মেঘভাঙা রৌদ্র পর্ব ১০

#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব-১০
#লিখা: #Nilufar_Yasmin

নাহ আর নয় আবিরকে সবটা বলতে হবে, আর সেটা এখনি। নিজের সমস্ত দোটানা কে ঝেড়ে ফেলে আবিরকে বললাম-

– আপনাকে কিছু কথা বলার আছে, যেটা আমি গতরাতেই বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি বলতে দেননি। আপনার ধারণা কথাগুলো না বলে রেস্ট নিলেই হয়তো আমি সুস্থ হবো। কিন্তু ব্যাপার তা নয়- বরং আপনাকে বলতে পারছিনা বলেই আমার বিবেক আমাকে বারবার অসুস্থ করে তুলছে।

খানিকটা দম নিয়ে আবার বললাম-

– এই কথা ঠিক, কথাগুলো না বললেই হয়তো আমার জন্য ভালো হবে; আমার ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে। কিন্তু না বললে-আমার নিজেকে ক্রমশ বেশি করে অসুস্থ করা হবে। কারণ ওই যে বললেন- সাইকোলজিস্ট দেখাতে হবে? ওসব কিছুই লাগবে না যদি আমার ভিতরের অপরাধবোধ টা যায়।

আমাকে এইভাবে বলতে দেখে হয়তো আবির কিছুটা অবাক ই হয়েছে। ও অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে- আমি কি বলছি আর কেনই বা বলছি! ও কিছুই বলছেনা দেখে বললাম-

– দেখুন, আমি মনে করি সম্পর্কের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা উচিত তা যতই কঠিন কিংবা নিষ্ঠুর হোক না কেন। বিশেষ করে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মত এমন পবিত্র একটা সম্পর্কে তো বটেই। কেননা, দুটো মানুষ সারাজীবনের একে অপরের পাশাপাশি চলবে বলে, সুখ দুঃখের ভাগিদারী হবে বলে যে স্বপ্ন নিয়ে পথ চলা শুরু করে সেখানে কোন প্রকার গোপনীয়তা থাকা, মিথ্যাচার থাকা সুখোকর নয়; তাতে বালুচরে গড়ে তোলা বাসার মত যেকোন সময় ভেঙে যেতে পারে। তাছাড়া এই কথা তো ঠিক, একটা সত্যিকে লুকিয়ে রাখলে হয়তো সাময়িক সমস্যা থেকে বাঁচা যায়, তবে আজীবনের জন্য নিজেকে অপরাধবোধে পোড়াতে হয়। এবং যেদিন সেটা প্রকাশ পায়, সেদিন সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা কিংবা ভালোবাসাগুলো প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়! তখন দুজনের মধ্যে সত্যি থাকলেও সবটা মিথ্যে হয়ে যায়, যা একটা মানুষের কাছে মৃত্যর চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক। আমি চাইনা আমাদের কখনো তেমন দিন দেখতে হোক। তাই আমি সবকিছু বলবো, আর সবটা শোনার পর,আপনার উপরেই বিচারের ভার। আপনি যা করবেন তা আমি মেনে নিবো। যেহেতু ভুলটা আমার ই তাই কোন কিছু আটকানোর অধিকার আমার নেই। তবে এটা বলার পর, আমি অন্তত জানবো, আমি আমার দিক থেকে সম্পূর্ণ পরিস্কার। আমি কোন মিথ্যের উপরে কিছু গড়তে চাইনি। কিংবা সত্যিকে আড়াল করার চেষ্টা করিনি। হ্যাঁ হয়তো বলবেন, এতই যখন বুঝছি তো আগে বলিনি কেন! তার ও কারণ আছে- কারণ তখন আমি জানতাম না, এই বাড়িতেই আমার সত্যিটা লুকিয়ে থাকবে। যা আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিবে, আমি ঠিক করিনি। বিশ্বাস করুন, আমার বিবেক আমাকে কাল থেকে বারবার বলছে- সত্যিই আমি ঠিক করিনি। আগে জানলে আমি এই বিয়েটা করতাম না।

– হুম্মম বুঝলাম, কিন্তু এত কথা কেন বলছেন! সেটায় তো বুঝছিনা। তাছাড়া এই কথাগুলো তো আমরা পরেও বলে নিতে পারি? বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানে চলছে, এখন এইগুলো না বললেই কি নয়?

– না। বললাম যে পরে হলে দেরি হয়ে যাবে?

– আচ্ছা বলুন; আমি শুনছি-

– তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। বিয়ের পর আপনি যদি জানতে পারেন, আপনি যাকে বিয়ে করেছেন, সে অন্য কারর জীবনে কোন এক সময় ছিলো? কি করবেন আপনি?

– কি আর করবো, সবটা শোনার পর যেটা সঠিক মনে হবে সেটায় করবো।

– এটা বলছেন ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে ঘটলে এমন টা আর বলবেন না।

– মানে!

– মানে হলো, আমি একজনকে ভালোবাসতাম, সেও ভালোবেসেছিল, অবশ্য আমি সেটা বিশ্বাস করিনা। কারণ সে আমাকে দেয়া সমস্ত প্রতিশ্রুতিকে ভুলে চলে গেছে। বুঝাতে পেরেছি এবার? এতক্ষণ কি বলছিলাম, কেন বলছিলাম?

তারপর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অয়নের ব্যাপারে সবকিছু আবিরকে বলি এবং সবটা শোনার পর ও আমাকে বলে-

– হুম্মম, শুনলাম কিন্তু এখন আপনি কি চান?
– আমি কি চাই মানে?
– হুম্ম- আপনি কি চান।
– আমি কি চাই এটা কোন প্রশ্ন হলোনা, আমি যা চেয়েছি তাতো দেখতেই পাচ্ছেন। কারণ আমি সবটা কে একপাশে সরিয়ে রেখেই এই সংসারে বউ হয়ে এসেছি, সেটা সংসার করবো বলেই। হ্যাঁ হয়তো বলবেন, অয়নকে ভুলে? তা হয়তো নয়, তবে এটাও ঠিক এই তিন বছরে ওকে ছেড়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, মেনেও নিয়েছি। কারণ যা আমার ভাগ্যে ছিলোনা তা নিয়ে যদি হা-হুতাশ করি লাভ নেই। বরং বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে যদি এই পরিবারের একজন হয়ে উঠতে পারি তবে সেটাই কম কি? কিন্তু এখন আর সেটা আমার উপরে নেই। আপনার উপরেই নির্ভর। এখন আপনিই বলুন, সবটা জানার পর আপনি আমাকে রাখবেন নাকি ত্যাগ করবেন।

– সেটা পরের ব্যাপার। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যা মন থেকে চাননি তা পেয়ে কি আপনি সুখি হবেন?

– দেখুন, সুখ তো একদিনে ধরা দেয় না, তার জন্য সুখটাকে পরিচর্যা করতে হয়, যত্ন দিয়ে লালন করতে হয়। আর তার জন্য দরকার হয় পাশে থাকা মানুষগুলোর সাহায্য সহযোগিতা।

– হ্যাঁ তা ঠিক। তবে এই মুহূর্তে আসলে আমার কি বলা উচিত, আমি বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস করুন আমি ভাবিই-নি আমার জীবনে এমন কিছু ঘটবে। তবে একটা কথা ঠিক- আপনি বলে ভালো করেছেন, যাই লাগুক সবটা শোনার পর আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ টা বেড়ে গেছে। কিন্তু এই কথাও ঠিক, আমার জীবনের নিজস্ব কিছু স্বপ্ন ছিলো, ভালোলাগা ছিলো, যা আমি লালন করতাম, কিন্তু –

– কিন্তু আপনি ঠকে গেলেন তাই তো?

– আমি তা বলিনি তবে, তবে এমনটা হবে তাও ভাবিনি।

– আমি জানি আপনি ভাবেননি; আর ভাবার কথাও না।

– সেটা তো যা আছে, আমি ভাবছি অন্যকথা। ভাবছি, অয়ন যে এইভাবে কারর সাথে জড়িয়েছিলো সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি! ও আমার এতটা কাছের অথচ আমি একদিন ও সেটা বুঝলাম না! আশ্চর্য হচ্ছি, ওর এমন কথা শুনার পরে। হয়তো আমি জানলে এমনটা হতো না হয়তো আপনাদের ভেঙে যাওয়াটা আটকাতে পারতাম।

– হাসালেন! যে নিজেই চায়না তাকে আপনি জোর করতেন,?

– তা নয়। তবে চেষ্টা করতে তো দোষ ছিলো না।

– বাদ দিন। যা হওয়ার ছিলোনা তা নিয়ে বলে লাভ নেই। বরং এখন কিন্তু আমি আপনার ইচ্ছে শুনার অপেক্ষায় আছি। আমি কিছুই আড়াল করিনি, সবটা তো শুনলেন, এখন আপনি বলুন কি সিদ্ধান্ত আপনার।

– কি বলবো- সত্যি বলতে কখনো কখনো খুব সহজ কথাগুলো বলতেও খুব কঠিন মনে হয়।

– এত ইতস্তত করার দরকার নেই। আপনি বলুন সমস্যা নেই। দেখুন, আপনি কোন কনফিউশান রাখবেন না- হ্যাঁ এই কথা ঠিক- সম্পর্ক টা ভাঙলে হয়তো দুটো পরিবার কষ্ট পাবেন, কিন্তু শুধুমাত্র তাদের কথা ভেবে আপনার মন যা না চায় তা করাটা ঠিক নয়।

– নীলা, আসলে ব্যাপার সেটা নয়, মানুষকে বিশ্বাস করে স্বপ্ন দেখা কোন ভুল নয়। আপনিও দেখেছিলেন। এটা আমার জীবনেও হতে পারতো। আর আমার জীবনে হয়নি বলেই সেটা দোষের হবে, সেটা আমি মানি না। তাছাড়া যদি কোন অন্যায় হয়ে থাকে সেতো অয়নের অন্যায় ছিলো।

– তারজন্য কোন অভিযোগ নেই। আমি সমস্ত অভিযোগ কে সরিয়েই বলছি ও যেভাবে সুখি হয় হোক। যাইহোক, অনেক কথায় বলে ফেলেছি- বাইরে সবাই এসে গেছে হয়তো। কথা হচ্ছে- আর কিছুক্ষণ পর সমস্ত রিচ্যুয়াল শেষে হয়তো আমাকে চলে যেতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী আপনাকেও আমার সাথে যেতে হয়। তবে আমি বলছি, আপনি না চাইলে যেতে হবে না। তার জন্য কেউ আপনাকে জোর ও করবেনা। কারণ মন যদি শাঁই না দেয় তবে তা করলে নিজেকে বন্দি লাগে। তাছাড়া সব সময় সামাজিকতা রক্ষা করতে হবে তার ও কোন মানে নেই।

– শুনেন, আমাকে এতটা ছেলেমানুষ ভাবার কোন কারণ নেই। আমার খারাপ লাগছে এই ভেবে অয়ন কোন একদিন আপনাকে চেয়েছিলো, যে কারণেই ছেড়ে যাক সেটা পরের কথা। কিন্তু সেই আপনাকেই আমি বিয়ে করে নিয়ে এসেছি।

– হ্যাঁ নিয়ে এসেছেন কিন্তু সেটা তো এমনি এমনি না! আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, অয়নের ভালোবাসা আমি কখনোই ছিলাম না থাকলে এইভাবে ফেলে যেতোনা। হয়তো আমি ওর যোগ্য ছিলাম না বলেই উচ্ছিষ্ট ভেবে ছুড়ে ফেলেছে।

– ছিঃ এসব কি বলছেন? আর কখনো এমন বলবেন না। যাইহোক- আমাকে একটু সময় দিন।

– অবশ্যই। আপনি ভাবুন। আমি বললাম তো আপনার মন না চাইলে কিছু করতে হবে না।

আমার কথার উত্তরে আবির কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো। ওকে খুব বিধস্ত দেখাচ্ছিল। বুঝছি ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু আমি কি করবো!

বাইরে লোকজনের আনাগোনা পাচ্ছি৷ হয়তো সবাই আসা শুরু করেছে। আয়নায় নিজেকে দেখলাম, খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ওয়াসরুমে ঢুকে অনেক্ক্ষণ ঝর্ণার নিচে ভিজলাম, চাইছি আমার সমস্ত কিছু ধুয়ে মুছে যাক। হাসিও পাচ্ছে খুব নিজের এমন পাগলামিতে। গোসল সেরে বের হয়ে দেখলাম মেয়েরা সমস্ত কিছু নিয়ে বসে আছে। আমি বের হওয়ার পর ওরা আমাকে ওদের মত করে সাজিয়ে দিলো। সত্যি বলতে আমার কোন ব্যাপারে হ্যাঁ না নেই। যে নিজেও জানেনা আর কয়েক ঘন্টা পর তার জীবনে কি ঘটছে তার আবার এসব কি! তবে যতক্ষণ এই বাড়িতে আছি, হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করছি আর যাইহোক এই বাড়ির মান রক্ষা করাও আমার দায়িত্ব।

বউভাতের সমস্ত আয়োজন শেষে মামা যখন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শাশুড়ী কে বললেন- শাশুড়ী বললেন-

– বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি মেয়েদের আসল বাড়ি হয়ে যায়, বুঝলে মা? তাই দেরি করোনা তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।

শাশুড়ি কথা বলছেন, কিন্তু আমি শুধু আড়চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। আমি বের হয়ে যাচ্ছি অথচ আবির কে দেখছিনা তারমানে ও যাবেনা আমার সাথে। সবচেয়ে বড় কথা আমাকে যখন সবার মাঝে বসানো হলো নিয়ম অনুযায়ী আবিরের আমার পাশে বসার কথা, ও সেখানেও একবার যাইনি। আচ্ছা আমি যদি চাইতাম ধরে রাখবো তাইলে কি বলতাম! বরং হারানোর সম্ভাবনা থাকার পরেও বলেছি তাহলে এতটা করার দরকার কি! চলেই তো যাবো। ভাবতে ভাবতে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। পরক্ষণেই মনে হলো, ঠিকই তো আছে, যাকে মন থেকে না মেনে নেওয়া যায় তাকে নিয়ে জীবন কাটানোর মানেই হয়না। তারচেয়ে শুরুতেই নাহয় এর সমাধান হলো। কথাগুলো বলে নিজেকে বুঝ দিচ্ছি ঠিকই কিন্তু কেন যেন চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে।

বের হয়েছি, গাড়িতে বসে আছি, শাশুড়ী বারবার এটা সেটা বলছেন, আমি শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছি। ততক্ষণে ধরে নিয়েছি আবির আমার সাথে যাচ্ছেনা। যাক ভালই হলো। বলছি ঠিকই কিন্তু ঘোমটার ভিতর থেকে অনবরত চোখ মুছছি। বারবার কেবল মনে হচ্ছে- আম্মু যখন সবটা জানবে, খুব কষ্ট পাবে। তাছাড়া এ-ই বাড়ির মানুষগুলো মাত্র কয়েক ঘন্টায় এতটা আপন করে নিলেন, তারাও যখন দেখবেন আমি আর আসবো না নিশ্চয়ই কষ্ট পাবেন। আর আম্মুদের এলাকার কথা নাই বা বললাম- তাদের খারাপ লাগার চেয়ে হয়তো কানাকানি করতেই বেশি সুবিধা হবে। বলবে অপয়া মেয়ে বিয়ের এক রাতেই বাপের বাড়ি ফেরত এসেছে! কথাগুলো ভাবছি, দেখলাম গাড়ি ছাড়ছে। এমন সময় পাশে তাকাতেই দেখি….

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here