মেঘমালা পর্ব ৯

#মেঘমালা
#পর্বঃ৯
#Sohana_Akther
মেঘ তুই যে দিন দিন পশু হয়ে যাবি তা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি । মালার মত এমন নিষ্পাপ মেয়েটাকে এমন পশুরমত আঘাত করতে তোর হাত কাপলো না । আমি জানি তোর রাগ অনেক বেশী কিন্তু তাই বলে নিজের স্ত্রীর সাথে কেউ এমন অমানুষের মত আচরণ করে মেঘ? আমি ছোট থেকে তোকে এই শিক্ষা দিয়ে বড় করিছি বল ? আমার কোনো মূল্য নেই তোর কাছে ? আর কতো তুই ঐ কালো অতীত নিয়ে পরে থাকবি ! একটিবার কি ঐসব কিছু ভুলে সুন্দর ভাবে জীবনটাকে এগিয়ে নিতে পারিস না । তুই তোর ঐ অতীতের সেই মানবীর সাথে মালাকে কেনো তুলনা করছিস । তোর একটুও বিবেকে বাধলো না ?

মেঘ রুমে ঢুকার সাথে সাথেই তার ফুফি তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উল্লেখ্য কথাগুলো বলতে লাগলো । ফুফির কথা শুনে মেঘের পুরনো অভিশপ্ত স্মৃতি গুলো মাথায় চাড়া দিয়ে উঠলো । রাগে তার চোখ দুটি একদম আগুনের গোলার মতো লাল হয়ে আছে ।
যে মানুষটি তাকে আর তার বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে তার কথা সে কিছুতেই মনে করতে চায় না ।
রাগকে দমন করার জন্য শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত মুঠ করে রেখেছে , যার ফলে তার হাতের রগ গুলা ফুলে ফেপে উঠেছে । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার ফুফিকে বললো ,

—- আমি কি করবো তুমিই বলো! ঐ কালো অভিশপ্ত অতীত আমি কখনোই ভুলতে পারবো না । আর রইলো মালা ! আমার যা পছন্দ নয় মালা সেই কাজটিই করে । আমি চাই না ঐ মহিলা আমার বাবাকে যেভাবে ছেড়ে চলে গেছে , মালাও আমাকে ছেড়ে চলে যাক । তাই আমি আগের থেকেই মালাকে একদম নিজের করে রাখতে চাই । বাহিরের সকল মানুষ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখবো । তার জীবনে পুরুষ বলতে শুধু ওর বাবা আর আমি হবো আর কেউ না । তার জন্য আমাকে যা করার প্রয়োজন আমি তাই করবো । প্রয়োজনে তার হাত পা ভেঙ্গে আমার কাছে চিরকাল রেখে দেবো ।

_________________________________

মেঘের কথা শুনে ঠাস করে তার গালে চড় বসিয়ে দিল তার ফুফি । ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে মেঘ । জীবনে প্রথম আজ তার ফুফি তার গায়ে হাত তুলেছে । গালে হাত দিয়ে একদম নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে মেঘ ।

—- পাগল হয়ে গেছিস তুই মেঘ ! পাগল হয়ে গেছিস ! আঠারো বছর আগে যা হয়েছিল তার সাথে তোর বর্তমান জরিয়ে পাগলামি করছিস । এই তুই কি মালাকে ভালোবাসিস নাকি শুধু নিজের শিকারের পশুর মত নিজের পিঞ্জরায় আটকে রাখতে চাস । যাতে তোর মা তোর বাবার সাথে যা করেছে তোর বউ তোর সাথে না করতে পারে তাই । এইসব তোর পাগলামো ছাড়া আর কিছুই না মেঘ । সব মানুষ এক হয় না আর মালাতো কখনো ঐ মায়ের মত হতে পারবে না ।

—- ঐ বাজে মহিলাকে তুমি আমার মা বলে সম্বোধন করবে না ফুফি । ঘৃনা করি! শুধুমাত্র ঘৃনা করি ঐ জঘন্য মহিলাকে যে তার স্বামী, সন্তান রেখে অন্য ছেলের হাত ধরে চলে যায় ।
আর মালাকে আমি সত্যিই অনেক ভালোবাসি ফুফি । আমার জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসি তাকে । মালাকে দেখেই তো একটু নতুন করে বাঁচতে শিখিছি আমি । কিন্তু মালাকে নিয়ে অনেক ভয় হয় আমার! যদি মালাও আমাকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে তো আমি মরেই যাবো । মালাকে ছাড়া এই জীবন এক পলক ও কল্পনা করতে পারবো না ।

নিজের মাকে নিয়ে যতটা কঠোর হয়ে কথাগুলো বললো তার ঠিক উল্টো গলে যাওয়া মোমের মত মালার কথাগুলো বলতে বলতে মেঘ তার ফুফির পায়ের কাছে বসে পরলো । আজ মেঘ কাঁদছে! দীর্ঘ আট বছর পর সে আবার ভেঙে পড়ে কাঁদছে । শেষবার যখন কেঁদেছিল সেই দিনটি ছিল তার বাবার মৃত্যুর দিন । মেঘের ভেঙে পড়া দেখে মেঘের ফুফি কেঁদে দিলেন । যাই হোক তিনি মেঘকে এই অবস্থা দেখতে পারবেন না ।
মেঘের কাছে মাটিতে বসে তার মাথা নিজের কোলে নিয়ে বললেন,

— দেখ বাবা , তুই যদি সত্যিই মালাকে ভালোবাসিস তাহলে তাকে এভাবে বন্দি করে রাখতি না । ভালোবাসা তো কোনো শেকল নয়, ভালোবাসা হলো মুক্তি । তুই মালার থেকে তার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিস । তার সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছিস । কিন্তু মালা একটা শব্দও করেনি । সব মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। সে তোর এমন ব্যবহারের কথা কাউকেই কিছু বলেনি , মালার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে এতকিছুর পর ঠিকই তোকে ছেড়ে চলে যেতো । কিন্তু মালা যাইনি , কেনো জানিস ? কারণ সে তোকে অনেক ভালোবাসে বলতে গেলে তোর থেকেও বেশি তাই এতকিছুর পরেও তোর কাছেই আছে । ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে আগলিয়ে রাখার জন্য একটু ভালোবাসা ও আদর যত্নের প্রয়োজন । দেখ তুই আমাকে ছুঁয়ে কথা দে তুই আর কখনো মালার সাথে এমন ব্যবহার করবি না । তাকে ভালোবেসে আগলে রাখবি । স্বাধীনতা দিতে হবে তাকে , দেখবি সে এমনিতেই তোর হয়ে থাকবে ।

— কথা দিচ্ছি আর কখনো তার সাথে এমন ব্যবহার করবো না । ভালোবেসে তাকে নিজের করে রাখবো ।

ফুফির কথা শুনে মেঘ তার এতদিনের মালার প্রতি করা অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত হলো । মনে ঠিক করলো আজ থেকে সে মালাকে কোনো প্রকার কষ্ট দিবে না ।

_________________________________

মালা সেই কখন থেকে তার রুমে পায়চারি করছে মেঘ কখন আসবে তার অপেক্ষায় । দরজা খোলার শব্দে সচেতন হয়ে দরজার দিকে তাকালো মালা । মেঘ এসেছে কিন্ত তার চোখ দুটি একদম লাল হয়ে আছে , মুখটাও কেমন মলিন হয়ে আছে । আগ বারিয়ে মালা জিজ্ঞাসা করলো ,

—- কি হয়েছে আপনার? আপনার মুখের অবস্থা এমন হয়ে আছে কেনো ? ফুফি কি বলেছে আপনাকে? আরেহ বলুন না কি হয়েছে চুপ করে আছেন কেনো ?

একাধারে মালা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে কিন্তু মেঘ কিছুটির উওর দিল না । সে একনাগাড়ে মালার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে যেখানে সে নিজের জন্য চিন্তার রেখা দেখতে পারছে । হঠাৎ মেঘ মালার কাছে যেতে তার হাত ধরে বলতে লাগলো ,

— মালা আমাকে মাফ করে দেও ? আজ পর্যন্ত তোমার প্রতি আমার করা প্রতিটি অন্যায়ের জন্য। আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসি কিন্তু অন্যদের মত মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনা। সর্বক্ষণ তোমাকে হারানোর চিন্তা মাথা ঘুরপাক করে এই বুঝি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাই । তাই যেই করেই হোক তোমাকে আমার করে রাখার জন্য যা প্রয়োজন মনে করতাম আমি তাই করতাম । কিন্তু এসবের কারনে তোমাকে যে কতটা কষ্ট দিয়েছি তা উপলব্ধি করতে পারিনি । প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দেও মালা । আর একটিবার সুযোগ দেও তোমাকে ভালোবাসার।

মেঘের প্রতিটি কথা শুনে মালা খুশিতে একদম কেদেই দিল । এতদিন তার চোখের পানি ছিল মেঘের দেয়া কষ্টের আজ তার চোখে পানি পড়ছে মেঘের দেয়া খুশিতে । আজ তার চাওয়া পূর্ণ হলো । বিয়ের পর থেকেই এটাইতো তার চাওয়া ছিল যে তার সংসার ভালোবাসায় পূর্ণ থাকবে । মেঘ ভালোবেসে তাকে আগলে রাখবে ।

—- আপনার ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই মেঘ । আমি কিছু মনে করিনি । আমি জানি আপনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন আর যা করেছেন আমাকে নিজের কাছে রাখার জন্যই । আমিও আপনাকে অনেক বেশী ভালোবাসি। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আমি কখনো ভাবিনি আর ভাবতেই পারবো না । বিয়ের পর আপনিই আমার সব , আপনার খুশিতেই জরিয়ে আছে আমার খুশি ।

মালার কথা শুনে মেঘের অনুতাপ, আত্মগ্লানি কিছুটা মুছে গেল । সে প্রচন্ড ভালোবাসায় মেঘ মালাকে জরিয়ে ধরলো , একদম বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললো । মালাও মেঘকে আকড়ে ধরলো । আজ মালার আনন্দের দিন । আজ তাদের ভিতরের লুকানো ভালোবাসা একে অপরের কাছে প্রকাশ পেল । আজ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে তাদের ভালোবাসাময় সংসার । মেঘমালার সংসার !

চলবে …..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here