মেঘমালা পর্ব ১২(শেষ)

#মেঘমালা
#পর্বঃ১২_শেষ_পর্ব
#Sohana_Akther
ছাদের দরজায় পিঠ ঠেকে দাঁড়িয়ে মেঘ মালার বৃষ্টি ভেজা দেখছে । বৃষ্টির পানিতে ভিজে মালার শাড়ি তার শরীরের সাথে একদম লেপ্টে আছে । এতে তার শরীরের প্রতিটি ভাজ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এই যেনো এক মনমোহনীয় দৃশ্য । মেঘ খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে আছে ।

বৃষ্টির প্রতিটি ফোটার উপর মেঘের ভিষন ঈর্ষা হচ্ছে । বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা যেমন করে মালার সর্বাঙ্গে মিশে আছে এভাবে যদি সেও মালার সাথে মিশে থাকতে পারতো । মেঘ দরজা থেকে পিঠ সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো । কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে মালার দিকে অগ্রসর হলো । ছোট ছোট কদম ফেলে সে মালার পিছনে যেয়ে দাঁড়ালো ।

মালা একদম আপন মনে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে । তার আর অন্য কিছুতে কোনো চোখ নেই । হাতে বৃষ্টির পানি নিয়ে বাচ্চাদের মত লাফাচ্ছে , ঘুরছে । মেঘ যে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সে তখনও বুঝতে পারি নি । হাতের পানি নিয়ে যখন আবার ঘুরতে লাগলো তখনই মেঘের সাথে ধাক্কা খেল মালা । মেঘকে দেখতে পেয়ে মালা কিছু বলতে যেয়েও কিছু বলতে পারলো না । মেঘের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে কেমন দুমরে মুচরে যাচ্ছে । মেঘ বৃষ্টিতে ভিজে পুরো জবজব । বৃষ্টির মধ্যে মেঘের চোখগুলোতে একধরনের নেশা দেখতে পারছে মালা । মেঘের এই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করার সামর্থ্য নেই মালার ।

মেঘ সেই কখন থেকে এক দৃষ্টিতেই মালার দিকে তাকিয়ে আছে । মালা চেয়েও যেনো কিছু বলতে পারছে না, কিছু একটা যেনো থার গলায় আটকে আছে । সে বারবার মেঘের চোখে চোখ রেখে আবার চোখ সরিয়ে ফেলেছে । বেশি সময়ের জন্য মেঘ চোখে চোখ রাখা অসম্ভব মালার । মালাকে ঘায়েল করতে মেঘের এই তীক্ষ্ণ চাহনিই যথেষ্ট । হঠাৎই মেঘ মালার এক হাত ধরে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেললো । মালার শ্বাস-প্রশ্বাস তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো । মালার এই ঘন ঘন শ্বাস নেয়া মেঘ খুব ভালো করেই উপলব্ধি করলো ।

মেঘ তার ডান হাত নিয়ে মালার কোমরে রেখে মালাকে একদম নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললো । এমন মনে হচ্ছে যেনো বৃষ্টির এক বিন্দু জল দুটি মানুষের উপর পরছে , এতটা কাছে মালা মেঘের । এই প্রবল বৃষ্টি ধারার মধ্যেও দুটি ব্যক্তি একে অপরের হৃৎস্পন্দন শব্দ অনাসয়ে শুনতে পারছে । কারো মুখে কোনো শব্দ নেই । দুজনেই এক অদ্ভুত নিরবতা পালন করছে । বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুর শব্দ শুনা যাচ্ছে না । হালকা মাতাল হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের । মালা এবার অনেক কষ্টে তাদের এই নিরবতা ভেঙে কিছু বলার চেষ্টা করলো ।

—” কি হলো তোমার এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?

মালার মুখে এই প্রথম বারের মত তুমি শুনে একদম স্তব্ধ হয়ে গেল মেঘ । সে তার বিশ্বাসই করতে পারছে না যে মালা তাকে তুমি করে বলেছে । মালার মুখ থেকে তুমি শোনার আনন্দ মেঘের মুখে একদম ফুটে উঠেছে । মালা মেঘের এই অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে । মেঘের নিরবতা ভাঙার জন্য এই তুমি ডাকটাই যথেষ্ট ।

— ” কি বললে তুমি? আরো একটিবার বলতো ?

— ” তুমি এভাবে তাকিয়ে কি দেখো ?

— ” হায়…..এই তুমি ডাকটা যে তোমার মুখে কতোটা মধুর শোনায় তা যদি তুমি বুঝতে পারতে ।

মেঘের কথা শুনে মালা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মালার ভুবন ভুলানো হাসি দেখে মেঘ আজ নতুন করে আবার তার প্রেমে পরে গেল । এতটা কাল মেঘের ভয়ে মালা কেমন নিশ্চুপ হয়ে থাকতো । খাচার ভিতরের বন্দি পাখির মত লাগতো তাকে । প্রাণ তো আছে কিন্তু ঐ প্রাণ থাকাও না থাকার মত যেখানে সে মনের সুখে, আনন্দে উড়তে পারবে না । মালার ঠিক তেমনি অবস্থা ছিল । প্রাণ খুলে হাসি কি জিনিস তা হয়তো সে ভুলেই গিয়েছিল । আজ প্রথম বারের মত মেঘের সামনে মনের খুশি প্রাণ খুলে হাসছে সে । মেঘ একহাতে মালার মুখের উপর চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিল। আচমকা মেঘের স্পর্শ মুখে পেয়ে মালার হাসি বন্ধ হয়ে গেল ।

— ” আজ নতুন করে আবার তোমার প্রেমে পরে গেলাম । তোমার এই প্রাণ খোলা হাসি দেখে আমি মুগ্ধ । তোমার এই স্নিগ্ধ ভরা মুখে প্রান্যজ্জল হাসি দেখে খুব করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে । ইচ্ছে করছে জীবনের বাকিটি সময় তোমার এই হাসি মুখখানা দেখেই কাটিয়ে দেই ।

মেঘের প্রতিটি কথা যেনো মালা শরীরে কম্পন সৃষ্টি করে দিচ্ছে । আজ মরলেও হয়তো তার কোনো আফসোস থাকবে না । খুশিতে তার চোখে পানি ছলছল করছে । এই বৃষ্টির মধ্যেও মেঘ তার বুঝতে পেল । মালার ঠোঁট দুটো একদম রক্তিম হয়ে আছে । ঠান্ডায় তার ঠোঁট দুটো সমানে কেঁপে যাচ্ছে । তার এই কাঁপা কাঁপা রক্তজবা ঠোঁট দুটো মেঘকে যেনো পাগল করে তুলছে । মালার ঠোঁট জোরায় মেঘ তার প্রবল তৃষ্ণা নিবারণের উপায় দেখছে । মালা কিছু বলতে নিলেই মেঘ তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই তার কম্পনরত ঠোঁট দুটো নিজের অধীনে নিয়ে নিল ।

মালা একদমই প্রস্তুত ছিল না মেঘের এমন কাজের । মেঘ তার এক হাত মালার কোমরে চেপে ধরে ও আরেক হাত মালার মাথার পিছনে দিয়ে তার অধর যুগলের অমিত্রসুধা পান করছে। মালাও পরম আবেশে মেঘকে আকড়ে ধরে তার ঠোঁটজোরাকে নিজের করে নিচ্ছে । মেঘ যেনো একদম উন্মাদ হয়ে উঠছে । সে মালার ঠোঁটের ভিতর নিজের ঠোঁটের গতি আরো বাড়িয়ে দিল । ঠিক কতক্ষণ এভাবে ছিল জানা নেই তাদের । মালাকে ছেড়ে মেঘ তাকে একদম কোলে নিয়ে নিল । মালা হাঁপিয়ে যাচ্ছে । সে লজ্জায় জরোসরো হয়ে আছে মেঘের বুকের সাথে মিশে ।

মেঘ মালাকে কোলে করে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসলো । ছাদ থেকে নেমে মালাকে রুমে নিয়ে নিজের পায়ের মাধ্যমে দরজা বন্ধ করলো মেঘ , এক মুহূর্তের জন্যও মালাকে কোলের থেকে নামায় নি মেঘ । দরজা বন্ধ করার বিকট শব্দে মালা হচকচিয়ে উঠে মেঘকে আরো গভীর ভাবে আকড়ে ধরলো । মালার এমনভাবে আকড়ে ধরা দেখে মেঘ মুচকি হাসলো । মালাকে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিল মেঘ ।

মেঘ তার ভিজা শার্ট খুলে এসে মালার পাশে বসলো । মালা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে । চোখ বন্ধ করেও সে টের পাচ্ছে মেঘ তার দিকেই ঝুঁকে আছে । মেঘ মালার দিকে ঝুঁকে তার এক আঙুল দিয়ে মালার মুখে স্লাইড করছে । কপাল বেয়ে গাল , গাল বেয়ে গলা আর গলা বেয়ে বুকের উপর মেঘর হাত আসতেই মালা তার হাত ধরে উঠে বসে পরলো । সে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে যার ফলে তার বুকের উঠানামা মেঘ স্পষ্ট বুঝতে পারছে । লজ্জায় মালর মালার মুখ লাল হয়ে আছে, সে ভুলক্রমেও মেঘের দিকে তাকাচ্ছে না । তাকালে দেখতে পেতো মেঘের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি ।

মেঘ মালাকে তার দিকে ফিরিয়ে কপালে একটিচুমু দিল । মালার ভিজা শাড়ির আঁচল খুলে তাকে আবার শুইয়ে সে নিজেও তার সাথে শুয়ে পরলো । বাহিরে প্রবল বেগে ঝর হচ্ছে , তার তাল মিলিয়ে ভিতরের এই বন্ধ রুমে ভালোবাসায় সিক্ত একজোড়া দম্পতির বুকের ভিতর ও ঝর বেয়ে চলছে । নিস্তব্ধ এই বন্ধ রুমে তাদের ফেলা নিঃশ্বাসেরশব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না । দুটি দেহ একে অপরের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে ।

________________________________

এক বছর পর……

হাসপাতালের করিডোরের সামনে পায়চারি করছে মেঘ । তাকে দেখে মনে হচ্ছে কতদিন ধরে নাওয়া খাওয়া নেই । চোখ দুটো একদম লাল হয়ে আছে । ওটির ভিতরে মালার প্রচন্ড চিৎকার তার কানে এসে পৌঁছাচ্ছে । মালার চিৎকার শুনে মেঘ যেয়ে দরজার পাশে দাঁড়ালো । মেঘের ফুফি এসে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো ।

— ” মেঘ চিন্তা করিস না বাবা । সব ঠিক হয়ে যাবে । দেখে নিস মালার ও বাচ্চার কোনো ক্ষতি হবে না । তুই একটু স্থির হয়ে বস । সেই কখন থেকে এভাবে পায়চারি করছিস , নিজের অবস্থা দেখেছিস একবার ।

ফুফির কথা শুনে মেঘ এবার বাচ্চাদেরমত কেঁদে ফেললো ।

— ” আমার মালা ও বাচ্চার কিছু হবে না তো ফুফি ? ওদের কিছু হলে আমি একদম মরে যাবো। আমার বেচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে আমি কি নিয়ে বেচে থাকবো ।

— ” অযথা কথা বলছিস মেঘ এক থাপ্পর মেরে দাত ফেলে দেবো , চুপচাপ বসে থাক এখানে ।

তাদের কথার মাঝেই বাচ্চার কান্না করার শব্দ শুনতে পেল । মেঘ খুশিতে তার ফুফিকে জরিয়ে ধরলো । ডাক্তার বের হয়ে আসতেই মেঘ বলতে লাগলো,

—- ” আমার স্ত্রী কেমন আছে ডাক্তার ? আমার মালা কেমন আছে আর আমার বাচ্চা?

—” চিন্তা করবেন না মি:আহমেদ, আপনার স্ত্রী ও বাচ্চা দুজনেই সুস্থ আছে । আর অভিনন্দন আপনার ঘরে ফুটফুটে এক রাজকন্যার জন্ম হয়েছে। আপনি একটু পরেই আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারবেন ।

মেঘ তার খুশিকে আটকে রাখতে পারলো না । নার্সকে বলে পুরো হাসপাতালে মিষ্টির ব্যবস্থা করলো । দশ মিনিট পর মেঘ মালার কেবিনে গেল । নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে মালা । ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার মুখে । বেবিকে বেডের পাশেই দোলনায় রাখা হয়েছে । মেঘ সর্বপ্রথম মালার পাশে যেয়ে টুলে বসে তার হাত ধরলো । বেবিকে সে মালার সাথেই দেখবে।

হাতে কারোর স্পর্শ পেয়ে মালা চোখ মেলে তাকালো । চোখের সামনে মেঘকে দেখে এক তৃপ্তির হাসি হাসলো মালা । খুশিতে তার চোখ বেয়ে পানি পরছে । বাচ্চাকে দেখতে না পেয়ে সে মেঘকে জিজ্ঞাসা করলো,

— ” বাবু কোথায় মেঘ ?

— ” আছে দোলনাতে । রাজকন্যা হয়েছে আমাদের মালা। আমি এখনো তাকে দেখিনি ।

হেসে উঠলো মালা মেঘের পাগলামি দেখে । তখন একজন নার্স রুমে আসলো । মেঘ তাকে বললো বাবুকে তাদের কাছে নিয়ে আসতে । নার্স বাবুকে মালার পাশে শুইয়ে দিয়ে চলে গেল । মেঘ ও মালা একনাগাড়ে তাদের মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে । মেয়ে দেখতে একদম মায়ের মতই হয়েছে। নাক আর চোখ একদম মেঘের মত । আর ঠোঁট ও গায়ের রঙ মালার মত ফর্সা । নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে মালা ও মেঘ দুজনের চোখেই অশ্রুরা আনাগোনা করছে ।

—” মেয়ে একদম তোমার মত হয়েছে মালা ।

— ” জ্বী না , মেয়ে আমার দেখতে একদম তার বাবার মত হয়েছে ।

— ” নাহ্ তোমার মত ।

— ” আমি বলছি না তোমার মত ।

নিজেদের এমন পাগলামোতে হেসে উঠলো তারা।

— ” মেঘ আমি মেয়ের নাম রাখবো ভেবেছি “মেঘলা” । কেমন হবে নামটা । তোমার আর আমার অংশ আমাদের মেয়ে । আমাদের নামের অংশ দিয়ে তার নাম ” মেঘলা ” ।

— ” অনেক সুন্দর! আমি তো ভাবিনিই এমন কিছু ।

— ” ভাবার জন্য আমি আছি না ।

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেঘের ফুফি তাদের খুনসুটি দেখে যাচ্ছে । আজ তার মা বাবা হারা মেঘের পরিবার পরিপূর্ণ । আজ সে ভিষন খুশি । মেঘমালার এই সংসার যেনো সর্বদাই এমন আনন্দে অভিভূত হয়ে থাকে । ভালোবাসার অংশকে নিজের মধ্যে পেয়ে ” মেঘমালা ” পরিপূর্ণ।

সমাপ্ত …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here