যে পাখি ঘর বোঝে না পর্ব -০৯

#যে_পাখি_ঘর_বোঝে_না
পর্ব-০৯
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে আফরাজ। নিস্পন্দ ওর দেহ। মাথার চুল কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে ঘিরে আছে সাদা ব্যান্ডেজ। ডাক্তার জানিয়েছেন কোমায় চলে গেছে ও। লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে ওকে। ব্রেন কাজ করলেও কোমা থেকে জেগে ওঠার চান্স খুব কম ওর। ডাক্তাররা আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। আফরাজ ছাদ থেকে লাফিয়ে ভেবেছিল কেবল ওরই জীবন শেষ হতে চলেছে। কিন্তু না, ওই একটা জীবনের সাথে যে আরও অনেক জীবন জড়িয়ে আছে। আলিম শেখ স্ট্রোক করেছিলেন। একেবারে শয্যাশায়ী তিনি এখন। রোজিনা স্বামী এবং পুত্রের এহেন দুরবস্থায় শোকে পাথর হয়ে ছিলেন। তাঁকেও স্যালাইন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল প্রায় সপ্তাহ কয়েক। এখন সংসারের প্রতি তাঁর যেন মোহই কেটে গেছে। সারাক্ষণ স্বামীর শিওরে বসে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ছাড়া আর কিছুতেই তার তেমন আগ্রহ নেই। এক বহ্নিশিখা ছাড়া এ বাড়িতে আলো জ্বালানোর কেউ নেই। বহ্নিশিখা চাইলেও আজ আর শোকে পাথর হয়ে জ্ঞান হারাতে পারছে না। চিৎকার করে কাঁদতে পারে না, বলতে পারে কাওকে নিজের কষ্ট। আফরাজের এই পরিণতির জন্য প্রতি মুহূর্তে নিজেকে দোষারোপ করে। আফরাজ খুব সহজে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। কারণ ওর পিছুটান নেই। বহ্নিশিখার দমবন্ধ হয়ে এলেও মরতে ভয় পাচ্ছে। ও মরলে এই তিনটে মানুষকে কে দেখবে? ভেতরটা ভেঙেচুরে শেষ হলেও ওর ওই শেষটুকুই শক্ত হাতে ধরে রেখেছে শেখ পরিবারের নড়বড়ে খুঁটিটা। এক হাতে ঘর, আলিম শেখের সকল ব্যবসা দেখাশোনা অন্য হাতে তাদের তিনজনকে সুস্থ, স্বাভাবিক করে তোলার প্রচেষ্টায় ও আজ নিজেকেই ভুলে বসেছে। চলতে বলতে পাড়া একটা রোবটে পরিণত হয়েছে বহ্নিশিখা। অথচ, এমন সংসার জীবন ও ভুলেও কামনা করেনি। বিয়ের পর ছ’মাসের সংসার জীবনে একই ঘরে, একই বিছানার থাকলেও আফরাজ ওকে ছুঁয়ে দেখেনি। তৃষ্ণার জল যতক্ষণ চোখের আড়ালে ততক্ষণ তৃষ্ণা ভুলে থাকা যায়, কিন্তু চোখের সামনে এক সাগর জল থাকা সত্ত্বেও তৃষিত থাকার পীড়ন এ বড়ো অসহ্য! তবুও বহ্নিশিখা সবর করেছে। প্রহর গুনেছে আফরাজের স্বেচ্ছায় কাছে আসার। এক মাস দু মাস এমন করে ছয় মাস পেরিয়ে যায়। বহ্নিশিখার দিবস রজনী হয় চোখের জলে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। তবুও আশা ছাড়েনি। কিন্তু হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল। আশা ভাঙল, বিশ্বাস ভাঙল আর সাথে ও নিজেও।

“ম্যাডাম, ম্যাডাম।”

ড্রাইভারের ডাকে সংবিৎ ফেরে বহ্নিশিখার। দীর্ঘশ্বাস গোপন করল।

“ম্যাডাম, আপনার মোবাইল বাজছে অনেকক্ষণ ধরে।”

রেয়ার ভিউ মিররে ড্রাইভারের দিকে চেয়ে মৃদু মাথা নাড়িয়ে ব্যাগ থেকে বের করল মোবাইল। বকুল কল করেছে।

“হ্যাঁলো।”

“বহ্নি, কতক্ষণ ধরে কল করছি ধরছিস না কেন?”

বকুলের উদ্বিগ্ন গলার স্বর। বহ্নিশিখা সে কথার জবাব না দিয়ে বলল,

“বাসার সবাই কেমন আছে ভাই?”

“ভালো। তুই এখন অফিস থেকে ফিরছিস?”

“হুম।”

“এমন করলে তুই তো বাঁচবি না বহ্নিশিখা। হুট করে এত চাপ একটা মানুষের শরীর সহ্য করতে পারে না।”

“আমি এবং আমার শরীর সব পারে ভাই। এসব থাক। কেন কল করেছিলে?”

“ভাই কি বোনকে কল করতে পারে না রে?”

“আমি সেভাবে বলিনি।”

“বুঝেছি। বহ্নি, একদিন বাড়িতে আয় না। মা খুব বলছিল তোর কথা। রোজও তোকে দেখতে চায়।”

“কাল একবার ওদের নিয়ে অফিসের পাশের রেস্টুরেন্টে এসো।”

বকুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে করুণ গলায় বলে,

“তুই আর কখনও এ বাড়িতে আসবি না বহ্নি?”

“আমার মাথাটা ধরেছে পরে কথা বলছি, রাখলাম। কাল মনে করে ওদের নিয়ো এসো দুপুরে।”

বহ্নিশিখা মোবাইল কোলে রেখে মাথা এলিয়ে দিলো গাড়ির সিটে। আফরাজের দূর্ঘটনার খবর পেয়ে ওদের বাড়ির সকলে এসেছিল। বকুল খুব সাহায্য করেছিল। নিশিতাও এসেছিল শাশুড়ির সাথে। বহ্নিশিখার চোখে চোখ রাখতে পারেনি লজ্জায়। ক্ষমাও চায়নি। দু-একদিনের বেশি ওদের এ বাড়িতে রাখেনি বহ্নিশিখা। এই বাড়ি, এই সম্পদ সব ওর কাছে আমানত। নিশিতার লোভী দৃষ্টি এদিকে পড়ুক ও কিছুতেই চায় না। মায়ের অনুরোধেও বকুলকে আলিম শেখের কোম্পানিতে কোনো কাজ দেয়নি। বলেছে যে মালিক সে যখন সুস্থ হবে তাঁর কাছেই অনুরোধ করবে ভাইয়ের জন্য। তখন যদি কাজ দেয় তবে ঠিক আছে নয়তো ওর কিছু আর করার নেই। এ নিয়ে নিশিতা খুব ক্ষিপ্ত। বহ্নিশিখার এখন ওর রাগ-বিরাগে কিছু আসে যায় না।

“আজকেও কি হাসপাতালে যাবেন ম্যাডাম?”

“হ্যাঁ, সেখানেই নিয়ে চলুন।” সোজা হয়ে বসল ও। শাশুড়ীর নাম্বারে কল দিলো। কয়েকবার বাজতে রোজিনা কল ধরেন।

“কখন আসছ বাসায় বউমা?” সারাদিনের ক্লান্তির খানিকটা যেন কাঁধ থেকে নেমে গেল শাশুড়ির গলা শুনে।

“আজ বোধহয় হাসপাতালেই থাকব আমি। আপনি খেয়েছেন মা? বাবা খেয়েছে? রাতের ঔষধ দিয়েছেন বাবাকে”

শাশুড়িকে শব্দ করে হাঁপ ছাড়তে শুনল বহ্নিশিখা। ওর চিন্তিত মস্তিষ্ক একটু যেন শান্ত হলো। রোজিনার বললেন,

“আমাদের বাঁচাতে তুই নিজে যে মরতে বসেছিস রে মা। আজ আমাদের জন্য তুই আছিস কিন্তু তোর জন্য কেউ নেই। আমার আফরাজটা সুস্থ থাকলে তোকে আজ এই দিন দেখতে হতো না। আমার আফরাজ।” রোজিনা ফুঁপিয়ে উঠলেন। বহ্নিশিখার চোখ জ্বলছে। কাঁদলে অবশিষ্ট থাকা শক্তিটুকুও আজ শেষ হয়ে যাবে। আফরাজের দরকার ওকে। নিজেকে সামলে নিলো ও। শাশুড়ীকে বুঝাতে গেলে আরও বেশি কাঁদবেন তিনি। কলটা তাই কেটে দেয়। বুয়াকে একটা কল করা দরকার। কল দিলো বুয়ার নাম্বারে। সাথে সাথেই ধরেছে। বহ্নিশিখা আর সব দিনের মতো তাকে জিজ্ঞেস করল শ্বশুর শাশুড়ী খেয়েছেন কি না। বুয়া জানায় তাঁদের রাতের খাবার এবং ঔষধ সবই দেওয়া হয়েছে। রোজিনা কাঁদছেন। বুয়া গেল তাঁকে শান্ত করতে। এই কাজটা সে বেশ ভালো পারে। বহ্নিশিখা মোবাইল রাখতে রাখতে গাড়ি হাসপাতালের গেটে এসে থামল।

আফরাজের কেবিনের কাছাকাছি আসতে নার্স মিনার সাথে দেখা। আফরাজের জন্য দুজন নার্স রাখা হয়েছে। মিনা তাঁদের একজন। বেশ আন্তরিকভাবে সেবা শুশ্রূষা করে দুজনই। মিনা বয়সে বহ্নিশিখার দু এক বছরের বড়ো হবে। এই ক’মাসে ভালো সম্পর্ক হয়েছে ওদের মধ্যে। বহ্নিশিখাকে দেখে এগিয়ে এলো,

“আজও থাকবেন এখানে?”

“হ্যাঁ, আপনি চলে যাচ্ছেন বুঝি?”

মাথা নাড়াল মিনা। বলল,
“আমার শিফট শেষ। নিহারিকাও চলে এসেছে। ও আফরাজ সাহেবকে দেখতে একজন লোক এসেছেন। বললেন উনার বন্ধু।”

“বন্ধু!” চমকে তাকায় বহ্নিশিখা। মিনা ওর চমকানো দেখে চিন্তিত হয়ে বলল,

“কেন? কোনো সমস্যা আছে তাকে নিয়ে?”

চট করে স্বাভাবিক হলো ও। বলল,

“না তো। আচ্ছা আপনি যান।”

বলেই ও দ্রুত পায়ে হেঁটে এলো আফরাজের কেবিনে। ঢুকতে আঁতকে উঠল। আরশাদ দাঁড়িয়ে আছে আফরাজের মাথার কাছের ভেন্টিলেটরের সামনে। একটু ঝুঁকে হাতটা ভেন্টিলেটরের দিকে বাড়াতে ছুটে এসে খপ করে হাতটা চেপে ধরল বহ্নিশিখা।

“কী করছেন আপনি?”

আরশাদের ধাতস্থ হতে সময় লাগল। বহ্নিশিখার আতঙ্কিত মুখ চেয়ে হেসে উঠল। হাত ছাড়িয়ে বলল,

“ভেবেছিলে রাজকে মেরে ফেলতে চাচ্ছি?” তারপর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তাকাল আফরাজের নিস্পন্দ শরীরের দিকে।

“ভালোবাসার মানুষদের হাতে মরা যায় কিন্তু তাদের মারা যায় না বহ্নি। তাছাড়া যে অলরেডি মরে আছে তাকে আর কী মারব?”

“ও মরেনি।”

“ওই তো মরে পড়ে আছে। শুনলাম ডাক্তাররাও আশা ছেড়ে দিচ্ছে। তুমি টাকার জোরে বাঁচিয়ে রেখেছ ওকে। কতদিন বহ্নি? কতদিন? একদিন এই মিথ্যা থেকে বের হতেই হবে তোমাকে। স্বীকার করতে হবে রাজ মৃত। তোমার স্বামী মৃত।”

“আরশাদ ভাই! চুপ করুন, প্লিজ।”

চুপ করে যায় আরশাদ। বসে পড়ে আফরাজের শিওরের পাশের চেয়ারটাতে। কান্নাজড়িত গলায় বলে,

“ওদের দুজনকে আমি প্রচণ্ড ভালোবেসেছিলাম বহ্নি। কেন এভাবে ধোঁকা দিলো আমাদের ওরা? এই রাজ, এই, বল না কেন এমন করেছিলি তুই? তুই তো মরে বাঁচতে চেয়েছিলি আমি যে সেটাও পারছি না। ওই চেয়ে দ্যাখ বহ্নির দিকে। ও আর চেনার মতো নেই। আমাদের শেষ করে দিয়েছিস তোরা। কেন ধোঁকা দিলি?” আফরাজের হাতটা চেপে ধরে শক্ত করে। বহ্নিশিখা দেখতে পেয়ে জোর করে ছাড়িয়ে নেয়। টেনে নিয়ে যায় বাহিরে।

“আসুন আমার সাথে।”

ওরা কেবিনের পাশে এসে বসল। আরশাদ নীরবে কাঁদছে। বহ্নিশিখা ওর বাহুতে হাত রাখতে বলে,

“রাজের এই অবস্থা হোক আমি তা কোনোদিন চাইনি বহ্নি।”

“আমি জানি।”

তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল আরশাদ।

“তাহলে ভয় পেয়েছিল কেন তখন?” বহ্নিশিখা অপ্রস্তুত হয়ে হাতটা কোলের মধ্যে নিয়ে মুখ নামিয়ে রাখে। ও জানে আরশাদ আফরাজের ক্ষতি করবে না কিন্তু বিশ্বাস এখন আর কাওকে সহজে করে উঠতে পারে না। আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

“ছবিগুলো তোমাকে না দিলে বোধহয় ভালো হতো। মাথা ঠিক ছিল না তখন। তুমিও সামনে এসে পড়লে৷ সব যেন বিভৎস এক স্বপ্নের মতো হয়ে গেল।”

বহ্নিশিখা কিছু সময় চুপ করে বলল,

“ছবিগুলো আপনি কোথায় পেয়েছিলেন আরশাদ ভাই?”

“রাহার ক্লজেটের কাপড়ের আড়ালে ছিল। ও সেদিন কাপড় বের করতে সব নিচে পড়ে। আমি সাহায্যের জন্য কাপড়গুলো তুলতে গিয়ে পেয়েছিলাম।”

“জিজ্ঞেস করেননি ওকে কিছু?”

“করেছিলাম কিন্তু জবাব দেয়নি। লজ্জায় মুখ নুয়ে ছিল। ওর নীরবতা আমাকে সব বলে দিয়েছিল বহ্নি।”

“আমি আফরাজকে দোষারোপ করেছিলাম আরশাদ ভাই, সে অস্বীকার করেছিল। বলেছিল রাহা ওর কিছু না।”

“মিথ্যাবাদী।” আরশাদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। বহ্নিশিখা দৃঢ় কণ্ঠে ওর কথার বিরোধিতা করল,

“না, ও মিথ্যাবাদী নয়। আমার মন বলছে ভুল আমাদের কোথাও আরশাদ ভাই।”

আরশাদ ওর অপরাধী মুখটার দিকে তাকায়। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“ভালোবাসা তোমাকেও অন্ধ করে দিয়েছে। ও মিথ্যাবাদী, অপরাধী বলেই মরতে গিয়েছিল।” আচমকা উঠে আফরাজের কেবিনে ঢুকে পড়ল আরশাদ। পিছু পিছু দৌড়ে এলো বহ্নিশিখা। আফরাজের দু’কাঁধ চেপে ধরে আরশাদ বলল,

“তুই একটা মিথ্যুক, প্রতারক। তুই নিজেও তাই জানতিস৷ আর তাইতো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলি। নিরপরাধ হলে এমনটা তুই করতি না রাজ। তুই অপরাধী, আর অপরাধীদের এভাবেই মরা উচিত।”

“আরশাদ ভাই ছাড়ুন ওকে।”

বহ্নিশিখা জোর করে ছাড়াতে গিয়েও পারে না। ইতোমধ্যে সেখানে নার্স নীহারিকা এসে পড়ে। আরশাদকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো নিচে।

“পাগল হয়েছেন না কি? আপনা_ শাদ ভাই?”

আরশাদের রাগ তখনও পড়েনি। উঠে দাঁড়ায় ও। নীহারিকার বিস্মিত মুখে কঠিন চাহনিতে তাকায়। তারপর হনহন করে বেরিয়ে যায় কেবিনের বাইরে। বহ্নিশিখা পেছন পেছন গেল।

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“জানি না। তবে এইটুকু জেনে রাখো আর এই ঢাকাতে ফিরছি না। গুড বাই।”
হাঁটতে হাঁটতে বলল। থামে বহ্নিশিখা। আরশাদ দৃষ্টিসীমার বাইরে যাওয়ার পরও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু সময়। দু কদম কেবিনের দিকে এগোতে পেছনে হিলের খট খট শব্দ কানে এলো। দু-হাত মুঠ করে থমকে যায়। হিলের শব্দটা আস্তে আস্তে অতি নিকট থেকে একসময় পাশে এসে দাঁড়াল।

“আজও আছো দেখছি?”

বহ্নিশিখা ফিরে তাকাল রাহার দিকে। আপাদমস্তক রূপের ঝলকানি রাহা। বেশ নামি মডেল। দৈহিক গঠন, পোশাক সবকিছুতেই ও বহ্নিশিখার চেয়ে হাজার গুন আগে। ভীষণ ঈর্ষান্বিত হয় ওকে দেখলে বহ্নিশিখা। আফরাজের সাথে রাহার ওই ছবি না দেখলে ঈর্ষাটা জীবনেও আসত না।

“কেন এসেছেন?”

কাঁধের চুলটা হাত দিয়ে উড়িয়ে বেশ ভঙ্গি করে হেঁটে সামনে এসে বলল,

“জানোই তো কেন আসি তবুও একই প্রশ্ন বার বার কেন করো? শুনতে ভালো লাগে বুঝি?”

ওর জবাবের প্রতিক্ষা না করে কেবিনে ঢুকে গেল রাহা। বহ্নিশিখা দাঁত কামড়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। ও যাবে না এখন কেবিনে। ওকে দেখলে গদগদ হয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে আফরাজকে নানান কথা বলে। ওদের একসাথের বিভিন্ন স্মৃতি স্মরণ করে রাহা। বহ্নিশিখার দু’কান, হৃদয় জ্বলে পুড়ে যায়। ইচ্ছে হয় আফরাজকে জাগিয়ে কষে দু চড় দিয়ে জিজ্ঞেস করতে এসবের সত্যতা। মিথ্যা হলেও চড়টা আফরাজের প্রাপ্য। ওর জন্যই রাহাকে সহ্য করতে হচ্ছে। প্রায় পনেরো মিনিট বাদে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো রাহা। গা জ্বালানো হাসি ওর ঠোঁটে। এগিয়ে এসে বলে,

“তোমার তুলনা হয় না বহ্নিশিখা। স্বামীর পরকীয়া জানা সত্ত্বেও একনিষ্ঠতার সাথে সেবা শুশ্রূষা করে যাচ্ছ। ওদিকে আরশাদকে দেখো। ক্ষমা চাওয়ার পরও আমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে।”

বহ্নিশিখা এবার হাসল। চোখে চোখ রেখে বলল,

“ক্ষমা আর আপনি? দুদিন না যেতেই আফরাজের কাছে ছুটে আসছেন। অথচ, আপনি বিবাহিতা, আরেকজনের বউ। লজ্জার বালাইয়ের চিহ্ন পর্যন্ত নেই আর আপনি পাবেন ক্ষমা? হাসালেন।”

“তোমার এই হাসি আমি মুছে দেবো মনে রেখো আমার কথা।” রাহা ঘুরতে বহ্নিশিখা বলল,

“আজকের পর আফরাজকে দেখার অনুমতি আপনি পাবেন না ম্যাডাম রাহা। সুতরাং ওই স্বপ্ন আপনার কোনোদিন পূরণ হবে না।”

“দেখা যাবে।”

একপলক চ্যালেঞ্জিং দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল রাহা। বহ্নিশিখা ফিরে এলো কেবিনে। বসল আফরাজের শিওরের পাশে৷ দুচোখ ছলছল করছে। আর কত সইবে? নীহারিকা নিঃশব্দে পাশে এসে বলল,

“মিনা আপাকে বলে দেবো ওই মহিলাকে যেন আর ঢুকতে না দেয়। আমিও দেবো না।” বহ্নিশিখা মৃদু হাসল ওর দিকে চেয়ে।

“অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। ফ্রেশ হয়ে নিন বরং।”

উঠল বহ্নিশিখা। ফ্রেশ হতে ওর বেশ সময় লাগল। যখন বেরোলো ওর চোখজোড়া লাল হয়ে ছিল। নীহারিকা জানে এর কারণ। কিন্তু কিছু বলল না। এক কাপ চা আর বিস্কুট এনে দিলো ক্যান্টিন থেকে। চা হাতে বহ্নিশিখা বসল আফরাজের শিওরে। হঠাৎ কী ভেবে নীহারিকাকে শুধাল,

“তুমি কি শাদ ভাইয়াকে চিনতে নীহার?”

সলজ্জে মাথা ঝাঁকাল নীহারিকা। বলল,

“উনি আমার এক কাজিনের ক্লাসমেট ছিলেন। প্রায়ই ভাইয়াদের বাসায় আসা যাওয়া ছিল শাদ ভাইয়ের। তাও পাঁচ বছর আগের কথা। এখন আমাকে উনি চিনবেন না। চেনার কথাও না।”

শেষের কথাটা বলতে বলতে বিষণ্ণ হলো ওর মুখ। বহ্নিশিখা মুচকি হাসল। অনেকক্ষণ আর কেউ কথা বলল না। আফরাজের মুখটার দিকে চেয়ে হঠাৎ বহ্নিশিখা বলল,

“তোমার মোবাইলটা একটু দেবে নীহার?”

নীহারিকা ভাবল জরুরী কিছু হয়তো। কারণ জিজ্ঞেস না করেই মোবাইলটা এগিয়ে দিলো। নিজের মোবাইলটাও হাতে নিলো বহ্নিশিখা। একটা নাম্বার নীহারিকার মোবাইলে তুলে সেভ করে বলল,

“নাও।”

“শাদ ভাই” দিয়ে নীহারিকার মোবাইলে সেভ করেছে আরশাদের নাম্বারটা। চকিতে তাকাল নীহারিকা। বহ্নিশিখা মৃদু হেসে বলল,

“আরশাদ ভাইয়ের তোমার মতো একজনকে প্রয়োজন নীহার। মানুষটা বড়ো কষ্টে আছে। আমাকে বলল আর ঢাকাতেই ফিরবে না কখনও। তুমি তাকে ছন্নছাড়া হতে দিয়ো না নীহারিকা। ভাগ্য সবাইকে একটা সুযোগ দেয়। কে জানে হয়তো এটাই সেই সুযোগ। যাও কল করো তাকে।”

“যদি রাগ করে?”

“বাহ রে! রাগ ছাড়া ভালোবাসা পাবে না কি? ওই রাগ গলিয়েই তো ভালোবাসা তৈরি করতে হবে।”

নীহারিকা ভীষণ সুন্দর করে হেসে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে গেল। বহ্নিশিখা চায়ের কাপটা রেখে এলো টেবিলে। পুনরায় এসে বসল আফরাজের শিওরের পাশের চেয়ারে। আফরাজের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আস্তে আস্তে মাথাটা রাখে ওর হাতের কাছে।

“একটা কবিতা শুনবেন মি.শেখ? আপনার পছন্দের সেই ছ্যাঁকা খাওয়া কবিতা নয়। চমৎকার ভালোবাসাময় কবিতা। সম্পূর্ণটা মনে নেই। তবে আমি জানি এলিজাবেথ ব্যারেটের সব কবিতাই আপনি পড়েছেন।”

বহ্নিশিখা মাথা তুলল আবার। বলল,

“আপনার হাতটা ধরলে রাগ করবেন না তো?”

আফরাজের অসাড় হাতটা দু মুঠোর মধ্যে তুলে গাল রাখল তার ওপর। অপলক চেয়ে আছে আফরাজের মুখের ওপর।

“Thine own dear pity’s wiping my cheeks dry:

A creature might forget to weep, who bore

Thy comfort long, and lose thy love thereby!

But love me for love’s sake, that evermore

Thou mayst love on, through love’s eternity”.

সমস্ত দিনের ক্লান্তি আর বিষাদে ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। দুচোখ বন্ধ করে তন্দ্রায় ডুবে যায়। ওর ঘুমন্ত চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে আসা অশ্রুর দুফোঁটা পড়ল আফরাজের হাতের ওপর। আঙুলটা যেন নড়ে উঠল। কিন্তু টের পেল না বহ্নিশিখা। আরও একটা জিনিস ও দেখল না। আফরাজের দুচোখে অশ্রুপাত হচ্ছে। বহ্নিশিখা জেগে ওঠার আগেই হয়তো তা আবার শুকিয়ে যাবে।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here