মেঘভাঙা রৌদ্র পর্ব ৮

#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব- ৮
#লিখা:#Nilufar_Yasmin

কিন্তু আমি ভাবছি- অয়নের ব্যাপারটা কিভাবে বলবো- নিজের ইতস্ততভাব কাটিয়ে বললাম-

– আপনাকে আমার কিছু কথা বলার আছে। জানিনা শোনার পর আপনি কিভাবে নিবেন; তবে না বলতে পারলে আমি শান্তি পাব না।

– শুনুন, এই মুহুর্তে আপনার কোন কথা শুনা হবেনা৷ কারণ, কথা বলার চেয়ে আপনার সুস্থতা বেশি দরকার, আর তারজন্য খাওয়া এবং ঘুম জরুরী। সুতরাং নাস্তা আর চা টুকু খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। দেখবেন একটা ফ্রেশ ঘুম হলে, সকালে উঠে ভালো লাগছে।

– কিন্তু আপনি বুঝছেন না, এখন না বললে পরে হয়তো দেরি হয়ে যাবে, আর তখন আপনিই বলবেন আগে কেন বলিনি।

– কি মুশকিল, সময় তো চলে যাচ্ছেনা! বলার তো অনেক সময় পাবেন, একমাত্র যে এটায় উপযুক্ত সময় তা তো নয়! আর একটা কথা, আপনি যখনই বলবেন তখনই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আপনি মানুষ টা নিজেই। সুতরাং এখন না বললেও চলবে।

– তবুও, আমার মনে হয় এখনই বলা উচিত, নইতো পরে এটাই আমার ভুল বলে গণ্য হবে।

– আচ্ছা, এই কথাতো? আমিই বলছি, কোন ভুল হবেনা, বা দোষ হবে না, হলো এবার? আপনি আসলে বুঝতে চাইছেন না, আপনি আমাকে কতটা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন! আমি তো বুঝতেই পারছিলাম না কি করবো। আপনার জ্ঞান ফিরতে আর একটু দেরি হলেই আমি আম্মুকে ডাকতাম।

– ভাগ্যিস ডাকেন নাই, নইলে এটা আমার জন্য খুবই লজ্জ্যার হতো। তাছাড়া পুরো ব্যাপারটার জন্য সত্যিই আমি লজ্জিত।

– হয়েছে, আর ফর্মালিটি দেখাতে হবেনা। সকালে কিন্তু বউ ভাতের অনুষ্ঠান, ও বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। তারা যদি এসে আপনার এই অবস্থা দেখেন, ব্যাপার টা কিন্তু খুব খারাপ হবে। উনারা হয়তো ভাববেন, আমি তাদের মেয়ের ঠিকমতো দেখাশুনা করতে পারিনি। তাছাড়া এইদিকের দাওয়াতের মানুষজন তো আছেই; তারা তো মুলত আপনাকেই দেখতে আসবে। প্লিজ আর দেরি নয়, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। নইলে কিন্তু এবার আরো বেশি করে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

– শুনুন, আপনি এতটা উতলা হবেন না, সত্যিই আমার তেমন কিছু হয়নি, এইযে দেখুন? আমি একদম ঠিক হয়ে গেছি।

– ঠিক হয়ে গেছি বললে আমি শুনবোনা, কালকের প্রোগ্রাম টা মিটে যাক, আমি আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।

– এ মা- না না- এটা কিন্তু বেশিই হয়ে যাবে। প্লিজ, এমন কিছু করবেন না; এটা দৃষ্টিকটু দেখাবে।

– দৃষ্টিকটুর কিছু নেই। অসুস্থ যে কেউ, যেকোন সময় হতে পারে। আর যেহেতু আপনার সমস্যা দেখা দিয়েছে, সুতরাং অবশ্যই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার, নইলে তো বুঝবো না কি প্রব্লেম হইছে?

– কি প্রব্লেম আবার! সামান্য অজ্ঞান হওয়াতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি জানিতো আমার কিছু হয়নি, হয়তো কয়দিন থেকে ঘুম হচ্ছিলো না বলেই মাথাটা ঘুরে গেছিলো। প্লিজ এটা নিয়ে আর কিছু করতে যাবেন না।

আমার কথা শুনে এবার আবির বলে-

– জানেন? কিছু কথা না বললেই নয়-জীবনে পড়াশোনার বাইরে আমি কখনো কিছু ভাবতাম না। বলতে গেলে আমার মাঝে ওইসব আসতোই না। হ্যাঁ, ভার্সিটিতে মেয়ের অভাব ছিলো না তবে ওরা যতটা অ্যাডভান্স ছিল আমি ততটা হয়তো ছিলাম না। আর এইজন্যই বন্ধুরা সব সময় বলতো আমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা, আমিও বুঝতাম ; সত্যিই আমাকে দিয়ে ওইসব হবার নয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তাতে আমার আফসোস ছিলো না। কারণ, আমি সব সময় ভাবতাম এমন কেউ আমার জীবনে আসুক, যাকে আমার হারানোর ভয় থাকবেনা আর তার জন্য বিয়ের চেয়ে উত্তম কিছু হতে পারেনা। আমি চেয়েছি যে আমার জীবনে আমার বউ হয়ে আসবে, তাকে আমি আমার পুরোটা দিয়ে ভালোবাসবো, আগলে রাখবো। আর তাই হয়তো আপনার সাথে যখন আমার বিয়ের কথা হলো, কোথা থেকে যেন একটা মায়া তৈরি হয়ে গেলো! আপনাকে দেখে আসার পর বারবার কেবল আপনার মুখটা আমার চোখে ভাসতো। ভয় হতো যদি আপনাকে হারিয়ে ফেলি? তাইতো বিয়ের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আল্লাহ কে বলতাম- ‘আল্লাহ তুমি তাকে মিলিয়ে দাও’। তারপর যখন সত্যি সত্যি বিয়েটা হলো- মনে মনে বললাম- আলহামদুলিল্লাহ, ‘আমি তাকে পেলাম’! জানেন? আমাদের বিয়ের পর, আল্লাহর দরবারে সাথে সাথে শুকরিয়া আদায় করেছি।

আবির কথাগুলো বলছে, আমি চা খাওয়া বাদ দিয়ে অবাক হয়ে শুনছি, আমি যে ওর মুখের দিকে চেয়ে ওর কথা শুনছি, ওর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ই নেই! ও তখনো বলেই চলেছে….

– বিশ্বাস করুন, বিয়ে হয়ে আসার সময় অনেকবার আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করেছে, কিন্তু পারিনি। মনে হচ্ছিলো কথা বললেই যদি হারিয়ে যান? আর সেই আপনাকে এসে যখন বাসর ঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম, আমার মনে হলো যেন, পুরো পৃথিবীটা নড়ে উঠলো!

এই বাড়িতে আসা থেকে অয়নকে নিয়ে যদিও প্রতিটা মুহুর্ত দুশ্চিন্তায় কাটছে তবুও আবিরের কথাগুলো শুনে কেমন যেন একটা অদ্ভুত শিহরণ হলো! বুঝলামনা এই মানুষটা এখনো আমাকে পুরোটা জানেনি, চিনেনি তবুও তার আমাকে নিয়ে কত ভাবনা! নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো-

– আবির, আপনি আমার কথাগুলো বলতে দিলেন না, তবে এখন আমি নিজেই আর বলতে চাইছিনা। বলবো কোন একসময়। তবে একটা কথা বলতে চাই, আমাকে নিয়ে আপনার ভাবনাই সত্যিই আমি অবাক হচ্ছি। কারণ আমাকে আপনি খুব বেশি জানেননি, চিনেন ও না। হয়তো আপনার ধারণা আমি আহামরি কিছু, কিন্তু এমন একদিন হয়তো আসবে আমাকে আপনার আর তেমন মনে হবেনা। হয়তো মনে হবে, আমি বিশ্বাসঘাতক, কিংবা ছলনাময়ী।

– কিসব অদ্ভুত কথাবার্তা! আমি জানিতো এমন কিছু কখনোই হবেনা।

– এটা কিন্তু বেশি ভাবা হয়ে গেলো। আচ্ছা বাদ দিন- একটা কথা; এতই যখন আমাকে নিয়ে ভাবনা, নিয়ে আসার পর হারিয়ে গেলেন কেন! কোথায় হাওয়া হইছিলেন?

– আরেহ নাহ, আমিতো বাইরে ছিলাম। বুঝছেন ই তো, আব্বা অসুস্থ, এদিকে অয়ন ও বাইরে, তাই বাইরের সব কিছু আমাকেই দেখাশুনা করা লাগছে। আগামীকাল বউ ভাতের অনুষ্ঠান, তার প্যান্ডেল, কত মানুষ হবে, খাওয়ার অ্যারেন্জমেন্ট, সবকিছু তো আমাকেই দেখতে হচ্ছে; তাই আর কি। ওহ ভালো কথা, আপনি তো অয়নকে চিনেন না, ও আমার কাজিন, ছোট খালার ছেলে, আমরা একসাথেই বড় হয়েছি, পড়াশুনা করেছি। কিন্তু ও এখন বাইরে। এই কিছুক্ষণ আগেই ফোন দিয়েছিলো, বললো আপনার সাথে কথা বলিয়ে দিতে। বেচারা বিয়েতে আসতে পারলো না। সেই নিয়ে মন খারাপ করে আছে। জানেন? আম্মু প্রায় বলতো – আমাদের দু’জনের একসাথে একদিনে, বিয়ে দিবে এমনকি একই বাড়ির দুটো মেয়েকে দিয়ে। ভাবুন তো কি ভাবনা এইগুলো!

আবির ওর সবকিছু বলার পর আমার আর কি বলা উচিত বুঝলাম না! ওর কথা শুনে বুঝলাম- ও ওর মনের সবটুকু দিয়ে আমাকে ধারণ করেছে, অথচ অয়নের কথাটা যদি ওকে বলে দিই ও অনেক বড় কষ্ট পাবে! কেন যেন এই মুহূর্তে ওকে আর সেই কষ্ট টা দিতে ইচ্ছে করলো না। কিন্তু না বলেই বা কয়দিন। আজ না হয় বললাম না- কিন্তু এরপর যদি অয়ন এসে বলে দেয়? তখন তো আরো বেশিই কষ্ট পাবে৷ হয়তো আমাদের সম্পর্ক টায় ভেঙে যাবে, আমি তখন কিভাবে তাকে আটকাবো। তাছাড়া অয়ন চলে ছেড়ে যাবার পর আমি আমার নিজেকে নিয়ে ভাবিনা কিন্তু এখন তো শুধু দুটো মানুষ ই জড়িত নই, আমাদের সাথে দুটো পরিবার জড়িত, তাই আমাদের কিছু হলে তারাই আগে কষ্ট পাবে।

“হে- আল্লাহ তুমি আমাকে এই কোন দোটানায় ফেললে!” কথা গুলো আপন মনে বলছি আর ভাবছি। এমন সময় আবিরের ফোনটা বেজে উঠলো- আবির ফোন রিসিভ করে, আমাকে বলেই, বাইরের বারান্দায় চলে গেলো- বুঝলাম অয়ন ই হবে, কারণ এত রাতে ও ছাড়া কেউ ফোন দিবেনা। ওর ওইখানের সাথে এইখানের সময়ের কয়েক ঘন্টা পার্থক্য রয়েছে। আবির কথা বলছে; ওর কিছু কিছু কথা আমার কানে আসছে; ও বলছে-

– তুই তো বিয়েতে আসলি না, আসলে কত ভাল হতো বলতো? কি বললি তোর ভাবির সাথে কথা বলতে চাস? ওয়েট দিচ্ছি-

আবির ঘরে এসে আমাকে ফোন দিয়ে বললো-

– প্লিজ, একটু কথা বলুন। ও আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাইছে।

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না শুধু বললাম-

– প্লিজ রাগ করবেন না, আসলে আমি অপরিচিত কারর সাথে কথা কম বলি। ঠিক আছে, সমস্যা নেই, উনি দেশে আসলে তো কথা হবেই।

– আচ্ছা, আপনার ইচ্ছে না হলে বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি আপনি আনইজি ফিল করছেন।

কথাটা বলেই আবির আমার কাছ থেকে ফোন নিয়ে আবারো বাইরের বারান্দায় চলে যায়। ও চলে গেলে, আপাতত হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

অয়নের সাথে কথা শেষ করে আবির, রুমে ঢুকেই বললো-

আচ্ছা শুনুন, কথায় কথায় কিন্তু অনেক রাত হয়ে গেছে, আপনি আর এক সেকেন্ড ও জেগে থাকবেন না।

বলেই ও বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে সোফায় চলে গেলো- দেখে বললাম-

– একি! এটা কি করছেন?
– কই কি করছি?
– তাও আবার জিজ্ঞাসা করছেন? বুঝছেন না কি করছেন? বালিশ নিয়ে সোফায় কেন!
– ওহ এই কথা! আসলে আপনি অসুস্থ, আমি চাইছি আপনি একদম রিল্যাক্সে ঘুমান। আমি বিছানাই থাকলে আপনার অস্বস্তি হতে পারে। এমনিতেই নতুন পরিবেশ, নতুন বিছানা। আমি চাইনা, অস্বস্তিতা বাড়িয়ে দিতে। এমনিতেই আপনি অসুস্থ। নিন শুয়ে পড়ুন।
– শুনুন, যাইহোক এটা কিন্তু খারাপ দেখায়, আচ্ছা আপনি আর আমি মাঝে বালিশ দিয়ে তো ঘুমাতেই পারি?
– আপনার অসুবিধা হবেনা তো?
– অসুবিধা তো কিছুটা হবেই, ও আমি ম্যানেজ করে নিবো। তাছাড়া আপনিই বলুন, এটা তো একদিন দুইদিনের ব্যাপার নয়, তো আপনি কি রোজ রোজ সোফায় ঘুমাবেন? নইতো? তাই শুরুতেই এর সমাধান করলাম, কি দরকার আপনার অসুবিধা করার। তারচেয়ে এটাই বেটার।

আবির কি বুঝলো বুঝলাম না, শুধু দেখলাম ওর মুখের গাম্ভীর্যের ভিতর থেকেও একরাশ দ্যুতি ছড়িয়ে পড়লো!

মাঝে বালিশ দিয়ে দু’জন দু’দিকে শুয়েছি। জানিনা ও ঘুমিয়েছে কিনা, কিন্তু আমার ঘুম আসছেনা। মনের মধ্যে হাজার রকমের ভাবনা ভিড় করেছে। এদিকে শরীরের অবস্থা সত্যিই ভাল নয়, আবিরের আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি টা সত্যিই মিথ্যে নই, কিন্তু তাতো আর ওকে বলতে পারছিনা! কি করে বলি, আমার এই অবস্থার জন্য অন্য কেউ নয়, ওর ই ভাই দায়ী। এই তিন বছর তো কম অত্যাচার করিনি নিজের উপরে!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here