শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব -১৪+১৫

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৪|
সাদিয়া মেহরুজ

শরিফের মৃ ত্যু তে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল কয়েকদিন। একজন এমপি কিভাবে এমন জ/ঘ/ন্যতম অপরাধ করতে পারে সরকারের এরূপ গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তা নিয়ে বেশ তোলপাড় চলেছে দেশে। জুই এবং শরিফের করা কর্মকাণ্ড পুরো দেশের সামনে উঠে এসেছে। সবার সামনে এ তথ্য আনতে সাহায্য করেছে সারতাজ, শাকিব সাথে সাংবাদিকেরা। সারতাজ ভীষণ করে চাইত তার বাবার এই নি ষ্ঠু র, নি র্ম ম আচরণ সকলের সামনে উঠে আসুক। চিনুক সকলে শরিফের ভালো মানুষ রূপী চেহারার আড়ালের নি কৃ ষ্ট রূপটা! শরিফের মুখোশ উন্মোচন হওয়ার পর সরকারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। কারণ দেশের সকল মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল প্রতিটি জেলা থেকে শুরু করে মফস্বলে। সারতাজকেও ভালোই দৌড়াদৌড়ির ওপর থাকতে হয়েছে ক’দিন। তবে তা বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। চূড়ান্ত শুনানি হয়েছিল দ্রুতই। শরিফের সাথে জড়িত অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আ ট ক করে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ছোটাছুটি থেকে মুক্তি মিলেছে সারতাজের। তবে অনিকের বিষয়টাতে তারও সাক্ষ্য প্রয়োজন। তাই পুনরায় এই আইনের দোরগোড়ায় তার উপস্থিতি।

সাবিনার সাথে কথা বলে মাত্রই ফোন কে টে ব্যাগে পুরলো মেহতিশা। এগোল সম্মুখে। সারতাজ বিরান পার্কটায় একাকী বসে বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে। কেন যেন মেহতিশার সারতাজের নিকট যেতে ইচ্ছে হলো না। লোকটার কাছে গেলেই শুধু তর্ক লাগে দু’জনের অযথাই। সারতাজ এমনই সব উটকো কথা বলে তাকে রাগিয়ে দেয় যে কথা না বলে থাকাই যায় না!

-” আপনি এখানে দাঁড়িয়ে যে? ”

মেহতিশা পিছন ফিরে হকচকাল! লহমায় এই লোক ওখান থেকে এতোটা দূর এতো দ্রুত কি করে এসে পড়লো? আশ্চর্য!

-” কথা বলছেন না কেন মেয়ে? আমি আরো ওয়েট করছিলাম ওখানে বসে বসে আপনার জন্য। ” কিয়ৎ অধৈর্য শোনাল সারতাজের গলা।

মেহতিশা বলে উঠলো, ” অপেক্ষা করছিলেন কেন?”

-” অদ্ভুত প্রশ্ন! কোর্টে যেতে হবে না নাকি? ”
-” এখনি? আপনি না বললেন সাড়ে দশটায়? মাত্র তো ন’টা বাজল। ”
-” কোর্ট দূরে। আমাদের এখনি রওনা দিতে হবে। নয়ত পৌঁছাতে সময় লাগবে। ”

চটজলদি ঠিকানা মনে করলো মেহতিশা। পরক্ষণেই নিজের কপাল চাপড়াল সারতাজের অগোচরে। সে এতোটা বেখেয়ালি কবে হলো? এখানে তার জন্ম, পুরো চট্টগ্রাম তার চষে বেড়ানো অথচ সে ঠিকানা, স্থান ভুলে বসল মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে? অদ্ভুত!

-” স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়েই থাকবেন? আমি কি জজ কে এখানে বিচার করতে ডাকব মেয়ে? হু? ডাকব? ”

প্রতিত্তোর না করে হাঁটা ধরল মেহতিশা। বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে এলো তার তপ্তশ্বাস। সবটা সময় ছেলেটার ত্যাড়া কথা!

গাড়ি নিয়ে শাকিব নিজেই উপস্থিত হলো মিনিট পাঁচেক বাদে। শাকিব এগিয়ে এলো তাদের কাছে। মিষ্টি হেঁসে মেহতিশাকে প্রশ্ন করলো,

-” ভালো আছো আপু? ”
-” জি ভাইয়া। আপনি ভালো আছেন? ”
-” আলহামদুলিল্লাহ আছি। ”

শাকিব উত্তর দিয়ে সারতাজের পানে তাকাল। সে দেখল ভ্রুকুটি কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে সারতাজ। তার কাছে গিয়ে হাত টেনে শাকিব হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো,

-” এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন সেন্টি? ”

সারতাজ একটু অদ্ভুত গলায় শুধাল, ” এতোটা ঢং করে রঙচঙ মেখে তো তুমি আমাকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করলে না ‘ কেমন আছি? ‘। ”

শাকিব শব্দযোগে হাসল। সারতাজের পিঠে তার শক্ত হাতের চাপড় পড়ল।

-” তোকে আর কি জিজ্ঞেস করবো? তুই তো সেন্টি, তাই সবসময় সেন্টির মতোই মুখ বানিয়ে রাখিস। তোকে আলাদা করে কেন জিজ্ঞেস করবো কেমন আছিস? বিষয়টা ফর্মালিটি মেইনটেইন টাইপ হয়ে গেল না? ফর্মালিটি মেইনটেইন মানতে পারবা তুমি!”

মৌন রইল সারতাজ। শাকিব নানান কথা বলছিল। শাকিবের কথা আবছা আবছা কর্ণকুহরে প্রবেশ করিয়ে ঘন ঘন পিছন ফিরে তাকাচ্ছে সারতাজ। মেহতিশা তাদের পেছনে। বেশ আস্তে ধীরে হাঁটছে মেয়েটা। ললাটে চামড়ার সাড়ি সাড়ি ভাজ সৃষ্টি করে সারতাজ। মেহতিশা এতো ধীরে হাঁটছে কেন? আবারও ব্যা থা পেয়ে বসল কি? মেয়েটার তো নিজের প্রতি বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই!

-” এতো পিছনে ঘুরে কাকে দেখছিস? ”
-” মেহতিশাকে। ”

শাকিব এ পর্যায়ে যারপরনাই অবাক হলো! বলল,

-” মেহতিশাকে! কেন? ”
-” কতোটা আস্তে হাঁটছে। আবারও আজকে ব্যা থা পেয়েছে কিনা কে জানে। ওনার নিজের প্রতি বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই। ”

শাকিব বিস্মিত! নেত্রযুগল বড়সড় হলো তার।

-” তাতে তোর কি? ইদানীং খেয়াল করেছি তুই মেয়েটার ব্যাপারে একটু বেশিই কনসার্ন। কাহিনি কিন্তু ভালো ঠেকছে না। ”

শাকিবের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে সারতাজ কেবল নির্লিপ্ত রইল। টু শব্দ অব্দি করলো না।

_

আদালতের কার্যক্রম শেষ হলো বেলা বারোটার দিকে।পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য হয়েছে সামনের মাসের আঠাশ তারিখ। কিছু বিষয় অস্পষ্ট ছিল বিধায় বিচারক সে বিষয়ে র‌্যাবকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।মেহতিশাকে একটু হতাশ দেখাল! তা লক্ষ্য করে শাকিব সাহস দিলো তাকে।

-” বি স্ট্রং মেহতিশা! হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে আপনি কি আর এতো সহজে মামলার রায় পেয়ে যাবেন? ভরসা রাখুন। সকল প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। কেসে আমরাই জিতবো। পরবর্তী শুনানির পর আশা করছি আর আপনাকে কোর্টে আসতে হবে না। ঐটাই হবে শেষ শুনানি। ”

মেহতিশা মাথা নাড়ল। সারতাজ এসে দাঁড়িয়েছে মাত্রই। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে মেহতিশা বলল,

-” ভাইয়া একটা হেল্পের দরকার ছিলো। ”

শাকিব মেহতিশার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। অভয় দিয়ে বলল,

-” বলো আপু। নির্দ্বিধায় বলো। যদি সম্ভব হয় তো হেল্প করার চেষ্টা করবো। ”
-” অনিকের সাথে আমার তালাকটা মুখে হয়েছিল। আমি ওকে তিন তালাক মুখে বলেছিলাম কিন্তু এখন চাচ্ছি ডিভোর্সটা যদি অফিশিয়ালি হয়ে যেত তাহলে ভালো হতো। একটু যদি হেল্প করতেন এই বিষয়ে। ”
-” আমি দেখছি ব্যাপারটা। চিন্তা করো না সবকিছু বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। ”

অনিককে সেই মূর্হতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জে লে। মেহতিশা তাকাল একবার। দেখল বি ধ্ব স্ত অনিককে। চোখের নিচে কালশিটে ভাব। শরীর ভেঙে গিয়েছে। সুদর্শন ভাবটা আর নেই ওর মাঝে। দূর থেকে অনিক চোখ দিয়ে শাসাচ্ছিলো তাকে। মেহতিশা তাচ্ছিল্যের হাসিঁ দিলো! জে লে গিয়ে, শত মা র খেয়েও অ/স/ভ্যটার শিক্ষা হয়নি। জনসম্মুখে কেমন চোখ রাঙাচ্ছে! সারতাজ অনিকের আচরণ দেখে ঠোঁট বাঁকাল। বলল,

-” মা/র – টার দাও না ভাই? এতো সাহস পায় কি করে? সবার সামনে কিভাবে তাকাচ্ছে। উল্টোপাল্টা কথা বলছে। ”

হু মকি দিচ্ছিল অনিক মেহতিশা আর সারতাজকে। শাকিব কঠোর চোখে তাকাল। দ্রুত ওকে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলো। তারপর ভারী বিরক্তি নিয়ে শুধাল,

-” গন্ডারের চামড়া! মা/র/লে আ র্ত না দ অবদি করে না। হাসতে থাকে। একে আজ কড়া ডোজ দিতে হবে। ”

সারতাজ হাই তুলল, ” পারলে ভিডিও সেন্ড করে দিও। পপকর্ন খেতে খেতে লাইভ থ্রিল মুভি দেখব।”

শাকিব হাসল! সাথে যোগ দিল মেহতিশা। পাথরের মতোন মূর্তি রূপে থাকা তার অধরে বহুদিন পর হাসির রেখা যুক্ত হলো।
সারতাজ হটাৎ তাড়া দিয়ে উঠলো,

-” অনেকদিন খালামনির সাথে দেখা হয়না। রাতে তো চলে যাবো এখন চলো তোমার বাসায় যাই। তুমি এখন ফ্রী না ভাইয়া? ”
-” ফ্রী-ই আছি। চল যাই। আম্মু বারবার বলেছে তোকে সঙ্গে করে বাসায় ফিরতে। ”

তিনজন গাড়িতে চড়ল। মেহতিশার কিয়ৎ অস্বস্তি হচ্ছে। সারতাজের খালামনির বাসায় সে গিয়ে কি করবে? কথাটা সারতাজকে বলেছেও। কাজ হয়নি। এদিকে মাত্র বাজে বেলা বারোটা। রাতের ট্রেনে ফিরবে ঢাকা। এতক্ষণ থাকবেই বা কোথায়? তার কোনো আত্নীয়-স্বজন নেই। হোটেলে থাকার মতো টাকাও নেই। এদিকে হুট করে সারতাজের খালার বাসায় যেতেও অস্বস্তি হচ্ছে। কি মুশকিল!
শাকিবের বাসায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। মাত্র বিশ মিনিটের ব্যাবধানে পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

-” শাকিব! মেয়েটা কে? তুই আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে এনেছিস? ” ঝাঝাঁল নারী কন্ঠস্বর।

তারা পেছন তাকাল। শাকিবের মা দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টিতে যেন আ গু ন ঝড়ছে। হতভম্ব মেহতিশা বাকি দু’জনের দিকে তাকাল। শাকিব, সারতাজকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল অতঃপর সারতাজ মেহতিশার নিকট এসে চটজলদি শুধাল,

-” মেহতিশা চলুন আমরা বাহিরে যাই। ”

নির্লিপ্ত থেকে মেহতিশা তাই করল। বাহিরে এলো দু’জন। পরবর্তীতে মেহতিশার প্রশ্ন করার পূর্বে সারতাজ নিজেই তার কাঙ্ক্ষিত বার্তা পেশ করল,

-” বড় খালামনির একটু মানষিক সমস্যা আছে মেহতিশা। শাকিব ভাইয়ার বাবা মা রা যাওয়ার পরই তার এই হাল! আঙ্কেলের মৃ ত্যুটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তার ওপর আম্মুর অবস্থা। খালার মানষিক অবস্থা উন্নতির থেকে অবনতি হয়েছে। তিনি বেশ সন্দেহপ্রবন, ভুলোমনা আর রগচটা হয়ে গেছেন। ”

মেহতিশা কিয়ৎক্ষণ চুপ রইল। প্রশ্ন করলো,

-” ডাক্তার দেখাননি? ”
-” দেখিয়েছি। চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার সাজেস্ট করেছিল রিহ্যাবে পাঠাতে কিন্তু ভাইয়া রাজি না। ”

ভেতর থেকে চেচামেচির শব্দ আসছে। মেহতিশা একবার সেদিকে তাকিয়ে সামনে চলল। শাকিবকে কতোটা প্রাণোচ্ছল দেখায় সর্বদা। অথচ ছেলেটা মনের ভিতর পুষে রেখেছে নিদারুণ য ন্ত্র ণা! সব মানুষের মাঝেই তবে বিষন্নতা লুকিয়ে থাকে? প্রকৃত সুখী কি কেও নয়?
অদূরে হাত নাড়াচ্ছে সারতাজ। বোধহয় মেহতিশা কে ডাকছে। মেহতিশা এগোল। ভাবল আদতে কি কেও পূর্ণ রূপে এই ত্রি-ভূবনে সুখী?

চলবে~#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৫|
সাদিয়া মেহরুজ

মেহতিশা নত মস্তকে নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল। হাসির শব্দে মাথা তুলে তাকাল ও। শায়লা সারতাজকে খাইয়ে দিচ্ছিল তখন। বড্ড প্রাণবন্ত, স্বাভাবিক দেখাচ্ছে তাকে। কিয়ৎ পূর্বে যেই অস্বাভাবিকতার বিচরণ তার মুখোশ্রী জুড়ে ছিল তা এখন বিলীন। ভদ্রমহিলা বর্তমানে কি সুন্দর মিষ্টি গলায় কথা বলছে, হাসছে। কিন্তু কয়েক প্রহর পূর্বে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো অদ্ভুত রণচণ্ডী ব্যাক্তি। অথচ এখন কতোটাই না স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। তিনবারের মাথায় শায়লা মেহতিশাকে পুনরায় বলল,

-” কিছুই তো খাচ্ছো না মেহতিশা। অতটুকু ভাত নিয়ে বসে আছো কেন? দেখি প্লেট দাও তো। ”

বাক্যের সমাপ্তি টেনে শায়লা নিজ হাতে টেনে নিল মেহতিশার প্লেট। পুনরায় দিলো দুই চামচ ভাত সাথে সবজি ও তিন টুকরো মুরগীর মাং স। মেহতিশাকে এই পর্যায়ে বড্ড অসহায় দেখাল। শায়লা তাকে এ নিয়ে তিনবার খাবার দিলো। ভদ্রমহিলা ভুলোমনা! মনে রাখতে পারেন না ক্ষণিকের ঘটনা। মেহতিশা পড়েছে মহাবি প দে! সে অসহায় চোখে তাকাল তার হতে কিছুটা দূরে বসা থাকা সারতাজের পানে। আর সঙ্গে সঙ্গে দেখল কি? অস ভ্য ছেলেটা ঠোঁট চেপে হাসছে। কতোবড় খা/রা/প ভাবা যায়? তপ্ত শ্বাস ফেলল মেহতিশা। শাকিব ওপরে যাওয়ার আগে বেশ বিনম্র গলায় তাকে বলে গিয়েছে,

-” সারতাজ হয়তো মায়ের ব্যাপারটা তোমায় খুলে বলেছে মেহতিশা। আমি একটু ওপরে যাচ্ছি। মা’র সাথে কথা বললে তুমি একটু সাবধানে কথা বলো কেমন? উনি মূর্হতের বলা কথা ভুলে যান। তোমাকে ঐ পিছের ঘটনা যা তিনি ভুলে গেছেন সেটা মনে করানো যাবেনা। এতে আম্মুর ব্রেনে চাপ পড়বে। তা নিয়ে সমস্যা হবে ওনার। পিছে যা বলল তা যদি পরে ভুলে যায় সেই কথাটা স্কিপ করে যেও কেমন?”

শাকিবের ব্যাক্ত করা অনুরোধে মেহতিশা ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়েছিল। ভেবেছিল এ আর তেমন কি কঠিন ব্যাপার? কিন্তু সে কি আর জানত নাকি তার জন্য সামনে কি ধরনের বি/প/দ ঘাপটি মে/রে বসে আছে? জানলে কক্ষনোই শাকিবটাকে ওপরে যেতে দিত না। শাকিব সারতাজকে যদিও দেখতে বলেছিল। কিন্তু ঐ বে/য়া/দ/ব ছেলেটা তো তাকে সাহায্য না করে উল্টো তার পরিস্থিতি দেখে হেঁসে ম/র/ছে! মেহতিশা একটুখানি চেষ্টা করেছিল শায়লাকে মনে করানোর যে, তিনি একটু আগেই মেহতিশাকে দু’বার খাবার দিয়েছেন। কিন্তু তার মনে পড়লে তো। হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল মেহতিশা। ভাত নাড়াচাড়া করল কিন্তু মুখে দিলো না। ভাবল সে শাকিবের কথা। ছেলেটা তার মাকে সামলায় কি করে?

খাওয়ার পর্ব শেষ হলো শাকিবের উপস্থিতির পর। মেহতিশা হাত ধুচ্ছিল বেসিনে। শাকিব সারতাজকে কড়া চোখে চেয়ে এগোল মেহতিশার পানে। কন্ঠের স্বর খাদে নামিয়ে আহত স্বরে বলল,

-” তোমাকে ক ষ্ট দিয়ে ফেললাম বোধহয় মেহতিশা, তাই না? সারতাজ এমনটা করবে বুঝতে পারিনি। ও মাকে সামলাতে পারে তাই ভেবেছিলাম ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করে নিবে কিন্তু,.. ”

মেহতিশা মাঝে থামাল শাকিবকে, ” ইট’স ওকে ভাইয়া। এই ছোট্ট ব্যাপার নিয়ে আপনার এভাবে বলার দরকার নেই। আমি বুঝতে পেরেছি। ”

-” এসো তোমাকে তোমার রুম দেখিয়ে দেই। একটু রেস্ট করো। রাতেই তো তোমাদের ট্রেন। ”

মেহতিশাকে ওর রুমে ছেড়ে শাকিব এলো তার রুমে। সারতাজ ওর রুমেই ছিলো। নোটপ্যাড ঘাটছিল। শাকিব গিয়ে তার পিঠে থা/প্প/ড় দিলো। বলল,

-” এই শা/লা তোকে না বললাম মাকে দেখিস। অযথা মেহতিশাকে ক ষ্ট দিলি। ”

সারতাজ আধশোয়া থেকে সটান হলো। ব্যাঙ্গ করে বলল,

-” তাতে তোমার কি? ক ষ্ট হচ্ছে নাকি কোথাও? কাহিনি তো ভালো না ভাই। ”

শাকিব কড়া দৃষ্টিতে তাকাল, ” এই সবটা সময় খালি উল্টাপাল্টা কথা বলস কেন তুই? ভালো কথা মুখ দিয়ে বের হয়না? আমার বউ আছে বউ। বিয়ে ডান আমার। ”

শাকিব সারতাজের পাশ থেকে সরে এলো। কাজ আছে তার। ভেজা চুলগুলো মুছে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,

-” আমি বাহিরে যাচ্ছি। রাতে কথা হবে। মেয়েটাকে জ্বালাস না। ”

সারতাজ চেঁচাল, ” এভাবে বলছো যেন ওকে আমি চব্বিশটা ঘন্টা জ্বালিয়ে মা/রি। ”

শাকিব শুনেনি সারতাজের কথা৷ সে ততক্ষণে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। সারতাজ উঠে দাঁড়াল। বসে বসে কি করবে ভেবে না পেয়ে চলল মেহতিশার জন্য বরাদ্দকৃত রুমটার পানে। মেয়েটাকে একটু রাগিয়ে আসা যাক? তাহলে সময়টাও কে/টে যাবে।

_

-” এই ফুল চোর, এই! ”

কালো গোলাপটা মাত্র ফুটেছে। ফুলটার প্রতি নজর মাত্রই পড়েছিল মেহতিশার অমনিই ছুটে এলো। ও কালো গোলাপের নাম শুনেছে কিন্তু বাস্তবে কখনো দেখেনি। তাই তো এতোটা উৎসাহ নিয়ে ছুটে আসা। তবে ফুলটা ছুঁয়ে দিতেই পেছন থেকে চেঁচাল এক পুরুষ! মেহতিশা জানে পুরুষটা সারতাজ।

-” আপনি ফুল ছিঁড়ছিলেন কেন? ” একটু কঠিন শোনাল সারতাজের কন্ঠ।

পূর্ণরূপে সটান হলো মেহতিশা। তাকাল সারতাজের পানে। বিরক্তিভাব ইতিমধ্যে তার বদনে ভেসে উঠেছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে ও বলে উঠলো,

-” ফুল ছিঁড়ছি তার প্রমাণ? ”
-” প্রমান আপনার হাত নিজেই। আপনার হাত এমন ভাবে ফুলটা ধরেছিল দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল আপনি ফুলটা ছিঁড়ছেন। ”

অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হলো মেহতিশার তবে সে নিজেকে সংযত করে নম্র গলায় বলল,

-” এটা আপনার দেখার ভুল। আমি শুধুমাত্র ফুলটা ছুঁয়ে দেখছিলাম। ”
-” দেখার ভুল? আপনি কি ইনডায়রেক্টলি আমায় অন্ধ বললেন? ”
-” অন্ধ কেন বলতে যাব? আমি তো বলেছি দেখার ভুল। মানুষের দেখতে ভুল হতেই পারে। মানুষ মাত্রই তো ভুল! ”

হতাশ সারতাজ! মেয়েটা আজ এতো কোমল কন্ঠে, স্বাভাবিক রূপে কথা বলছে কেন? স্বভাববশত তো তার এখন একটু চড়া গলায় সারতাজকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেয়া উচিত যা সে সর্বদা করে। কিন্তু আজ মেহতিশাকে বড্ড শান্ত দেখাচ্ছে। শান্ত মানুষের সাথে কি আর তর্ক করা যায়? উঁহু!

বিশুদ্ধ বাতাবরণে চঞ্চল হাওয়াদের অবাধ বিচরণ। দমকা হাওয়া থেমে থেমে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে দৈত্যের মতো গাছগুলোকে। গাছগুলো দুলছে, যেন নৃত্য করছে তারা। শব্দ হচ্ছে, শা শা! পাখিদের তারস্বরে কিচিরমিচিরে মুখরিত নভোমণ্ডল। পশ্চিম আকাশ রক্তিমাভ। যেনো আগুন লেগেছে অম্বরে। সূর্যের দেখা নেই। সে ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছে ধরনী হতে। জানুয়ারির শেষ দিক হওয়ায় শীতটায় কমে এসেছে প্রায়। সারতাজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মেহতিশা পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখায় মত্ত হলো।

-” আপনি কখনো প্রেমে পড়েছেন মেহতিশা? ”

সারতাজ মেহতিশার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অদ্ভুত প্রশ্নটা শ্রবণ মাত্রই মেহতিশা হকচকাল! আড় দৃষ্টে তাকাল পাশে। তার অন্তরালে মরিচা পড়া দুঃখের বাক্সটা একটু নড়বড়ে হলো। মনে পড়লো অতীত। সে অতীত যা তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে অথৈ তমসায় ডুবিয়ে মে/রে/ছিল। মেহতিশা মরা গলায় আনমনে শুধাল,

-” প্রেমে পড়িনি তবে একজনের প্রতি ভালোলাগা ছিলো। ”

বি/ষা/ক্ত দমকা হাওয়া যেন ছুঁয়ে দিল সারতাজকে আলত করে। তার মন কেমন করে উঠল। তৎপর সে ধাতস্থ করল নিজেকে। মেহতিশা কে হয় তার? কেও না! তাহলে সে প্রেম করলে তার কি? কিচ্ছুটি না। এসব বলে কয়ে সারতাজ স্বাভাবিক হলো। অলিন্দে পাতা চেয়ারে আয়েশ করে বসে বলল,

-” আপনার মতো ঝগড়াটে মেয়ের কারো প্রতি ভালোলাগা তৈরি হতে পারে? আই কান্ট বিলিভ! ডিটেইলস বলুন তো। ”

নিজেতে নেই মেহতিশা। তার আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা জড়তা, সংকোচ, দ্বিধার দেয়াল সারতাজের সামনে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। মেয়েটা বেখেয়ালি কন্ঠে বলতে লাগল,

-” আমার বাবা – মা দু’জনেই মা রা যান যখন তখন আমি সদ্য এইচএসসি পাশ করেছি। তারা মা রা যাওয়ার পরই আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাই। মেহজাকে ফুপির কাছে চট্টগ্রামে রেখে আমি ঢাকায় টিউশনি করিয়ে পড়াশোনা করতাম। তখন মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আমার এক ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হলো। বোকাসোকা টাইপের ছেলেটা। ক্লাসে কারো সাথে মিশতো না। ইন্ট্রোভার্ট সাথে তোতলা টাইপের ছিলো বলে কারো সাথে লজ্জায় মিশতে চাইত না। ওর সাথে কিভাবে যেন আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বন্ধুত্বের একটা বছর ছুঁই ছুঁই তখন বুঝলাম তার প্রতি আমার বন্ধুত্ব এক ধাপ এগিয়ে ভালোলাগা সৃষ্টি হয়েছে। ছেলেটা আমায় প্রপোজ করল। প্রপোজ এক্সেপ্ট করিনি কারণ নিজের অবস্থানের জন্য। ছেলেটা তবুও ছ্যাচড়ার মতো আমার পেছন পড়ে থাকত। আমি আমাদের মাঝে তখন দূরত্ব সৃষ্টি করলাম। এভাবেই চলল বাকি দিন গুলো। ওর আমাকে প্রতিনিয়ত জ্বালানো, প্রেমের বার্তা বলা। এভাবেই কা/টছিলো। আমি মুখ বুঁজে ছিলাম শুধু পড়াশোনাটা শেষ হওয়ার খাতিরে। ওর প্রতি আমার মায়া হতো। কিন্তু কিছু করার ছিলোনা।
একবছর পার হয়ে যাওয়ার পর একসময় খেয়াল করলাম ও আর ভার্সিটিতে আসছে না, আমাকে জ্বালাচ্ছে না। আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম কিন্তু ভেতরে ভেতরে মন ছিল উচাটন! বড্ড জানতে ইচ্ছে হতো হটাৎ কই গায়েভ হলো ও? পরে ধরে নিয়েছিলাম হয়ত ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে। তবে আমার ধারণা ভুল ছিলো। ২১ ফেব্রুয়ারী সেদিন। ভার্সিটিতে ফাংশন ছিলো। প্রায় তিনটা মাস পর আমি সেদিন ওকে দেখেছিলাম।কি যে খারাপ অবস্থা ছিলো ছেলেটার। ও আমার সাথে একান্ত কথা বলতে চাইল আমি দেখা করতে যাই। নির্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও প্রথম সেদিন আমায় ছুঁয়েছিল। আমার হাত ধরে কাতর গলায় বলেছিল, ‘ তুমি আমার এক না হওয়া প্রিয় মানুষ মেহতিশা। তুমি আমার না হওয়া সুখ। আমার না হওয়া বউ। তোমাকে বড্ড বউ ডাকার ইচ্ছে ছিল তবে সৃষ্টিকর্তা বোধহয় তোমায় আমার ভাগে লিখে রাখেনি। তুমি বোধহয় অন্য কারো জন্য এই পৃথিবীতে এসেছ আমার জন্য না। ‘ ঐটাই ছিল ওর সাথে আমার শেষ কথা। শেষ দেখা। আমার হাতে আচানক চুমু খেয়ে ছুটে চলে গিয়েছিল। কদিন পর জানতে পারি মা রা গেছে ও। থ্যালাসেমিয়া রো গ ছিল। মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল রো গ টা। ”

সারতাজ নির্লিপ্ততা ভাঙল, ” আপনি কি ওকে ভালোবাসতেন? ”

-” জানিনা। কিন্তু ওকে আমি ভুলতে পারিনি, হয়ত পারবোও না। অপরাধবোধ কাজ করে আমার। আমি কি পারতাম না ওর হতে? ”

লম্বা পা ফেলে এগোল সারতাজ। মেহতিশার বরাবর দাঁড়াল সে। বলল,

-” না! আপনি ওর হতে পারেন না। কারণ আপনি অন্যকারো। ”

মেহতিশার ঘোর কা ট ল। সে চটজলদি ওদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করল।
সারতাজকে অন্যরকম লাগছে কি? ছেলেটার দৃষ্টিও আলাদা। কেমন যেন গা কাঁপিয়ে দেয় সে দৃষ্টিপাত। মেহতিশা অবুঝ কিংবা নির্বোধ নয়। পঁচিশটা বছর পার করে এসেছে সে। এই দৃষ্টির অর্থ জানে ও। ভ য় হলো তার! জড়তা নিয়ে জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল লহমায়।

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here