মেঘভাঙা রৌদ্র পর্ব ৭

#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব- ৭
#লিখা:#Nilufar_Yasmin

ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে আরিবার সাথে খাবার রুমে ঢুকতেই চমকে গেলাম! দেখলাম খাবার টেবিলে আবির বসে আছে! আশ্চর্য এই ছেলে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এসে সেই যে হাওয়া হইছিলো আর দেখিনি! মানুষ প্রেম করলেও এত লুকোচুরি করেনা। অথচ আমি কিনা তার বিয়ে করা বউ! শুনেছি ও খুব শান্ত আর লাজুক প্রকৃতির কিন্তু তাই বলে এতটা! নাকি অন্য কোন কারণে বুঝলাম না!

যাইহোক খাবার টেবিলে আবিরের সাথে আমাকে বসানো হয়েছে; দুটো প্লেট আগে থেকেই সাজানো ছিলো, একজন মহিলা শাশুড়ীর হাতে ধরিয়ে দিলে শাশুড়ী সেগুলো আমার আর আবিরের সামনে দিয়ে বললেন- ‘ নাও তোমরা খাওয়া শুরু করো। সেই কখন এসেছো অথচ তোমার কিছুই খাওয়া হয়নি’!

কিন্তু বাসার সবাইকে রেখে একা একা খাবো ভেবে শাশুড়ী এবং সবাইকে খেতে বললাম, কিন্তু আরিবা ছাড়া কেউ বসলো না। শাশুড়ী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-

– আবির অনেক্ক্ষণ থেকে বসে আছে, আমার অপেক্ষা করোনা। এসে থেকে তো দেখছোই এই বাড়ির সব দিকে আমাকে নজর দিতে হয়, তাছাড়া তোমার শ্বশুর অসুস্থ, উনি এই ঘরে আসতে পারেন না। উনাকে গিয়ে খাইয়ে আসতে হয়৷ আজকে কাজে কাজে ওষুধ খাওয়ানোর দেরি হয়ে গেলো, আমি যাই উনাকে খাইয়ে আসি।

শাশুড়ী বের হওয়ার জন্য দাঁড়াতেই, আমি বললাম-

– আম্মা, আমি না হয় উনাকে খাওয়াতে যাই? আপনি সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি তে অনেক ক্লান্ত। আপনি বরং আপনার ছেলের সাথে খেয়ে নিন।
– তুমি বলেছো এতেই আমি খুশি। তোমাকেই তো সবকিছুর দায়িত্ব নিতে হবে কিন্তু আজ নয়, আজকে তুমি এই বাড়িতে নতুন বউ হয়ে এসেছো, আর নতুন বিয়ে হয়ে এলে কিছু রিতী রেওয়াজ থাকে। তাই আজকে নয়, আজকে বরং আমি খাওয়াই, এরপর না হয় তুমিই খাওয়াইও।

যেহেতু আমি নতুন বউ তাই উনার কথার পরে আর কিছু বললাম না। উনি একজন মহিলার হাতে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

শাশুড়ী খেতে বলে গেছেন, আবির, আরিবা ওরা খাচ্ছে, অথচ আমি না খেয়ে খাবার নিয়ে বসে আছি। মাথার ভিতর এত বেশি কথা ঘুরপাক খাচ্ছে যে কিছুতেই খেতে ইচ্ছে করছেনা। অন্যমনস্ক হয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছি দেখে, আবির নিচু গলায় বললো-

– আপনার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে?

আমি হকচকিয়ে ওর দিকে তাকাই, দেখি ও আমাকেই বলছে- আমি কোনরকমে উত্তর দিলাম-

– কই নাতো, কিসের আবার অসুবিধা হবে!
– আমার তো তাই মনে হলো। অনেক্ক্ষণ থেকেই দেখছি খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।
– আসলে ইচ্ছে করছে না।
– ইচ্ছে না করলে জোর করে খাওয়ার দরকার নেই। আপনি বরং হাত ধুয়ে উঠে পড়ুন। পরে ভালো লাগলে খাবেন।

এই প্রথম আবির আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বললো৷ ও যখন কথা বলে, ওর চোখের মধ্যে গভীর ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে। বুঝা যায় খুব ধীর স্থীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ সে। আচ্ছা আমি যেমন ওর দিকে তাকিয়ে ওকে বুঝতে পারলাম, ও কি কোনদিন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনের কথা বুঝতে পারবে? যেমন টা অয়ন পারতো? কিজানি!

খাওয়া শেষে লিভিং রুমে বসে আছি, খুব ক্লান্ত লাগছে শুতে পারলে ভালো লাগতো কিন্তু আজকে আমি নতুন বউ, নিজে থেকে কিছু বলা ঠিক হবেনা ভেবে চুপ রইলাম। বসে আছি, এমন সময় শাশুড়ি এসে বললেন-

– ‘আরিবা কোথায় বৌমা?’
– ‘জ্বি- আমিতো জানিনা, ও আমাকে বসিয়ে কোথায় যেন গেলো।’
– এই মেয়ে থেকে থেকে কোথায় যে হারিয়ে যায়। সবকাজ কি আমি একাই করবো! তাছাড়া বাড়ির আর সব গেলো কোথায়? আচ্ছা তুমি একটু বসো, আমি ওদের কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তোমাকে তোমার শোবার ঘরে দিয়ে আসবে।

আমি উনার কথায় মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

উনি বলে যাওয়ার পর কয়েকটা মেয়ে দল ধরে এসে বললো-

-‘ভাবি চলুন, আপনাকে আপনার ঘরে দিয়ে আসি।’

বলেই ওরা লিভিং রুম থেকে বের হয়ে ডান পাশের করিডোর হয়ে; দক্ষিণের একটা রুমে নিয়ে গেলো- রুমে ঢুকতেই খুব চেনা একটা ঘ্রাণ পেলাম! বুঝলাম না এইখানে এই ঘ্রাণ কেন! দেখলাম রুমটা নানান রকম ফুল দিয়ে সাজানো। ওরা আমাকে বিছানায় বসিয়ে বললো-

” ভাবি এটাই আপনার রুম। মানে আবির ভাইয়ার রুম, আচ্ছা- আপনি বসুন, ভাইয়াকে আমরা এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

ওরা চলে যাওয়ার পর আমি চুপচাপ খাটের এক পাশে বসে আছি। রুমটায় চোখ বুলালাম। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। ভাবতে অদ্ভুত লাগে, আজ থেকে হয়তো এটাই আমার স্থায়ী ঠিকানা! শুধু আমি নই, প্রতিটা মেয়ের ই হয়তো এই দিনটা নিয়ে, কিংবা স্বামী সংসার নিয়ে স্বপ্ন থাকে। কিন্তু এই কথাও ঠিক বিয়ের পর কেবলমাত্র একটা মেয়েকেই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যা হয়তো ছেলেটিকে হয়না কারণ মেয়েটি কে ছেড়ে আসতে হয় তার পুরো অতীত, তার বাবা, মা আত্মীয়স্বজন সবকিছু! এটা একজন মেয়েই বুঝে, নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশে, নতুন কিছু মানুষের সাথে এডজাস্ট করা কতটা কঠিন। তবুও জগতের নিয়ম অনুযায়ী তাকে পারতে হয়, কারণ না পারলে সে কখনোই সুখি হয়না। এই বাড়িতে আসার আগে কথাগুলো আম্মু, কম করে হলেও দশ বার আমাকে বলে বুঝিয়েছে। কিন্তু আম্মু হয়তো জানেনা, আমি এমন কিছু কোনদিন বা কখনোই করবো না যাতে তাদের সম্মানে আঘাত লাগে। মেয়ে হিসাবে আমারও দায়িত্ব তাদের সম্মান রক্ষা করা।

কথাগুলো যদিও বলছি, তবুও মনে মনে ভয় হচ্ছে, এই বাড়ির মানুষগুলোর আমাকে নিয়ে এত আশা, এত আকাঙ্খা, আমি পারবো তো তাদের উপযুক্ত হয়ে উঠতে? পারবো তো আবিরকে সুখি করতে! কিন্তু অয়ন? অয়ন যেদিন আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে- সেদিন আমি কি করবো? সেদিন যদি আবিরকে সব ও বলে দেয়? তারচেয়ে কি আমার নিজেরই আবিরকে সবটা বলে দেওয়া উচিত ? কারণ অয়নের মুখ থেকে শুনলে নিশ্চয়ই আবির আমাকে ভুল বুঝবে। তাছাড়া এই কথাতো ঠিক, সত্য বেশিদিন চাপা থাকেনা।

এইখানে এসে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো একবারও ভাবিনি। তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, যা হয় হবে আবিরকে বলে দিবো। তাতেই ভালো। কিন্তু এই মুহুর্তে নিজেকে কেন যেন খুব অসহায় আর ক্লান্ত লাগছে। তাছাড়া এই কয়দিন বিয়ের নানান ঝামেলা আর মানসিক চাপে ঠিকমতো ঘুম ও হয়নি তাই হয়তো চোখ দুটো জড়িয়ে আসছে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে আবির এসে হয়তো অন্যকিছু ভাববে! তার থেকে বসেই থাকি।

বেশ কিছুক্ষণ হলো বসে আছি। অথচ আবির আসছেনা, মাথা ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে- কানের চারিপাশ টা ভো ভো আওয়াজ তুলছে, হঠাত সামনের দিকে তাকাতে মাথা টা গুলিয়ে উঠলো! দেখলাম আবির নয় অয়ন আমার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে, যেমনটা আগে হাসতো। কিন্তু আজকের হাসিটা বিদ্রুপের হাসি। ওর ঠোঁট নড়ছে- আমার কানে কিছু কিছু কথা আসছে- ‘নীলা তোমার না আমার বউ হওয়ার কথা! অথচ আজ তুমি অন্য কারর জন্য অপেক্ষা করছো? সে কি তোমাকে আমার মত বুঝবে? আরেহ ও তো আমার ই ভাই, ও এতটাই লাজুক যে কখনো কোন মেয়ের দিকে ভাল করেই চায়নি, ও কিভাবে তোমাকে খুশিতে রাখবে, সুখে রাখবে- হা হা হা!

“প্রচন্ড হাসির শব্দে মনে হয় আমার কানের ভিতর ফেটে যাচ্ছে! আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি না শোনার। তবুও পারছিনা!

‘এই যে শুনছেন? নীলা প্লিজ তাকান’

কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকছে, খুব খীণ ভাবে সে আওয়াজ আমার কাছে আসছে। আমি চোখ মেলতেই দেখলাম আবির আমার মুখের উপরে ঝুকে বারবার আমার নাম ধরে ডাকছে। ওর হাত তখনো আমার গাল ছুয়ে, ওর খেয়াল নেই, আমি তাকিয়ে আছি, ও উদ্ভ্রান্ত হয়ে তখনো ডেকেই চলেছে!

বেশ কিছুক্ষণ লাগলো আমার পরিস্থিতি বুঝতে, আমি তাড়াহুড়ো করে উঠতে যাবো অমনি আবির বললো-

– প্লিজ উঠবেন না। আপনি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। কি হইছিলো আপনার? আমি রুমে ঢুকতেই দেখি আপনি খাটের উপরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তারপর চোখেমুখে পানি দেওয়ার অনেক পরে আপনার জ্ঞান ফিরলো।

কথাগুলো বলার সময় ওর চোখেমুখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তা ফুটে উঠেছে। আমি কি বলবো বুঝতেই পারছিনা। খুব লজ্জ্যা লাগছে, নিজের এমন অবস্থা দেখে, কোনরকমে বললাম-

– আমি খুবই দুঃখিত, আপনাকে এত টা ঝামেলাই ফেলার জন্য।

– ঝামেলা আবার কি! বরং আমার ই দোষ, আমি আর একটু আগে আসলে হয়তো এমনটা হতোনা। নিশ্চয়ই আপনি ঠিকমতো খাননি বলেই এমনটা হয়েছে, না খেলে শরীর তো খারাপ করবেই! রাতেও তো দেখলাম একটুও খেলেন না! আপনি শুয়ে থাকুন, আমি বরং আম্মাকে ডেকে আসি, পরে জানলে বকা দিবে। আর দেখি কিছু খাবার নিয়ে আসতে বলি।

– না না প্লিজ, এত রাতে এসবের দরকার নেই। আর এটা কাউকে জানানোর দরকার নেই। তাছাড়া আমিতো এখন ঠিক আছি। প্লিজ, আমার কথাটা রাখুন, আমি সত্যিই চাইনা এই ব্যাপার টা কেউ জানুক। আর উনার উপর দিয়ে সারাদিন অনেক খাটাখাটুনি গেছে। এখন একটু ঘুমাচ্ছেন; ঘুমাতে দিন।

– তাহলে আমিই কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি।

– না প্লিজ, আমি এখন কিছু খাবোনা। আপনি শুধু শুধু কষ্ট করতে যাবেন না।

– বুঝলেন তো? এইজন্যই আপনার এই অবস্থা, তবুও যদি বুঝতেন।

– আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন। আমি এখন একদম ঠিক আছি।

ততক্ষণে আবির আমার পাশ থেকে সরে গিয়ে বসেছে। আমি উঠতে গেলে ও আমাকে ধরে ফেলে।

– উঠবেন?

– হ্যাঁ একটু ওয়াসরুমে যাবো। এইগুলো ভিজে গেছে, একটু চেঞ্জ করতে হবে।

– ওহ সরি, আসলে আপনার অমন অবস্থা দেখে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই জ্ঞান ফেরাতে অনেকটা পানি চোখেমুখে দিয়ে ফেলেছি।

– সমস্যা নেই। আমি এমনিতেই এসবকিছু চেঞ্জ করতাম। সকাল থেকে এইগুলো পরে আছি।

বলেই আমি আমার লাগেজ থেকে যা যা প্রয়োজনীয় নিয়ে ওয়াস রুমে ঢুকলাম। আয়নায় নিজের দিকে তাকাতে চমকে গেলাম, অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে আমাকে, সাধে আবির বলছেনা আমি না খেয়ে খেয়ে দূর্বল হয়ে গেছি। ও যদি জানতো সবটা। আচ্ছা আমি যদি ওকে সবকিছু বলি ও কি খুব কষ্ট পাবে? কিন্তু বলবো না এটাও তো মানতে পারছিনা। বারবার কেবল মনে হচ্ছে, এটা ঠকানো হবে। কিন্তু কিভাবে বলবো তাও তো বুঝছিনা।

চেঞ্জ করে ওয়াসরুম থেকে বের হতেই অবাক হইলাম! দেখলাম সোফার টেবিলে কিছু নাস্তা আর ধোয়া উঠানো চা!

“আচ্ছা এত করে বারণ করলাম; তবুও আপনি এসব করে আনলেন ই!”

শুনে আবির বললো, আমাকে কি আপনার এতই নিষ্ঠুর মনে হয়? আর যখন জানি বউ টা আমার! যাকে ভালো রাখার সমস্ত দায়িত্ব আমার?

“ভালো রাখার দায়িত্ব” কথাটার মাঝে কোথায় যেন একটা নির্ভরতা ছিলো। ছিলো একটা পবিত্র বন্ধনের প্রতিশ্রুতি। যা আমি অয়নের মধ্যে কখনো পাইনি! আরো একটা জিনিস ভেবে অবাক হইলাম, ওকে আমার যতটা শান্ত আর চুপচাপ মনে হয়েছিলো ও ঠিক ততটা নয়। এই কিছুক্ষণের ওকে দেখে আমার অন্তত তাই মনে হচ্ছে।

– কি এত ভাবছেন! নিন খেয়ে নিন।
– কিন্তু আপনার কই?
– আমাকে খেতেই হবে?
– নইতো আমি একা খাবো!
– আচ্ছা শুধু চা নিচ্ছি।

বলেই ও স্যান্ডউইচ আর চায়ের কাপ টা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে, ওর জন্য ফ্লাক্স থেকে একা কাপ চা নিলো শুধু।

কিন্তু আমি ভাবছি- অয়নের ব্যাপারটা কিভাবে বলবো- নিজের ইতস্ততভাব কাটিয়ে বললাম-

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here