মেঘের পরে মেঘ -১২
বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ির বারান্দায় এক কোণে বসে চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিলো নাবিল।সামনেই হতভম্ব হয়ে বসে আছে কবির।এতোক্ষন যা শুনলো সব ওর মাথার উপর দিয়ে গেছে।দীর্ঘ পনেরো বছর পর দেশে ফিরেছে কবির।নাবিলের বিয়ের পর সিলেট থাকাকালীন সময়েই লন্ডন যাওয়ার কাগজপত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিলো ওর।নাবিল শায়েরী কে নিয়ে ঢাকায় ফেরার মাসখানেক পরই ও চলে যায়।
সেই যাওয়াই যাওয়া।আর আসেনি।সেখানেই বিয়েশাদী করে থিতু হয়েছে।এবার এসেছে নিজের একমাত্র ছেলেকে দেশ টা ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য।
ঢাকায় যখন আসলো তখন ও নিজে থেকেই নাবিলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো।এবং সফলও হলো।খুব ইচ্ছে ছিলো নাবিল শায়েরীর গুছানো সংসার দেখার।সেই কোমলমতি শায়েরীই বা কেমন হয়েছে তা দেখার।কিন্তু একি বিস্ময়!
কবিরের বিশ্বাস করতে কস্ট হচ্ছে। সেই সাথে নাবিলের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় দুঃখও।
নাবিল কবিরকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে হাসলো।
“কি রে,চা টা শেষ কর।ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।”
“হোক মাথা এমনিতেই গরম আছে।তারপর কি করলি?তানজু কে কিছু বললি না”
“বলতেই তো গিয়েছিলাম।গিয়ে দেখি আমাকে ফাঁসানোর পুরো প্রস্তুতি শেষ।”
“তারপর?তারপর কি হলো?”
“তানজুর সাথে কথা বলার কোন সুযোগই হলো না।ঘর এলাকার কিছু মাস্তান দিয়ে ভরা।আমি যাওয়ার সাথে সাথেই ওরা ঘিরে ধরে।আমাকে নাকি তানজুকে বিয়ে করতে হবে।বহু বাকবিতণ্ডার পর আমি তানজুকে বিয়ে করতে রাজি হলাম।”
“বিয়ে করতে রাজি হলি মানে কি?তুই কি শেষ মেষ বিয়েই করে ফেললি?”
“আরে না।ওটা তো পরিস্থিতি থেকে বাঁচার পথ খুঁজে না পেয়ে বলেছি।ওকে বিয়ে করার তো কোন প্রশ্নই উঠে না।আমি শুধু একটা চালাকি করতে চেয়েছিলাম।”
“পেরেছিলি?”
“হ্যাঁ।পেরেছিলাম।আল্লাহ সহায় ছিলো।আমি ওদেরকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম তানজুর জন্য আর ওর ছেলের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে।হাজারহোক বিয়ে বলে কথা।ওরা প্রথমে রাজি হয়নি।পরে দুজনকে রেখে যায় আমাকে পাহারা দেয়ার জন্য। ওরা চলে যাওয়ার আধঘন্টা পর দুজনের একজন যায় টয়লেটে।অপরজন এমপিথ্রি তে গান শুনছিলো আমার সামনে বসে।আমি সোফা থেকে উঠতেই লোকটা থমকে উঠে। আমি বলি অনেকটা সময় বসে আছি তাই পা ব্যাথা করছে।একটু হাঁটাহাঁটি করি।আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না।ঘরেই আছি।লোকটা আমার দিকে বেশকিছু সময় তাকিয়ে থাকলো। আমি ওর দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সারাঘরে পায়চারী করতে লাগলাম।ভাবলাম একসময় না একসময় নজর এমপিথ্রি তে পরবে। একটু হলেও ব্যস্ত হবে।হলোও তাই।আমার ভয় ছিলো দরজা খোলা নিয়ে।কিন্তু আল্লাহর কি অশেষ মেহেরবানী দরজা ভেজানো ছিলো।আমি খুব আস্তে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম।”
“তারপর কি সোজা বাসায়?না কি আবার ধরা টরা খেয়েছিলি?”
“না ধরা খাইনি।”
“তাহলে কি এমন হলো যে তুই ফেরত আসার পরও শায়েরী তোকে ছেড়ে চলে গেলো?”
নাবিল বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।বারান্দার গ্রীল ধরে দুর আকাশে তাকালো।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললো,
“আমি ফেরত এসেছিলাম কিন্তু সাতদিন পর।”
কবির অধৈর্য হয়ে গেলো।
“পালিয়ে এসে সাতদিন পর বাড়ি ফিরলি।কেনো?ভয়ে? তুই এতো বোকা কেন রে নাবিল?শায়েরী তোকে আলটিমেটাম দিয়েছিল একদিনের আর তুই এলি সাতদিন পর।এটা কোন কথা।একবারও মনে হয়নি
তুই না ফেরাতে মেয়েটা কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ”
“না মনে হয়নি।কারন মনে হওয়ার মতো অবস্থাতে ছিলাম না।সেদিন ফেরার পথে এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।টানা দুদিন হসপিটালে অজ্ঞান ছিলাম।তিনদিনের দিন জ্ঞান ফিরলেও কথা বলার মতো শক্তি ছিলো না।এমনকি কে বা কারা আমাকে হসপিটালে এনেছিলো তাও বলতে পারবো না।পরে শুনেছিলাম আমার বাবাই না কি সমস্ত ব্যবস্থা করেছে।যেই গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট হয়েছিলো সেটা আমাদেরই গাড়ি ছিলো।গাড়ির ড্রাইভার অক্ষত থাকায় আমাকে সহজেই চিনেছিলো।এরপর মোটামুটি সুস্থ হতেই সাতদিন পেরিয়ে গেলো।বাড়ি আসলাম।এসে দেখলাম শায়েরী নেই৷ ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে রেখে গেছে টি-টেবিলের ওপর। যাতে লেখা ছিলো,জীবনে চলার জন্য একজন সঙ্গীর দরকার। আল্লাহ আমাকে তা দিয়েছেন। তুমি ভালো থেকো।আমিও ভালো থাকবো।তোমার নতুন জীবন সুখী হোক।”
বলেই নাবিল চুপ হয়ে গেলো।ওর চোখের কোন ভিজে উঠেছে। কবির নাবিলের কাঁধে হাত রাখলো।নাবিলকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
নাবিল আবার বলতে শুরু করলো।
“সারাজীবন মানুষের ভালো করতে চেয়েছি।সেই সূত্রেই চেয়েছিলাম তানজুকে সাহায্য করতে। কিন্তু ও আমাকে এমন শিক্ষা দিলো,কাউকে উপকার করার মতো,কারো ভালো করার মনমানসিকতা এখন আর৷ আমার নেই।”
“ওকে খুঁজিস নি?”
“খুঁজবো না কেনো?অনেক খুঁজেছি।পাইনি।অন্যের বউ বাচ্চার ভালো করতে গিয়ে নিজের বউ বাচ্চাকেই হারিয়ে ফেলছি।”
কবির অবাক হলো।
“তোদের বাচ্চা হয়েছিল না কি?”
“না।কিন্তু অনেক দিন থেকেই নিতে চাইছিলাম।আর শায়েরীর চিরকুট পড়ে এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছি যে ও কনসিভ করেছিলো।কেননা মাঝে মাঝেই বলতো,আমাকে যদি ও কোন কারনে হারিয়ে ফেলে তবে বাচ্চা কে নিয়েই বাকি জীবন পার করে দেবে।আর ও ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই ওর কিছু প্রেগন্যান্সির সিম্পটম ছিলো। খেতে পারতো না তেমন।সব খাবার থেকেই নাকি গন্ধ পেতো।প্রথমে মনে করলাম জন্ডিসই হয়েছে কি না?তুষার ভাইয়ের সাথে ব্যাপারটা আলাপ করতেই উনি বললো এসব কিছুই নাকি প্রেগন্যান্সির দিক নির্দেশনা দেয়।আমি বলেছিলাম ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো কিন্তু ওই বলেছিলো আরো কিছুদিন পরে যাবে।এরপর তো যা ঘটার ঘটলোই।”
কবির চুপ করে থাকলো না।
“কিন্তু নাবিল এভাবে আর কতোদিন থাকবি?যা হওয়ার হয়েছে। এবার একটা বিয়ে করে নে।শায়েরীর ফেরার হলে এতোদিনে ফিরে আসতো।তুই আর এভাবে কস্ট পাস না।”
কবিরের কথায় নাবিল মৃদু হাসলো।
“আমার কি বিশ্বাস জানিস?ওর সাথে আমার দেখা হবে।আমাকে ভুল বুঝে ও গেছে।আল্লাহর কাছে শুধু এটুকুই প্রার্থনা করি আমার মৃত্যুর আগে যেন একবারের জন্য হলেও ওর সাথে দেখা হয়।ওর ভুলটা যেন ভাঙে।ওকে যেন বলতে পারি আমি কোন অন্যায় করিনি।আমি শুধু ওকে আর ওকেই ভালোবাসি।”
______
“মা, একটু আলু ভাজা করে দাও না।এই শাক ভাজি আমার একটুও ভালো লাগে না।”
আবদার করে বললো রুপসা।
” সব্জী খাওয়া ভালো।বিশেষ করে সবুজ শাক।আজ এগুলো দিয়েই খেতে হবে।আলু ভাজা কাল করে দেবো।শাক নাও,মাংস নাও। ”
বলেই মেয়ের পাতে আরো একটু শাক তুলে দিলো শায়েরী।মেয়েটার আলু ভাজা খুব প্রিয়।আর কোন কিছু না হোক৷ শুধু আলুভাজা থাকলেও ওর খাওয়া হয়ে যাবে।
রুপসা মুখ কালো করে শাক দিয়ে ভাত মেখে মুখে তুলে নিচ্ছে।
ওর কালো মুখ শায়েরী যতবার দেখে ততবারই বুকটা ধক করে উঠে। একদম নাবিলের মতো দেখতে লাগে ওকে।এমনিতেও নাবিলের চেহারারই আদল পেয়েছে রুপসা।
যার থেকে দুরে সরে থাকার জন্য এতো আয়োজন সেই নাবিলেরই কার্বনকপি রুপসা।তবুও শায়েরীর মনে কোন ক্ষোভ নেই।থাকবেই বা কেনো?রুপসাই তো জীবনে এগিয়ে চলায় একমাত্র পাথেয়।ওর জন্যই তো বেঁচে থাকা।ওর জন্যই তো এগিয়ে চলা।ও যদি না থাকতো তবে কবেই মরে যেতো।ভালোবাসার মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় যেখানে শ্বাস ফেলতে কস্ট হচ্ছিল সেখানে বেঁচে থাকা তো যুদ্ধ সমান।
কিভাবে যে দিনগুলো পার করেছে তা একমাত্র শায়েরীই জানে।
আজ সেসব দিনের কথা আর মনে করতে চায় না শায়েরী।কি দরকার পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে গন্ধ ছড়ানোর।ভালোই তো আছে মা মেয়ে।নাবিলও নিশ্চয়ই ভালো আছে।কেন যেন ওর জন্য কখনোই মন থেকে অভিশাপ আসেনা।থাকুক, ভালো থাকুক।
চলবে……..
মুনিরা মেহজাবিন।