মেঘভাঙা রৌদ্র পর্ব ৫

#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব- ৫
#লিখা:#Nilufar_Yasmin

অয়নের সাথে প্রায় পনেরো দিন হতে চললো দেখা বা কথা নেই। ওর ইউনিভার্সিটি এইখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। অন্য সময় হলে ও কলেজে আসতো দেখা করতে। এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে হাটছি। হঠাত একজন ছেলে পিছু ফিরে ডাকলো-

– আপনি কি নীলা আপু?
– হ্যাঁ? কিন্তু কেন?
– আপু আমি এবার নতুন এডমিশন নিয়েছি, আপনি আমাকে চিনবেন না, আসলে…
– হ্যাঁ? আসলে কি! আর পিছু ডাকলে কেন?
– আপু, এই চিরকুটটা একজন দিয়েছে।
– আমাকে! কিন্তু কেন?
– তাতো জানিনা, প্লিজ এটি নিন। আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
– আশ্চর্য! চিনিনা জানিনা, কার কি আমি নিবো! আচ্ছা দাও।

ছেলেটি দিয়েই চলে গেলো,আমি ওইখানে দাঁড়িয়ে ছেলেটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থ- মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম, হাতের মুঠোর চিরকুট টা খুলতেই –

“ক্যান্টিনের ডান পাশের টেবিল টায় বসে আছি”

হাতের লিখাটা অপরিচিত তবুও বুঝতে অসুবিধা হলোনা, এই নিশ্চয় অয়ন হবে, কারণ ও ছাড়া এইভাবে অন্য কেউ ডাকবেও না বা লিখবেনা। আমি একছুটে ক্যান্টিনের দিকে দৌড়ে গেলাম, গিয়েই টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ততক্ষনে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। খেয়াল হতেই কিছুটা লজ্জ্যা পেয়েছি। নিজেই অবাক হয়েছি নিজের এমন পাগলামিতে! ছিছি ও কি ভাব্বে! অয়ন কি বুঝলো জানিনা- আমার দিকে তাকিয়ে বললো-

– হাঁপাচ্ছেন তো, প্লিজ বসুন।

আমি বসতে বসতে, বললাম-

– আপনি ডেকে পাঠিয়েছেন?
– হ্যাঁ, নইলে এইখানে থাকবো কেন? আচ্ছা পরে কথা বলছি- তার আগে পানি খান।

বলেই ও আমার দিকে গ্লাস টা বাড়িয়ে দিলো। আমি পানিটা খেয়ে কিছুটা স্থীর হওয়ার পর অয়ন বললো-

– এখন ঠিক লাগছে?
– হুম্ম।
– কেমন আছেন?

আমি উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। অয়ন আবারো জিজ্ঞাসা করলো-

– কি হলো বলুন?
– কি বলবো?
– কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করেছি।
– জানিনা।
– জানিনা এটা কোন কথা হলো!

ও জিজ্ঞাসা করছে- অথচ কেন যেন আমার খুব অভিমান হচ্ছে, চোখে উপচে পানি আসছে। কোন রকমে নিজেকে সামলিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এমন সময় অয়ন বললো- “মামা, দুই কাপ চা দিয়ে যান প্লিজ।”

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম –

– আমি কিন্তু চা খাবোনা।
– কেন? আমি অর্ডার দিয়েছি তাই?
– না তার জন্য নয়, ইচ্ছে করছেনা। তাছাড়া আমি বাইরের কিছু খাইনা, আমার সমস্যা হয়।
– কিন্তু চা খেলে আপনার ভালো লাগতো।
– প্লিজ জোর করবেন না। আমি চাইনা এটা নিয়ে সিনক্রিয়েট হোক।
– আচ্ছা কি আর করা, আমিই খাই তাহলে।

ক্যান্টিনের মামা চা দিয়ে গেল, অয়ন কাপ টা হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে বললো-

– তুমি কি জানো? তোমার চোখ দুটোতে রাজ্যের ক্লান্তি নেমে এসেছে? খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে! আজকাল কি ঠিকঠাক খাওনা নাকি?
– নাহ খাইতো।
– উঁহু তুমি মিথ্যে বলছো কারণ, তুমি হয়তো জানো না আমি তোমাকে বুঝতে পারি। যেমন আমি এটাও বুঝি তুমি আমাকে খুব পছন্দ করো, ভালোও বাসো। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করোনা।

ওর কথায় কয়েকটা হার্টবিট মিস করে গেলাম – একটা লজ্জ্যা চোখে মুখে এসে ভর করেছে, কিছু না বলতে পেরে চুপ করে রইলাম। কি আশ্চর্য অয়ন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসছে! আমি গলাটা পরিস্কার করে বললাম-

– দেখুন আপনি যা ভাবছেন তা ভুল।
– তাই বুঝি?
– হ্যাঁ,
– তাইলে আমি ডাকতেই ওইভাবে ছুটে আসলে কেন? তুমি কি ভাবো এই ১৫ দিন তোমাকে আমি খেয়াল করিনি? করেছি, সত্যি বলতে আমি ইচ্ছে করেই দূরে থেকেছি তবে তোমাকে ছেড়ে যাইনি এক মুহুর্তের জন্য। সব সময় তুমি আমার চোখের ভিতরেই ছিলে, আমি চেয়েছিলাম আমার শূন্যতা টা তুমি বুঝো। আর এই পনেরো দিন তার জন্য যথেষ্টই ছিলো। তারপর তোমার সামনে আসলাম।
– তো এতদিন পর আসলেন কেন!
– কারণ এর আগে আসলে তুমি শূন্যতা টা অনুভব করতেনা উল্টো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে। বারবার তাড়া খেতে কার ভালো লাগে বলো?

ওর এই কথায় আমার ঠোঁটে হাসি চলে আসলেও গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললাম-

– শুনুন- প্রথম কথা হচ্ছে আমি মোটেও শুন্যতা অনুভব করিনি, আর দ্বিতীয়ত আমি আপনাকে এক মিনিটের জন্য হলেও ভালোবাসিনি,
– শিওর?
– হ্যাঁ,
– তাহলে আমাকে দেখার পর অমন অস্থির হয়েছিলে কেন? কেন তোমার চোখে পানি জমে উঠেছিলো?
– কই পানি জমেছিলো! আপনি ভুল দেখেছেন।
– এতোটা ভুল দেখলাম! তা তোমার কি আজকে কলেজ নেই? যাবো যাবো করে যে অস্থির হচ্ছো না! এটাও কি বলবে আমার বোঝার ভুল?

ওর কাছে ধরা পড়ে গিয়ে চুপ হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম- এতে ও অনেকটায় উত্তেজিত হয়ে বললো-

– আসলে তোমার এই এক দোষ, ভাঙবে তবু মচকাবে না- কেন মনে আসাটা কথা টা বলতে পারছোনা? কিসের এত দ্বন্দ্ব তোমার? আমি দেখতে খারাপ? পড়াশোনায় খারাপ? না কিসে সমস্যা প্লিজ বলো!
-আপনি কোন সমস্যা না, সমস্যা আমি নিজেই। আমার অনেক প্রব্লেম।
– আমিতো চাই সেসব কে সামাল দিয়েই তোমাকে নিজের করে পেতে।
– আমি জানিনা- আমি কি করবো-

অয়ন এই কথায় উঠে যেতে যেতে বললো-

– ভেবেছিলাম এই কয়দিনে তুমি তোমার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছো। দেখো আর যাই হোক মনের উপরে জোর চলেনা। আমি পছন্দ করি বলে তুমিও করবে এমনতো নাও হতে পারে। আচ্ছা ঠিক আছে, তোমাকে আর জোর করবো না। তবে আজকের পর আমাকে আর দেখবেনা।

কথাগুলো অনর্গল বলে অয়ন ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো, যাওয়ার সময় একবারো পিছু ফিরে দেখলোনা। ওর চলে যাওয়া দেখে কেন জানিনা কান্না চলে আসলো- নিজের হাতে মুছে দিয়ে, ঘড়ির দিকে তাকাতে গিয়ে চমকে উঠলাম! তিন টা ক্লাস মিস করে ফেলেছি!

দ্রুত পায়ে ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলাম- আজকের আকাশ টাও মেঘলা। বৃষ্টি নামলো বলে! ক্লাসে যাবো ভেবে ক্লাসের দিকে পা বাড়াতে হঠাত থমকে গেলাম। নাহ ক্লাসে গিয়ে কাজ নেই, মনযোগ হবেনা তার চেয়ে বাসায় যাওয়ায় ভাল হবে। রিকশা নিবো কিনা ভাবতে একটা রিকশা পাশে এসে দাঁড়ালো-

– আপা যাবেন?
– হ্যাঁ যাবো তো..
– কই যাবেন বলেন..

আমি রিকশায় উঠে হুড তুলে বললাম-

– আপনি আগান, আমি বলে দিবো।

রিকশাওয়ালা কে বাসার লোকেশন বলে দিয়ে আনমনেই বসে আছি, বারবার অয়নের বলা কথাগুলো মনের ভিতরে ভাসছে… ও হয়তো আজকে সত্যি সত্যি রাগ করেছে- কিন্তু আমি কি করবো! আমার যে হাত পা বাধা। এই কথা ঠিক, এই কয়দিনে ওকে যতটুকু বুঝেছি, নিঃসন্দেহে ও ভালো মনের মানুষ, কিন্তু আমি যে জানি এই সম্পর্ক মানবার নয়- তবুও মন মানতে চায়না, নিজের মনে হাজার রকমের দোটানা, একবার আগালে দশবার ফিরে আসি!

কলেজ থেকে ফিরে রুমের দরজা দিয়ে শুয়ে রইলাম। আম্মু বেশ কয়েকবার এসে ডেকে গেছে। আমি মাথা ধরেছে বলে দরজা দিয়ে চুপ করে পড়ে রইলাম। রাত যখন আট টা নাগাদ আম্মু দরজায় দাঁড়িয়ে আবারো ডাকলো-

– নীলা দরজা খোল, কথা আছে-
– আম্মু পরে এসো ; এখন ভাল্লাগছে না।
– কেন ভাল্লাগছে না আমাকে তো বলবি, দয়া করে দরজা টা খোল বাবা- এমন করলে আমার খারাপ লাগেতো। সেই বিকেলে কলেজ থেকে ফিরেছিস; অথচ মুখে কিছুই দিস নাই, এইভাবে শরীর খারাপ করবে তো।

আম্মুর কন্ঠটা করুণ শোনালো, আমি উঠে গিয়ে দরজা টা খুলে দিতেই আম্মু রুমে ঢুকে খাটের একপাশে বসে বললো-

– এইখানে আয়, আমার কাছে একটু বস-

আমি আম্মুর পাশে বসতেই-

– কি হইছে তোর বলতো?
– কি আবার হবে!
– তাহলে চোখ মুখের এমন অবস্থা কেন?
– কই!
– আয়নায় ভাল করে দেখ?
– বাদ দাও তো আম্মু, ঘুমাইছি তাই অমন দেখায়-
– তাই বুঝি? মায়ের চোখ কে ফাঁকি দিবি এতই সোজা? বল কি হইছে?
– আম্মু প্লিজ থাকনা-
– থাকবে কেন? আমার এত বছরের একাকী জীবনে আমি শুধু তোকে বুকে আগলেই বেঁচে আছি, সেই তুই যদি এমন থাকিস কেমন লাগে বলতো? যেদিন মা হবি সেদিন বুঝবি মা হওয়ার কত জ্বালা!

আমি কিছু বলতে না পেরে, আম্মুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। তারপর বললাম-

– আচ্ছা আম্মু তুমি আব্বুকে খুব ভালোবাসতে তাইনা?
– পাগলি মেয়ের কথা শুনো!
– বলোনা?
– এটা কোন প্রশ্ন হলো! আমি যা বাসতাম তোর আব্বু তার দ্বিগুণ বাসতো। এইজন্যই হয়তো সুখটুকু সইলো না।
– হয়তো.! ধরো কখনো যদি আমাকে কেউ এইভাবেই ভালোবাসে তুমি কি রাগ করবে?
– হা হা হা রাগ করবো কেন! আমিতো চাই, বিয়ের পর জামাই তোকে খুব ভালোবাসুক। আমি জানবো আমি না থাকলে কেউ একজন থাকবে যে আমার মেয়েকে যত্নে রাখবে। দিন-রাত আল্লাহ কে কত যে বলি, আল্লাহ তুমি আমার মেয়েটার জন্য এমন একজন কে জুটিয়ে দিও যে তাকে সকল পরিস্থিতি তে আগলিয়ে রাখবে।

আম্মুকে আর কিছুই বলতে পারলাম না। আমি যা বুঝাতে চেয়েছিলাম হয়তো আম্মু সেটা বুঝেনি, আমিও আর বুঝানোর চেষ্টা করলাম না। অথচ বলতে পারলে হয়তো হালকা হতে পারতাম। আমি চুপচাপ আম্মুর কোলে শুয়ে আছি। আম্মু আমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। হঠাত কি ভেবে আম্মু বললো-

– ‘তবে একটা কথা কি জানিস? জীবনে চলতে চলতে অনেক সময় অনেক রকম ভুল হয়ে যায়, সেসময় বুদ্ধি দিয়ে সেগুলোকে মোকাবিলা করতে হয়। মনে রাখবি, জীবন ছেলেখেলা নয়। তাই যেকোন কথা ভাবার আগে কিংবা যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হাজার বার ভাববি। এতে জীবনে জটিলতা কম আসবে।’

আমি জানিনা আম্মু কেন কথাগুলো বললো- তবে আমার জন্য এইগুলো খুব শিক্ষনীয়। তাই আম্মুকে আশ্বস্ত করতেই বললাম-

– আমি জানি আম্মু, আমাকে নিয়ে তোমার খুব ভয়, কারণ আব্বু নেই, তুমি আমাকে একা হাতে এতটা বড় করে তুলেছো, আমি অবশ্যই তোমার সম্মানের কথা, মামার সম্মানের কথা মাথায় রেখেই চলবো। এমন কিছু করবো না যাতে তোমরা ছোট হও।

এরপর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়, অয়নের সাথে কথা হয়না। বুকের ভেতরের শুন্যতা টা বুঝতে পারি, তবুও নিজেকে বুঝ দিয়ে রাখি। জানি অয়ন রাগ করেই যোগাযোগ করেনা। অন্য সময় হলে ও ঠিকই ফোন দিতো।

রাত প্রায় বারো টা বাজতে চললো- ফোন দেয়া ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতে ফোন দিয়েই ফেলি- যাইহোক আজকে এর একটা শেষ হওয়া চাই, হয় এইদিক নইতো ওইদিক। ওপাশে রিং হচ্ছে, কিন্তু অয়ন ফোন টা তুলছেনা!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here