❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[০৬]
-”লজ্জা থাকলে এই বাসা মুখো আর হবে না। তোমাকে দেখলে আমার ঘৃণা লাগছে, যাও বের হও।”
আদিত্যের তিক্ত কথা শুনে মেধা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সে কখনো কারো কাছে এত অপমানিত হয় নি। কেউ তার সনে এভাবে কথাও বলে নি। অথচ গতকাল রাত থেকে আদিত্য তার সঙ্গে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করছে। একটবারও ভাবছে না কষ্ট পাচ্ছে কী না! তাছাড়া খারাপ কী এমন বলেছে? সে
যা করছে তাইই তো বলেছে। সে করতে পারলে তার বলতে
বাঁধা কিসের? সৌমির কথা এবং বর্তমান অবস্থা না জানলে
আলাদা কথা। কিন্তু জেনে বুঝে কীভাবে চুপ থাকবে? সৌমি রুপে গুনে কোনোকিছুতেই কম ছিলো না। বরং নজরকাড়া সুন্দরী ছিলো। তাহলে তাকে কেন মেনে নিলো না আদিত্য?
এমন তো না সে কখনোই বিয়ে করবে না, বাচ্চা ফুটাবে না।
সবই করবে তবে আজ অথবা কাল, এছাড়া সৌমির ঘটনা না জানত সেটাও হতো ভিন্ন কথা। কিন্তু জেনে বুঝে চোখের দেখাকে কীভাবে ভুল ভাববে?
(বি:দ্র: গত পর্বে সৌমির মাসির ছেলে স্বাগতর সঙ্গে সৌমির বিয়ে নিয়ে কিছু লিখেছিলাম। আমি জানতাম না হিন্দু ধর্মে রক্তের সঙ্গে জড়িত ভাইয়ের সঙ্গে বিবাহ একেবারে নিষিদ্ধ।
যদিও না জানার কথা কারণ আমি সংবাদপত্রে পড়েছিলাম দক্ষিণ ভারতে হিন্দুদের, খালাতো, মামাতো, চাচাতো ভাই বোনদের মধ্যে বিয়ে খুবই সাধারন ব্যাপার। শুধু তাই’ই নয়, তামিলনাড়ুতে মামা তার ভাগনীকে বিয়ে করার অগ্রাধিকার পায়। যারা বলছেন এটা সম্ভব নয় তাদেরকে বলবো দক্ষিণ ভারতীয় কিছু নায়কদের কথা। যারা হিন্দু হয়ে কাজিন বিয়ে করেছিলেন। যেমন, Karthi & Ranjini – (কাজিনকে বিয়ে – ২০১১ সাল) তামিল অভিনেতা। Mohon Babu & Vidya – (কাজিনকে বিয়ে – ১৯৭০ সাল) তেলেগু অভিনেতা ও প্রযোজক। বর্তমানে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে, সিনেমায় অভিনয়ও করে। Krishna & Indira – (কাজিনকে বিয়ে – ১৯৬৩ সাল) তেলেগু অভিনেতা ও পরিচালক। তার ছেলে Mahesh Babu বর্তমানে একজন বিখ্যাত অভিনেতা।
উপরের তথ্য আমার বানানো নয় গুগোল থেকেই নেওয়া।আধুনিক টেন্ডের কথা বাদ দিয়েও উপরোক্ত তথ্য অনুযায়ী আগেও এই ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বাস না হলে নিজেরাই যাচাই করে দেখুন। আর আমার পাশে বাসাতেও এই একই ঘটনা ঘটেছে। সেটা দেখেই ভেবেছিলাম সাধারণ ব্যাপার। যেহেতু এখন আপনারা বলছেন এটা সম্ভব না। তাই আমি যুক্ততর্ক
না করে, গতপর্বে লেখা স্বাগতকে মাসির ছেলে থেকে তাদের বাসার ভাড়াটিয়া করে দিলাম। আপনারাও সেভাবেই ধারণা করে নিন, ধন্যবাদ।)
মেধাকে কাঁদতে দেখে আদিত্যের মেজাজ আরো চড়া হলো।
সে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইল মেধার দিকে।একদিনের তিক্ত আচরণে ওর বেহাল দশা। তাহলে এতদিন যে ওর সনে এমন করে এসেছে তার বেলা? সে কোথাও একটা পড়েছিল
চোখের পানি মেয়েদের মোক্ষম অস্ত্র।এটা দিয়ে তারা তাদের প্রেমিক পুরুষকে কাবু করতে ওস্তাদ।পরিস্থিতি যেমনই হোক
যখনই দেখে প্রেমিক পুরুষটা সামান্য ব্যাপারে কাঁদতে পারে না, নিজের কষ্টটাও ব্যাখা করতে পারে না ওমনি এই অস্ত্রের
ব্যবহার করে ওরা। এর জলজ্যান্ত প্রমাণ মেধা। এতদিন সে ভালো ব্যবহার তো দূর যা ইচ্ছে তাই বলেছে। উচিত অনুচিত
কোনো কিছুর ধার ধারে নি। অথচ গতরাত থেকে এ অবধি একটু চড়া কথা বলতেই কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। এই না হলো মেয়ে মানুষ। এসব ভেবে সে মেধার কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসল। তবে সেই হাসি তার ঠোঁটের কোণেই রয়ে গেল। এইটুকু সময়ে মেয়েটা নাক, চোখ, মুখ লালবর্ণ করে ফেলেছে। ক্ষণে ক্ষণে ফ্যাচ ফ্যাচ করে নাকও টানছে। যেনো তাকে মারধর করা হয়েছে। সামান্য এ কথার ভার নিতে পারছে না অথচ নিজের বলে কত বড় বড় কথা। তখন তার স্মরণে থাকে না যাকে বলছে তার খারাপ লাগছে কী না, কষ্ট পাচ্ছে কী না! যদিও বাঙালি কোনো কাজ করার চেয়ে অন্যের খুঁত ধরতে পটু। তখন আদিত্যের গা জ্বলা কথা শুনে সীমা বেগম বললেন,
-”সকাল সকাল কি শুরু করলি তুই?”
-”আমি কিছু করি নি যা করার ওই মেয়েটা করেছে।”
একথা শুনে মেধা ঝটপট ওর কাপড়ের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলো। বিনাবাক্য বাইরে যেতে যেতে শুনতে পেলো,
-”যাচ্ছে যাক খবরদার আঁটকাবে না ওকে।”
-”ওর বাবা নেই দেশে কোথায় যাবে মেয়েটা?”
-”আমি কী জানি।”
-”আদিত্য মার খেতে না চায়লে এক্ষুণি সরি বল মেধাকে।”
-”হা হা হা দারুণ জোক্স। ”
একথা বলে আদিত্য ওর রুমে চলে গেল। মেধা ব্যাগ হাতে গেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। দু’একবার পেছনে ঘুরেও দেখলো। না কেউ আসছে না এদিকে। সে রাগের বশে চলে যাচ্ছে অথচ তাকে কেউ বারণ করছে না, আটকাচ্ছেও না, এটা কোনো কথা? মামনি আঁটকাবে বলেই তো ভাব দেখিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সঙ্গে টাকাও তো নেই। টাকা থাকলে নাহয় মামার বাসায় যাওয়া যেতো। মেধা নখ কামড়াতে কামড়াতে
এসব ভাবছিল তখন আমান জগিং করে ফিরছিলো। ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,’ কি হয়েছে?’
মেধা পুনরায় কেঁদে কেটে আদিত্যের কথাগুলো বলল।এসব শুনে আমান জোর করে তাকে বাসায় ধরে নিয়ে গেল। আর এমন ভাব করল যেনো সে এই বাসায় আসতেই চায় না শুধু আমানই তাকে জোর করে এনেছে।আমান ওকে বসতে বলে রুমে গেলো ফ্রেশ হতে। মেধা কয়েক সেকেন্ড বসে এক এক করে গেল রান্নাঘরের দিকে। তারপর মুখটা ফুলিয়ে মামনির
দিকে তাকিয়ে রইল।যেনো তার সমস্ত অভিমার উনার প্রতি। ওর উপস্থিতি বুঝতে পেরে সীমা বেগম পরোটা ভাজতে ভাজতে বললেন,
-”যাস নি এখনো?”
-”তুমিও চলে যেতে বলছো?”
-”তুই আসলেই বোকা তা জানিস?”
-”আমি আবার কী করলাম”
-”আদিত্যকে জ্বালানোর দায়িত্ব দিয়েছিলাম তোকে। অথচ তুই…! তোকে দিয়ে সত্যিই কিছু হবে না।”
-”তোমার গুনধর ছেলের খোঁচা মারা কথা শুনে রাগ সংবরণ করতে পারি না। এমন এমন কথা বলে গা পিত্তি জ্বলে যায়।
দাঁড়াও বাবা ফিরুক আর কখনো তোমাদের বাসায় আসবো না। যতদিন না তোমার ছেলে সরি বলে নিয়ে আসবে।”
-”হ্যারে মা বিয়ের পরেও কী সামান্য কথায় তোরা এভাবেই খোঁচাখুঁচি করবি?”
-”খোঁচাখুঁচি না খু*না*খু*নি করবো। তোমার ত্যাড়া ছেলের দফারফা করে দিবো দেখে নিও।”
-” তবে কী ধরে নিবো আদিত্যকে বিয়ে করতে তুই রাজি? না মানে খু*না*খু*নি করার জন্য হলেও বিয়েটা করা উচিত।”
-”হুম তাকে বলে দিও আমি বিয়েতে রা.. না না মানে না।”
-”কি রা না রা না করছিস? হ্যাঁ কি না তাই বল।”
-”না একটুও না একবিন্দুও না।”
একথা বলে মেধা গমগম শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। সীমা বেগম ভ্রুঁ কুচকে উঁকি মেরে দেখে আদিত্য এসে চেয়ারে বসেছে। হয়তো নাস্তা সেরে কোথাও যাবে। উনি মূল কাহিনি বুঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। দু’জনকে রাজি করাতে না জানি কতকাল কেটে যায়। উনি এসব চিন্তা বাদ দিয়ে নাস্তা দিলেন আদিত্যকে। আমান একেবারে রেডি হয়ে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে যাচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে ট্যূরে। কবে ফিরবে তা বলতে পারছে না। আমান বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বড় মামা সেখানে উপস্থিত হলেন। সীমা বেগমের ডাকে বড় মামা সহ মেধাও এসে বসলো নাস্তার টেবিলে। খেতে খেতেই মামা জানালেন উনার মেয়ের সূচির বিয়ের দিনকাল ঠিক হয়েছে। আর সূচির মায়ের খুবই ইচ্ছে গ্রামের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার তাও গ্রাম্য প্রথায়।ছেলেপক্ষসহ সূচিরও মত আছে এতে। এসব নিয়ে মামা কথা শেষ করে আদিত্যকে বললেন দুপুর পরপরই বেরিয়ে পড়তে। আদিত্য যাবে শুনে মেধা ওর খাওয়া থামিয়ে আড়চোখে আদিত্যের দিকে তাকাল। অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে আদিত্যের ‘ না ‘ শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আদিত্য বলল,
-” চারটায় বের হলে সুবিধা হতো, কিছু কাজ বাকি আছে আমার।”
ছেলের কথা শুনে আদিত্যের মা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
-”তাহলে আমি এখনই তোমার মামার সঙ্গে যাচ্ছি। তুমি আর মেধা তোমার বাবাকে চাবি দিয়ে ধীরে সুস্থে এসো।”
সীমা বেগমের এ কথা শুনে মেধা লাফিয়ে উঠল। একবার মামনি তো আরেকবার আদিত্যের দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বলল তাকেও সঙ্গ নিতে। কিন্তু তাতে কোনো কাজই হলো না। বরং আদিত্যকে দুপুরের খাবার গুছিয়ে দেওয়ার তাগাদা দিলেন সীমা বেগম। মেধা ঘ্যান ঘ্যান করে পিছু পিছু ঘুরেও শুনেন না তিনি। সীমা বেগম ওর কথা পাত্তা না দিয়ে হাতের কাজ সেরে ব্যাগ প্যাক গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
বলে গেলেন আদিত্যের সঙ্গে যেতে। উনি যাওয়ার পর মেধা মুখ বেজার করে বসে রইল। আদিত্যও নেই, মহারাজ গান্ডে পিন্ডে গিলে কোথায় যেনো বের হয়েছে। তখন স্মরণ হলো মামনি দুপুরের রান্না করে যায় নি। অর্থাৎ তাকে ঝটপট কিছু করতে হবে। সে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ফোনে রিংটোন বেজে উঠল। আদিত্যের কল দেখে মুখ ভেংচিয়ে কল ধরে বলল,
-”হুম, বলুন।”
-”রান্নার প্রয়োজন নেই আমি খাবার নিয়ে আসব। চুপচাপ টিভি দেখো নয়তো ঘুম দাও।আর পন্ডিতি করে কিছু করতে গেলে খবর আছে বলে দিলাম।”
-”কি খবর শুনি?”
একথার জবাবে আদিত্যের পাশ থেকে কেউ একজন কন্ঠে দুষ্টুমি ঢেলে গেয়ে উঠল,
-”তুমি আমি, আমি তুমি, উথাল পাতাল প্রেম। দরজা বন্ধ জানালা বন্ধ জমিয়ে দেবো প্রেম। আদিত্যকে পাঠিয়ে দিচ্ছি প্রেম জমিয়ে ফেলো মেধা এই সুযোগ। উম… উম… উম… !”
আদিত্যের বন্ধু শামিমের বলা কথা শুনে মেধা চোখ বড় বড় করে ফেললো। বোধহয় কেউ শামিমের মুখটা চেপে ধরছে।
উম..উম শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না। অতঃপর কলটা আপনা-আপনিই কেটে গেল। তখন মেধা কান থেকে ফোন সরিয়ে বলল,
-”ওই মাগুর মাছের সঙ্গে প্রেম জমানোর চেয়ে ফিট খেয়ে
স্মৃতি হারিয়ে ফেলা উত্তম। সে নাকি করবে প্রেম, যত্তসব আজাইরা ঢং।”
To be continue…..!!