সামনে সে কিছুই বলতে পাড়লো না।

মেয়ের নাম জান্নাত। সে ডাক্তারি পড়তে। ঘরের সবার তাকে পছন্দ হয়েছে। কথনকে তার সাথে একা কিছু কথা বলার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের বেশি কথা হয়নি। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ ছিল তার। এভাবে মিথ্যা কথা বলে তাকে এখানে আনার মানে হয় না।
মেয়ের পক্ষ থেকেও বিশেষ কথা হয়নি। মেয়েটাকে ভীষণ লাজুক মনে হলো।

সেখান থেকে বের পর কথন রাগের তার মা বাবাকে দুলাভাইয়ের গাড়িতে বসিয়ে একাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সে কোথায় যাচ্ছে জানে না। অচেনা পথে রওনা দিলো সে। কিন্তু এই মুহূর্তে বাসায় যাবার কোন প্রকার ইচ্ছা নেই তার। সেই চায় না রাগের মাথায় কাউকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে কষ্ট দিক। রাগে তার মাথা ঠিক থাকে না। কখন কি বলে নিজেও বুঝতে পারে না।
সে ভালো করে জানে, তার মা যা করছে তা বেঠিক নয়। মা তাকে নিয়ে প্রচুর চিন্তা করে। এ-কারণেই বিয়ে নিয়ে এত তাড়াহুড়ো। কিন্তু সে নতুন সম্পর্কে জড়াতে তৈরি কি’না সে বুঝতে পাড়ছে না। সে এখনো কবিতাকে ভালোবাসে। তাকে ভালোবাসা উচিত কি’না তাও জানা নেই কথনের। তবুও ভালোবাসে। সে জেনে বুঝে অন্যকোনো মেয়ের অনুভূতির সাথে খেলা করতে পারে না।
.
.
তাহিরাকে দেখতেই তাকে জড়িয়ে ধরে কবিতা। শক্ত করে। তাহিরা একটুখানি অবাকই হয় কবিতার এমন কান্ডে। সে আলতো হাতে কবিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “কি হয়েছে তোর? মন খারাপ?”
কবিতা উওর দিলো না সাথে সাথে। কেবল শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো তাহিরাকে।
তাহিরা আবারো জিজ্ঞেস করল, “তীর্থও সন্ধ্যায় এসেছে ধ্রুবর কাছে।”
আচমকায় কবিতা ছেড়ে দিলো তাহিরাকে। বিস্মিত গলায় বলল, “তীর্থ এসেছে?”
“হ্যাঁ, ওরা ভিতরে গল্প করছে। এক কাজ কর তুই যেয়ে তাদের সাথে গল্প কর। আমি তোর জন্য কেক বানিয়েছি, তা নিয়ে আসছি।”
তাহিরা যাবার পূর্বে কবিতা তাকে ধরে নিলো। ছটফট করতে শুরু করে সে, “আপু তুমি জানো তীর্থ কেন এসেছে?”
তাহিরা হাসে, “স্বাভাবিক ধ্রুবর সাথে গল্প করতে এসেছে। তীর্থ তো প্রায়ই আসে, তোকে কত বলি তোরই সময় হয় না।”
“কেন এসেছে আমি বলছি তোমাকে। নতুন পরিকল্পনা করতে।”
“পরিকল্পনা? কিসের পরিকল্পনা?”
“আবার আমাকে কিভাবে ধোঁকা দেবে তার পরিকল্পনা।”
তাহিরার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছায়া পড়লো, “এসব কি বলছিস তুই?”
“আপু তোমার আন্ডারে যে চাকরি করে আইদ ও গতকাল আমার বাসায় এসেছিলো।”
“আইদ তোর বাসায় হঠাৎ কেন গেল?”

কবিতা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার বুক কাঁপছে। গলা কাঁপছে। কথাটা বলতে আজও তার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে কাঁপানো সুরে বলল, “ওর স্ত্রীর সাথে তী…তীর্থের অবৈধ সম্পর্ক আছে। তাও দুই বছর ধরে।”
তাহিরা চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। তার চোখ দুটো যেন কোটর থেক বেরিয়ে আসতে চাইছে।
“কী বলছিস তুই!”
“ওই মেয়ে তীর্থের বাচ্চার সাথে প্রেগন্যান্ট।”
“না কবিতা, আমার মনে হয় তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। তীর্থ তো তোকে অনেক ভালোবাসে। আমি ওর চোখে দেখেছি তোর প্রতি ভালোবাসা। সবাই জানে ও তোকে কতটা ভালোবাসে।”
“আমারও তাই মনে হতো আপু। কিন্তু আমি প্রমাণ দেখেছি। এরউপর ও নিজেও স্বীকার করেছে।”
তাচ্ছিল্য হেসে আবার বলে কবিতা, “আর আজ আমার অনুপস্থিতিতে তাদের একত্রে আমার বাসায় দেখে এসেছি।”
তাহিরা চিন্তিত দৃষ্টিতে কিছু মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো কবিতার দিকে। তারপর বুকে ভরে নিলো তাকে। তার নিজের চোখও ভিজে এলো। সে বলল, “তুই আমাকে বলিস নি কেন?”
“প্রথমে কল দিয়ে তোমাকে পাইনি। পরে রাতে আর দেওয়ার সাহস হয় নি। তোমাকে একটা কথা বলার আছে আপু।”
“পরে বলিস আমি আগে ওই লোককে ঘর থেকে বের করে আসি। ওই বেয়াদবটার আমার বোনকে এত কষ্ট দেওয়ার পরও বেহায়ার মতো মুখ তুলে আমার বাসায় আসলো। সাহস কত?”
তাহিরা কবিতাকে ছেড়ে এগিয়ে যায় ড্রইংরুমের রুমের দিকে। তখনই কবিতা বলে উঠে, “তীর্থকে এসব করতে ধ্রুব উৎসাহ দিয়েছে আপু। আমার সন্দেহ উনি…উনি নিজেও অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত। উনার অতীত দেখে আমার তাই মনে হয়, নাহয় উনি কেন তীর্থকে এসব করার জন্য প্রশ্রয় দিবে?”
তাহিরা থেমে যায় কবিতার কথা শুনে। নিথর হয়ে যায় সে।

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here