মেঘভাঙা রৌদ্র পর্ব ৯

#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব-৯
#লিখা :#Nilufar_Yasmin

এই তিন বছর তো নিজের উপরে কম অত্যাচার করিনি! কিন্তু কথা সেটা নয়; আমার চিন্তা অয়নকে নিয়ে, ও যদি আবারো কথা বলতে চায় অযুহাত কতবার দিবো! আর বারবার না বললে আবির ই বা কি বলবে? ভাববে হয়তো আমি অহংকারী, তাই কথা বলতে চাইনা। কিন্তু কি করে বলি, কেন বলতে চাইনা।

চোখে ঘুম নেই- শুয়ে থেকে ঘাড় ব্যাথা হবার উপক্রম; অগত্যা বিছানা থেকে উঠে বসলাম। আবিরের দিকে তাকাতে দেখলাম, ও ঘুমুচ্ছে। কিন্তু ওর গায়ের চাদর টা সরে গেছে, সেটাকে ঠিক করতে গিয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম, এই প্রথম ওকে ভাল করে দেখলাম, ঘুমন্ত ওকে এতটা স্নিগ্ধ আর নিস্পাপ দেখায়! না দেখলে হয়তো বুঝতাম না! তবে এটাও ঠিক, এই কয়েক ঘন্টায় এ বাড়িতে এসে ওকে যতটুকু দেখলাম কিংবা বাকি সবাইকে যতটুকু দেখলাম, তাতে ওকে এবং এই পরিবারকে পাওয়া নিঃসন্দেহে ভাগ্যের ব্যাপার। আমার জীবনে অয়ন নামের কেউ যদি কখনো না এসে থাকতো, হয়তো আজকে আবিরের মত একজনকে পেয়েছি ভেবে গর্ববোধ হতো! যাইহোক, ও যদি ঘুম ভেঙে আমাকে এইভাবে দেখে, ব্যাপারটা লজ্জ্যার হবে; ভেবেই তাড়াতাড়ি ওর মুখের উপর থেকে সরে গেলাম। কিন্তু ঘুম না আসলে এইভাবে কতক্ষণ বসে থাকা যায়! আবির কে কি ডাকবো? না থাক, কেবলমাত্র ঘুমাইলো, উঠানো টা ঠিক হবে না, তারচেয়ে কিছুক্ষণ নাহয় বারান্দায় গিয়ে বসি।

উঠে বারান্দায় গেছি; রেলিঙে ভর দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আকাশের দিকে তাকাতে দেখলাম, আকাশ টা কেমন যেন ঘোলাটে থমথমে! হয়তো চাঁদ টা মেঘের আড়ালে গিয়ে লুকোচুরি করছে বলে! তবে যাই বলিনা কেন- রাতের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে, যেমন আছে তার নি:সঙ্গতাও! আর তাই হয়তো দিনের আলোয় হাসিখুশি থাকা মানুষগুলো রাতের আঁধারে ঠিকই মুখ লুকিয়ে কাঁদে!

নিজের শুণ্যতাটা কে অনুভব করলাম, বুকের ভিতরে দীর্ঘশ্বাস টাকে চাপা দিতেই চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো! মনে পড়ে গেলো- কত স্বপ্ন ছিলো; অথচ সবটায় তার মরিচিকা ছিলো!

কিন্তু এই মুহূর্তে কেন যেন, নিজের চেয়ে আবিরের জন্যই বেশি খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে আমি ওর জীবনে এসে ওর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম, আমার উচিত হয়নি এই বিয়েটা করা। আমার সাথে বিয়ে না হয়ে অন্য কারর সাথে হলে নিশ্চয়ই ওকে ঠকতে হতো না, নিশ্চয় ও সুখি হতো। সবার মতো তো ওর ও সুখি হওয়ার অধিকার ছিলো। সব আমি শেষ করে দিলাম! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টার দিকে চোখ গেছে, দেখলাম ওখানে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে! কিন্তু এখন তো অনেক রাত ! এত রাতে কেউ থাকবেই বা কেন? পরক্ষণেই মনে হলো, কেউ কোন দরকারে থাকতেই পারে। বলেই ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাবো, দেখলাম অয়ন আমার সামনে দাঁড়িয়ে! বিস্ফোরণ চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে! ও এইখানে আসলো কখন! ভাবতেই মাথার ভিতর ঝিমঝিম শুরু হয়। চেষ্টা করছি আবিরকে ডাকার কিন্তু গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। ঘরে চলে যাবো তাও পারছিনা- মনে হচ্ছে কেউ আমার পা- দুটো চেপে ধরে আছে। পুরো শরীর ঘেমে একাকার। কি করবো বুঝতে পারছিনা!

*

সকালে ঘুম ভাঙতে নিজেকে বিছানায় আবিস্কার করলাম। দেখলাম আবির আমার সামনে বসে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম-

– আমি এইখানে কিভাবে আসলাম? আমিতো বারান্দায় ছিলাম!

– হ্যাঁ, আপনি বারান্দায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। আমি নিয়ে এসেছি।

– কি বলছেন!

মাথাটা এখনো ঝিম ঝিম করছে। কপালে হাত দিতেই দেখলাম ব্যান্ডেজ! মাথায় ব্যান্ডেজ কেন! বলেই উঠতে যাবো, আবির নিষেধ করলো। বললো-

– আমি ফার্স্টএইড করে দিয়েছি। পড়ে যাওয়ায় আপনার কপালের খানিক টা কেটে গেছিলো।

– কি বলছেন, এতকিছু হলো অথচ আমি কিছুই জানলাম না!

– জানবেন কিভাবে? আপনিতো জ্ঞানে ছিলেন না। আসলে রাতে কিছু একটা ভারি পড়ার শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। বিছানায় তাকাতে দেখি আপনি নেই, খুঁজতে গিয়ে দেখি বারান্দায় পড়ে আছেন, আর কপাল থেকে রক্ত ঝরছে, হয়তো পড়ার সময় চেয়ারের সাথে ঠুকে গেছে। অবস্থা দেখে আপনাকে উঠানোর চেষ্টা করি, কিন্তু আপনি তখন এমন ভাবে সেন্স লেস যে আপনার জ্ঞান ই ফিরে না, পরে আমি বিছানায় নিয়ে এসে ফার্স্টএইড দেই। তারপর ডাক্তারকে ফোন দিয়ে সব টা বললে, উনি মেডিসিনের নাম বলে দেন, পরে আপনার ঘুম ভাঙলে আপনাকে মেডিসিন দেই। এবং কিছুক্ষণ পর আবারো ঘুমিয়ে পড়েন। অবশ্য সকালে ডাক্তার নিজে এসেও দেখে গেছেন। বললেন- ভয়ের কিছু নেই। শুধুমাত্র ঘুম আর খাওয়া ঠিকঠাক হলেই দ্রুত সেরে উঠবেন।

– তারমানে তো এই কয়েক ঘন্টা যাবত আপনি আমাকেই নিয়ে বসে আছেন। আজকে বাড়িতে অনুষ্ঠান আর আমি কি না আপনাকে বদ্ধ করে রেখে দিয়েছি। প্লিজ আপনি এখন যান। আমি এখন ঠিক আছি।

– হুম্মম কতটা ঠিক আছেন সে তো দেখতেই পারছি। তার উপরে তো একটাও কথা শুনেন না।

– শুনলাম না কোথায়!

– তাই তো! রাতে আপনাকে এত করে বললাম, ঘুমিয়ে পড়ুন, তাহলে কি দরকার ছিলো বারান্দায় যাওয়ার! আপনি এর আগেও একবার অজ্ঞান হয়েছেন, ঠিকমতো খান না ঘুমান না বলেই তো এমন হচ্ছে! অথচ আপনি সেই না ঘুমিয়ে বাইরে গেছেন! দেখলেন তো? আবারো অসুস্থ হলেন! আমার কথা শুনলে এমনটা হতো না।

– আমি সত্যিই দুঃখিত। আসলে বারবার ক্ষমা চাওয়াটাও লজ্জ্যার কিন্তু কি করবো, আপনি ঘুমানোর পর এক ফোটাও ঘুম আসছিলো না তাইতো একটু…

– বারান্দায় গেছিলেন; তাইতো?

– হুম্মম বললাম তো সরি।

– এখন সরি বলে কি লাভ, সেই কষ্ট টা তো আপনার ই হলো। আর ঘুম আসছিলো না যখন, আমাকে ডাকলেও তো পারতেন।

এত বকা দিচ্ছেন কেন? কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলামনা। আসলে নিজের এই অবস্থার কথা ভেবে নিজেই লজ্জ্যা পাচ্ছি! না জানি, শাশুড়ি কি ভাবছেন! আবিরের দিকে তাকালাম, চোখে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ভাঁজ! ওকে কি বলা উচিত বুঝতে পারছিনা। শুধু বললাম-

– কয়টা বাজে?

– এইতো প্রায় ৮ টা।

– ও বাড়ি থেকে কি কেউ ফোন দিয়েছিলো?

– হ্যাঁ, আম্মার সাথে কথা হয়েছে।

– আম্মুকে আমার কথা বলেছেন?

– না শুধু শুধু চিন্তা করবেন; তাই বলিনি। আপনার সাথে কথা বলতে চাইছিলেন, বলেছি আপনি ঘুমুচ্ছেন, পরে কথা বলতে তা ছাড়া আপনি তো বিকেলেই ও বাড়ি যাচ্ছেন।

– মামারা কি রওনা দিয়েছেন?

– না- বললেন কিছুক্ষণের মধ্যে বের হবেন।

– আর আত্মীয়স্বজন?

– নাহ, তবে কাছাকাছি যারা আছেন তারা এসেছেন কিন্তু এত কথা আপনি জিজ্ঞাসা করছেন কেন!

– আসলে আমিতো অসুস্থ, এই অবস্থায় বাইরের কেউ দেখলে এটা কারর ই ভালো লাগতো না। তাই আর কি। এই ঘরে আম্মা এসেছিলেন?

– হুম্মম, এসেছিলেন তো। আম্মা অনেক্ক্ষণ বসে ছিলেন আপনার পাশে।

– ছিঃ উনি কি ভাবলেন!

আবিরকে কথা টা বলছি এমন সময় শাশুড়ী ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন-

– এখন কেমন বোধ করছো মা?
– জ্বি, ভালো।
– তুমি নাকি রাতেও এমন হয়েছিলে, আবির বললো, তা আমাকে ডাকোনি কেন! তোমার এমন অবস্থা দেখে সবাই কত ভয় পেয়েছি বলতো? আর শুনলাম রাতে ঠিকমতো খাওনি। তা না খেলে তো মাথা ঘুরবেই। তোমার মা শুনলে কি ভাববেন বলোতো? ভাববেন আমরা তোমার ঠিকঠাক দেখভাল করিনি। আর কখনো এমন করোনা কেমন? সব সময় নিয়ম করে খেতে হয়। নইলে তো শরীর খারাপ করবেই।
– আম্মা, আমি খুব ই দুঃখিত।
– ওই দেখো, সে আমাদের পরের মতো কথা বলছে। আরে মেয়ে, তুমি অসুস্থ হয়েছো এতে দুঃখিত হওয়ার কি আছে! আমরা তো তোমার আপনজন, আর এখন থেকে তোমার ভালো-মন্দ সবকিছুই তো আমাদের। তাই তুমি যেন ভালো থাকো তার জন্যই বললাম।

উনার কথার উত্তরে কি বলা উচিত বুঝতে পারিনা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি আবারো বললেন-

– এখন তুমি উঠতে পারবেতো?
– জ্বি পারবো।
– তাহলে ধীরে ধীরে উঠে, গোসলটা সেরে খেয়ে নাও। চারিদিক থেকে লোকজন আসা শুরু করবে, তাছাড়া তোমার বাবার বাড়ির সবাই আসছেন। উনারা এসে যদি তোমাকে এইভাবে দেখেন, কষ্ট পাবেন। আর হ্যাঁ, আমি মেয়েদের পাঠিয়ে দিচ্ছি ওরাই তোমাকে শাড়ি গয়না পরতে সাহায্য করবে। তাড়াতাড়ি কর, দেরি করোনা কেমন?

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই উনি বেরিয়ে গেলেন। এদিকে উনি চলে যাওয়ার পর আবির বললো-

– আমি বাইরে যাচ্ছি, টেবিলে নাস্তা রাখা আছে, গোসল সেরে খেয়ে নিবেন। আর ডাক্তার কিছু ঔষধ দিয়ে গেছেন, নাস্তার পর মনে করে ঔষধ গুলোও খাবেন। আমি সব দেখিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।

তারপর ঔষুধ গুলো দেখিয়ে দিয়ে ও বের হতে যাবে এমন সময় বললাম-

– একটা কথা বলবেন?
– কি-
– ডাক্তার কি বলেছেন আমার ব্যাপারে?
– তেমন কিছু না, ব্যাথার ঔষুধ দিয়েছেন, রেস্ট নিতে হবে, আর ঠিকঠাক খেতে হবে। এই আর কি।
– আর কিছু বলেননি?
– আর কি বলবেন!
– সেটাই তো জানতে চাইছি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আপনি কিছু একটা আড়াল করছেন।
– আড়াল করার কিছু নেই। তাছাড়া করে লাভ কি। আপনাকে তো বলতেই হবে। আর বাড়ির এই সমস্ত ঝামেলা মিটে গেলে আমিই নিয়ে যাবো। কারণ, ডাক্তার আপনাকে একজন ভালো সাইকোলজিস্ট দেখাতে বলেছেন।
– সাইকোলজিস্ট কেন!
– আসলে আপনার ব্যাপারে সবটা শোনার পর উনার ধারণা, আপনার হয়তো কিছু মানসিক সমস্যা হচ্ছে । যার কারণে এমন টা হচ্ছে৷ উনি বললেন- মানুষ যখন কোন বিষয় নিয়ে খুব বেশি ভাবে, কিংবা সে বিষয় টায় ভয় পেয়ে যায়, তখন সে একরকম নিজর মধ্যে কিছু কল্পকাহিনি গড়ে তুলে এবং সেটাকেই সত্যি ভেবে নেয়, অথচ বাস্তবে যার কোন অস্তিত্বই থাকেনা। অবশ্য আপনার তেমন কিছু হতে পারে তেমন না, তবে উনি শিওর না আর সেটা ক্লিয়ার হওয়ার জন্যই সাইকোলজিস্ট দেখাতে বলছেন। আপনি হয় কিছু নিয়ে ভাবছেন কিংবা কিছুতে ভয় পাচ্ছেন, যার কারণে আপনার এমন হচ্ছে। চিন্তার কারণ নেই, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।

কথাগুলো বলেই ও একটু হাসি দিলো, হয়তো আমাকে আশ্বস্ত করতেই। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। ডাক্তার যা বলেছেন তা যদি ঠিক হয়, তবে তো আমারো ঠিক তাই তাই হচ্ছে, নইলে আমি বারবার অয়নকে দেখবো কেন! নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে খুব বেশি ভাবার কারণে কিংবা ভয় পাবার কারণে এমনটা হচ্ছে। নাহ আর নয় আবিরকে সবটা বলতে হবে, আর সেটা এখনি। সমস্ত দোটানা কে ঝেড়ে ফেলে আবিরকে বললাম-

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here