ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। আমি তাদের সম্পূর্ণ ইগনোর করেই পাশ কেটে যাচ্ছিলাম। এমন সময়, ঐ ছেলেগুলোর মধ্যকার একজন এসে আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। আমি স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম,
‘পথ আটকালেন কেন?’
ছেলেটা বাঁকা হাসি দিলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বখাটে ছেলে। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম,
‘সমস্যা কী? এভাবে পথ আটকানোর কারণ?’
পাশ থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো,
‘ম্যাডাম মনে হচ্ছে নতুন এসেছে ভার্সিটিতে। তাই ক্যাম্পাসের নিয়ম-নীতি জানে না।’
কথাগুলো বলেই একসাথে হেসে উঠলো। আমার বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। চোখ মুখ খিঁচে বললাম,
‘এভাবে ডিস্টার্ব না করে পথ ছাড়ুন। মেয়েদের দেখলেই টিজ করতে ইচ্ছে করে কেন? বাসায় কি মা-বোন নেই?’
এতোক্ষণে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার টনক নড়লো। ও হেসে বললো,
‘মা-বোন আছে ম্যাডাম। কিন্তু বউ নেই৷’
আবারও সেই বিদখুটে হাসি দিতে লাগলো। আমি ছেলেটার দিকে একবার চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আবারও পাশ কেটে যাওয়ার জন্য এক কদম এগোনোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি ব্যর্থ। এবার অন্য আরেকটা ছেলে এসে আবার ডান পাশে দাঁড়ালো। আরেকজন বাম পাশে। এমন করে ঐ দলের সবাই আমার চারপাশ ঘিরে ফেললো।
মুহুর্তে অজানা ভয় আমার ভেতরে চেপে বসলো। ছেলেগুলো চাইছে কী? আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, সবাই আমাকে এক নজর দেখে যে যার মতো করে চলে যাচ্ছে। আজব! এমন দিনের বেলায় একটা মেয়েকে কয়েকটা ছেলে ঘিরে রেখেছে তাও কেউ এগিয়ে আসছে না কেন? ব্যাপার কেমন ঘোলাটে লাগছে।
আমি উঁচু গলায় বললাম,
‘দেখুন এবার কিন্তু আমি চিৎকার করবো। আমার পথ ছাড়ুন বলছি।’
আমার কথা শুনে ছেলেগুলো আরো জোরে জোরে হাসতে লাগলো। অদ্ভুত! এদের কি ভয়ডর কিছু নেই? চিৎকার করবো এটা শুনেও কেউ সামান্য ঘাবড়ালো না। বরং আর উঁচু স্বরে হাসছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলাম।
হঠাৎ পিছন থেকে কারো এক কন্ঠস্বর পেয়ে ছেলেগুলো ঘুরে তাকালো। আমার চারপাশ থেকে সরে গিয়ে একপাশে যবুথবু হয়ে দাঁড়ালো। দলটার এহেন কান্ডে আমি যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কার আগমনে ছেলেগুলো এমন ভয় পেলো, তা দেখার জন্য মাথা তুলে তাকাতেই আমি থমকে গেলাম।
এই ছেলেটা তো আমাদের পাশের বাসায় থাকে। প্রায়ই দেখি উনাকে। উনি এই ভার্সিটিতে পড়েন, তা জানা ছিলো না। উনাকে দেখা মাত্রই যেনো একটা নিজস্ব শক্তি পেলাম। আমি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বললাম,
‘থ্যাঙ্ক…’
আমার কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই উনি ওই ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বললেন,
‘কী সমস্যা? কী ভুল করেছে ও?’
আমি ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,
‘দেখ্, এখন কেমম মজা লাগে। মেয়েদের পথ আটকানো? এখন কয়েকটা পড়লেই সোজা হয়ে যাবি একদম।’
‘ভাই, মেয়েটা আমাদেরকে দেখেও সালাম না দিয়েই পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলো।’
দলের একটা ছেলে থমথমে গলায় কথাটা বললো।
উনি আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
‘নাম কী?’
লোকটা এতোক্ষণ নিজের লোক মনে হলেও এখন কথার ধরনে কেমন জানি লাগছে। আমি কেঁপে কেঁপে বললাম,
‘ফারিন দিবা।’
‘দিবা?’
আমি উপর নিচ মাথা ঝাঁকালাম। উনি আবার বললেন,
‘ভার্সিটিতে আজ প্রথম?’
আমি আবারও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলাম।
‘র্যাগ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই? ভার্সিটিতে না হয় প্রথম এসেছো। নাটক, সিনেমাতে দেখো না ভার্সিটিতে আসলে প্রথমেই বড় ভাইদের সালাম দিতে হয়?’
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আড়চোখে একবার ওই দলের ছেলেগুলোকেও পরখ করে নিলাম। ওদের দেখলে কেউ-ই বলবে না ওরা আমার সিনিয়র। বখাটে বখাটে ভাব প্রত্যেকটার ছেলের মুখেই রয়েছে। আর ওদের সর্দার হচ্ছেন, আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহান ব্যক্তিটি। দেখতে সুদর্শনই বটে। কিন্তু ব্যবহার সেই বখাটেদের মতোই। আর উনাকে কিনা আমি ভালো ভাবছিলাম!
আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা ধমকের সুরে বললো,
‘নেক্সট টাইম যাতে এমন ভুল না হয়। আর আজকের ভুলের জন্য শাস্তি হচ্ছে, এখন এই মুহুর্তে দশ লিটার পানি নিয়ে এই চারতলা ভবনটির উপরে উঠতে হবে। ঠিক আছে?’
উনার কথায় ঘাবড়ালাম আমি। একবার ঢোক গিলে ভবনটি পরখ করে নিলাম। ইম্পসিবল! যে আমি বাসায় এক গ্লাস পানি নিয়ে খেতে গেলেই হাঁপিয়ে যাই, সেই আমি কি-না দশ লিটার পানি নিয়ে চার তলায় যাবো? নেভার!
কিন্তু সিনিয়দের র্যাগের হাত থেকে তো বাঁচতে হবে। কিন্তু উপায় কী? এখন আমি না করে দিলে হয়তো আরো কঠিন কোনো টাস্ক দিয়ে বসবে। আমার রাগ হচ্ছে। প্রচুর রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা ছেলের গালে ঠাস ঠায় চড় বসিয়ে দেই। অসভ্যের দল। সিনিয়র হয়েছে দেখে সাপের পাঁচ পা দেখেছে না-কি? মনে মনে হাজারটা গাল দিলেও ওদের মুখের উপর কিছু বলার সাহসই পাচ্ছি না। হুট করে মাথায় একটা আউডিয়া আসলো।
আমি শীতল গলায় বললাম,
‘ওকে।’
ওকে বলার সাথে সাথেই একটা ছেলে এগিয়ে এসে দশ লিটার পানি আমার হাত ধরিয়ে দিলো। আমি পানির বোতল দু’টো নিয়ে দু’কদম এগিয়েই ধপাস করে বসে পড়লাম নিচে।
তারপর চেঁচিয়ে বললাম,
‘ও মা গো, গেলো গেলো! আমার পা দুইটা বোধহয় ভেঙেই গেলো।’
আমি গোঙ্গানির আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি ছেলেগুলো আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমি কান্নার অভিনয় কন্টিনিউ করে গেলাম।
দলের লিডার এগিয়ে এসে বললো,
‘ব্যাথা বেশি লেগেছে?’
ছেলেটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আমি মাথা নাড়ালাম। উনি আশেপাশে তাকিয়ে দু’টো মেয়েকে ডাক দিলেন। মেয়ে দু’টো এসে আমাকে ধরে দাঁড় করালো। তারপর ওদের সহায়তায় ক্লাস রুমে উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। মাঝে একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে লিডার মুখটা দেখে নিলাম। বেচারা! আমায় না-কি র্যাগ দিবে, হুহ!
__________
শীতের আগমনীতে প্রকৃতি রুক্ষতায় ছেঁয়ে গেছে। কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে চারপাশ। এখন বিকেল পাঁচটা মানেই প্রকৃতি নিজেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করার প্রস্তুতি শুরু করে। এমন সময় গরম দু’মগ কফি নিয়ে ছাদে বসলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না। দিয়াকে ডাক দিলাম। ওকে আজ ক্যাম্পাসের গল্পটাও বলা হয়নি। ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দিয়া পিছন পিছন আসছে। দু’বোনে মিলে ছাদে বসে খোশগল্প জুড়ে দিলাম। মাগরীবের আযান বোধহয় আর মিনিট দশেকের মধ্যেই হয়ে যাবে। দিয়াকে ক্যাম্পাসের ঘটনা বলার পর ও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
আমি ওর হাসি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
‘জানিস ছেলেটা কে?’
দিয়া ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কে?’
আমি পাশের বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘এই বাসার পাঁচ তলার সেই ব্যাচেলর ছেলেটা। আমাকে বোধহয় চিনতে পারেনি। অবশ্য চেনার কথাও না। আমাদের এর আগে সরাসরি দেখা হয়নি। আমি বেশ কয়েকবার উনাকে ছাদে দেখেছিলাম। তখন উনি ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত থাকতেন। তাই আমায় হয়তো খেয়াল করেনি।’
‘প্রণব ভাইয়ার কথা বলছিস তুই?’
দিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘নাম তো জানি না। আর নাম জানার দরকারও নেই। এখন তো প্রতিশোধ নেবার পালা। দিয়া শোন্, তুই আশে-পাশে খেয়াল রাখ্। আমি একটা কাজ সেরে আসছি।’
‘কী কাজ আপু?’
দিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে আমি ছাদের কর্ণারে এক টুকরো ইটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ওটা হাতে নিয়ে পাশের বিল্ডিংটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের বাসা চার তলা। আর ঐ বদ লোকের বাসাটা পাঁচ তলায়। ছাদ থেকে ঐ ছেলের রুমটা আমাদের ছাদের দিকে হওয়ায় সুবিধা করতে পারলাম। হাতের ইটটা ছুড়ে মারলাম উনার রুম বরাবর। ব্যস! জানালার কিছু অংশ জুড়ে কাঁচটা কয়েক খন্ডে বিভক্ত হয়ে গেলো। আমি আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়ালাম না দৌঁড়ে ছুটে আসলাম আমাদের সিঁড়িঘরে। দিয়াও আমার পিছন পিছন দৌঁড়ে আসলো। দু’বোনই হাঁপাচ্ছি।
দিয়া হাঁপাতে হাঁপাতেই বললো,
‘কী হলো ব্যাপারটা? তুই জানালার কাঁচ ভাঙলি কেন? কেউ যদি দেখে ফেলতো?’
আমি হাতে ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম,
‘দেখার চান্স নেই। রুমের লাইট অফ ছিলো। কেউ রুমে নেই বিষয়টা খেয়াল করেই ভেঙেছি। ব্যাটা আমায় র্যাগ দিতে চেয়েছিলো। আজ থেকে আমিও ওর জীবন তছনছ করার মিশনে নামলাম। এখন থেকে প্রতিটা দিন উনি বুঝবেন, র্যাগ কাকে বলে!’
কথাটা বলেই দিয়ার কাঁধের উপর আমার হাতটা রাখলাম। ও ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমার পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
.
(চলবে…)
.
#রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০১