মোনালিসা পর্ব ৪৯

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪৯
প্রিয়ম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় মোনার দিকে।প্রিয়ম এমন চাহনির কারণ বুঝতে না পেরে মোনা ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকায়।প্রিয়মের গলায় রসিকতা,
– “মোনা আমায় তুমি বলেছে!ও মাই গড!ভুল শুনেছি নাকি আমি?এত মনোমুগ্ধকর কথা।”
প্রিয়ম যেন বিলাপ জুড়ে দিলো। অবিশ্বাস্য ভাবের পাল্লা’টা আরো ভারি করে বলল,
– “মাঝে মাঝেই যেন আমার হার্টে প্রবলেম’টা হয়। সতেরো দিন হসপিটালে থাকলেও অন্তত তুমি সম্বোধন শুনতে পারবো। আর—-”
মোনা প্রিয়ম’কে ছেড়ে দিয়ে রূষ্ট চোখে তাকালো। প্রিয়মের এরূপ রসিকতায় ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেলেও,মুখের অভিব্যক্তি’তে মনে হলো খুব বিরক্ত হয়েছে। প্রিয়ম এ পর্যায়ে মোনার রাগ দেখে আম্ভরিক হয়ে বলে,
– “আর হবো না অসুস্থ মোনা পাখি।”
প্রিয়ম’কে ছাড়া এতদিনের একাকিত্ব’তা,শূন্যতা কিংবা অসহ‌্য যন্ত্রনা গুলোর কথা মনে পড়ায় মোনা নিসাড় হয়ে থাকে।প্রিয়মের সাথে এতদিন পর কথা বলার আনন্দে সেই কষ্ট গুলো যেন উপচে উঠছে। মোনার চেহেরার ব্যঁজনে বুঝা যায় ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেছে মোনার। প্রিয়ম মোনার শরীর ঘেঁষে বসে মোনার কাঁধের উপর মুখ ঠেকিয়ে বলল,
– “মিস করো নি আমায়?”
মোনার গলা ভারি হয়ে আসছে।নিচু স্বরে বলে,
– “কি মনে হয়?”
– “আচ্ছা আমি যদি মারা যেতাম?”
মুহূর্তেই মোনা ত্রাসিত হয়ে তাকায়।চোখে মুখে দোর্দণ্ড আতঙ্ক। চোখ গুলো আপনা-আপনি বড় হয়ে যায়। গলদেশ বেদনায় ছলছল। মুখে গাঢ় নীরদ এসে জমেছে। প্রিয়ম এরকম কথা বলে মোনা’কে কষ্ট দেওয়ায় অনুতপ্ত আর আবেগ মিশ্রিত গলায় বলল,
– “মোনা পাখি স্যরি স্যরি।”
মোনা প্রিয়মের কাছ থেকে সরে বসে।প্রিয়মের ফোন পেয়ে ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছে। দু দন্ড ভাবেও নি।প্রিয়ম’কে দেখার পর সেই ঝোঁক কিছু’টা হলেও দূর হয়েছে। এখন মোনার মনে হচ্ছে লিলি বেগম কি ভাববে?কেউ কি দেখেছে ওঁদের?দরজা’টাও খোলা!মোনা ভয়বিহ্বল হয়ে যায়। এতক্ষণ এসব চিন্তা ভাবনার ঊর্ধ্বে ছিলো মোনা। চিন্তাগ্রস্থ চিত্তে মেনিমুখো গলায় বলল,
– “আমি এভাবে চলে এসেছি খালা কি ভেবেছে বলেন তো? আমি তো কখনো আসি না এ বাসায়!”
প্রিয়ম মুখের ভাব অচঁচল। স্বাভাবিক গলায় বলল,
– “কি আর ভাববে? এতদিন আসো নি বলে কি আজও আসতে পারবে না?”
কিছুক্ষণ পর মোনার মুখের ভাব বদলে যায়।চোখে মুখে রাগের স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে যেন।মুখ কিছু’টা বিকৃত করে বলে,
– “এতদিন বিভা আপুর সাথে হাসপাতালে ভালোই ছিলেন।মাথার কাছে বসে থাকতো।রাতেও এক সাথে ছিলেন নাকি?”
প্রিয়ম অস্বাভাবিক ভাবে হেসে উঠে। মাথায় এলোমেলো হয়ে থাকা চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলে,
– “আম্মু থাকত সব সময়।আর ওঁর কথা কেন জিজ্ঞেস করছ বুঝতে পারছি না! আমার কাছে ও বিরক্তকর একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই না। অসহ্য লাগে!”
প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে আবার বলল,
– “আমি তো শুধু আমার মোনা পাখি’কে ভালোবাসি। লজ্জাবতী রানী সে।”
বিভার ব্যাপার’টা মনে পড়লেই মোনা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে।প্রিয়ম যখন হসপিটালে ছিলো,মোনার মনে বার বার একটা কথা পীড়ার সৃষ্টি করত।বিভা প্রিয়মের পাশে! এটা হজম করতে মোনার বেগ পোহাতে হত। প্রিয়মের কথার প্রত্যুত্তর না করে উল্টো জিজ্ঞেস করত,
– “বিভা আপু উনারা কবে যাবে?”
এই প্রশ্নের উত্তর প্রিয়ম দেওয়ার আগেই লিলি বেগম রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
– “কয়েকদিন পর যাবে।”
লিলি বেগমের গলা শুনে মোনা মোনা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়।মুখ আপন শক্তিতে হাঁ হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলিয়ে প্রিয়মের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে দুই জনের মনে একই চিন্তা সৃষ্টি হয়েছে কিনা।লিলি বেগম কি এর আগের কথা শুনেছে?লিলি বেগম এসে মোনার পাশে বসে আক্ষেপ করতে করতে বলো,
– “কত করে বললাম আসলি না আমাদের বাসায়।এখনই তো ঠিকই আসলি।”
মোনা অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ে যায়।লিলি বেগমের এই আক্ষেপের ভিতর ব্যঙ্গাত্মক ভাবও ছিলো বোধ হয়।মোনা কি উত্তর করবে দ্রুত ভাবতে থাকে। কোন যুক্তি সংগত উত্তর না পেয়ে মনে মনে ব্যর্থ হয়। এর ভিতর নিপা বেগম রুমে আসে।মোনা’কে দেখে নানান রকমের গল্প জুড়ে দেয়। গল্পের ভাঁজে লিলি বেগমের প্রশ্ন’টা চাপা পড়েছে। প্রিয়ম মোনার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে উনারা কি মনে করবে? মোনা সকলের দৃষ্টির অগোচরে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙায়। প্রিয়মের মুখে বিরক্তির ছাপ, কারো উপস্থিতি ভালো লাগছে না। অনেকক্ষণ পর মোনা বলল,
– “খালা আমার যেতে হবে নিশান বাসায় তো। আমি এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম একবার প্রিয়ম ভাই কে দেখে যাই।”
লিলি বেগম প্রশ্ন করে,
– “তুই এখান দিয়ে কোথায় গিয়েছিলি?”
– “আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায়।”
– “যেখানেই যাস এখন তুই বাসায় যেতে পারবি না। নিশান’কে না হয় এরিক নিয়ে আসবে।”
মোনা ব্যস্ত গলায় বলে,
– “না,না খালা আমার খুব একটা জরুরী কাজ আছে।”
সবার সব কথা উপেক্ষা করে মোনা বাসা থেকে বের হয়ে যায়।প্রিয়ম মোনা’কে ইশারায় থাকতে বলেছে বার বার। মোনা দেখেও না দেখার ভান করে ছিলো।
_________________________________
আরো চার-পাঁচ দিন কেটে যায়।প্রিয়ম বেড রেস্টে।মোনার ভার্সিটি, অফিস ঠিকঠাক চলছে। দিনশেষে প্রিয়মের সাথে ফোনে কথা। প্রিয়ম বার বার বাসায় যেতে বলে। ওইদিন যেয়ে লিলি বেগমের যে তোপের মুখে পড়েছে আর যাবে না! লিলি বেগম সব বুঝে যাবে।
মোনা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে গেটের সামনে যেতেই দেখে একটু দূরে নিপা বেগম,মুনির হাসান আর বিহি,বিভা। মুনির হাসান দূর থেকে হেসে হাতের ইশারায় মোনা’কে দাঁড়াতে বলে। মোনার কাছাকাছি এসে খানিক চমকে গিয়ে বলল,
– “আরো ভার্সিটি’তে যাচ্ছো? আমরা কাল চলে যাবো।তাই তোমার বাসায় এসেছি।”
নিপা বেগম পাশ থেকে বলে,
– “আচ্ছা তুমি ভার্সিটি যাও।দেখা তো হলো।বাসায় ঢুকব না।”
মোনা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
– “কি বলছ খালা? একদিন ভার্সিটি মিস গেলে কিছু হবে না ।চলো তো তোমরা।”
মোনা নিপা বেগমের হাত ধরে।জোর গলায় আবার বলে,
– “বাসায় চলো তো।”
বিভার উপর মোনার প্রচণ্ড ক্ষোভ। অসহ্য লাগলেও প্রকাশ করল না। সৌজন্যমূলক আচরণ করা আবশ্যক। উনারা সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় চলে গেল। নিপা বেগমেরা চলে যাওয়ার পর মোনা এক রাশ বিরক্তি নিয়ে আধোয়া থালা-বাসন নিয়ে ওয়াশ রুমে গেল।বিভা চলে যাবে কেমন একটা স্বস্তিদায়ক খরব।
কয়েকদিন পর সকাল বেলা মোনা নিশান’কে খাইয়ে দিচ্ছিলো। এর ভিতর ডোর বেল বেজে ওঠে।প্রিয়ম আগে যে ভাবে এসে বেল বাজাতো ঠিক সেই সুর যেন। মোনার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রিয়ম আসলে তো জানাতো মোনা’কে। তবুও মোনা প্রিয়ম এসেছে এই প্রত্যাশায় দরজার দিকে পা বাড়ায়।দরজা খুলে মোনা রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়ম ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,
– “সারপ্রাইজ।”
মোনাও বিস্মিত চেহেরা নিয়ে হাসে। মনের ভিতর প্রশান্তি ভাব আসে। নিশান স্কুলে চলে যায়। মোনা দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে প্রিয়মের পাশে বসে। প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “অফিসে যাবেন? পুরোপুরি সুস্থ তো আপনি এখন?”
– “আপনি কে? আমি কারো আপনি না।”
– “ধ্যাত! তুমি বলতে লজ্জা লাগে আমার।”
– “তোমার লজ্জা পাওয়া দেখতে আমার ভালোলাগে।”
মোনা ফের একই প্রশ্ন করল।প্রিয়ম উত্তর দিলো না। তুমি বলতে গেলে অস্বস্তি’তে মোনার গা গুলিয়ে যায়। অনেকক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর মোনা অন্যদিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে,
– “অফিসে যাবে না তুমি? পুরোপুরি সুস্থ এখন?”
প্রিয়ম হেসে উঠে। বাঁধ ভাঙ্গা হাসি যেন।মোনা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকায়।প্রিয়ম ডান হাতের পৃষ্ঠদেশ মুখে চেপে ধরে হাসির থামানোর চেষ্টা করে।
– “না আজ অফিসে যাবো না। তোমায় দেখার তৃষ্ণা মেটাবো আজ। কতদিন দেখিনি। অফিসে কাল থেকে যাবো।”
প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
– “এই মোনা আমায় দেখলে এখনো অস্বস্তি হয় তোমার? এভাবে জড়সড় হয়ে থাকো না?তুমি আসলে ভাই-বোনের সম্পর্ক’টা বেজায় রক্ষা করে চলেছ। অথচ আমরা নিউলি ম্যারেড কাপল।”
প্রিয়মের কথার শেষ অংশটুকু কৌতুকোচ্ছল ছিলো। কাপল শব্দ শুনলে মোনার গা শিরশির করে উঠে যেন।প্রিয়ম মোনার কানের কাছে এলোমেলো হয়ে থাকা চুল গুলো বাম হাত দিয়ে সরিয়ে মোনার গালে ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া দেয়। মোনা কেঁপে কেঁপে উঠে কেবল। প্রিয়মের চোখে অদ্ভুত এক নেশা। সেই নেশায় মোনার বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।প্রিয়ম জড়িয়ে ধরে মোনা’কে।মোনার ওষ্ঠের সুধা পান করে। মোনা গভীর ঘোরে হারিয়ে যায় যেন।খানিক বাদে প্রিয়ম’কে ধাক্কা সরিয়ে বারান্দায় চলে যায়।মোনার চোখে-মুখে নিদারূন লজ্জার স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে। হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে।প্রিয়ম হাসে মোনার দিকে তাকিয়ে। প্রিয়ম কিছুক্ষণ পর মোনার কাছে গেল।
– “এত লজ্জা কোত্থেকে আসে বউ?”
বউ বউ শব্দ’টা মোনার কর্ণকুহরে বার বার প্রতিধ্বনিত হয়। মোনা’কে নিরুত্তর দেখে প্রিয়ম আবার বলে,
– “আচ্ছা আর চুমু-টুমু খাবো না।আসো রান্না করি দু’জনে।”
এতক্ষণে মোনা জিজ্ঞেস করল,
– “রান্না করতে পারেন?”
– “পারি কিছু আইটেম। আব্বু-আম্মু তো মাঝে মাঝেই ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে যেত।তখন আমি আর এরিক নতুন নতুন রান্নার আইটেম আবিষ্কার করতাম।”
মোনা হেসে ফেলে।প্রিয়মের দিকে তাকায়।বড্ড বেশি ভালো লাগে এই মানুষ’টা কে এখন। মোনার পিছু পিছু প্রিয়ম কিচেনে ঢুকে। প্রিয়মের সামনে মোনার সব সময় একটা অস্বস্তি বোধ কাজ করে। আর প্রিয়ম যখন গভীর মনোযোগে তাকায় মোনার দিকে অস্বস্তি বোধ’টা যেন বেড়ে যায়। প্রিয়ম বলে,
– “আমি রান্না করছি।তুমি দেখো।”
মোনাও অনন্যচিত্তে তাকিয়ে তাকিয়ে রান্না দেখছে।মোনার ঠোঁটে হাসি হাসি ভাব। তীব্র ভালোলাগা কাজ করছে। প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “আমি তোমায় রান্না দেখতে বলেছি। আমায় দেখতে বলেনি মোনা পাখি।”
মোনা লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।প্রিয়ম রান্না শেষে মোনা’কে খাইয়ে দিলো। তারপর চা নিয়ে বারান্দায় আড্ডা। কেমন আদরমাখা একটা দিন। সুখ, প্রশান্তি যেন মোনার বার বার মোনার কানে বলছে,’এই তো এসেছি আমি।’
_________________________________
মাঝ রাত।মোনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়ম মোনা’কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত।আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। রুম থেকে আসা কয়েক খণ্ডে আবছা আলো’তে দুই জন দেখছে দুই জন’কে। আলো-অন্ধারের এই রসহ্যয়মী রূপ সবকিছু কে যেন মায়াময় করে তুলেছে।মোনার মন জুড়ে বসন্তের রং। বারান্দায় হিমশীতল মৃদু পবন। বাতাসে যেন প্রেম প্রেম গন্ধ। অন্ধকারেও যেন প্রেমের ঘ্রান।মোনা শিউরে উঠছে বার বার। প্রিয়ম মোনা’কে কোলে তুলে রুমের দিকে হাঁটলো। জগদ্বাসীর সমস্ত লজ্জা, আড়ষ্টতা এসে মোনার মাঝে ভর করে।সময় গুলো মাদকপূর্ণ। মোনার শরীর যেন লজ্জায় কাঁপতে থাকে।প্রিয়মের প্রতিটি ছোঁয়ায় সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠছে।প্রিয়ম মোনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
– “বউ আজ তোমার লজ্জা পাওয়া দিবস।”
(চলবে)
~আজও রিভিশন দিই নি😁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here