যে পাখি ঘর বোঝে না পর্ব -০৪

#যে_পাখি_ঘর_বোঝে_না
পর্ব-০৪
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

বহ্নিশিখা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারল না। একে এ বাড়ি ছাড়া ওর কোনো যাওয়ার জায়গা নেই, তার ওপর মা আর ভাইয়ের মানা। বহ্নিশিখা মেয়ে মানুষ। এই দেশে একলা মেয়েদের জন্য বাইরে নিরাপদ নয়। সবস্থান তাদের জন বিপৎসংকুল হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই ধর্ষণ, নির্যাতনের আর খুনের খবর শোনা যায়। বকুল এবং মনিরা বেগম এসব মনে করিয়ে ওর মনে ভয় আনতে চাচ্ছে। ভয় যে বহ্নিশিখা পাচ্ছে না তা নয়। কিন্তু অপমান, লোকের নিন্দা সয়ে ভাইয়ের বাড়িতে থাকাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। নিজের কথার ওপর কায়েম রয়েছে নিশিতা। হাসপাতাল থেকে সরাসরি বাপের বাড়ি ফিরে গেছে। মেয়েকে নিশিতার কাছে দিয়ে এসেছে বকুল। মা’কে না দেখে রোজেল খুব কাঁদছিল। মেয়ে এবং স্ত্রী ছাড়া ঘরটা শূন্য লাগছে বকুলের। সকালে না খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। দুপুরের গ্যারাজ থেকে ফেরেনি। রাতে এসেও না খেয়ে শুয়ে পড়ল। মনিরা ছেলের শিওরে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“খাবি না বাপ?”

“না, খিদে নেই।”

“মুখটা ওমন শুকনা দেখাচ্ছে, সারাদিন তো না খেয়ে আছিস দেখছি। চল কিছু খেয়ে শুবি।”

“আহ! বললাম তো খাব না। একটু শান্তিতে শুতেও কি দেবে না তোমরা?” বিরক্তি ঝাড়ল মায়ের ওপর। মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে বকুলের। সব কিছুতেই রাগ হচ্ছে। একদিকে বউ অন্যদিকে বোন। যাবে তো যাবে কোনদিকে? মনিরা ছেলের বিরক্তিতে মন খারাপ করে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার কাছাকাছি যেতে আবার ঘুরলেন।

“বউমার সাথে কথা বলেছিলি?”

বকুল জবাব দিলো না। মনিরার এবার খুব খারাপ লাগে। হনহন করে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। বহ্নিশিখা চুল আঁচড়াচ্ছিল। মনিরা ঢুকেই বিছানায় বসে কাঁদতে লাগলেন। ওর মা কথায় কথায় কাঁদেন। বাবা বকলে কাঁদতেন, বাসায় দেরি করে ফিরলে কাঁদতেন, বাবা নতুন শাড়ি আনলে আনন্দে কাঁদতেন আর ওদের বোর্ড রেজাল্ট আউট হলে খুশিতে কাঁদতেন। তাঁর জীবনে দুঃখ, আনন্দ সবকিছু প্রকাশের মাধ্যমই হলো এই কান্না। বহ্নিশিখা কাঁদতে অপছন্দ করে, মায়ের কান্না দেখতে আরও বেশি অপছন্দ করে।

“কথায় কথায় কাঁদবে না মা। রাগ হয় আমার।”

“কেমন মেয়ে তুই মা কাঁদলে রাগ হয়? মা কাঁদলে রাগ হয় আবার ভারি কাঁদাতে পারিস মাকে। আজ তোর কারণে বকুলের সংসার ভাঙতে বসেছে। নিজের তো ঘর হলো অন্যেরটাও ভেঙে দিচ্ছিস।”

কথাটা বলেই উপলব্ধি করলেন এভাবে বলাটা ঠিক হলো না। সজল চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। রাগে অভিমানে মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে বহ্নিশিখার। গত দুদিন ধরে সে এই কথার খোঁটা শুনছে। ভাই পর্যন্ত কথা বলছে না ওর সাথে। কিন্তু মায়ের মুখে এমন কিছু প্রত্যাশা করেনি। ওর চোখ ছলছল করে উঠল। চুল আজ আর বেণী করতে ইচ্ছে করল না। কাওকে চোখের জলও দেখাবে না। চুপচাপ বিছানায় মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইল। মনিরা আবার গুনগুন করে কাঁদতে লাগলেন। বিছানার দু’প্রান্তে দুই নারী কাঁদে।

“আজ দেখা করতে গিয়েছিলি মেয়েটার সাথে?”

“কোন মেয়েটা?” আরশাদের প্রশ্নে পালটা প্রশ্ন করল আফরাজ। আরশাদ কপাল চুলকে হতাশ গলায় বলল,

“নাহ! তোকে দিয়ে বিয়ে টিয়ে সত্যি আর হবে না রে।”

এতক্ষণে আরশাদের প্রথম প্রশ্ন বুঝল আফরাজ। নিরস মুখে বলল,
“বিয়ে করতেই কে চাচ্ছে? তুই জানিস না বিয়ে শব্দটা শুনলে আমার অবস্থা কী হয়। একশ পাঁচ ডিগ্রী জ্বর এসে যায় শরীরে। কিন্তু আমাকে মরতে মরতে হলেও আজ বিয়ে, বিয়ে এবং বিয়ে নিয়েই ভাবতে হচ্ছে। কতটা ভয়ানক পরিস্থিতিতে আছি তুই কল্পনা করতে পারবি না। জাস্ট মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কেউ বুঝতে চাইছে না আমার সমস্যা।”

শেষে উত্তেজিত হয়ে উঠল খানিক ও। আরশাদ চিন্তিত মুখে সরে এলো। ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,”উত্তেজিত হোস না রাজ। লম্বা শ্বাস নে। ওয়ান, টু, থ্রী,,,, অ্যান্ড রিল্যাক্স।”

ধীরে ধীরে আফরাজের শ্বাস স্বাভাবিক হয়। আরশাদ চুপ করে রইল। হঠাৎ ওর মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠে।

“মামণি কল করেছে।” আরশাদ এবং আফরাজ দুজনই অবাক হলো। রোজিনা সচারাচর আরশাদকে কল দেয় না। আফরাজ ইশারা করতে ও রিসিভ করল,

“আসসালামু আলাইকুম মামণি।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। শাদ, রাজ কোথায়? ওকে কখন থেকে কল করছি ধরছে না।”

রোজিনার গলার কাঁপুনি ওরা মোবাইলে এপাশ থেকে স্পষ্ট শুনতে পেল। আফরাজ পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল ওর মোবাইল সাইলেন্ট। ওপরে ত্রিশটা মিসড কল। আরশাদের কানের কাছ থেকে মোবাইল টেনে নিয়ে বলল,

“কী হয়েছে মামণি? আব্বু ঠিক আছে তো?”

“রাজ, আব্বু আমার, তোর আব্বুর অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। ডাক্তারের কোনো কথায় তিনি শুনছেন, আর না নিচ্ছেন ওষুধ। আমি পারছি না এসব দেখতে। তুই একটু এসে তোর আব্বুকে বুঝা বাবা।”

রোজিনা কাঁদছেন। আফরাজ উঠে দাঁড়ায়।

“কেঁদো না মামণি, এখনই আসছি আমি।”

কল কেটে রওনা হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। সাথে আরশাদও এলো। আলিম শেখ গুম মেরে বসে আছেন। রোজিনা কখন থেকে বলেছেন খেতে খাচ্ছেন না। নার্স বুঝাতে এলে ধমকে ওঠেন। বেচারী নার্স মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আফরাজ ভেতরে ঢুকতে আলিম শেখ আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন।

“আপনি এমন কেন করছেন আব্বু? বলেছি তো ওই মেয়ে না করে দিয়েছে বিয়ে করতে। তারপরও গোঁ ধরে বসে আছেন।”

“রোজি, এই ছেলেকে বলো, পিতার জন্য ওর মনে ন্যূনতম মায়া দয়া থাকলে মেয়েটাকে রাজি করাতো। ওর কারণে যখন না করেছে ওকেই রাজি করাতে হবে। না পারলে আমার সামনে যেন না আসে আর।” দূর্বল গলায় বললেন আলিম শেখ।

“বাচ্চাদের মতো করছেন আপনি। ইচ্ছে করে কিছু বুঝতে চাইছেন না।”

“কথা বলবে না তুমি আমার সাথে। সন্তান হিসেবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছ তুমি। পিতাকে বুড়ো বয়সে হাসপাতালের বেডে এনে ছেড়েছ।”

পিতার এহেন কঠিন কথায় মনে ব্যথা পেল আফরাজ। মনে মনে খানিক রাগও হলো। পিতার সন্তুষ্টির কথা ভেবে মানসিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও আরশাদের পরামর্শে গিয়েছিল বহ্নিশিখার কাছে। মেয়েটি দুবার ফিরিয়ে দিয়েছে বিয়ের প্রস্তাব। এবার কি ওর পা ধরবে আফরাজ!

“আপনার নিজের ভুলে আজ আপনি হাসপাতালে। অযথা আমাকে দোষ দেবেন না।”

“কী! আমার ভুলে হাসপাতালে আজ? তা বেশ বলেছ। তোমার মতো সন্তানের মুখ থেকে এমন কিছুই আশা করা যায়।”

আফরাজ এই পর্যন্ত সন্তান হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করেছে। কেবল বিয়েটা করতে চাচ্ছিল না। এইটুকু কেন ছাড় দিচ্ছে না ওর বাবা? রাগ হচ্ছে ওর, ভীষণ রাগ হচ্ছে। সব কিছু ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে। আরশাদ ওকে অস্বাভাবিকভাবে ঘামতে দেখে কাঁধ শক্ত করে ধরে। তারপর টেনে আনল বেডের বাইরে।

“শান্ত হ রাজ।”

“কী করে?” ঘুরে সামনের দেয়ালে সজোরে ঘুষি মারল। আশপাশের কয়েকজন ভীত চোখে চেয়ে দ্রুত হেঁটে চলে গেল। আরশাদ ওকে জোর করিয়ে বসায় চেয়ারে। দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে ওর হাতে দিলো। পানিটুকু পান করে হাঁপাতে লাগল আফরাজ।

“স্ট্রেস বল সাথে আছে?” জিজ্ঞেস করে আরশাদ। আফরাজ মাথা নাড়ায়।

“না।”

“ওটা অলওয়েজ সাথে রাখতে বলেছিলেন ডাক্তার।”

ডাক্তার শব্দ শুনে চোখ জ্বলে উঠল আফরাজের।

“তুইও ভাবিস আমি মানসিক রোগী?”

“আমি সেটা বলিনি রাজ। তোর এগ্রেসিভ মুড কতটা ভয়ানক তুই ভালো করেই জানিস। রাগ কমাতে ডাক্তার তোকে স্টেস বল সবসময় হাতের কাছে রাখতে বলেছিল। এখানে মানসিক রোগীর কথা কেন তুললি তুই?”

একটু যেন ক্ষোভ ঝাড়ল আরশাদ। আফরাজ জবাব দেয় না। দু’হাত কাঁপছে ওর। উঠে দাঁড়াল।

“কোথায় যাচ্ছিস?”

“জাহান্নামে।”

আরশাদ ওর পিছু নেয়। আফরাজ গাড়ির কাছাকাছি আসতে আরশাদকে দেখে প্রশ্ন করে,

“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

“তোর সাথে জাহান্নামে। জাহান্নামে গরম কেমন একটু দেখে আসতাম আরকি।”

আফরাজ রেগে তাকাতে দাঁত বের হাসল ও। আফরাজ দাঁতে দাঁত চেপে ড্রাইভিং সিটে বসতে গেলে আরশাদ ওকে ঠেলে সিটে বসে পড়ে।

“এটা কী হচ্ছে শাদ?”

“আমি এখনই মরতে চাই না জান। তুই এখনও এগ্রেসিভ মুডে আছিস। ড্রাইভিং করলে হাই স্প্রিডে করবি যেটা অনিরাপদ।”

“একদম ওসব শব্দে সম্বোধন করবি না।”

“হুয়াই জান, হুয়াই?”

“আরেকবার বল লাথি না মারছি তোরে এবার।”

আরশাদ আফরাজের গম্ভীরতা দেখে আর মজা করার সাহস করল না। চুপচাপ পাশের সিটে গিয়ে বসল আফরাজ। গাড়ির গ্লোব বক্স থেকে মেডিসিন আর পানি বের করে খেতে আরশাদ বলল,

“ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ খাওয়া কি ঠিক হচ্ছে রাজ? সাইড ইফেক্ট হতে পারে এতে।”

আফরাজ প্রত্যুত্তর করল না। আরশাদ আবার সতর্ক করতে চায়।

“রাজ!”

“শাদ প্লিজ চেঞ্জ দ্য টপিক।”

দুজনেই চুপ এরপরে। আফরাজ সিটে চোখ বন্ধ করে পিঠে লাগিয়ে দিয়েছে। বেশ রাত হয়েছে। ঢাকার ব্যস্ত সড়কে চলছে গাড়ি। শেওড়াপাড়ার কাছাকাছি আসতে ওদের গাড়ি জ্যামে আঁটকে গেল। আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল,

“শালার জ্যাম!”

আফরাজ প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। গত কয়েকদিন খুব স্ট্রেস গেছে ওর ওপর। আরশাদ একটা সিগারেট ধরিয়ে নেমে দাঁড়ায় গাড়ি থেকে। গাড়ির কাছাকাছি রাস্তার এককোনে গিয়ে থামল। ও নামার কিছুক্ষণ পরে আফরাজের মোবাইলটা বেজে ওঠে। ঘুমের ব্যঘাতে কপাল কুঁচকে যায়। সামনে থেকে মোবাইলটা হাতে নিলো। ভেবেছিল মামণি কল করেছেন। না দেখেই রিসিভ করে বলল,

“বলো মামণি।”

ওপাশে পিনপতন নীরবতা। আফরাজের কপালের ভাঁজ আরো বাড়ে।

“মামণি?”

“আমি বহ্নিশিখা বলছি।”

হাতটা শক্ত হলো মোবাইলের দুপাশে। ভ্রম হলো কি না ভেবে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাল। মামণির নাম্বার নয়। ও আস্তে আস্তে মোবাইল আবার কানের কাছে ধরে।

“বহ্নিশিখা!”

“জি, মি.শেখ, আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিল। এখন কি একটু আসতে পারবেন আমার বাসার সামনে?”

হাত ঘড়ি দেখল আফরাজ। রাত প্রায় বারোটা। সামনে লম্বা জ্যাম। বিআরপি পর্যন্ত যেতে আরও সময় লাগবে।

“এখন!”

“আমি অপেক্ষা করছি মি.শেখ আসুন আপনার সময় নিয়ে। একটু তাড়াতাড়ি এলে ভালো হয়।”

কলটা কেটে দিলো বহ্নিশিখা। আফরাজের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না বহ্নিশিখা কল করেছে। ওর নাম্বার মেয়েটা পেল কোথায়? এত রাতেই কীসের জরুরি কথা? ওর প্রস্তাবে রাজি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি তো! আফরাজের হাত কাঁপতে লাগল। শরীরে ঘাম ছুটে গেল আবার। সামনের সামান্য জ্যাম ছেড়েছে। আরশাদ উঠে এলো গাড়িতে। আফরাজের ঘর্মাক্ত মুখ দেখে বলল,

“কী হয়েছে?”

“বহ্নিশিখা কল করেছে। আজই দেখা করতে চাচ্ছে।”

আরশাদ থ মেরে বসে রইল আফরাজের ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে। বিয়েতে কি বহ্নিশিখা শেষমেশ মত দেবে? বহ্নিশিখা তখন না করাতে মনে মনে আফরাজ খুশি হয়েছিল। যদিও সেটা আরশাদকে বুঝাতে চায়নি। কিন্তু আরশাদ ওকে ভালো করেই চেনে। এই যে এখন ওর মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওর ভয়। বিয়ে নিয়ে কেন এত ভয় ওর মনে? বন্ধু হয়েও আজ পর্যন্ত এ রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি ও।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here