#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১২|
সাদিয়া মেহরুজ
থমথমে চেহারা মেহতিশার। মুখোশ্রীতে ঘন কালো মেদুরের প্রলেপ পড়েছে। নিস্তরঙ্গ মেহতিশাকে লক্ষ করে শুষ্ক ঢোক গিললো সাবিনা। জড়োসড়ো হয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে সে। সাবিনার নিজেকে মনে হচ্ছে কোনো পা/পী/ষ্ঠ এক আসামি সে। পাপ করে দাঁড়িয়ে আছে কাঠগড়ায়। মেহতিশা এখানে বিচারকের ভূমিকা পালন করেছে যে কিছুক্ষণ পর তাকে দিয়ে বসবে শা/স্তিস্বরূপ কিছু ভারী, কঠিন কয়েক বার্তা।
-” কোনো তুচ্ছ বিষয়কে অযথা বাড়িয়ে বলা কবে বন্ধ করবেন সাবিনা খালা? মেহতিশার স্তিমিত কণ্ঠ।
সাবিনা কাচুমাচু করে বলে উঠলো, ” আফা মাফ কইরা দেন। আমার কি দো/ষ কন তো? সব দোষ ভাইয়ের। ”
-” সারতাজের দো/ষ কি করে হলো খালা বলেন তো আপনি! আপনি দেখলেন সারতাজের হাতে ছু/রি। ওনার হাতে লাল রঙের তরল পদার্থ। তাকে আপনি র ক্ত বানিয়ে আমায় এই রাতে ডেকে আনলেন? আপনার কি উচিত ছিলো না আগে সারতাজের কাছে যাওয়া, বিষয়টা ঘেটে দেখে তারপর আমায় ফোন দেয়া? আপনি ওনার হাতে সামান্য লাল রঙ দেখেই আমায় ফোন দিতে ছুটলেন? হুলস্থুল কান্ড করে ফেললেন? আমি তো আপনার কথা শুনে ভেবেছি কিনা না কি হয়েছে! এসে দেখলাম উল্টো ঘটনা। ”
মেহতিশার কন্ঠ বিরক্তিতে ঠাসা! বাড়িতে রঙ করা হচ্ছিল ক’দিন পূর্বে। সেখান থেকে কিছু রঙ বেঁচে যাওয়াতে তা রেখে দেওয়া হয় ওপর তলায়। ফল কা/টা/র উদ্দেশ্যে ছু/রি হাতে নিয়ে নিজের রুমের দিকে যাওয়া সারতাজ পথিমধ্যে তার পায়ে রঙের কৌটা ধাক্কা লাগে। কৌটাগুলো নির্দিষ্ট স্থানে রাখার উদ্দেশ্যে অন্যত্রে নিতে গেলে অসাবধানতা বশত কিছু রঙ তার হাতে মিশে একাকার হয়ে যায়। উক্ত দৃশ্য দেখে সাবিনা উল্টোপাল্টা ভেবে বসে। ঘটনা সম্পূর্ণ না ঘেঁটেই মেহতিশা থেকে শুরু করে শাকিব কে ফোন দিয়ে বসে। সাবিনার এই একটা বাজে অভ্যাস! তুচ্ছ বিষয়কে সে সর্বদা বড় করে বাড়িয়ে বলতে ওস্তাদ। মেহতিশার এখন নিজের ওপরই রাগ লাগছে। তার কি দরকার ছিল আসার? আরেকটু ভালো ভাবে সাবিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন ছিলো না? বোকার মতো সাবিনার পূর্ব অভ্যাস সম্মন্ধে অবগত থাকা সত্বেও ছুটে এসেছে সে। এই দিকে যাকে ঘিরে এতো কাহিনি উক্ত ব্যাক্তি কেবল বিষয়টা মাত্র কয়েক শব্দে সমাধান করে দিয়ে ছাঁদে চলে গিয়েছে। মেহতিশার ক্ষো/ভ/টা বাড়ে। যার চিন্তায় ছুটে এলো সে ব্যাক্তি তাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে দেদারসে ছাঁদে গিয়ে বসে আছে!
-” শাকিব ভাইয়াকে ফোন দিয়ে খুলে বলেছেন তো? নাহলে দেখা যাবে বেচারা আবার তো অযথাই কাজ ফেলে এসে ঘুরে যাবে! ”
সাবিনা ঘন ঘন মাথা নাড়ল। বলল,
-” বলছি আফা। ”
-” আচ্ছা। মেহজা কোথায় গেল? ”
-” আফা মেহজা তো ছাঁদে গেলো দেখলাম। ”
-” সারতাজের কাছে গিয়েছে? ”
-” হ, হেতিই তো লইয়া গেলো ছাঁদে। ”
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল মেহতিশা। ক্লান্ত দেহটা টেনেটুনে উঠে দাঁড়াল। ছাঁদে যেতে ইচ্ছে করছেনা। সারতাজের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছেনা। ছেলেটা কেমন! সে যে তার চিন্তায় ছুটে এলো একটুখানি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলো না। বলল না,’ এতো দূর ছুটে এলেন মেহতিশা এই রাতের বেলা। চলুন আমি আপনাকে আপনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। ‘
এ কথাটা তো বলল না! সে কি আর যেত নাকি ঐ ত্যাড়া লোকটার সাথে? হু? যেত না তো! বললে এমন কি হতো? কেমন মুখ ঝামটা দিয়ে উঠে চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে। এতো অবজ্ঞা! এতো ভাব!
মেহতিশা সাবিনাকে দেখল। ঠিক করলো সাবিনাকে বলবে মেহজাকে ডেকে আনতে।
-” খালা আপনি একটু মেহজাকে ডেকে আনতে পারবেন? আমার ছাঁদে যেতে ইচ্ছে করছেনা। ”
ছটফটে সাবিনা কোনোমতে বলল,
-” আফা চুলায় যে রান্না বসায় আইছি। আক্কাস আলী’রে কইছিলাম রান্না দেইখা রাখতে। কিন্তু হেয় তো জানেনই মাথায় ঘিলু নাই। যদি খাওন পুড়ায় ফেলে? আমি একটু রান্নাঘরে যাই আফা? আপনে কষ্ট কইরা একটু ছাঁদে যান। মেহজারেও ডাইকা আনেন সাথে হাওয়া বাতাস লাগায় আহেন শরীলে। তাইলে ভালা লাগবো। ”
সাবিনা ছুটল। কেমন ঝাঁঝালো, পো/ড়া একটা গন্ধ ইতিমধ্যেই নাসারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করে য ন্ত্র ণা দিচ্ছে। মেহতিশা পিছন থেকে নজর সরিয়ে সামনে তাকাল। সিঁড়ি দিয়ে ধীরস্থ পায়ে উঠছে। যতো ছাঁদের কাছাকাছি যাচ্ছে ততোই একটা ভরাট পুরুষালী কন্ঠস্বর তেজী হচ্ছে।
ছাঁদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় মেহতিশা হোঁচট খেয়ে পড়ল মুখ থুবড়ে। শব্দ শুনে সারতাজ, মেহজা দু’জনই পিছন তাকাল। মেহতিশাকে অমন করে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে ছুটে এলো মেহজা। একটু ধীর পায়ে বাদে এলো সারতাজ।
-” কিভাবে পড়ে গেলে আপা? ব্যাথা পেয়েছো? ” মেহজা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলো।
প্রতিত্তোর এলো না মেহতিশার তরফ থেকে। সে ধীর গতীতে উঠে দাঁড়াল। পোশাক থেকে ধূলো ঝাড়তে ব্যাস্ত হলো।
-” আপনার মতো কেয়ারলেস মেয়ে মানুষ আমি আর একটাও দেখিনি। এতো পড়ে – টরে যান কি করে? চোখে ছানি পড়েছে আপনার? ” সারতাজ ব্যাঙ্গ করে বলল।
-” আমি পরে গেলে কিংবা কেয়ারলেস হলে আপনার কি? ” অত্যান্ত রূঢ় শোনাল মেহতিশার কণ্ঠ!
-” আমার কি? কিছুই না! জাস্ট বললাম। আই থিংক আপনি একটু দূর্বল টাইপের মানুষ। তাই শুধু পরে যান ধুপধাপ! আপনাকে একটা মাউন্টেন ডিউ কিনে দিব, ওকে? ”
সারতাজের কথায় কান না দিয়ে মেহতিশা পেছন তাকাল। খুঁজল তার হোঁচট খেয়ে পড়ার উৎস তবে আশানুরূপ কিছু পেল না। কি আশ্চর্য! সে খালি স্থানে হোঁচট খেলো তবে? কিন্তু পা বেঁধেছিল তো কিছুর সঙ্গে। বস্তুটা গেল কোথায়?
-” আপা তো ছোটবেলায় খালি ধামধুম করে পড়ে যেত হাঁটতে গিয়ে। তার জন্য আম্মু কতো ব/কা দিত আপাকে যেন দেখে চলে। কিন্তু আম্মুর ব/কা দেয়া শেষ হলেই আপা আবার হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেত।”
সারতাজ খানিকটা ভাবুক গলায় বলল,
-” ওহ আচ্ছা! তোমার আপার তাহলে হোঁচট খেয়ে পড়া জন্মগত রো/গ। ”
মেহতিশা খোঁজাখুজিঁ বন্ধ করে মেহজার নিকট এসে তাকে ধমকাল,
-” এই মেহজা চুপ! এই রাতের বেলা ছাঁদে এসেছিস কেন আমাকে না বলে? চল বাসায় যাব। ”
-” আপনি আবার মাঝে কথা বলছেন কেন মেহতিশা? জানেন না বড় আর ছোটর কথার সময় মাঝারি জনের চুপ থাকতে হয়? ” ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলো সারতাজ।
হতবিহ্বল হয়ে তাকাল মেহতিশা! মেহজা তাদের দু’জনকে সেখানে রেখে ছাঁদের অন্য প্রান্তে চলে গেল। মেহতিশা কিংবা সারতাজ দু’জনের কেওই আর কোনো কথা বলল না। তাদের মধ্যে পালিত হলো অঘোষিত নীরবতা। কাছের নিমগাছটায় বসে একটা পেঁচা ডাকছে। বাড়ির পিছের জঙ্গল থেকে, থেমে থেমে ডাকছে শিয়াল, হুক্কা হুয়া! সবুজ ডানা জ্বলজ্বল করে উড়ছে ঝোনাক পোকা। অন্তরীক্ষে আজ নজরকাঁড়া চাঁদের বিস্তার।
-” আপনার বাকি দুই ভাই, তারা কি আন্টির অবস্থা জানে না? ” মেহতিশা কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করল।
সারতাজ কেমন উদাস গলায় বলল, ” কে জানে! ওদের সাথে কথা হয়না আমার। শাকিব ভাইয়া হয়ত জানিয়েছে। ”
-” তবুও তারা এলো না! ” মেহতিশার কণ্ঠে বিষ্ময় ঝড়লো।
ভাইদের ফোন দিয়েছিল সারতাজ। কিন্তু কেও তার ফোন তুলেনি। বেশ কয়েকবার, প্রায় কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করেছিল ভাইদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কিন্তু তার চেষ্টা কেবল বৃথা গিয়েছে।
-” আপনি এখন কোথায় বাসা নিয়েছেন মেহতিশা? চলুন পৌঁছে দিয়ে আসি আপনাদের। ”
হুঁশে এলো মেহতিশা। বলে উঠলো, ” কাছেই বাসা। ত্রিশ মিনিটের পথ। আপনার যাওয়া লাগবে না। আমি পারবো। ”
-” উঁহু এটা কি করে হয়? আমার জন্য এলেন এখন আমার একটা দায়িত্ব আছে না আপনাদের প্রতি? ”
-” আমি যেতে পারব। ”
একরোখা জবাব দিয়ে মেহতিশা সামনে পা বাড়াল। চিনচিনে ব্যা থা য় মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠল সে।সেদিন যে পাহাড়ে কা টা বিঁধেছিল তার পায়ে ঠিক সেখানটায় আজ পুনরায় আ ঘা ত লেগেছে। নিচে নজর ফেলতেই দেখা গেল সেখানটা কালশিটে হয়ে আছে। পুনরায় পা ফেলতে নিলে য ন্ত্র ণা টা যেন এবার একটু বেশিই অনুভূত হলো। দৈবাৎ পিছন থেকে এলো সারতাজের চিন্তিত কন্ঠস্বর,
-” আপনি ঠিক আছেন কি? ”
-” হু। ”
সামনে এগিয়ে মেহতিশার পায়ের ক্ষ ত স্থানটা পরখ করলো সে। বলে উঠলো,
-” ঐদিন যে ব্যা থা পেলেন পরে পায়ে আর ড্রেসিং করাননি? ”
মেহতিশা মাথা নাড়িয়ে না জানাল। সারতাজ দম ফেলল। ইচ্ছে করলো তার মেহতিশাকে শা ষ ণ করতে। কিছু কড়া কথা শোনাতে। তবে সে অধিকার কি আর তার আছে?
সে এগিয়ে এলো। বিনা দ্বিধায় মেহতিশার বাহু চেপে ধরে সামনে এগোল। কিয়ৎ কাঁপল মেহতিশা। চমকে বলল,
-” হাত ধরছেন যে? ”
সারতাজ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” হেঁটে যেতে পারবেন? ”
মেহতিশা চুপ রইল। সারতাজ মেহজাকে ডাকতেই মেহজা তাদের দু’জনকে ফেলে ছুটে নিচে চলে গেল। সারতাজ মেহতিশার এক হাত চেপে ধরে সামনে এগোচ্ছে ধীর পায়ে। মেহতিশা নিস্তরঙ্গ! তার অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু এ ছাড়া কি আর উপায় আছে?
হাওয়ায় দুলছে মেহতিশার চুল। কেশের দল বাড়ি খাচ্ছে সারতাজের মুখে। বিরক্ত হলো সারতাজ! সে মেহতিশাকে থামিয়ে বলল,
-” আপনার চুল এতো ডিস্টার্ব করছে..,”
বলতে বলতে সারতাজ এক মুঠো চুল মেহতিশার কানের পিঠে গুঁজে দিলো। অস্বস্তিতে গাটঁ হয়ে রইল মেহতিশা। চন্দ্রাবতীর দেয়া মিহি আলোয় সে চেয়ে দেখল সারতাজকে। সুঠাম দেহের ছিপছিপে গড়ন এর ছেলেটাকে চন্দ্র’রশ্মিতে একটু বেশি স্নিগ্ধ লাগছে কি?
-” চলুন এবার যাই। ”
ম্লান কন্ঠ মেহতিশার কর্ণকুহরে কড়া নাড়তেই নিজের বে হা য়া দৃষ্টি সরালো সে। ভাবতে লাগল কিয়ৎপল পূর্বের নিজের মনের সাং ঘা তি ক কথন! সিঁড়িতে সারতাজের হাত ছেড়ে দিল মেহতিশা ঝট করে। রেলিঙ ধরে আস্তেধীরে নামা ধরল। সারতাজ মেহতিশার আচরণে অবাক হলো! মেয়েটা এভাবে তার হাত ছুঁড়ে দিল? সে বলে উঠলো,
-” আপনাকে আসলে সাহায্য করাই উচিত হয়নি মেয়ে। এভাবে হাত ছাড়ালেন যেন আমি আপনাকে বাজেভাবে স্পর্শ করেছি। ”
জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল সারতাজ। তার যাওয়ার পরপরই মেহতিশার মনে হলো, আসলেই তো! এভাবে আদও কি হাতটা ছুঁড়ে ফেলা উচিত হয়েছে? ছেলেটা তো তাকে সাহায্য করতেই হাত ধরল। তার নিজেরও সম্মতি ছিলো। শেষে এভাবেই কেন তার হাত ছাড়তে হলো? মেহতিশা মনে মনে নিজেকেই আওড়াল, ” তুই একটা নির্বোধ, গাধা মেয়ে মেহতিশা! নূনতম ম্যানার্স নেই তোর মাঝে। ”
চলবে~
ছবিয়াল: আরিফা ইসলাম ❤️#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৩|
সাদিয়া মেহরুজ
কলিংবেল বাজছে অনবরত। তিন, চার পরাপর পাঁচবার বাজল। রাজ্যসম বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলল মেহতিশা। বিছানা হাতড়ে ফোনে সময় দেখল। ন’টা বেজে পঁচিশ মিনিট। শুক্রবার আজ। তাইতো বেলা করে পরে পরে ঘুমোচ্ছিল সে। চুল গুলো হাত’খোঁপা করা শেষে মাথায় ওড়না টেনে দরজা খুলল মেহতিশা। দর্শন মিললো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির, সারতাজ!
-‘ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? সরুন! ভেতরে যেতে দিন। ‘
দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল সারতাজ। পিছন ফিরে একবার তাকালও না। আর না নিলো ভেতরে প্রবেশ করার জন্য মেহতিশার অনুমতি। হন্তদন্ত হয়ে মেহতিশা কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন ছুড়ঁল,
-” কি আশ্চর্য! আপনি এভাবে ব/দ/মা/ই/শ ছেলেদের মতো আমার অনুমতি না নিয়ে আমার ঘরে ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়লেন? ”
বাসাটা ঈগল চোখে পরখ করছিল সারতাজ। প্রশ্ন শ্রবণ মাত্রই সে মেহতিশার নিকট এগোল। দাঁড়াল ওর কাছাকাছি। মাথাটা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” ঠেলেঠুলে? আমি কি আপনাকে ধাক্কা টাক্কা দিয়েছি নাকি ? আপনাকে আমি স্পর্শ পর্যন্ত করিনি এখন অপবাদ দিচ্ছেন ঠেলেঠুলে ঢুকেছি আমি? ”
দরজার সাথে সিঁটিয়ে ছিল মেহতিশা। তার অস্বস্তি হচ্ছে! বিরক্তিকর ছেলেটা তার কাছে এলে কেমন অদ্ভুত হাসঁফাসেঁ জর্জরিত হয় মন, হৃদয়।
-“আবার অসভ্যের মতো ঝুঁকে আছেন দেখি। দূরে সরুন! আর আমি কি আমাকে ঠেলেঠুলে ঢোকার কথা বলেছি নাকি? ” বাম হাত দিয়ে বল প্রয়োগ করে সারতাজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় মেহতিশা।
ঘুমো ঘুমো ফোলা চোখ, হৃদয়স্থল শীতল করা চাহনি সাথে চমৎকার অধর জোড়া ব্যাস্ত ভঙ্গিতে নাড়িয়ে কথা বলা! মেহতিশার এই কার্যক্রম গুলো নিখুঁতভাবে দেখছিল সারতাজ। দেখায় ব্যাঘাত ঘটাল মেহতিশার ধাক্কা। সে তপ্তশ্বাস ফেলে, তারপর অকপটে বলে দেয়,
-” আপনার ঠোঁট দু’টো সুন্দর মেহতিশা। অন্যরকম আকর্ষণ করার মতো সুন্দর। ”
মেহতিশা হতভম্ব! সে টের পেল তার বক্ষঃস্থলের অস্বাভাবিক ওঠানামা, মৃদুমন্দ কম্পন। এই ছেলেটা অকপটে কি অদ্ভুত কথা বলে দিল, আশ্চর্য!
স্থিরচিত্তে ভাবনামত্ত মেহতিশার মস্তিষ্কে রাগ চাপাল হটাৎ সারতাজের বলা পরবর্তী কথা গুলো।
-” কিন্তু আপনার এই সুন্দর ঠোঁট দু’টো দিয়ে বের হয় পৃথিবীর সবথেকে চিপ টাইপ কথাবার্তা। সো স্যাড! ঠোঁট দু’টোর অপমান হচ্ছে আপনার ষ্টুপিড টাইপ কথার জন্য। আপনার কথার মাধ্যমে স্পষ্টত বোঝা গেল আপনি নিজেকেই ঠেলেঠুলে ঢোকার কথা বলছিলেন। ”
শীতল নেত্রজোড়া হটাৎ করে জ্ব/লে উঠলো রাগের প্রকোপে। নিটোল অধর জোড়া তিরতির করে কেঁপে উঠল। মেহতিশা কন্ঠনালী দ্বারা ভারী তিক্ত কিছু কথা উগলে দিবে তৎক্ষনাৎ সারতাজ তাড়া দিয়ে বলল,
-” তো যা বলতে এসেছিলাম। আপনাকে কালকের মধ্যে চট্টগ্রাম উপস্থিত থাকতে হবে। কোর্টে যেতে হবে। অনিকের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে। ভাইয়া ফোন করেছিল আমাকে কালই। আমার ফোন নষ্ট হয়ে যাওয়াতে আপনার বাসায় আসতে হলো। আজ রাতেই চট্টগ্রাম রওনা দিতে হবে, বুঝেছেন? আমি মামার থেকে আপনার জন্য ছুটি চেয়ে নিব। ”
তিক্ত, কঠিন কথা গুলো অবিন্যস্ত হয়ে অনিলে অদৃশ্য হয়ে গেল। অন্তঃকরণে উদয় হলো নতুন চিন্তা। কয়েক প্রহর ভেবে মেহতিশা বলল,
-” কালই যেতে হবে? ”
-” হ্যা। কেন, কোনো সমস্যা? ”
-” মেহজাকে নিয়ে যেতে পারবোনা। ওকে কোথায় রাখব? কাল থেকে তো ওর বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। ”
-” মেহজাকে আমাদের বাসায় নাহয় রেখে যাব? সাবিনা খালা ওকে স্কুলে দিয়ে আসবে। ”
– ” ঠিক আছে। ”
সারতাজ আশপাশে তাকাল। মেহজাকে খুজঁছে সে। ছোট্ট একটা বাসা। দু’টো রুমের বোধহয়। সারতাজ এখন যে রুম দাড়িয়ে, সে রুমটা বিরান। কিছুই নেই তবে এক কোণে দু’টো চেয়ার ছাড়া। অপর ঘরে কি আছে তা আর দেখা যাচ্ছে না। সারতাজকে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে মেহতিশা জিজ্ঞেস করলো,
-” কি খুঁজছেন? ”
-” মেহজা কোথায়? ”
-” পড়ছে। পাশের রুমে। যান। ”
সারতাজ পাশের রুমটায় গেল। সেদিকে আর এগোল না মেহতিশা। চলে এলো রান্নাঘরে। কিয়ৎ সময় চেয়ে রইল শূন্যে। তার মনে উথাল-পাতাল ঢেউ বইছে। চট্টগ্রাম তার অপছন্দের শহর। বাবা – মা সাথে নিজের সুন্দর জীবনটা তো ওখানেই হারিয়েছে সে। সেখানে যাওয়ার কথা উঠলে মন কেমন করে উঠে তার!
ট্রে-তে কিছু খাবার নিয়ে মেহতিশা শয়নকক্ষে এসে দেখল সারতাজ বেশ মনোযোগ সহকারে মেহজাকে কিছু বুঝাচ্ছে। সম্ভবত অঙ্ক ! বিছানার ওপর ট্রে রাখতেই মেহজা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” আপা, ভাইয়া না অনেক সুন্দর করা পড়ায়। এই অঙ্কটা তুমি বুঝিয়ে দেয়ার পরও বুঝতে পারছিলাম না এখন বুঝে গিয়েছি। ”
থমথমে, গুমোট হলো মেহতিশার মুখশ্রী। ভার ভার গলায় সে শুধাল,
-” তার মানে আমি তোমাকে ভালোভাবে পড়াতে পারি না এটাই বুঝাতে চাচ্ছো? ”
মেহজা থতমত খেল। তার আপার মুখশ্রীর রূপরেখা হটাৎ বদলে যেতে দেখে হতবিহ্বল হলো! সে কন্ঠের খাদ নামিয়ে মিনমিন করে বলল,
-” না আপা। এটা তো বলিনি। তুমি ভুল বুঝছ। ”
কপালে সরু বলিরেখার সৃষ্টি করে সারতাজ অদ্ভুত নজরে দেখছিল মেহতিশাকে। এ পর্যায়ে সে মৌনতা ভাঙল,
-” আপনি সবটা সময়, সবটা সময় কথার উল্টো মানে বের করেন কেন বলুন তো? এটাও কি আপনার জন্মগত রোগ নাকি? ভেরি স্যাড! কতো সব অদ্ভুত রোগ নিয়ে আপনি পৃথিবীতে এসেছেন মানুষকে জ্বালাতে। ”
-” আপনি কিন্তু আমাকে অ/প/মা/ন করছেন। ” চাপা গলায় বলল মেহতিশা।
সারতাজ হতাশ হলো ভীষণ! দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে নিজের হতাশা ব্যাক্ত করলো সে।
-” স্যাড! ভেরি স্যাড! নরমাল কথা আপনি কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তা দেখে অবাক হচ্ছি! আমি অবশ্যই আপনাকে অ প মা ন করছি না। আমি তো জাস্ট যুক্তিসই কথা বলছিলাম। ”
মেহতিশা কথা বাড়াল না আর। সে বিছানায় গুটিয়ে রাখা কাঁথা ভাজ করতে আরম্ভ করলো। মুখোশ্রী তার পাংশুটে বর্ণের। দেখে মনে হবে যেন কেও এই মাত্র তাকে আচ্ছা মতোন একচোট ব কে দিয়েছে! থেমে থেমে তপ্তশ্বাস ফেলল মেহতিশা। সারতাজের সাথে কথা বলতে গেলে শুধু ঝ গ ড়া আর তর্কই বেঁধে যায় দু’জনের। কি য ন্ত্র ণা!
মেহজাকে অঙ্ক বোঝানোর পাশাপাশি সারতাজের অবাধ্য, ছটফটে দৃষ্টিপাত বাড়ে বাড়ে গিয়ে আঁটকে যাচ্ছিল মুখ ভার করে রাখা মেহতিশার ওপর। সে সুক্ষ্ম নজরে দেখছিল মেয়েটাকে। দেখছিল তার প্রতিটা পদক্ষেপ, প্রতিটা কার্যক্রম। মেয়েটার অধর জোড়ায় গিয়ে শেষে তার নজর স্থির হলো। বেখেয়াল, আনমনা সারতাজ বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
-” আপনার ঠোঁট দু’টো ভীষণ বে হা য়া মেহতিশা। মনে মনে তাকে এতো ব কা দিলাম তবুও সে তার প্রতি আমার দৃষ্টি আটকাচ্ছে। মানুষের অঙ্গ – প্রতঙ্গের বিচার করার যদি কোনো আদালত থাকত তবে আমি সেই আদালতে আপনার ঠোঁটের নামে আমি মামলা করতাম আমায় বিরক্ত, বেখেয়ালি করে দেয়ার অপরাধে। ”
_
বটতলায় একাকী বসে প্রান্তিকা। হাত ঘড়িতে সময় দেখল সে। ঘড়িতে চারটা বেজে তেইশ মিনিট। কল লিস্টে গিয়ে শাকিবকে ফোন করতে গিয়েও থেমে গেল। ফোন পাশে রেখে সামনে তাকাল। কল করবেনা সে শাকিবকে। পেয়েছেটা কি ঐ ছেলেটা? তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা এভাবে অপেক্ষা করিয়ে কি বোঝায় আসলে? যেদিনই শাকিবের সাথে তার দেখা করার কথা হয় সেদিন প্রান্তিকা সঠিক সময়ে পৌঁছে গেলেও শাকিবের খবর হয় তারও এক কি দেড় ঘন্টা বাদে। মস্তিষ্কে চড়াও হওয়া রাগ নিয়ে যেই সে উঠতে নিবে তৎক্ষনাৎ কালো পোশাকধারী সেই নি ষ্ঠু র, পা ষা ণ ছেলেটা তার পাশে এসে শব্দ করে বসলো।
-” বেশি লেট করে ফেলেছি না? ”
প্রান্তিকা রাগ চেপে কৃত্রিম হেঁসে শুধাল,
-” বেশি না স্যার মাত্র এক ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিট লেট করেছেন। খুবই জলদি এসে পড়লেন যে স্যার। আজ তো আপনার না এলেও হতো। আরেকটু পর আসতেন? ”
শাকিব টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে রাগে কাঁপতে থাকা প্রান্তিকাকে দেখল। দেখতে দেখতেই মৃদু হাসল সে। প্রান্তিকার হটাৎ কি যে হলো! নি ষ্ঠু র ছেলেটার হাসি দেখে তার রাগ নিভে গেল। মন নরম হলো। দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। সে একটু চেপে বসলো শাকিবের সাথে। শাকিবের পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে পা ষা ণ ছেলেটার মুখোশ্রী মুছে দিল যত্ন করে। বলল,
-” এতো ঘেমে আছো কেন? কুকুর তাড়া করেছিল নাকি? ”
-” কুকুর না সোনা, সময় তাড়া করেছিল। ”
ডান হাতটা দিয়ে প্রান্তিকার কোমড় চেপে তাকে কাছে টানল শাকিব। নরম তুলতুলে হাতটা নিজের রুক্ষ হাতের মাঝে আগলে নিয়ে খরখরে ঠোঁট দিয়ে চুমু খেল। তৎক্ষনাৎ ছিটকে হাত সরাল প্রান্তিকা। তেতেঁ উঠে বলল,
-” একদম তোমার ঐ সিগারেট খাওয়া পোড়া ঠোঁট দিয়ে আমায় চুমু খাবেনা শাকিব। ”
শেভ করা দাড়িবিহীন গালে হাত বুলিয়ে নাক উঁচু হাসিটা হাসল শাকিব। প্রান্তিকাকে একদম চেপে ধরল নিজের সাথে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” একশোবার চুমু খাব তোমায় আমি। তোমাকে চুমু খাওয়া আমার স্বামীগত অধিকার। ”
-” চুমু খেতে বারণ করেছি? বলেছি ঐ পোড়া ঠোঁট দিয়ে খাবেনা। সিগারেট’টা ছাড়া যায় না শাকিব? তোমার কি নিজের জীবনের একটুও মায়া নেই? ”
-” নেই তো। ” প্রান্তিকার চুলে নাক ডুবিয়ে শাকিব মোহাবিষ্ট গলায় জবাব দিল।
বিরক্ত হলো প্রান্তিকা। ঠেলে দূরে সরালো তাকে। আশেপাশে তাকিয়ে ওড়না মাথায় দিল। তেমন মানুষ নেই আজ। জনমানবহীন পার্ক।
-” আমাদের বিয়ে কবে হবে? ”
-” বিয়ে তো করলামই কাজি অফিসে। আবার কি? ” ভ্রু নাচিঁয়ে জিজ্ঞেস করল শাকিব।
-” ফ্যামিলিকে জানাবে না নাকি? আমরা কি আর এভাবেই সংসার করতে পারব? দুই পরিবারের একটা মত লাগবে না? ”
শূন্যে তাকিয়ে তপ্তশ্বাস ফেললো শাকিব। তারপর কেমন মলিনতা যুক্ত হলো তার কন্ঠস্বরে।
-” আমার ছোট খালামনি কোমায় প্রান্তিকা বলেছিলাম না? এই অবস্থায় আম্মুকে আমি নির্বোধের মতো নিশ্চয়ই আমার বিয়ের কথা ফ্যামিলিতে বলতে পারবো না। আম্মুর অবস্থা ভালো না। তাছাড়া আমার কাজিন, সারতাজের কথা বলেছিলাম মনে আছে? ”
প্রান্তিকা ভাবুক গলায় প্রতিত্তোর করলো,
-” ঐ যে বাংলাদেশের ফেমাস ফটোগ্রাফারদের মধ্যে একজন? সারতাজ শাহরিয়ার? ”
-” হ্যা। ”
-” তুমি বলেছিলে আমাকে ওনার সাথে দেখা করাবে শাকিব। আমি কতোটা ডেস্পারেট তার সাথে দেখা করার জন্য। ”
-” করাব। ওর মন মানষিকতা এখন ভালো নেই। একটু ইজি হোক দেখা করাবো। ”
-” আচ্ছা যাইহোক তাহলে এখন বিয়ের কথা বলার দরকার নেই। কিছুদিন সময় নাও। আন্টি একটু নরমাল হোক। ”
দু’জন কিছুক্ষণ চুপ রইল। সায়াহ্ন নামতে আর মাত্র কিয়ৎক্ষণ। শেষ বিকেলের ম্লান রোদে দুজন একে অপরের পানে সম্মোহনী চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর আচানক শাকিব তার আর প্রান্তিকার মাঝে থাকা নি ষ্ঠু র দূরত্বটাকে কিছুটা ঘুচিশে দিল। নিম্ন স্বরে মিহি গলায় শুধাল,
-” তোমার ঠোঁট দু’টোতে আজ চুমু খেলাম না প্রান্তিকা। আশপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। পরে তোমার ঠোঁটে চুমু খেলে দেখা যাবে তারা চুমু খাওয়ার দৃশ্যের ছবি তুলে ফেসবুকে ছেড়ে বলছে,
‘ দেখুন দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দেখুন। কিভাবে পাবলিক প্লেসে এক অসহায়, অবলা মেয়েকে চুমু খাচ্ছে। কিন্তু আমরা পাবলিক প্লেসে চুমু খেতে নিলেই তারা আমাদের ধরে ব্যাক সাইড লাল করতে ব্যাস্ত হয়ে যায়। ‘ বুঝেছ? কি ভ য়ং কর ব্যাপার না? পরে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি লাগবে। আমি বেকার হয়ে গেলে তো তোমার বাপ ইহজন্মে আমাকে তোমার সাথে বিয়ে দেবেন না। যেই মীর জাফর বাপ তোমার! ”
প্রান্তিকা মনে মনে একচোট হাসল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
-” খবরদার শাকিব! আমার বাবাকে কিছু বলেছো তো আমিই তোমায় বিয়ে করবো না। আর তোমার চুমু খাওয়ার জন্য ম রে যাচ্ছি মনেহয় এভাবে বলছো। হাহ্! ”
চলবে~
| লিখা গুলো মনঃপুত হচ্ছে না। বিন্যস্ত লেখার খেইঁ হারিয়ে ফেলেছি। লিখতে হবে এই ধরাবাধা নিয়মটার জেরেই হয়ত লিখছি এখন। অবিন্যস্ত লেখা আপনাদের নিকট পেশ করার জন্য মেহরুজ অত্যান্ত দুঃখিত…💔 |