মোনালিসা পর্ব ২০

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২০
শীতের তীব্রতা একদম কমে এলো। হালকা গরম পড়ছে।সকাল বেলার রোদ’টা মিষ্টি, দুপুর বেলা রোদের ঝাঁঝ খুব বেশী। ভরদুপুরে রোদে হেঁটে মোনার গলা শুকিয়ে যায়। সূর্যের কিরণ যেন তির্যক ভাবে ঠিক মোনার মাথা বরাবর পরছে। মোনা মাথায় হাত দিয়ে দেখে মাথার উপরিভাগে যেন গরম জলীয়বাষ্প বের হচ্ছে। মোনা গিয়েছিল নিশান কে আর্ট স্কুলে ভর্তি করাতে। মোনা চেয়েছিল বছর খানেক পর ভর্তি করাতে কিন্তু জ্যাকের পিড়াপিড়ি’তে এক্ষুনি ভর্তি করাতে হলো।আর নিশানেরও আঁকাআঁকির প্রতি গভীর আগ্রহ। মোনা একটা আইসক্রিম কিনলো, আইসক্রিমটা আরো ঠান্ডা হলে ভালো হতো বোধ হয়। হঠাৎ মোনার চোখে পড়লো শ্রুতি আর সমীর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সমীর স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও, শ্রুতি স্থির নয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভরদুপুরে শুদ্ধ বাংলায় যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে সমীর’কে। মোনা জানে যেকোন একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এমন করছে শ্রুতি। সমীরের ধৈর্যসীমা দেখে অবাক হয় মোনা। মোনা একবার ভাবলো এগিয়ে যাবে, মুহূর্তেই আবার মত পাল্টে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলো।
গত অনেকদিন যাবৎ প্রিয়ম মোনার সামনে আসছে না। মাঝে মাঝে বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন আসে কখন যায় মোনা বলতেও পারে না। ফোন কিংবা ম্যাসেজ কিছুই দেয় না। প্রিয়মের এই অদ্ভুত কর্মকাণ্ড মোনার মনে অহরহ না হলেও, মাঝে মাঝে চিন্তার সৃষ্টি করে। মোনা বাসায় আসে, কিচেনে রাখা সব থালা-বাসন পরিষ্কার করে। গলায় ব্যাথা অনুভব করে, এই গরমেও গলা ব্যাথা! মোনা বিরক্ত হয়। দরজায় পদাঘাতের শব্দ পায় মোনা কিচেনে বসে। তৎক্ষণাৎ মোনা ক্ষীপ্রবেগে দরজার দিকে যায়। কলিংবেল রেখে দরজায় ধাক্কাধাক্কি! মোনার মেজাজ বিগড়ে যায়। দরজা খুলতেই প্রিয়ম উদ্ভ্রান্তের মতো বাসার ভিতরে ঢুকলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মোনা হতভম্ব হয়ে ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম নিষ্পলক দৃষ্টিতে মোনার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত পেরুতেই মোনার ভয় ধীরে ধীরে আক্রোশ আর ক্রোধে পরিণত হতে থাকে। প্রিয়মের চুল গুলো উস্কখুস্ক, নীল চোখ গুলো যেন আরো নীলচে বর্ন ধারন করেছে। দেখে মনে হচ্ছে কোন ফেরারী আসামি, পুলিশের ধাওয়া খেয়ে হন্তদন্ত হয়ে কারো বাসায় ঢুকে পড়েছে। মোনা কয়েক মুহূর্ত বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে থাকে, রুমে রুদ্ধনিঃশ্বাসের মত স্তব্ধতা নামে। মোনা রুক্ষ গলায় ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,
-“কি ব্যাপার প্রিয়ম ভাই? দরজায় কি কলিংবেল নেই? এভাবে কারো বাসায় ঢুকে পড়া কোন ধরণের ভদ্রতা?”
মোনা একটু থামে। প্রচন্ড বিরক্তে কপাল ভাঁজ করে। আবার বলে,
-“আপনি এক্ষুনি বাসা থেকে বের হন।”
প্রিয়ম ভাবলেশহীন ভাবে বসে থাকে। বেড সাইডে রাখা ল্যাম্প’টার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অকারণে। প্রিয়ম নির্লিপ্ত গলায় বলে,
-“তোমায় দেখতে আসলাম। ইচ্ছে করছিলো কাছ থেকে দেখতে।”
প্রিয়মের উপস্থিতিতে মোনা অস্থির হয়ে উঠে। মোনা বার বার বেড়িয়ে যেতে বলে বাসা থেকে। প্রিয়মের চোখে মুখে নির্লিপ্ততা আগের মতই বিদ্যমান। মোনার দরজা খুলে,দরজার সামনেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়ম ধীর পায়ে মোনার কাছে আছে। মোনার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। মোনা দূরত্ব বজায় রাখার জন্য কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়মের মুখ থেকে উদ্ভট একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে, নেশা জাতীয় কিছু খেয়েছে। কিন্তু আচরণ নেশাগ্রস্ত মানুষের মত না, হয়ত অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসবে। মোনা হঠাৎ রাগে চিৎকার দিয়ে বলে,
-“আপনি কেন এসেছেন এখানে?”
-“তোমায় দেখতে।”
মোনা ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,
-“দেখছেন না আমায়?এবার বেড়িয়ে যান।”
-“হ্যাঁ দেখেছি। বেড়িয়ে যাবো?”
প্রিয়ম প্রশ্ন নিজেকে নিজে করেছে মনে হচ্ছে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“আচ্ছা চলে যাচ্ছি। মোনা তুমি তো লেখাপড়া করছো না ঠিকমত। লেখাপড়া মেইন পয়েন্ট এটা চালিয়ে যেতেই হবে। আমি যতই বাজে কাজ করেছি কিন্তু লেখাপড়াও ঠিকঠাক চালিয়ে নিয়েছি। আর আমার ব্রেন অসম্ভব শার্প। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ফেলেছি এখন হাই স্যালারির একটা জব হয়ে যাবে। তারপর তোমায় নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করবো।”
শেষ উক্তিটা মোনার কানে তীরের মত বিঁধলো। মোনা বিরক্তে কপাল ঘুচিয়ে ফেলল।প্রিয়ম যেন বয়স্ক মানুষের মত উপদেশ দিলো গম্ভীর গলায়। নিজ দোষ ,গুণ আত্মপ্রকাশ করলো স্বচ্ছন্দে। প্রিয়ম চলে গেলো। প্রিয়ম’কে বুঝা মোনার পক্ষে দিন দিন দূর্বিষহ হয়ে উঠছে। প্রিয়মের অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড মোনার অহরহ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে যাচ্ছে যেন। মোনা এসব ভাবনায় ডুবে যায়। একটা মানুষ’কে যতই অবজ্ঞা করুক না কেন কোন এক অবসারে সেই মানুষটা’কে নিয়ে হাজারো চিন্তা মাথায় আসবে।
মোনা কিচেন পরিষ্কার করতে ছিলো কিন্তু ঘটনার স্রোতে তা যেন ভুলে গেলো।এই অচেনা প্রবাসে, নির্জন একটা রুমে মোনা যে ভালো আছে তাও না। মোনা ভালো নেই কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। মন খারাপ থাকলেই মোনা ছুটে যায় জ্যাকের বাসায়। মোনা এখানে ভালো নেই কিন্তু মাঝে মাঝে মন ভালো থাকে জ্যাক আর প্রিন্সেসের সান্নিধ্যে। মোনার বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে। মায়ের ক্লান্ত চোখ-মুখ ভেসে উঠে প্রায়শ চোখের সামনে। অন্ধকারে একাকিত্বে মোনা স্মৃতিচারণ করে
—–
মোনার পরীক্ষা ঘনিয়ে আসে। প্রস্তুতি তেমন ভালো না। সারাদিন ভার্সিটি,জব ,রাতে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে পড়তে ইচ্ছে হয়না। তাছাড়া নিশান কে সামলানো, রান্নাবান্না সব মিলিয়ে পড়ার সময় আর হয়ে ওঠে না। পড়ার সময় পেলেও মোনা কেন যেন পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না। নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলো না ভার্সিটির পরিবেশের সাথে।
কয়দিন ধরে মোনা রাতে প্রায় দুইটা-তিনটা পর্যন্ত পড়ে। এখানে আসার মূল কারণ লেখাপড়া। বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে মোনা লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যায়। মোনা পড়া শেষ করে রাত দেড়টার দিকে বারান্দার যায়। আকাশের দিকে তাকায়। এক ফালি বাঁকা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। তারা গুলো হীরার মত ঝলমল করছে। কয়দিন আগেও চাঁদটা পরিপূর্ণ গোলাকার ছিলো। মোনার হাতে থাকা মোবাইলটা ভাইব্রেশন থাকার ফলে ম্যাসেজ আসলে কেঁপে উঠে। অনেক রাত জাগার ফলে চোখে কিছুটা অস্পষ্ট,ঝাপসা দেখছে। মোনা ভালো করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল প্রিয়ম ম্যাসেজ করেছে-
“আমি তোমার বাসার কাছাকাছি। বারান্দার নিচে আসবো?এক ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছিলাম। বাসায় ফিরছি, ভাবলাম তোমায় একটু দেখে আসি।”
মোনা ভেবেছিল প্রিয়ম কয়েকদিন জ্বালাতন করে হাল ছেড়ে দিবে। একটা মেয়ের পিছনে এতদিন পরে থাকার মত মানসিকতা প্রিয়মের আছে মোনার জানা ছিলো না। প্রিয়ম সেই আগের মত অদ্ভুতই রয়ে গেছে। ম্যাথ সাবজেক্টের মত কঠিন, যা মোনা এখনও বুঝতে পারছে না।
মোনা রিপ্লাই দিলো,
“এত রাতে আমার বাসার বারান্দার নিচে আপনার কি?খরবদার ভুলেও আসবেন না।”
প্রিয়মের থেকে কোন উত্তর আসলো না। খানিকক্ষণ পর প্রিয়ম এসে গেলো। মোনা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। মোনা চায় না প্রিয়ম এখানে আসুক। মোনার ভালো লাগে না, অস্বস্তি লাগে ভীষণ। এত অবজ্ঞার পরও মোনার প্রতি কোন অভিযোগ নেই, কোন আক্রোশ কিংবা রাগ নেই। মানুষ প্রেমে পড়লে বদলায়। তখন মানুষ মাতাল হয়ে যায়। একজন মানুষ মাতাল অবস্থায় হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তেমনি একজন প্রেমে পড়া মানুষও সব করতে পারে। কিন্তু এসব প্রিয়মের মত মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায়না। প্রিয়মের এসব অপ্রত্যাশিত কাজ আজকাল মোনার ভাবনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। মোনা একবারও বারান্দায় যায় না। প্রিয়ম আছে কিনা চলে গেছে তাও আজকাল জানার আগ্রহ জাগে না। প্রতিনিয়ত প্রিয়মের এমন আচরণ দেখতে দেখতে মোনা যেন তেতো হয়ে গেছে। অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসবে।
প্রিয়ম প্রায় প্রতিদিনই মোনার ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে গাড়ি নিয়ে। প্রতিদিন মোনা কে বলবে,’চলো পৌঁছে দিই।’ মোনা একদিনও প্রিয়মের গাড়িতে আসেনা, গ্রাহ্য করেনা। তবুও রোজ নিয়ম করে প্রিয়ম এই কথাটা বলবে।
প্রায়ই মোনার বাসার সামনে ঘুরঘুর করবে, রুটিন করে মোনা যেখানে কাজ করে সেখানে যাবে বসে থাকবে। মোনার কেন জানি কোন অনুভূতিই জাগে না, প্রিয়মের কোন কাজই মোনার অনুভূতি কে জাগ্রত করতে পারেনা। হয়ত মোনার মন কঠিন হয়ে যাচ্ছে কষ্ট সহ্য করতে করতে।
—–
লিলি বেগম মোনার উপর রাগ করে আছে, কিন্তু প্রকাশ করছে না। রাগের মূল কারণ মোনা রাজি হয়না লিলি বেগমের বাসায় যেতে। কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আপনজনের রাগ বিরক্তের কারণ হয়ে উঠে।মোনারও তাই হয়েছে। মোনা যদি তাঁদের বাসায় না যায় তাহলে মনে হচ্ছে এই রাগ যাবে না। কিন্তু তা মোনার দ্বারা কখনো সম্ভব না। মোনা কখনো যাবে না। লিলি বেগম বার বার জিজ্ঞেস করবে,’কেন যাবি না তুই আমার বাসায়?’ এ প্রশ্নের উত্তর মোনার কাছে আছে। কিন্তু বলতে গেলে মনে হয় কেউ ভিতর থেকে গলা চেপে ধরেছে মোনার। মোনার গলা ধরে আসে। ভিতর থেকে কথা বের হয়না। মোনা চায় না এসব কখনো বলতে।
মোনা লিলি বেগম কে ফোন দিয়ে আসতে বলে। মোনা জানে লিলি বেগম যতই রাগ করে থাকে কিন্তু আসবে। এ ব্যাপারে মোনার ধারণা মিথ্যা হয়না। লিলি বেগম আসে। লিলি বেগম আসলে মোনার আর রান্না ঘরে যেতে হয় না। লিলি বেগম বার বার মোনা কে বুঝিয়ে বলবে,’জবটা ছেড়ে দে, কত ডলারই বা পাস মাসে?’ এ কথা শুনলেই মোনার মুখ শক্ত হয়ে আসে।
লিলি বেগম থাকাকালীন একদিন জ্যাক আসে প্রিন্সেস কে নিয়ে মোনার বাসায়। জ্যাক যখনই আসবে,প্রিন্সেস’কে নিয়ে আসবে। লিলি বেগম দরজা খুলে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়।জ্যাক চমকে যায়। অপ্রস্তুত ভাবে বলল,
-“এ বাসায় তো মোনালিসা থাকে।”
লিলি বেগম ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি টানে। জ্যাক হাসি দেখে সহজ হয়। লিলি বেগম বলে,
-“হ্যাঁ,হ্যাঁ ভিতরে আসো।”
জ্যাক প্রিন্সেস’কে নিয়ে ভিতরে এসে বসে। লিলি বেগম বলে,
-“মোনালিসা শাওয়ার নিচ্ছে। অপেক্ষা করো।”
জ্যাক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।লিলি বেগমের চোখ যায় প্রিন্সেসে দিকে। সদ্য ফোঁটা ফুলের মত পরিস্ফুট প্রিন্সেস! লিলি বেগম বলে,
-“হাউ সুইট বেবি!”
মেয়ের প্রশংসা শুনলে যেন খুশি হয় জ্যাক। মোনা বাথরুম থেকে কথার শব্দ পায়। ভেবে নেয় লিলি বেগম এ বাসায় তাই প্রিয়ম নয়ত এরিক এসেছে, হাবিব সাহেব কখনো আসে না।
মোনা বেড়িয়ে দেখে জ্যাক আর প্রিন্সেস এসেছে। মোনা ভেজা কাপড় শুকাতে দিয়ে দ্রুত রুমে আসে। চুল গুলো তোয়ালে দিয়ে পেঁচানো। ভালো করে না ঝাপটানোর ফলে তোয়ালে ভিজে চুলের পানি দুই-এক ফোঁটা গড়িয়ে ফ্লোরে পরছে।
মোনা কে দেখেই অভ্যাস অনুযায়ী প্রিন্সেস ঝাঁপিয়ে পড়ে মোনার কোলে। লিলি বেগম আড়চোখে দেখছে। বুঝতে পারছে না, এঁদের সাথে মোনার কিসের এত খাতির?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here