শরতের শুভ্র মেঘের ভেলায় পর্ব- ১৬

#শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়(১৬)
(রহস্য উন্মোচন পর্ব)
Sadia afrin nishi
_____________________________

দশমিনিট অপেক্ষার পর সাক্ষরের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলাম। আমি এসেছি সাক্ষরের হয়তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার মুখপানে। তার অবাকদৃষ্টি আর আমার হতবাক দৃষ্টি নিয়ে কেটে গেল পাঁচমিনিট।এই পাঁচমিনিট দুজন দুজনের দিকে তাকিয়েই পাড় করে দিলাম।সাক্ষর হয়তো অবাক হচ্ছে আমাকে তার সামনে আসতে দেখে আর আমি হতবাক হচ্ছি তার চেহারার পরিবর্তন দেখে। এই তিনদিনে লোকটার মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়।মুখমন্ডল/ঠোঁট শুষ্ক,চোখ জোড়া রক্তরঙা,চুলগুলো অগোছালো পুরোই অন্যরকম লাগছে তাকে।নিরবতা ভেঙে আমিই প্রথম কথা শুরু করলাম,,

_”কেমন আছেন?”

সাক্ষর–আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, তুমি?

আমি কিছুক্ষণ নিরব থেকে উত্তর দিলাম,,

_”হুম আছি”

সাক্ষর– বিশ্বাস করতে পেরেছ কী?

_”পুরোপুরি নয় তবুও একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই। আমি চাই আমার ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যে প্রমাণিত হোক।জিতে যাক আপনার বলা বাক্যগুলো।সেই লক্ষ্যেই আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাতে চাই তাই তো আপনার থেকে সব ঘটনা জানতে এলাম।আশা করি আর কোনো সত্য গোপন করবেন না।”

সাক্ষর–কী জানতে চাও বলো?

_জানতে চাই আপনি আইনের লোক হওয়া সত্বেও কেন এতবড় অন্যায় করেছেন? কেন সবসময় মুখে মাস্ক পরে থাকতেন?কেন হাবাগোবা ছেলে সেজে কলেজে যেতেন আর বছর কয়েকপর কাউকে কিছু না বলে কলেজ থেকে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন? কে প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে রান্না করে রেখে যায়? আর এসবকিছু কেন আমার থেকে গোপন করেছেন? বলুন আজ আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর চাই।

আমার করা প্রশ্ন শুনে সাক্ষর একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলতে শুরু করল,,

আইনের লোক হওয়া সত্বেও আমি কোনো রুপ অন্যায় করিনি তাই তোমার এই প্রশ্নটা আমি যৌক্তিক বলে মনে করছি না। সবসময় মাস্ক পরে থাকতাম কারণ আমি “সিক্রেট পুলিশ অফিসার ” সো আমাকে সবার থেকে আড়ালে থেকে আমার দায়িত্ব পালন করতে হতো কিন্তু একদিন মিশনের সময় অসাবধানতা বসত একজন ক্রিমিনাল আমার পরিচয় জেনে ফেলে এবং আমার চেহারাও দেখে ফেলে।ওই ক্রিমিনালকে আমার হাত থেকে সেদিন ফসকে যায়।এজন্য আমাকে অলটাইম মাস্ক ইউজ করতে হয়।আমাদের বাড়িতে রান্না করে দেয় রিফাত। আমার বাড়িতে বাহির থেকে লোক আনা বিপদজনক। রিফাত সবধরনের রান্না শিখেছে হোস্টেলে থাকাকালীন তাই ওই সব রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে রাখত।রিফাত আমার সহকারী কর্মকর্তা।আর এসব কিছু তোমার থেকে গোপন করার একটাই কারণ সেটা হলো আমার পেশা।আমার পেশায় আমি শপথরত যে প্রশাসন এক্সপোজ না করা পর্যন্ত আমি কাউকে আমার পরিচয় দিতে পারব না তাই আমি তোমার থেকেও আমার পরিচয় লুকিয়েছি।তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শেষ এবার তুমি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেও, কলেজে হাবাগোবা ছেলে সেজে থাকতাম বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছো?

_”কেন বুঝতে পারছেন না? ”

সাক্ষর–নাহ সত্যিই বুঝতে পারছি না প্লিজ বলো?

_”আমি যখন কলেজে নতুন এডমিট হই তখন আমাদের কলেজে একটা হাবাগোবা ছেলে ছিল।সে পড়াশোনায় মারাত্মক ভালো এবং সিরিয়াল ছিল।কিন্তু কয়েকবছর পর হঠাৎই সে লাপাত্তা হয়ে যায় কাউকে কিছু না বলে। এমন কী স্যাররা পর্যন্ত কেউ কিছুই জানে না।তারপর আমাদের বিয়ের রাতে আমি আপনার মুখ দেখে প্রচন্ড রকম শকড হয়েছিলাম। কারণ কলেজের সেই হাবাগোবা ছেলেটিই তো আপনি।তবে আপনার বেশভূষা আর সেই ছেলেটির বেশভূষা বিস্তর ফারাক। কিন্তু চেহারা হুবহু একই।”

আমার কথা শেষ হতেই সাক্ষর ব্যস্তকন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,

_”তারপর তারপর কী হয়েছে? পেয়েছ আর সেই ছেলেটির দেখা?”

_হ্যাঁ পেয়েছি তো সেই ছেলেটি তো আপনিই।

সাক্ষর– না না নাহ সেই ছেলেটি আমি না। সে আমার যময ভাই সার্থক যাকে আমি এই তিনটি বছর যাবত খুঁজে চলেছি কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না।আমার ভাইটা আমাকে একা করে কোথায় হারিয়ে বসে আছে তা আমি আজও জানতে পারলাম না।সবকিছু যদিও আমার আর আমার এই পেশাকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। তবুও আমি তাকে খুঁজে চলেছি প্রতিনিয়ত।

সাক্ষরের কথায় আমি এবার পুরোই শকট হয়ে গেলাম। কলেজের সেই ছেলেটি কী না সাক্ষরের যময ভাই। যাকে এতোদিন আমি সাক্ষর ভাবতাম সে আসলে সাক্ষর নয় সার্থক।এ আমি কী ভুল করে এসেছি এতোদিন।আমি এবার সাক্ষরের দিকে তাকিয়ে উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলাম,,

_”কেন এমন হলো আপনার ভাইয়ের? কোথায় হারিয়ে গেল সে?কীভাবে হলো সবকিছু? প্লিজ বলুন।

সাক্ষর–পুলিশের চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে আমার সব অপারেশনই সাকসেসফুল হয়েছে। এতে করে দেশের মঙ্গল হলেও চরম ক্ষতি হয়েছে দুষ্কৃতিকারীদের।ওই যে তখন বললাম একজন ক্রিমিনাল আমার মুখ দেখে ফেলেছিল তারপর তারা আমার ডিটেইলস বের করে জানতে পারে আমার বাড়িতে আমি আর আমার ভাই থাকি।আমার বাবা- মা লন্ডনে সেপারেট। আমি আর আমার ভাই দেশের টানে এই বাংলাদেশে থাকি।দেশের জন্য কিছু করতে চাই।আমার ভাই একজন সাইন্টিস্ট হতে চাইত সবসময়।দু ভাই একজোট হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে উঠে পড়ে লেগে গেলাম। আমি পুলিশ আর ও সাইন্টিস্ট হওয়ার লক্ষ্যে।আমার ভাইটার মাথায় একটু বুদ্ধি কম ছিল। ঠিক বুদ্ধি কম নয় সে মানুষের বাহ্যিক চাকচিক্যকে বেশি প্রাধান্য দিত না সবসময় সাদামাটা থাকতেই পছন্দ করত।বেশ ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু একদিন আমার ভাই কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয় কিন্তু আর বাড়িতে ফেরে না। তারপর অনেক খুঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান আমি পাইনি।আমি নিশ্চিত এটা ওই দুষ্কৃতকারীদের কাজ।আর এসব খুনের পেছনে নিশ্চয়ই ওদেরই হাত আছে।

_কিন্তু সেই দুষ্কৃতকারীরা কারা?তাদের আসল পরিচয় কী? আর তাদের অপরাধ ই বা কী যার জন্য তাদের সঙ্গে আপনার শত্রুতা?

সাক্ষর–তারা হলো এমপি হাশেম মির্জা এবং তার চাচা খায়েশ মির্জা। মন্ত্রীত্বের পবিত্র আসনকে তারা করেছে অপবিত্র।ভালো মানুষীর মুখোশ পরে প্রতিনিয়ত অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে দুই চাচা-ভাতিজা।সব রকমের কালো ব্যবসা তাদের হাতের মুঠোয়। এটা নিয়ে তদন্ত করে তাদের মুখোশ সবার সামনে টেনে খুলতে চাওয়ায় আমার পেছনে পড়ে যায় তারা।অনেক বার আমাকে মারার চেষ্টাও চালায়।কিন্তু আমার কোনো প্রকার ক্ষতি করতে না পেরে আমার সহজসরল ভাইটাকেই গুম করে দেয়।

কথা শেষ করে আড়ালে দু’হাতে চোখের জল মুছল সাক্ষর।সেই জল আমার চোখের দৃষ্টি এড়াল না। সাক্ষর হয়তো সবকিছু সত্যি বলছে। এখন আমার দায়িত্ব সবকিছুর যথাযথ প্রমাণ দিয়ে সাক্ষরকে মুক্ত করা। আরও একটি দায়িত্ব এখন আমার বেড়ে গেল সেটা হলো সার্থককে খুঁজে বের করা। আসল অপরাধীর নাগাল আমাকে পেতেই হবে তা যে করেই হোক।আমার ভালবাসাকে মুক্ত করতে জীবন বাজি রাখতেও আমি প্রস্তুত।

সাক্ষরকে বিদায় জানিয়ে চলে এলাম হাইওয়েতে।সাক্ষর আমাকে বারবার সাবধান করে দিয়েছে যাতে আমি সাবধানে থাকি। যে কোনো মুহূর্তে আমার ওপরেও বিপদ আসতে পারে।

————————————————————-

হাইওয়ের পাশ ঘেঁষে হেটে চলেছি।কিছুই ভালো লাগছে না। নিজেকে বড্ড একা একা লাগছে। কী করে এতসব প্রমাণ আমি জোগাড় করব? কী করে সার্থককে খুঁজে বের করবো? কী করে সাক্ষরকে মুক্ত করবো?কিছুই বুঝতে পারছি না। সবকিছু তো আমার একার দ্বারা সম্ভব নয়। সাক্ষরের কর্মগত সততার ওপর ভিত্তি করে তাকে এখন কোর্টে চালান না করে জেলের একটা স্পেশাল কক্ষে রেখে তার কাজের তদন্ত
করা হচ্ছে। সবাই জানে সাক্ষর এমন কোনো কাজ করতেই পারে না যার জন্য তার পেশার গাঁয়ে চুনকালি লাগবে। তবুও আইনের কাছে সবাই সমান। আইন চায় সাক্ষী,প্রমাণ। মুখের কথায় আইন চলে না।

হাইওয়েতে কিছু দুর হেঁটে যেতেই গাড়ির হর্নের শব্দে পেছনে ফিরে তাকালাম। তারপর যা দেখলাম তারজন্য মটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here