যখন তুমি এলে পর্ব ৮

#যখন_তুমি_এলে
#পর্ব- ০৮।

রোহানী এবার আফসোস করতে লাগলো। কেন যে তখন রাদকে চ্যালেঞ্জ দিতে গেল। এখন ওর নিজেরি খারাপ লাগছে। অপরাধবোধ কাজ করছে। রাদকে বারবার বলা স্বত্তেও, সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। রোহানীর কেন যেন বিষয়টা অন্যরকম ঠেকছে। রাদের চোখেমুখে অন্যকিছু পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে সেটা ঠিক কি, তা অনুমান করতে পারছেনা। ঐদিন ফুল ছুঁড়ে মেরেছিল দেখে কি?
নাহ,এটা আর এমন কি। কিন্তু আর কি হতে পারে তাহলে? রোহানী ভাবতে পারছেনা। নিজের গালে নিজের দুইটা লাগাতে মন চাইছে। রাদকে ও নিজেই কেন যে উস্কে দিতে গেল। এখন এতো কিউট কাপলটার যদি সত্যিই ব্রেকআপ হয়!
রাদ বিষয়টা সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে মানে,ওদের ব্রেকআপ নিশ্চিত! তবে হ্যাঁ,ওদের সম্পর্কের ভিতটা যদি শক্ত থেকে থাকে, তবে ভিন্ন কথা। রোহানী তাড়াতাড়ি তুহিনের আইডিতে গিয়ে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসটা কবে দেয়া সেটা চেক করলো। বেশিদিন হয়নি,মাসখানেক। তারমানে নতুন রিলেশান,এবার রোহানীর সত্যিই ভয় হতে লাগলো। কেন যেন মনে হচ্ছে, রাদ এবারের কাজটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত জেদ থেকে করছে। অন্যসময় ঠিকই কিছু না কিছু পর্যবেক্ষণ করে,তারপর ব্রেকআপ করাতো। কিন্তু এবার হুঁট করেই বলে দিল। এমনকি মেয়েটাকে দেখলো পর্যন্ত না। ঐদিনও তো মেয়েটাকে পেছন থেকে দেখেছিল,তাহলে পরে চিনবে কি করে?
রোহানীর সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ভীষণ বড় ভুল করে ফেলেছে সে। রাদ কোন বিপদে না পড়লেই হলো এবার। অন্যসময় পুরো বিষয়টা ভার্সিটির ভিতরে ছিলো। কিন্তু এবার বিষয়টা একটু জটিল,তাও তুহিনের মত এতো ফেমাস একজন আরজে। যদি কোনক্রমে রাদ ফেসে যায়,সব ফাঁস হয়ে যাবে। এতদিন যা যা করেছে,তা জানাজানি হলে সর্বনাশ!
রোহানীকে যে করেই হোক রাদকে থামাতে হবে। কোনপ্রকার ঝামেলায় জড়াতে দিবে না রাদকে। ছেলেটার সাথে এত বছর যাবত থেকেও,এখন অবধি ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনা রোহানী। বড্ড ভয় করছে ওর। কোন বিপদ সংকেতের আভাস কেন জানি পাচ্ছে সে।

মান-অভিমানের পাঠ চুকিয়ে আবারো প্রেম জমে উঠেছে। সেদিন ভার্সিটির মধ্যে তুহিন সাচীর অভিমান ভাঙানোর জন্য, আর নিজে বেশি রাগ দেখানোর অপরাধে, সবার সামনে দুইহাতে কান ধরে সরি বললো। সাচী পুরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ভীষণ লজ্জাও পাচ্ছিল,আবার বেশ ভালোও লাগছিলো। মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিলো। রাগ তো তুহিনের মুখ দেখেই নিরুদ্দেশ হয়েছিল। ঐ বাঁকা দাঁতের হাসিতে, শত দোষ মাফ! সাচী নিজের খেই হারিয়ে ফেলে ঐ হাসির ফোয়ারায়। সবার সামনেই বার্থডে উইশ করে। হাতে ডজনখানেক লাভ শেইপের বেলুন,আর সেখানে হ্যাপী বার্থডে লিখা। সেগুলো মুখের সামনে রেখে,হুঁট করেই সাচীর পথ আগলে দাঁড়ায়। সাচী ভেবেছিল হয়তো আবার কোন উটকো ছেলে,তাই মেজাজ দেখিয়ে দু’কথা শুনাতে যাবে,তখনি থমকে যায়। অভিমানের দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। চলে যেতে নিতেই,তুহিন একহাতে বেলুন ধরে রেখে আরেকহাতে কান ধরে হাঁটু ঘেরে বসে পড়ে। সাচী চোখ বড়বড় করে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। কারন ইতিমধ্যে সেখানে মানুষজন জড় হয়ে গিয়েছিল। সাচী কড়া মেজাজে তুহিনের সামনে এসে তিরিক্ষি মেজাজে কথা বলতে লাগলো। তুহিন যখন বুঝতে পারলো,সহজে কাজ হবেনা তখন দুইহাতে কান ধরে সরি বললো। তার আগে বেলুনগুলো পাশে একটা ছেলের হাতে রাখলো কিছুক্ষণের জন্য। সাচী তুহিনের একেক কার্যে হতভম্ব হয়ে রইলো। কি করছেটা কি লোকটা?
নিজের একটা ইমেজ আছে না,এমন পাগলামীর কোন মানে হয়? সাচীর মন ভালো হওয়ার সাথে সাথে, আবার নতুন করে রাগের উদয়ও হচ্ছিল। একটু ফোন দেয়নি এ সাতদিনে,আর এখন আসছে রোমিও সাজতে। ফোন দিলেই তো সব মিটে যেত। না, তিনি তো ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখাবেন।
ভার্সিটির কিছু মেয়ের মুখ তখন দেখার মত হয়েছিলো। হয়তো হিংসায় পুড়ছিলো। তাতে সাচীর কি!
সে বেশ উপভোগ করছিলো বিষয়টা। তুহিন সবার মাঝখান দিয়ে সাচীকে হাত ধরে নিয়ে এসেছিল। সাচী তখন অনুভূতির সর্বোচ্চ জোয়ারে ভাসছিল। মুখে রাগ পুষে রাখলেও,মনে তখন ভালোলাগার প্রজাপতি নাচানাচি করছিলো।
অনুভূতিরা বারবার হুঁশ হারাচ্ছিল। সাচী চাইও না,অনুভূতিরা হুঁশে ফিরে আসুক। বারবার, শতবার,হাজারবার হুঁশ হারাক ভালোলাগায়। ঠিক তখনি সাচীর ফোন বেজে উঠলো। ফোনের নাম্বারটা দেখে আরেকদফা হুঁশ হারালো সে। রিসিভ করে সে তুহিনকে কপি করে কথা বলতে লাগলো।
” হ্যালো লিসেনার, আপনারা শুনছেন আরজে সাচীকে। আপনাদের মনের কথা ব্যক্ত করুন, আমাদের ওয়ালে। আমরা আপনার প্রিয়জনদের জানিয়ে দিবো,আপনার না বলা কথাগুলো। তো আর দেরি কেন,শুরু করে দিন। ভালোবাসাকে ভালোবাসি জানিয়ে দেন। ফোনের ওপাশে তুহিন হেসে কুটিকুটি হচ্ছে সাচীর কথা শুনে। আর সাচী এপাশে সেই বাঁকা দাঁতের হাসির কল্পনায় বিভোর হচ্ছে।

ভোরবেলায় বিরুনিকা ছাদে দাঁড়িয়েছিল। এই সময়টা কেমন নীরব, নিস্তব্দ থাকে। শিরশির করে মৃদু বাতাস বয়ে যায়।পরিবেশটা একদম শান্ত। ফজরের নামায পড়ে হালকা আলো ফুটতে শুরু করতেই সে ছাদে যায়। সূর্যোদয় পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করে। ছাদের একপাশে দাঁড়িয়েছিল সে। হেঁটে হেঁটে অন্য পাশে আসতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ঐ কুনোব্যাঙ এতো সকালে করছেটা কি? বিরুনিকা সায়াহ্ন কে কুনোব্যাঙ নাম দিয়েছে। কেমন সারাদিন কুনোব্যাঙ এর মতো ঘরের কোনে বসে থাকে। যতবার নামটা ডাকে, বিরুনিকার পৈশাচিক শান্তি লাগে। যদিও সামনা-সামনি ডাকতে পারেনা। কিন্তু কুনোব্যাঙ এতো সকাল সকাল ঘরের বাইরে কি করে?
বিরুনিকা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর বললো,
” ওহ,এই কাহিনী। নতুন ব্যাঙামি লঞ্চ করছেন বোধহয়। তাও ভালো যে ঘর থেকে বের তো অন্তত হয়েছেন। জনাবের মুখ তো দর্শন করতে পারলাম,নতুন ব্যাঙামির সুবাধে। বিরুনিকা পিছনে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। দেখছিলো করছেটা কি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে পারলো,উনি সূর্যোদয়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করছেন। একদম ছোট বাচ্চাদের মতন কাজ-কারবার। যখন যেটা মনে উঠে,সেটাই করে। কে কি বললো,তাতে কিছু যায় আসে না। বিরুনিকা গালে হাত দিয়ে ছবি আঁকা দেখছিলো। সহসা রঙ ওর মুখে এসে পড়লো। সায়াহ্নর সেদিকে খেয়াল নেই। সে তার মত আঁকছে। বারবার রংতুলি ঝাড়ছে,আর সেই রং পিছনে বিরুনিকার শরীরে পড়ছে। বিরুনিকার মুখ মনে হয় এতোক্ষণে রংধনু হয়ে গেছে। আর সাদা জামা পরা। মানে পুরো রাঙিয়ে দিচ্ছে ওকে। অথচ ঐ ব্যাক্তির সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। একজন জলজ্যান্ত মানুষ যে তার আশেপাশে আছে,তা অনুভব করার মত অবস্থায় বোধহয় তিনি নেই। অবশ্য থাকলেই কি।
বিরুনিকা হতাশ হয়ে ভাবতে লাগলো,পৃথিবীতে সাতশো কোটি মানুষের মাঝে তোর এই কুনোব্যাঙ কেই চোখে পড়লো বিরু?
যার দুনিয়াবি কোন ভাবনাই নেই। নিজের আলাদা একটা জগত গড়ে তুলেছে,সেখানেই তার বিচরণ। বাহিরের জগত চুলোয় যাক,তাতে তার কিছুই যায় আসেনা।
মানুষ প্রেম করে ইতিহাস রচনা করে ফেললেও,সে মানুষরূপী কুনোব্যাঙ হওয়ার রেকর্ড গড়বে। একটা মানুষ কি করে এমন হয়,বিরুনিকা ভাবতে পারেনা। রাগে ওড়নার কোনা হাতে নিয়ে পেচাচ্ছিল। ঠিক তখনি যে কথাটা শুনলো,বিরুনিকার মন চাইছিলো ছাদ থেকে লাফ দিতে। সায়াহ্ন ছবি আঁকা মোটামুটি শেষ করে,যেই পেছনে ফিরে তাকালো, বিরুনিকাকে দেখে বেশ অবাক হলো। অবশ্য বিরুনিকার অবস্থা দেখে হুঁট করে জোরে হেসে উঠলো। বিরুনিকা বিড়বিড় করে বললো,কুনোব্যাঙ হাসতেও জানে?
সায়াহ্ন হাসি থামিয়ে বললো,
” সকাল সকাল রংধনু সেজে আছেন কেন?”
” বিরুনিকা কথাটা শুনে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো। আর ভাবতে লাগলো,এ কোন নরাধমের প্রেমে পড়লি তুই বিরু?”
যে এই পৃথিবীতে থেকেও,থাকেনা। নিজে আমাকে ভূত বানিয়ে,নিজেই জিজ্ঞেস করছে, কেন রংধনু সেজেছি?
এটা শোনার আগে, আমার কান বয়রা হয়ে গেল না কেন!
বিরুনিকাকে চুপ থাকতে দেখে, সায়াহ্ন আবার জিজ্ঞেস করলো,
” আজকে কি রং উৎসব?”
” হ্যাঁ,রং উৎসব। দাঁত কটমট করে কথাটা বললো সে।”
” সায়াহ্ন বললো,ওহহ। মনে নেই।” বিরুনিকার বলতে ইচ্ছে করছিলো,তোর কি মনে থাকে রে কুনোব্যাঙ? কখনো কখনো তো হয়তো নিজের নামও ভুলে যাস। কোনদিন জানি বাসার ঠিকানাটাও ভুলে যাবি। তারপর আমাদের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। কিন্তু সেখানে কি লিখবো? লিখবো একটা কুনোব্যাঙ হারিয়ে গেছে,কোন সহৃদয়বান ব্যাক্তি যদি তার সন্ধান পান,তবে ডট ডট ঠিকানায় যোগাযোগ করুন। বিরুনিকা চরম বিরক্ত হয়ে গেল এবার। সায়াহ্ন আবার জিজ্ঞেস করলো,
” তারপর আপনার প্রেসার ঠিক আছে তো এখন?”
” বিরুনিকা অনেক কষ্টে মাথা ঠান্ডা রেখে বললো,হ্যাঁ ঠিক আছে। আর মনে মনে বললো, তোকে দেখলেই আমার প্রেসার বেড়ে যায় রে ব্যাঙ। মানুষ যাকে ভালোবাসে, তাকে দেখলে হার্টবিট বাড়ে। আর আমার প্রেসার বাড়ে।”
” সায়াহ্ন বিরুনিকাকে ছবিটা দেখালো। হঠাৎ সায়াহ্ন কি যেন পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠলো,
আপনার মুখের রংগুলো তো প্রায় আমার আঁকার রংগুলোর সাথে মিলে গেছে। ভারী অদ্ভুত তো! আপনি কি আমার রং চুরি করেছেন নাকি?”
বিরুনিকা এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলনা। একটা ভয়ঙ্কর সাহসের কাজ করে ফেললো। ঐ মুহুর্তে এতো সাহস কোথা থেকে উদয় হলো,সে নিজেও জানেনা। রাগ হলে বোধহয় মানুষের সাহস বেড়ে যায়। কাজটা করে দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল। আর সায়াহ্ন হাত থেকে তুলি মাটিতে ফেলে দিয়ে থ মেরে রইলো। কি করলো মেয়েটা?
সায়াহ্ন বোকার মত আনমনে গালে হাত ঘষতে লাগলো।

#চলবে…
#জাহান_লিমু।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here