মেঘমালা পর্ব ১১

#মেঘমালা
#পর্বঃ১১
#Sohana_Akther
পাহাড়ের উপর একজোড়া কপোত কপোতি দাঁড়িয়ে হাত মেলে মেঘ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে । চারদিকে শুধু মেঘের রাজত্ব । চোখ মেলে যেদিকে তাকায় সেদিকেই মেঘ । পরম আবেশে প্রিয়তম তার প্রিয়তমাকে পিছন থেকে জরিয়ে তার ডান হাত উঁচু করে মেঘেদের স্পর্শ করছে ।

মেঘ তার একে একে সকল চিত্রের নাম ও নামের পিছনের কারণ বর্ণনা করছে । তার সকল চিত্রের মধ্যে অন্যতম একটি চিত্রের নাম হলো “মেঘমালা ” । যার বর্ণনা সরূপ উপরোক্ত কথাগুলো বললো মেঘ গ্যালারির সকল মানুষদের ।

মালা মুগ্ধ নয়নে মেঘের বর্ণনা দেয়া শুনছে । যখনই সে “মেঘমালা ” চিত্রের নাম ও তার বর্ণনা শুনলো , চরম খুশিতে তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক দিয়ে উঠলো । মেঘ মালার দিকে তাকিয়ে থেকেই চিত্রের বর্ণনা দিল । একজন রিপোর্টার তখন মেঘকে প্রশ্ন করলো ,

—- মিঃ আহমেদ , আপনার স্ত্রীর নামও তো মালা তাই না?

—- জ্বী ।

—- তাহলে আপনি কি আপনার নিজের নামের সাথে আপনার স্ত্রীর নাম সংযুক্ত করে এই চিত্রটির নাম “মেঘমালা” রেখেছেন?

রিপোর্টারের প্রশ্নে মেঘ স্মিত হেসে একপলক মালার দিকে তাকালো তারপর রিপোর্টারের প্রশ্নের উত্তর সরূপ বললো ,

—- বাহ্ আপনি অনেক ভালো অভজার্বেশন করলেন ! আপনার চিন্তা একদম যথার্থ । এই চিত্রটির নাম আমি আমাদের নাম সংযুক্ত করেই রেখেছি ।

—- চিত্রটির নাম তো অন্য কিছুই দিতে পারতেন, মেঘমালাই কেনো ?

—- আমার জীবনে আমার একমাত্র ভালোবাসার মানুষটিই হলো আমার স্ত্রী মালা । চিত্রটি আঁকার পর কেনো যেনো এতে আমি নিজেকে ও মালাকে অনুভব করতে লাগলাম । তাই ভালোবেসেই এই চিত্রটির নাম মেঘমালা দিলাম । আর একটি কথা আজকের সকল চিত্র এক্সিবিশনের জন্য হলেও এই চিত্রটি নয় । এটা আমার পক্ষ থেকে আমার ভালোবাসার মানুষ , আমার স্ত্রী মালার জন্য উপহার ।

মেঘের কথা শুনে সম্পূর্ণ গ্যালারিতে করতালির স্রোত বয়ে গেল । মেঘের সকল চিত্রের প্রশংসায়
পঞ্চমুখ সকল মানুষ, বিশেষ করে মেঘমালা চিত্রের । মেঘমালা চিত্রটি গ্যালারিতে উপস্থিত সকল মানুষের মন কেড়ে নিল ।

_______________________________

মালা একনাগাড়ে মেঘের দিকে তাকিয়েই আছে ।মেঘের সমস্ত কথাগুলো তার পুরো শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগিয়ে দিল । মেঘ তাকে এতটা ভালোবাসে যার কল্পনা সে কখনো করতে পারে নি । মালার চোখে মুখে মুগ্ধতা বিরাজমান ।মালার অতসত ভাবনার মধ্যে মেঘ এসে তারপাশে দাঁড়ালো । কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই মালার ।

— কি হলো, কি ভাবছো এত ?

— আপনি এখানে কখন এলেন ? সরি উপলব্ধি করতে পারিনি ।

— আপনি যখন ভাবনার রাজ্যে বিভর ছিলেন তখনই এই মেঘের আগমন হয়েছে ।

— তা এই মেঘ কি বৃষ্টি হয়ে ঝরবে নাকি সবার উপর ?

— নাহ্ এই মেঘ শুধু বৃষ্টি হয়ে তার ভালোবাসার মানুষটির উপরেই ঝরবে । আর কারো অধিকার নেই এই মেঘের উপর। তাছাড়া আপনি যদি ভিজতে চান তাহলে এই মেঘ আজ রাতেই বৃষ্টি হয়ে ঝরতে রাজি আছে । কি রাজি তো ?

মেঘের কথায় মালা লজ্জায় একদম লাল হয়ে গেল । মালার লজ্জামাখা মুখ দেখে মেঘের বেশ মজাই লাগতে লাগলো । সে ইচ্ছে করেই মালাকে আরো লজ্জা দেয়ার জন্য বলতে লাগলো,

—- আজ রাতে কিন্তু একদম ছাড় নেই মায়াবিনী আপনার বলে দিলাম । আজ তো আমার ভালোবাসার বৃষ্টিতে আপনাকে ভিজিয়ে একদম টুইটুম্বর করে ফেলবো । আজ ভালোবাসার এক নতুন সংজ্ঞা শিখাবো আপনাকে ।

মেঘের কথাগুলোতে যেনো মাদক মিশ্রিত, প্রতিটি কথায় মাদকতাপূর্ণ । মেঘের এক একটা কথা মালার মনে কম্পন সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট । সে তো মেঘের এই রূপ আগে কখনো দেখেনি । আর নতুন নতুন করে কি দেখার বাকি আছে আল্লাহ জানে ।

দেখা গেল মেঘের ইচ্ছেটাই পূর্ণ হলো । মালা অতিরিক্ত লজ্জা পেয়ে একদম নেতিয়ে আছে । সে লজ্জা কাটাতে বারবার চারদিকে তাকিয়ে দেখছে, মেঘের দিকে ভুলক্রমেও দেখছে না । মেঘের তো সেই পরিমাণ হাসি আসতে লাগলো । সে হাসতে হাসতেই মালাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে জরিয়ে ধরলো । মালাও মেঘের বুকে মুখ লুকালো ।

_______________________________

বিকাল চার টায় এক্সিবিশন শেষ হলো । আজ মেঘের অফিস বন্ধ তাই মালাকে নিয়ে সে বাড়িতে চলে আসলো । বাড়িতে এসেই দুজনে প্রথম ফ্রেশ হয়ে নিল । মালা ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে কফি বানাতে চলে গেল । মেঘ ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে যখন মালাকে রুমে দেখতে পেলো না তখন রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো । রান্নাঘরে যেয়ে দেখে মালা দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছে । মেঘ চুপিসারে মালার পিছনে দাঁড়িয়ে তার কাধে মুখ গুঁজে মালাকে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো ।

হঠাৎ কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে মালা প্রথম চমকে গেল । পরক্ষণেই মুচকি হেসে ঐ শীতল হাতখানা আরো গভীর করে নিজের সাথে আলিঙ্গন করলো ।

—- ভয় পেয়ে গেলে নাকি আমিই তো ।

—- ভয় না হঠাৎ চমকে গেলাম ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে ।

—- ওহহহ আচ্ছা তাই বুঝি ” বলে মেঘ তার ঠান্ডা হাত দুটো মালার পেটে চেপে ধরলো ।

—- আহহ্ মেঘ হচ্ছে টা কি , এক্ষুণিই তো কফিটা পরে যেতো ।

—- ওপসস সরি , এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো আমার রোমেন্সে ডিস্টার্ব করবে না ।

—- জ্বী না জনাব এখন সব কিছু বাদ । এই নিন কফি চলেন বারান্দায় যেয়ে গল্প করতে করতে কফি শেষ করি ।

বারান্দায় দুটো বেতের চেয়ার ও একটি টেবিল রাখা আছে । বারান্দার গ্রিলে ঝুলন্ত টবে কতগুলো ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে । অবসর সময়ে মালা এগুলোর দেখা শোনা করে ।
মেঘ ও মালা যেয়ে চেয়ারে বসলো । মেঘ একদম মালার গা ঘেঁষে বসেছে । কফি খেতে খেতে সে আড়চোখে মালাকে দেখছে । পুরো বারান্দা জুড়ে সম্পূর্ণ নিরবতা বিরাজমান । এই নিরবতা ভেঙে হঠাৎ মেঘ বলে উঠলো ,

—- মালা তোমার কফি মগটা দাও তো ।

—- কেনো , কফি মগ দিয়ে আপনি কি করবেন?

—- আহহা বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি দাও ।

—- আচ্ছা এই নিন ।

মালার থেকে তার কফি মগ নিয়ে মেঘ কয়েক ঢোক খেয়ে নিল ।

—- এই কি করছেন আপনি, আমার অর্ধেক খাওয়া কফি আপনি কেনো খেলেন ? এখন আমি কি খাবো ।

মেঘ তার আধ খাওয়া কফির মগটা মালার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো ,

—– এই নাও তুমি আমার কফি খাও । কথায় আছে একে অপরের এটো খাবার খেলে নাকি তাদের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় । এখন খাবার তো নেই কিন্তু কফি তো আছে , তাই ভাবলাম এটাই খাওয়া যাক । আজ থেকে কফি কখনো দুই মগে নিবে না । একটি মগেই আমরা দুজন কফি খাবো । প্রথম চুমকটা তুমিই নিবে কিন্তু ।

মেঘের এই পাগলামি দেখে মালা হেসে ফেললো । আজ মালা অনুভব করছে পৃথিবীর সকল খুশিই যেনো তার হাতের মুঠোয় । মনে প্রাণে সে এক দোয়াই করে যাচ্ছে, মেঘ যেনো সবসময় এমনই থাকে ।

—- কি ব্যাপার, এত কি ভাবছো খাও । নাকি আমার এটো খেতে তোমার কোনো সমস্যা । সমস্যা হলে খেতে হবে দিয়ে দাও ।

—- আরেহহ না না , আমি কি একবারও বলেছি যে আমার খেতে সমস্যা হবে । আপনিই এক লাইন বেশি বুঝেন হুহহ ” এই বলে মালা সাথে সাথে এক চুমুকেই সমস্ত কফি শেষ করে ফেললো ।

মালার এই পাগলামি দেখে মেঘ না হেসে পারলো না । সে হো হো করে হাসতে শুরু করলো । মেঘের হাসি দেখে মালা নিজেও হাসতে শুরু করলো । এই যেনো হাসির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে । দুজন হেসেই যাচ্ছে , কেউই থামছেই না । হঠাৎ বাহিরে বিদ্যুত চমকে উঠলো । বিদ্যুত চমকানোর শব্দে মালা ভয়ে মেঘকে জরিয়ে ধরলো । বাহিরে যত বেশি করে বিদ্যুত চমকানোর শব্দ হচ্ছে মালা আরো তত বেশি জোরে মেঘকে আকড়ে ধরছে । মেঘ নিজেও মালাকে জরিয়ে ধরে আছে ।

বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হওয়া শুরু করে দিয়েছে । বাতাসে বৃষ্টির ছিটা এসে তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে । মালা হঠাৎ মেঘকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো ।

—- কি হলো তোমার ?

—- আজ অনেক দিন পরে বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে ভিজবো আমি ।

—- নাহ একদম ভিজবে না তুমি বৃষ্টিতে । পরে জ্বর টর বাধিয়ে বসবে ।

—- প্লিজ প্লিজ , অনেক সময় হয়েছে আমি বৃষ্টিতে ভিজি না । সেই বিয়ের আগে শেষবারেরমত ভিজে ছিলাম । প্লিজ আজ না করবেন না ।

মেঘকে আর কিছু বলতে না দিয়েই নিজের কথা শেষ করে মালা দৌড়ে ছাদে ছলে গেল । মালার এমন ছুটে চলা দেখে মেঘ হতভম্ব হয়ে গেল । সে মালা বলে ডাকতে ডাকতে তার পিছু পিছু ছাদে চলে আসলো । মালা ছাদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি আরো বেড়ে গেল । এখন যেই বৃষ্টি হচ্ছে তাকে ঝুম বৃষ্টি বলা হয় । ঝুম বৃষ্টির আরেকটি নাম ইংরেজিতে আছে যাকে বলে ক্যাটস্ এন্ড ডগস্ রেইনিং । মালা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারলো না বৃষ্টির সাথে কুকুর বিড়ালের কি সম্পর্ক । যাক অত সত ভাবার সময় নেই এখন তার কাছে । সে তো আজ এতটা সময়ের পর বৃষ্টির পানি গায়ে মাখছে । খুশিতে মালা একদম দিশেহারা হয়ে আছে । সে ছাদের এক প্রান্ত
থেকে আরেক প্রান্তে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে । ছাদের জমে যাওয়া পানিতে মনের সুখে লাফিয়ে যাচ্ছে । আজ অন্য কোনো কিছুতে মনযোগ নেই তার , বৃষ্টির পানিকে আপন করে নিতে ব্যস্ত সে ।

চলবে. . . .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here