যে পাখি ঘর বোঝে না পর্ব -০৩

#যে_পাখি_ঘর_বোঝেনা
পর্ব-০৩
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

এ যাত্রায় বেঁচে গেল নিশিতা। কষ্ট কিন্তু কম হয়নি ওর। ভেতর থেকে বিষ বের করার প্রসেস নিশ্চয়ই সহজ ব্যাপার না। ডাক্তার কেবিনে শিফট করেছে ওকে। বেশ দূর্বল শরীর নেতিয়ে আছে বেডের ওপর। বকুল টলতে টলতে বেডের পাশে এসে বসল।

“এখন কেমন লাগছে নিশি?”

নিশিতা জবাব দেয় না। ফিরেও তাকায় না। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। বকুল দেখল সেটা। স্ত্রীর কষ্টে সেও আজ কষ্ট পেল। একটু ঝুঁকে নিশিতার চোখের জল ফেলে অপরাধী গলায় বলল,

“আমাকে ক্ষমা করো নিশি। আমাকে ক্ষমা করো।”

শব্দ করে কাঁদল স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে। নিশিতা জানে বকুল তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। স্বামী হিসেবে সে যথেষ্ট ভালো। বিয়ের সাত বছরে উঁচু গলায় একটা কথাও বলেনি ওর সাথে। তাহলে হঠাৎ এমন হলো কেন? এর জন্য ও বহ্নিশিখাকে দায়ী করে। ননদের সাথে প্রথম প্রথম সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু সময় যত যায় সেই সম্পর্কে একটা তিক্ততা চলে এলো। নিশিতা এই বাড়ির বউ হওয়া সত্ত্বেও ওর মতামতের ততটা গুরুত্ব নেই যতটা বহ্নিশিখার আছে। সব ব্যাপারে বকুল ওর পরামর্শ নেয়। অথচ, নিশিতা কিছু বললে বলবে,

“বহ্নি বলেছে ওটা ঠিক হবে না। ও ভাবছে। দেখি কী বলে!”

ওর মনে হয় এই বাড়ির নাম সর্বস্ব কর্ত্রী সে। আসল ক্ষমতা তো বহ্নিশিখার হাতে। একে সংসারের টানাপোড়েন তার ওপর বহ্নিশিখার এই কর্ত্রীভাব নিশিতাকে আস্তে আস্তে ননদের প্রতি বিরুপ হতে বাধ্য করেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে পাড়া প্রতিবেশীদের মেকি সান্ত্বনা। নিশিতার মূল্যহীন ক্ষমতা নিয়ে এরাও বেশ কটাক্ষ করে। একদিনে বিষ খাওয়ার সিদ্ধান্ত সে নেয়নি। দিনে দিনে ক্ষোভটা সহ্যতীত হয়েছে। মরে সে শাস্তি দিতে চেয়েছিল বকুল আর বহ্নিশিখাকে। বুঝাতে চেয়েছিল আজ ওদের জন্য নিশিতার বাঁচার সাধ ঘুচেছে। লোকে বোকামি বলুক আর যাই বলুক নিশিতা যা করেছে তাতে সে অনুতপ্ত নয়। বকুলের এই কান্না দেখার পর তো নয়-ই।

“এমন একটা কাজ কী করে করতে পারলে তুমি নিশি? আমি আর রোজ তোমাকে ছাড়া কী করে বেঁচে থাকতাম?”

নিশি বকুলের কোনো কথার জবাবই দিলো না। থম ধরে আছে। বহ্নিশিখা কোথায়? এই মেয়ে কি খুশি হয়েছিল তাকে মরতে দেখে? দরজার সাদা পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো বহ্নিশিখা। নিশি চোখ মুছে তাকাল ওর দিকে। এই মেয়ের চোখে পানি নেই। মেয়েদের মন কোমল হয়। কিন্তু এই মেয়ের মন, দৃষ্টি সব পাথর।

“এখন কেমন বোধ করছ ভাবি?” নিশিতার পায়ের কাছে বসল বহ্নিশিখা। ওর গলার স্বর শান্ত। বকুল মাথা তুলে চোখ মুছল। নিশি বিদ্রুপ করে হাসল একটু। তারপর বলল,

“যেমন আশা করেছিলে তেমনই ধরো।”

“নিশি!” বকুল কাতর গলায় স্ত্রীকে নিষেধ করে। নিশি সে নিষেধ উপেক্ষা করল। বহ্নিশিখা বিমর্ষ মুখে বলল,

“আমি তোমার এই অবস্থা কখনও আশা করি না ভাবি।”

“হ্যাঁ, তা তো সকলে জানে।”

নিশিতার শেষ কথার অর্থ বহ্নিশিখা বুঝেছে। এতক্ষণে হয়তো মহল্লায় খবর রটে গেছে ননদের যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে ভাবি বিষ খেয়েছে। আরো কত কী যে বলছে তা ও আন্দাজ করতে পারে। ও যে সেসব কথা তোয়াক্কা করে না তা নয়। খারাপ লাগে কিন্তু দেখায় না কাওকে। লোকের মুখ তো আর ওর কন্ট্রোলে না। বহ্নিশিখার এমনিতে বিয়ে হচ্ছিল না এবার বোধহয় আর হবেও না। উঠে দাঁড়ায় ও। নিশিতা ভাই বোনের উদ্দেশ্যে বলে,

“আমার মা-বাবাকে খবর দাও। তোমাদের বাড়ি আমি আর ফিরব না।”

“এসব বলো না নিশি।” বকুল ওর হাত ধরতে গেলে হাত সরিয়ে নেয়। বলে,

“তোমার সাথে আমার আর সংসার করা হবে না বকুল। আমাকে তুমি মুক্তি দাও এই যন্ত্রণা থেকে।”

“নিশি!” বকুল স্তম্ভিত। বহ্নিশিখা ভাইয়ের অসহায় মুখটা দেখে চোখ বন্ধ করে দম ফেলে। তারপর বলে,

“আমি কী করলে খুশি হও তুমি ভাবি?”

“আমি তোমাকে কিছু বলছি না বহ্নি। এবার অন্তত আমাদের মাঝে এসো না। এবার অন্তত আমার কথার ওপর কথা বলো না দয়া করে। যাও আমার চোখের সামনে থেকে, যাও।”

বহ্নিশিখা বেরিয়ে এলো। বাইরে ভোরের আলো এখনও পুরোপুরি ফোটেনি। ও বসল সামনের চেয়ারে। মাথাটা বড্ড ধরেছে। পেছনে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করল। কী করা উচিত এখন? একটা জব হলে না হয় বেরিয়ে যেত বাসা থেকে। একলা মেয়েমানুষ কোথায় যাবে? তেজ দেখিয়ে রাস্তায় নামবে না সে। সেই আবেগ এখন অনেকটা ম্যাচুিউর হয়েছে। তাহলে কী করবে? আফরাজের প্রস্তাব মেনে নেবে? না, ওর প্রস্তাব মানা আত্মহত্যার শামীল। বহ্নিশিখা জানে ওই লোক মন থেকে ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। ওর বাবা হাসপাতালের বেডে শুয়ে। বহ্নিশিখা নিশ্চিত আফরাজ বাবার জীবন বাঁচাতে বিয়েতে রাজি হয়েছে। এটাও একপ্রকার অসহায়ত্ব। মানুষের জীবনে এত অসহায়ত্ব কেন? অসহায় হলেও বহ্নিশিখা নিজের জীবন বিসর্জন দেবে না। একটা উপায় যে করেই হোক বের করবে তবুও মনের বিরুদ্ধে কাওকে বিয়ে করবে না। পাশে কেউ বসল। বহ্নিশিখা চোখ মেলে তাকায়। আফরাজ কফির কাপ পাত্র এগিয়ে বলল,

“নিন। গরম কফিতে মাথা ধরা কিছুটা কমবে।”

আফরাজের হাতের কফির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল খানিক্ষণ। যে লোক গতকাল বিয়ে করবে না বলল আজ আবার সেই প্রস্তাব দিয়েছে। না করার পরও কফি হাতে বসেছে পাশে। সন্দিগ্ধ আফরাজের ব্যবহারে বহ্নিশিখা। সোজা হয়ে বসে বলল,

“আমি কফি খাই না।”

“ওহ!” আফরাজ পাত্রটা পাশে রাখল। দুজনে চুপ। বহ্নিশিখা নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করে,

“আপনার বাবার অবস্থা এখন কেমন?”

“বেশি ভালো না।”

“আপনি কি সেজন্য বিয়েতে রাজি হলেন?”

আফরাজ মাথা নাড়িয়ে বলল,

“হ্যাঁ।”

আফরাজের এই সত্যি প্রকাশে বেশ অবাক হলো। ভেবেছিল সরাসরি হয়তো ভিন্ন কোনো কারণ দেখাবে।

বাইরেটা একটু একটু করে আলেকিত হচ্ছে। হাসপাতালের কড়িডোরে ডাক্তার, নার্স আর রোগীদের আত্মীয় পরিজনের ব্যস্ত পদচারণা বাড়ল।

“একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে?”

বহ্নিশিখার প্রশ্নে আফরাজ মৃদু মাথা নাড়াল। বলবে কী বলবে না ভাবনা চিন্তা ঠেলে একসময় বলল বহ্নিশিখা,

“আপনি সেদিন যে কথাগুলো বলেছিলেন সেগুলো সত্যি ছিল? মানে সত্যি কি সাংসারিক সম্পর্কে বাঁধা পড়তে চান না না কি অন্য কারো সাথে কমিটেড।”

আফরাজ জবাব দিতে একটু সময় নিলো। বলল,

“আমি কারো সাথে কমিটেড নই। হলে কী প্রস্তাব দিতাম আবার? সেদিন যা বলেছিলাম সেটা ছিল তখনকার জন্য সত্য। এখন আমি বিয়েটা করতে চাই।”

বহ্নিশিখা সহজে কাওকে বিশ্বাস করে না। পুরুষমানুষকে তো নয়ই। সেও কেমন বোকার মতো প্রশ্ন করল। কমিটেড হলেও কি আর এই মুহূর্তে বলবে? আফরাজের কথা বিশ্বাস করল না। যার ওপর বিশ্বাস নেই তাকে বিয়ে করবে না সে।

“আমি তো আগেই বলেছি আপনি রাজি হলেও এবার আর আমি রাজি না। তবুও আবার কেন এলেন?”

“আমার গতকালের ব্যবহারে আমি সত্যি অনুতপ্ত। তাই তো ক্ষমাসমেত কন্যার মন জয় করতে এসেছি। এখন ফিরিয়ে দিলে আবার আসব।”

বহ্নিশিখা নিরস মুখে একটু মুচকি হাসল।

“হাজারবার এলেও এ কন্যা রাজি হবে না মি.শেখ। আপনার কারণে আপনার পরিবারের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি আমি। আপনাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছি। এত কিছুর পরে আপনাকে বিয়ে করা ঠিক উচিত হবে না। তাছাড়া কে জানে আপনার রাজি হওয়ার পেছনে হয়তো ভিন্ন কোনো মোটিভ থাকতে পারে।”

আফরাজ ঢোক গিলল। বহ্নিশিখা আড়চোখে সেটা খেয়াল করল। সন্দেহ যেন আরেকটু পাকা হলো এবার। আফরাজ আরো কিছু বলত তখনই সামনের পর্দা ঠেলে বকুল বেরিয়ে এলো।আফরাজকে দেখে অবাক হয় সে।

“আফরাজ সাহেব?”

আফরাজ দাঁড়িয়ে করমর্দন করল।

“এখন কেমন আছেন ভাবি?”

“ভালো।” মলিন মুখে জবাব দিলো বকুল। তারপর বোনের রাগত মুখের দিকে চেয়ে ওকে প্রশ্ন করল,

“আপনি হঠাৎ এখানে?”

“আব্বু হসপিটালাইজড।”

“কী হয়েছিল?”

“বিপি এবং সুগারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল।”

“এখন কেমন আছেন আঙ্কেল?”

“বেশি ভালো না।”

একজন নার্স আফরাজকে ডাকতে সে বকুলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বহ্নিশিখার দিকে ফিরল,

“আবার দেখা হবে তাহলে মিস. বহ্নিশিখা। চলি।”

বহ্নিশিখা কোনো কথা বলল না। যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। আফরাজ যেতে ভেতর থেকে নিশিতা ডাকল বকুলকে। বকুল চিন্তিত মুখে ভেতরে গেল। একটু পর ডাক্তার এলো নিশিতাকে পরীক্ষা করতে। বহ্নিশিখা তার পেছন পেছন নিশিতার বেডে ঢোকে। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলে যেতে নিশিতা বলল,

“বহ্নি, আজ আমাকে একটা সত্যি কথা বলো। তুমি কি চাও তোমার ভাইয়ের সাথে সংসারটা আমার টিকে থাকুক?”

“অবশ্যই চাই।”

“তাহলে আফরাজ সাহেবের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও।”

নিশিতা এবং বকুল ওদের সব কথা শুনেছে। নিশিতা চায় আফরাজের সাথে বহ্নিশিখার বিয়েটা হোক। ধনীর দুলাল আফরাজ। আলিম শেখের রয়েছে রয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন ব্যবসা। বকুলকে যদি কোনোভাবে একটা ব্যবস্থা করে দিত ওরা। নিশিতা স্বামীকে পাঠিয়েছিল আফরাজের মোবাইল নাম্বার আনার জন্য। বকুল শোনেনি সে কথা। উলটো সেখানে গিয়ে এমন ভাব করেছে যেন কিছু জানে না। বহ্নিশিখা ভাবির দিক থেকে মুখ সরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। বকুল আজ আর কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে আছে। বহ্নিশিখা সব বুঝল। ভাইয়ের নীরবতা ভীষণ কষ্ট দিলো ওকে। কষ্ট পেলেও অন্যায় আবদার কিছুতেই মানল না।

“তুমি যা জানো না তা নিয়ে কথা না বললেই ভালো হয় ভাবি। তোমার সমস্যা আমার ওই বাড়ি থাকা নিয়ে। ঠিক আছে চলে যাব আমি।”

“কোথায় যাবি তুই?” প্রশ্ন করে বকুল।

“আল্লাহর দুনিয়ায় একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চয়ই হবে। আশা করি এরপরে আর তোমার কোনো সমস্যা থাকবে না আমাকে নিয়ে ভাবি।”

বহ্নিশিখা হনহন করে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। নিশিতা এই মেয়ের জেদকে ভীষণ অপছন্দ করে। ও যেন ভাঙবে তবুও মচকাবে না। পরিবার এবং সমাজের নিয়ম নীতির চাপে মেয়েদের একদিন সমঝোতা করতে হয়। কতদিন বহ্নিশিখা সেই চাপ অগ্রাহ্য করে যেতে পারে সেটাই দেখবে নিশিতা।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here