#মেঘের_আড়ালে_বৃষ্টি
#আট
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
সন্ধ্যার পর সবাই রিসোর্টে ফিরে আসে। ঠিক করা হয় যে, তারা যে আটজন এই রিসোর্টে আছে। তারা সবাই মিলে মাছের বারবি কিউ করবে। গানের আসর বসবে। আর একটা গেইম হবে।
এসব সাবা শশীর প্লান সাথে সকালও আছে।
রোদ ফিরে এসে বালিশের সাথে হেলান দিতেই মিনিট কয়েকের মাঝে তার ঘুম চলে আসে।
এদিকে সবাই ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে গেছে বাইরে একটা মাদুর পেতে বসেছে। হালকা শীত পড়েছে। সকালের বন্ধু রনি একটা কম্বল এনে মাদুরের উপর দিয়েছে যাতে কারো শীত না লাগে।
বারবি কিউ ব্যবস্থা ও রনি করে দিয়েছে। এই হচ্ছে সুবিধা কোথাও বেড়াতে গেলে পরিচিত কেউ থাকলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।
একে একে সবাই এসে বসে। প্রয়াসের হাতে গিটার, গায়ে ব্লু কালারের ব্লেজার জড়ানো, সদ্য মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসেছে। মনে হয় মুখ মুছেনি তাই মুখে বিন্দু বিন্দু জল চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে যেন মুক্ত দানা!
সবাই এসেছে সুচির প্রেমিক রাহাত ও এসেছে এখানে।
সুচি রাহাতের সাথে কথায় ব্যস্ত আর নিশি রহিমের সাথে। এদিকে রোদ যে আসেনি সেটা তাদের খেয়ালই নেই।
হঠাৎ প্রয়াস চারপাশে রোদকে দেখতে না পেয়ে।
বলে,
“রোদেলাকে দেখছি না। সে কোথায়?”
তার এমন প্রশ্নে সবাই খুব একটা অবাক হয়নি। কারণ এই দুইদিনে কারোরই বুঝার বাকি নেই, প্রয়াস কী ফিল করছে রোদেলার জন্য।
সুচি বলল, ” রোদ মনে হয় ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর ঘুম যে গাঢ় আমি ভাঙাতে পারব না।”
নিশি ও সায় দিলো তার কথায়।
সাবা শশী ব্যস্ততা দেখাল। তাই বাধ্য হয়ে প্রয়াসকেই যেতে হলো। প্রয়াসের বুকের ভেতর কেমন শব্দ হতে শুরু করল। সে বুঝতে পারেনা। কেন এমন হয়। অথচ সবাই বুঝে।
দরজাটা আস্তে করে খুলে ভেতরে ঢুকে প্রয়াস।
রোদ এখনও হেলান দেয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে।সামনের দিকের লেয়ার কাট চুলের কিছু মুখের উপর পড়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়ায় ঘন পল্লব যেন আরো ঘন দেখাচ্ছে। মায়ায় চেয়ে আছে পুরো মুখখানা।
সব মেয়েদের কী ঘুমালে এমন মায়াবী লাগে?
ঘুমালে দেখছি এই মেয়েকে আরও বেশী বাচ্চা মনে হয়! আলাদা এক পবিত্রতায় চেয়ে আছে চারপাশে। এত সুন্দর লাগছে সব কিছু।
খুব কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিল সে। আস্তে করে মায়া মায়া গলায় ডাকল, “রোদেলা এই রোদেলা উঠো, সবাই আড্ডা দিচ্ছে, না উঠলে মিস করে যাবে।”
তার এই নরম গলায় রোদ উঠবে বলে মনে হচ্ছে না।অনেক্ষণ ডাকার পরও যখন রোদ উঠেনি। প্রয়াস কিছু না ভেবে দুহাতে টেনে রোদকে উঠিয়ে নেয়।
রোদ চোখ মেলে প্রয়াসকে দেখে আচমকা চিৎকার করে বলল, ” আহহহ……আপনি?”
রোদের চিৎকারে প্রয়াস ভয় পেয়ে যায়। সে রোদকে থামাতে তার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে।
রোদের দুইচোখ যেন কোটর থেকে বেড়িয়ে আসছে। যেভাবে তাকিয়ে আছে।
প্রয়াস মিনিট পরে ছেড়ে দেয় রোদকে। নিজের কাজের জন্য লজ্জিত সে। কিন্তু এভাবে না ধরলে সবাই কি ভাবত।
দুজনই কিছুক্ষণ চুপ তারপর রোদ বলে,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো।
“অপেক্ষা করছে সবাই।” বলেই চলে যেতে লাগে একটু পেছনে ফিরে এসে রোদকে বলে সরি আসলে বাইরে সবাই তোমার চিৎকার শুনে অন্য কিছু ভাবত তাই এভাবে ধরে ফেলেছি। কিছু মনে কোরো না।
________________________
সবাই গোল হয়ে বসেছে। মাঝখানে লাড়কি জ্বালিয়েছে শীতের মাঝে বেশ ভালো লাগছে আগুনের তাপ। সমুদ্র দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এই রিসোর্টের থেকে সমুদ্র দেখা যায়। রাতের সমুদ্র যে এতটা সুন্দর নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না।
রোদ ব্লু কালারের লেডিস ব্লেজার পড়ে এসেছে।দেখতে বেশ লাগছে তাকে।
সদ্য ঘুম থেকে উঠায় মুখের লাবণ্য আরও বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে।
সে এসে চুপচাপ বসতে চায় সুচি নিশির পাশে। কিন্তু তারা কেউ তাকে বসতে দিলোল না।
সাবা, শশির কাছে গেলে তারাও বসতে দিল না।
জায়গা আছে শুধু প্রয়াসের পাশে। তাই বাধ্য হয়ে রোদ প্রয়াসের পাশে বসে।
এটা যে সবাই ইচ্ছে করে করছে রোদকে প্রয়াসের পাশে বসানোর জন্য। রোদ না বুঝলে ও প্রয়াস বুঝে গেল। তাই সে মুচকি হাসছে। সবাই বলছে গান গাইতে।
সুচি বলে,
“রোদ তুইও গান গাইবি আজকে।”
রোদ একেবারে না করে দেয়।
সাবা বলল, ” তুমি গান গাইতে পারো! তাহলে তো আজ ডুয়েট গান শুনতে পারবো। ”
“ডুয়েট মানে?” রোদ ভ্রুকুচকে প্রশ্ন করল।
“আরে তুমি আর প্রয়াস গান গাইবে। যাই বলো না করলে শুনছিনা।”
সবাই জোর করায় রোদ রাজি হয়। তবে আগে প্রয়াস একটা গাইবে তারপর সে গাইবে।
সবাই বলে তাতেই হবে।
প্রয়াস গিটার হাতে গান ধরেছে।
মেলেছো চোখ, উড়েছে ধুলো
দূরের পালক, তোমাকে ছুঁলো
তবু আজই, আমি রাজি
চাপা ঠোঁটে কথা ফোটে, শোনো ..
আমাকে রাখো চোখের কিনারে,
গোপন মিনারে ..
হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে রোদ গেয়ে ওঠে।
ঘুম ভেঙ্গে কিছু মেঘলা দিন ও হোক
ওড়নার পাশে সেফটিপিন ও হোক
দুজনে গানের মাঝে দুজনের দিকে অদ্ভুত মুগ্ধতায় তাকাচ্ছে। চারপাশে চাঁদের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। মাঝখানে আগুনের আলোয় রোদকে লাল দেখাচ্ছে। ব্লেজারটায় মানিয়েছে খুব।
প্রয়াসের চোখে আজ অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছে রোদ।
রোদের চোখেও অন্যরকম কিছু দেখছে প্রয়াস। সেটা তার চোখের আড়াল হলো না। এমনভাবে তারা গান গাইছে মনে হচ্ছে অনেকগুলো বছর ধরে তারা একসাথে জুটি বেধে গান গেয়ে এসেছে।
কোন অন্তরার পর কোনটা কে গাইবে সব যেন আগে থেকে সেট করা আছে,অথচ এইমাত্র তারা গান গাইবে বলে ঠিক হলো।
এটাই হয়তো মনের মিল।এটাই হয়তো আত্নার সম্পর্ক!
গান শেষে সবাই হাত তালি দিতে শুরু করে। দুজনের গানের প্রসংশা করে সবাই।
সকাল প্রয়াসের কোমরে চিমটি কেটে বলল, “তোমাদের দুজনকে বেশ মানিয়েছে।”
রোদ বলল, “কি বললেন?”
সকাল কথা ঘুরিয়ে বলে,
“আরে তোমাদের গানের জুটি দারুণ।”
তোমরা একসাথে গানকে প্রফেশনালি নিলে, ভালো কিছু করতে পারবে। সবাই সকালের সাথে একমত হয়।
সাবা বলল,
“কিরে তোরা দুজন কী প্ল্যান করে ব্লেজার কিনেছিস নাকি একি রঙের?”
প্রয়াস আগে খেয়াল করলে ও রোদ এখন খেয়াল করলো। আসলেই তো একই রঙের।
শশী বলে,
“এখন দুজন এটা বলিস না দুজনের পছন্দের রঙ নিল?”
“আসলেই দুজনেরই প্রিয় রঙ নীল?”
সকাল আর সুচি একসাথে বলল, “হুম নীল রোদের প্রিয় রঙ।”
সকাল বলল প্রয়াসের কথা।
প্রয়াস আস্তে আস্তে বলে,
“ওহ মাই গড এটা কী হচ্ছে!”
দুজনই হাসছে।
সুচি রাহাতের হাতের উপর হাত রেখে বসে আছে। চোখাচোখিতে হাসল শুধু।
রোদ বলল, ” ওই তুই এখানে এসেও এভাবে আঠার মত লেগে বসে আছিস রাহাত ভাইয়ার সাথে? কী রে তুই?”
“কেন বাবু তুমি যে একসাথে গান গাও সেটা কিছু না।”
“এই শোন আমরা প্রেম করছি না হুম?”
আমি কখন বললাম,
“তুই প্রেম করছো? তোমার মনে প্রেম লেগেছে মামা। তাই এমন নিজ থেকে বলছো। খুব তো বলেছিলে প্রেম করবে না। আজকে যা দেখলাম তুমিতো অন্য জিনিস। ”
সাবা সবাইকে বলল,
“এটেনশন প্লিজ! এখন আমরা একটা গেইম খেলব। একটা গ্লাসের জারকে নির্দেশ করে বলল, “এই জারে কতগুলো চিরকুট আছে যার ভাগ্য যা আসবে তাকে সেটা করতে হবে।
না করা যাবে না। সো গার্লস এন্ড বয়েস, গেট রেডি?”
সবাই যার যার চিরকুট নিয়ে নিয়েছে।
সুচির উঠেছে তাকে কবিতা আবৃত্তি করতে হবে। সে কোনোদিন আবৃত্তি করেনি। কী করবে এবার, তাও করলো। কোনরকম হলো। খারাপ হয়নি।
সনির চিরকুটে এসেছে নাচতে হবে। সে নাচলো। ভালোই নাচলো সে। সবার খুব ভাল লেগেছে।
এবার প্রয়াসের আসে আপনার পাশের জনকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হবে ৫মিনিট সমুদ্রের ধারে।
প্রয়াস পাশে তাকায় রোদের দিকে। রোদ এটা দেখলে কীভাবে রিয়াক্ট করবে কে জানে?
সকাল প্রয়াসের মুখ দেখে বুঝতে পারে। চো মেরে কাগজ নিয়ে নেয়।
তারপর চিরকুট সবাইকে পড়ে শোনায়। এটা পড়ে, বলল, ” ওয়াও দোস্ত তোর পাশের জনকে কোলে নিয়ে নেয়।”
রোদ বুঝতে পেরে চোখ কপালে উঠে তার।
রাজি হয় না সে। কিন্তু সবাই যেহেতু যার যার টা করেছে তোমরা রুল ভাঙতে পারবানা।
রোদ আর উপায় না পেয়ে রাজি হয়।
সকাল বলে,
“লেটস স্টার্ট দোস্ত!”
রোদের পুরো শরীর অজানা কারণে শিয়রে উঠছে।বুকের শব্দ বেড়ে যাচ্ছে, নিঃশ্বাস ঘনঘন পড়ছে।
একইরকম হচ্ছে প্রয়াসেরও।
প্রয়াস কাছে এসে কোলে নিতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে রোদ। লজ্জায় লাল,নীল,বেগুনী হয়ে যাচ্ছে তার মুখের আদলের রঙ।
রোদ প্রয়াসের গলা ধরছেনা দেখে, প্রয়াস হালকা করে ছেড়ে দিতে চায় রোদকে।
রোদ ভয়ে প্রয়াসের গলা জড়িয়ে ধরে।
প্রয়াস রোদের দিকে তাকিয়ে জয়ের হাসি হাসে।
কারণ এই কাজটা সে ইচ্ছে করে করেছে যাতে রোদ তার গলা জড়িয়ে ধরে।
প্রয়াস হাঁটছে রোদকে নিয়ে। সকাল পেছন থেকে ভিডিও করছে। যদিও দেখা যাচ্ছেনা রাত বলে, কিন্তু দুটো মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে।
যেটা কিনা ভিডিওটির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আকাশে পূর্নিমার চাঁদ,
প্রয়াসের কোলে তার জীবনের চাঁদ।
সমুদ্রের চারপাশে ঘিরে আছে সে চাঁদের আলোয়।
একজোড়া ভালবাসার পায়রা হাটছে সে আলোকে ঘিরে।
চাঁদের আলোয় রোদের মুখটা নীল পরীর মত লাগছে।
নীল ব্লেজার, নীল ওড়নার সাথে যোগ হয়েছে, চাঁদের নীল আলো।
কী পবিত্র লাগছে রোদকে।
প্রয়াস বলে, ” দেখো কি সুন্দর চাঁদের আলো তাকাও রোদেলা। ”
রোদ তাকায় প্রয়াসের দিকে, এই শীতে প্রয়াসের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। বেশী জমেছে নাকে।
এই ঘাম যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে প্রয়াসকে।
চোখ বন্ধ করে হাঁটছে প্রয়াস।
প্রয়াস আস্তে আস্তে চোখ খোলে তাকায় রোদের দিকে। প্রয়াসের এই চোখের সাথে পরিচিত নয় রোদ। রক্তবর্ণ চোখ। অন্যরকম চাহনি।
দেখেই বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো রোদের।
রোদের নিজের ও কেমন যেন লাগছে।
প্রয়াসের চোখের ভাষা যেন অন্য কিছু বলছে।
যেন কত হাজার বছরের অতৃপ্ত দুটো চোখ, তার কাছে কিছু বলতে চাইছে।
সকাল প্রয়াসের চোখ দেখে বুঝতে পারে তার কী হয়েছে।
তাই সে বলল, ” পাঁচ মিনিট শেষ, এবার নামাতে পারিস। ”
প্রয়াস সেটা না শুনে। রোদকে রিসোর্টের কাছে ফিরিয়ে এনে তারপর নামায় কোল থেকে।
“নামিয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করবে চলে যায় তার রুমের দিকে।
রোদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সকাল যায় প্রয়াসের পেছন পেছন। সে জানে প্রতাস এখন এলোমেলো হয়ে আছে।
চলবে,,