শরতের শুভ্র মেঘের ভেলায় পর্ব- ১৫

#শরতে_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়(১৫)
Sadia afrin nishi
___________________________

পুরো পুলিশ ফোর্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের বাড়ির ড্রইংরুমে। আমাদের সামনেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাক্ষর। কাল রাতটা কোনোরকম পেরতেই আমি সকাল সকাল প্রশাসনে বিস্তারিত ঘটনা জানাই।তারা সবাই আমার আইডি কার্ড চেক করে আমার বলা কথার সত্যতা যাচাই করতে চলে এসেছে। সাক্ষরের মুখে হাসি নেই হয়তো ভীষণ চিন্তিত সে।এই সময়ে এই বাড়িতে পুলিশ হয়তো আশা করে নি সে। পুলিশের সর্বাপেক্ষা উচ্চ পদবিশিষ্ট কর্মকর্তা আইপিএস অফিসার মাইনুল হাসান সাক্ষরের দিকে এবার প্রশ্নের তীর ছুড়লেন,,

_” মি.সাক্ষর আহমেদ আপনার বাড়িতে নাকি বর্তমান সময়ের বহুল ভয়াবহ চিত্তে বর্ণিত খুনের লাশগুলো রক্ষিত রয়েছে। কিন্তু কেন আপনি একজন প্রশাসনের সেবক হয়ে প্রশাসনের থেকে এসব গোপন করলেন।তাহলে কী ধরে নেব এই খুন এবং লাশ মর্গ থেকে সরানোর সবরকম কার্যক্রম আপনার অর্ডারে সম্পাদন হয়েছে?”

সাক্ষর পুলিশের মুখ থেকে এমন কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল,,

_”নো নো নো স্যার, নো স্যার, আমি জানি আমি আমার এখতিয়ারের বাহিরে গিয়ে এসব করে ফেলেছি তবে আমি চেয়েছিলাম এই কেসটার পুরোপুরি তদন্ত করে তারপর সবাইকে জানাতে”

সাক্ষরের জবাব শুনে পুলিশ অফিসার হতাশ ভঙ্গিতে বললেন,,

_আপনার মতো একজন দক্ষ “সিক্রেট পুলিশ এজেন্ট” কর্মকর্তার কাছে এহেন ভুল কাম্য নয়। আমরা যা দেখছি তাতে সন্দেহের তীর আপনার দিকেই ওঠে। আইনের নিয়ম নিশ্চয়ই আপনাকে শিখিয়ে দিতে হবে না। তাই বলছি ইচ্ছে না থাকা সত্বেও আপনাকে আমরা আইনের আওতায় এনে আপনার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বাধ্য হচ্ছি।সাময়িক সময়ের জন্য আপনার পেশা থেকেও আপনাকে সাসপেন্ড করা হলো। যথাযথ প্রমাণ দিতে পারলে অবশ্যই আইন আপনাকে আপনার আগের সম্মান ফিরিয়ে দেবে।আর যদি প্রমাণ হয় আপনিই দোষী তাহলে তো জানেনই কী হবে। আবার বলছি আমরা ডিপার্টমেন্টের কেইউ আপনার মতো একজন দক্ষ পুলিশ অফিসারকে হারাতে চাই না। তাই আমাদের জন্য হলেও আপনাকে নিজের প্রমাণ করতে হবে। আমাদের হাত পা বাঁধা আপনাকে নিয়ে যেতেই হবে।

সাক্ষর একজন ” সিক্রেট পুলিশ এজেন্ট ” এটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।একজন আইনের রক্ষক হয়ে সে কী করে এতটা জঘন্য কাজ করতে পারল।ছিস কতটা বিকৃত মস্তিষ্ক সম্পন্ন মানুষ হলে এমন জঘন্য ভাবে কাউকে হত্যা করতে পারে। ছিস ছিস ছিস……

সাক্ষর অফিসারের কথায় আর কোনো দিরুক্তি না করে সোজাসুজি বলে দিল,,

_”হুম বুঝতে পারছি আপনাদের অপারগতা। তবে ভুলটা যখন আমারই তখন তা প্রমাণ করার দায়িত্বও আমার ওপরই বর্তায়। আমি প্রস্তুত আইনের আওতায় গিয়ে শাস্তির সম্মুখীন হতে কিন্তু আমার একটা বিষয় জানার আছে? ”

অফিসার তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করল,,

_”কী বিষয় বলুন ”

সাক্ষর–আসলে এত সকালে আপনারা আমার বাড়িতে এসে এসব নিয়ে কথা বলছেন তারমানে আপনাদের কাছে কেউ কোনো ইনফরমেশন দিয়েছিল।কাইন্ডলি আমার ওটাই জানার ছিল।কে এই ইনফরমার। যে কী না সাক্ষর আহমেদের ওপর নজরদারি করছে?

অফিসার–সে আর কেউ না আপনারই স্ত্রী এবং সদ্য জয়েনকৃত আইন কর্মকর্তা “ডিটেকটিভ নীহারিকা আহমেদ”

আমার নামের সাথে ডিটেকটিভ পদকটার অর্থ বিশ্লেষণে বেশ বেগ পেতে হলো সাক্ষরকে।সে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল আমার মুখপানে।তার এই দৃষ্টি আমার কাছে আজ বরই অমূল্য। আমি ঘৃন্ন্যিত চাহনি নিয়ে মুখ ঘুরালাম অন্য পার্শ্বে।এই লোকটার মুখ দেখাও পাপের সমতুল্য বলে মনে হচ্ছে।

অফিসার তারা দিতেই সাক্ষর ওই তালাবদ্ধ ঘরের দরজা খুলে প্রত্যেকটি লাশ বের করে নিয়ে এলো।তার সাথে এলো রিফাত নামের ছেলেটি। মোট সাতটি লাশ।লাশগুলো আবার ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হলো।সাক্ষর আর রিফাতকে নিয়ে যখন পুলিশ বেড়িয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই সাক্ষর আমার অতি নিকটে এসে আমার দুহাত নিজের দু’হাতে আগলে নিয়ে করুন দৃষ্টিতে বলল,,

_”বিশ্বাস করো নীহুপাখি আমি নির্দোষ। তুমি যা দেখেছ তা পুরোপুরি সত্যি নয়। আমার কথাটা প্লিজ বিশ্বাস করো”

আমি তার হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাতটা ঝাড়া মেরে ছুটিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বললাম,,

_”বিশ্বাস তাও আবার আপনাকে।আপনি একটা প্রতারক, খুনি। জঘন্য মানুষ একটা। মুছে ফেলেছি আমি আপনাকে আমার মন থেকে। দুর হয়ে যান এখান থেকে।মুখ দেখতে চাই না”

আর কিছু বলতে পারলাম না। দুচোখ ভিজে উঠল নোনাজলে কিন্তু এই জল তার দেখার যোগ্যতা নেই তাই ঝটপট লুকিয়ে ফেললাম নিজের ওরনার আঁচলে।

সাক্ষরকে নিয়ে চলে গেল। পুলিশের গাড়ি যখন চলতে শুরু করল তখন কোথাথেকে সেই পুলিশ অফিসার এসে হাজির হলেন আমার সম্মুখে। উনি হয়তো বাইকে চড়ে যাবেন।কিন্তু আমার কাছে আসার হেতু আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। আমি বিষ্মিত চোখে চেয়ে আছি।আমার তাকানোর ধাঁজ বুঝতে পেরে অফিসার বললেন,,

_”ঘাবড়ানোর কিছু নেই।আমি শুধু একটা কথা বলতে এসেছি আপনার কাছে। আর সেটা হলো,
আপনার স্বামী মানে সাক্ষর আহমেদ তিনি একজন সিক্রেট পুলিশ কর্মকর্তা। অতীতে তার কাজের প্রচুর সুনাম রয়েছে। তার দ্বারা এমন কাজ আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।সে হয়তো আসলেই নির্দোষ।কিন্তু আপনি হয়তো তার এই পেশা সম্পর্কে অবগত নন এবং তিনিইও হয়তো আপনার পেশা সম্পর্কে অবগত নয় তা আপনাদের কথার ভাঁজে প্রকাশিত। যাই হোক আসল কথায় আসি। আমি বুঝতে পারছি আপনার মানসিক অবস্থা এখন ততটা ভালো নয় তবুও বলবো আমি চাইলে এই কেসের তদন্ত ভাঁর আমি আপনার হাতে হস্তান্তর করতে পারি। আমার কাছে এটাই ঠিক মনে হচ্ছে। এখন ডিসিশন আপনার। আপনার স্বামীর জীবন এখন অনেকটাই আপনার ওপর নির্ভরশীল। আচ্ছা এখন তাহলে যাই, ভেবে দেখবেন কিন্তু আমার কথাটা।”

————————————————————-

বাড়িটা পুরো শূন্য শূন্য লাগছে। শুধু বাড়িটা নয় আমার বুকের বা পাশটাও আজ বরই বেরঙ। নাওয়া খাওয়া ভুলে এই দুদিন কেমন জানি নিশাচরী প্রাণীদের মতো বাড়িময় ঘুরে বেড়ানোই আমার বর্তমান পেশা।আমি যে একজন ডিটেকটিভ তা হয়তো আমি নিজেই ভুলতে বসেছি। এভাবে আর কতদিন।কিছুই ভালো লাগে না। এক মন বলে সাক্ষর অপরাধ করেছে, অন্যায় করেছে আমার সাথে কিন্তু পরক্ষণেই আরেক মন বলে সবকিছু ভুলে সাক্ষরকে মুক্ত করা দরকার। সবকিছু নতুন করে শুরু করা দরকার। সব রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু খুঁজে বের করা দরকার।

————————————————————-

আজ তিনদিন পর ছাদে এলাম।গাছগুলো সঠিক পরিচর্যার অভাবে কেমন নেতিয়ে পড়েছে। মানুষও হয়তো এমনি।পরিচর্যা বিনা মরিচা ধরে যায়।এই তিনদিন সাক্ষরের একটি খোঁজও আমি নেই নি। পাহাড়সম অভিমান জমা হয়েছে হয়তো। অভিমানের রেশ এতটাই বেশি হয়েছে যে তা থেকে বেড়িয়ে রহস্য উন্মোচন করাটা আমার জন্য খুবই কষ্টসাধ্য।তবুও আমাকে পারতেই হবে।

আজ ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল তখন একটা দুঃস্বপ্ন দেখে সাথে সাথেই ঘুম ছুটে যায়।স্বপ্নে দেখেছি সাক্ষর খুব বিপদে আছে আমাকে ডাকছে সাহায্যের জন্য। এতটুকু দেখেই ধরফরিয়ে উঠে পড়ি ঘুম থেকে। তারপর থেকে নিজের মনকে স্থির করে নিয়েছি, যে করেই হোক সাক্ষরকে আমি মুক্ত করবোই।আমি তাকে নির্দোষ প্রমাণ করবোই। তাকে বিপদে ফেলার পেছনে যখন আমার অপদান সবথেকে বেশি তাহলে তাকে বিপদমুক্ত করার পেছনে নাহ একটু হলেও আমার অবদান থাকুক।মান অভিমানের খাতা বন্ধ করে এবার হাঁটব শুধু সত্যের সন্ধানে। মান অভিমান না হয় পরে মেটাবো।

কোনো রকমে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে একটা সাদামাটা কাপড় গাঁয়ে জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়লাম থানার উদ্দেশ্যে।ঘড়ির কাটায় এখন সকাল এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। এক টা অব্দি আসামিদের সঙ্গে দেখা করার সময় নির্ধারণ করা। রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে শহরের জনবহুল এলাকার রাস্তা ধরে। আমি বারকয়েক হাত ঘড়িটার কাটায় নজর বোলালাম।তাড়াতাড়ি পৌঁছনোটা খুব জরুরি। সাক্ষরের থেকে সবটা জেনে তারপর আমাকে ইনভেস্টিগেশন স্টার্ট করতে হবে।আমার নিজেরই তো এখনো অনেক কিছু ক্লিয়ার হওয়া বাকি আছে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here