শিশিরের বিন্দু পর্ব ১৯

শিশিরের বিন্দু
১৯ তম পর্ব

শিশির খালি গায়ে টাওয়াল পরে দরজা খুলেই দেখে বিপ্লব এসে হাজির৷ শিশির চোখ মুখ আগুন করে বলল,
___ ” তোর আর আবিরের সমস্যা কি আমারে একটু বল তো? একটু বউয়ের সাথে রোমান্সও করতে দিবি না নাকি? ”
___ ” এই টাইমে তুই রোমান্স করতেছিলি নাকি?”
বিপ্লব অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল। শিশির আর কথা না বাড়িয়েই বলল,
___ ” কি জন্য এসেছিস তাই বল?”
___ ” সবাই মিলে মুসলিম হোটেলে খেতে যাব তাই তাড়াতাড়ি রেডি হওয়ার জন্য বলতে এসেছি। কিন্তু যে অবস্থা তাতে তুই তো মনে হয় যেতেই পারবি না খেতে “।
বিপ্লব ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল। শিশির ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুরেই দেখলো বিন্দু বেরিয়ে এসেছে। টাওয়াল পরেই বেরিয়ে এসেছে বিন্দু কাপড় নিয়ে ঢোকে নি তাই এই দশা। শিশির ধীর পায়ে বিন্দুর দিকে আগাতে বিন্দু কাপড় টেনে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে যেয়ে দরজা দিল। শিশির দুঃখের ঠেলায় নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়তে লাগল। একটু শান্তি মত রোমান্সও করতে পারে না বউয়ের সাথে। বিন্দু কাপড় পরে বের হতেই শিশির মুখ অন্ধকার করে শাওয়ার নিতে ঢুকলো। রেডি হয়ে যখন ওরা ভারী শীত পোষাক পরে চলল রাতের খাবার খেতে তখন প্রায় সাতটা বেজে গেছে। ওদের হোটেলের পাশেই ছোট্ট একটা খাবার হোটেল আছে। যেহেতু শ্রীনগর সহ পুরো কাশ্মীরই মুসলিম অধ্যুষিত তাই মুসলিম হোটেল পেতে ওদের আর দেরি হয় নি। হোটেলে ঢুকেই গরুর মাংস, চানা ডাল ভূনা, সবজি, দম আলু আর সাদা ভাতের অর্ডার করল ওরা। বিন্দু খেয়াল করল সবাই হাসাহাসি করে কথা বললেও শিশির কেমন জানি চুপ হয়ে আছে। বিন্দু শিশিরের হাত ধরতেই ওর হাত আস্তে করে সরিয়ে দিল শিশির। বিন্দু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। সবাই গরুর মাংস খেয়ে তারিফ করল। ধোঁয়া উঠা ভাতের সাথে ঝাল ঝাল গরুর মাংসের তুলনাই হয় না। খাওয়া শেষে ওরা আবার হোটেলে ফিরল। কালকে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বের হতে হবে তাই যে যার রুমে চলে গেল। বিন্দু রুমে ঢোকার পরেই শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” আপনার কি হয়েছে, আমার সাথে রাগ করেছেন আপনি?”
শিশির কোন উওর না দিয়েই ড্রেস চেঞ্জ করে শুয়ে পড়ল। বিন্দুর যেন বুক ভেঙ্গে যেতে লাগল। শিশিরের এই রুপ ও আগে কখনও তো দেখে নি। এমন করছে কেন শিশির। বিন্দু বিছানায় না শুয়ে সোফায় পা উঠিয়ে বসে রইল চুপ করে। ভাবতে লাগল ও করেছেটা কি। রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইল বিন্দু। ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে গেছে ওর সেটা ও নিজেও জানে না। একটু পরেই টের পেল ওর কানের কাছে ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ বিন্দু বুঝলো যে শিশির এসেছে। শিশির আস্তে করে ওকে কোলে তুলে নিল ও ভেবেছে বিন্দু ঘুমিয়ে গিয়েছে। এই মেয়েটাতে ভয়ংকর নেশা হয়ে গেছে ওর। বিন্দুকে ছাড়া ঘুমই আসে না ওর। সোজা বিন্দুকে বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়ে কম্বল টেনে দিল গলা পর্যন্ত। বিন্দুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কি মনে করে বিন্দুর মুখের উপরে ফোনের লাইট মারল ও। বিন্দুর চোখ থেকে তখন এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। বিন্দু ঘুরে শিশিরকে শক্ত করে জাপটে ধরল। শিশির বুঝতে পারল যে ওর রাগ দেখানোর কারনে মেয়েটা এতটা কষ্ট পেয়েছে। ও নরম স্বরে বিন্দুকে বলতে লাগল,
____ ” রাগ করো না বিন্দু কি করব আমি? যখনই তোমাকে একটু আদর করতে মন চায় হয় কেউ চলে আসে না হয় তুমি পালিয়ে যাও। আমিও তো এক্কটা মানুষ রাগ তো আমারও হতে পারে তাই না? ”
___ ” রাগ কর মারো কাটো কোন আপত্তি নেই কিন্তু আমাকে ইগনোর করবে না এই বলে দিলাম “।
চোখ ভরা পানি নিয়ে কোন মতে বলল বিন্দু। শিশির শক্ত করে বিন্দুকে জড়িয়ে ধরল। আর বিন্দুও শিশিরের বুকের একরাশ পশমে নাক ডুব্যলো। শিশির বিন্দুর কানের কাছে মুখ এনে বলল,
____ ” চলো না আজকে একসাথে ভিজি দুজনে “।
___ ” এই ঠান্ডার ভিতরে কে ভিজবে “।
বিন্দু অবাক চোখে প্রশ্ন করল। শিশির বিন্দুর নাকে নাক ঘসে বলল,
___ ” ভালবাসার বৃষ্টিতে ভিজবো “।

পরের দিন সকালে এলার্মের শব্দে বিন্দুর ঘুম ভাঙ্গে। চোখ খুলে ফোন বের করে দেখলো সাড়ে ছয়টা বাজে। তখনও বাইরে সূর্য ভাল করে ওঠে নি। ও ঘুরতে যেয়ে বুঝলো কেউ আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে ওকে। হালকা ঘুরে দেখলো শিশির বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বিন্দু ঠোঁটের কোনে একটা হাসি ফুটে উঠলো। মানুষটা এত এত কেন ভালবাসে ওকে। বিন্দু আস্তে করে উঠে যায় শিশিরের পাশ থেকে। গোসল করে চুল মুছতে মুছতে এসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় সাতটা বেজে গেছে। ও তাড়াতাড়ি শিশিরকে ডাক দেয়। শিশির ঘুম ঘুম স্বরে বলল,
___ ” উমম, আর একটু ঘুমাই না প্লীজ।”
___ ” এই তাড়াতাড়ি ওঠো সাড়ে সাতটায় গাড়ি চলে আসবে”।
শিশির বিন্দুর কথা শুনে চোখ খুলেই দেখে, ভেজা চুলে বিন্দু দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। শিশির ওকে টেনে আবারও বিছানায় ফেলে দিয়ে বিন্দুর ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে ঘ্রাণ নিতে লাগল। বিন্দু শিশিরের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
,___ ” তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হও লেট হয়ে যাবে “।
___ ” যাক লেট হয়ে। এই মাতাল করা ঘ্রান ছেড়ে আমি কোথাও যাব না “।
বিন্দু হেসে শিশিরের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
___ ” পাগল একটা। ওঠো তো আবার কেউ এসে পড়বে।”
শিশির অনিচ্ছায় গেল ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে। ওরা দুইজনে যখন নিচে নামল তখন অলরেডি সবাই গাড়িতে উঠে পড়েছে। শিশিরকে দেখেই আবির বলে উঠলো ,
___ ” লাইলী মজনু, শিরি ফরহাদ আর রোমিও জুলিয়েটের পরে নেক্সট লিজেন্ড জুটি হল আমাদের শিশির বিন্দু। ”
___ ” কয়দিন পরে বাচ্চার বাপ হবি এখনও ফাজলামি কমে না তোর।”
শিশির বিরক্তির স্বরে বলল। তারপর ঘুরে বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” আজকে যাচ্ছি কই আমরা?”
___ ” পেহেলগাম যাচ্ছি আজকে। এটা কাশ্মীরের অন্যতম প্রধান টুরিস্ট স্পট।”
বিপ্লব বাইরে দেখতে দেখতে বলল। যেতে যেতে আবির নিনার দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” আজকে একটা সারপ্রাইজ আছে সবার জন্য “,।
আবিরের এই কথা শোনা মাত্র নিনা তো ভালই তুলি আর বিন্দুও আবিরের কান ঝালাপালা করে দিল। সারপ্রাইজ কি সেটা জানার জন্য। ওদের কান্ড আর আবিরের হেনস্ত হওয়া দেখে বিপ্লব শিশির তো ভালই ড্রাইভার নূর মোহাম্মদও হাসতে হাসতে খুন। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করে দাঁড়াতেই আবির সবাইকে নিচে নামতে বলল। ওরা নিচে নামতেই নিনা বিন্দু আর তুলি হাঁ করে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। বিশাল এক আপেল বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। শ্রীনগর থেকে পেহেলগাম যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটা বড় বড় আপেল বাগান পড়ে। যে কেউ চাইলে এখান থেকে হাতে দিয়ে আপেল ছিঁড়ে খেতেপারে। কিন্তু হ্যাঁ তারজন্য অবশ্যই পে করতে হবে। ওরা আপেল বাগান ঘুরে আপেল খেয়ে ছবি তুলে তারপর আবারও গাড়িতে উঠলো ওদের গন্তব্য স্থানে যাওয়ার জন্য।

রাস্তার দুপাশে উঁচু উঁচু সাদা বরফ ঢাকা পাহাড় আর এক পাশে পাহাড়ের উঁচু থেকে বয়ে চলা লিদার নদী। এ যেন এক কল্প রাজ্যের রুপ কথার দেশে হাজির হয়েছে ওরা। প্রকৃতি যেন আপন হাতে সাজিয়েছে তার এই কন্যা কাশ্মীরকে। এজন্যই তো পৃথিবীর ভূস্বর্গ বলা হয় কাশ্মীরকে। বিন্দু শিশির হাত মাঝে মাঝে শক্ত করে চেপে ধরছে এই সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখে। ও যেন ভুলেই গেছে নিঃশ্বাস নিতে। পেহেলগামে ঢুকতেই ওদের দশরুপি করে টোল দিতে হল। বিপ্লব তখন সবাইকে বলল,
___ ” শ্রীনগর থেকে বাসে এখানে আসতে ভাড়া হল সাড়ে তিনশটাকা আবার ট্যাক্সি ভাড়া করে আসা যায় চারজনের একটা ট্যাক্সি সারাদিন ভাড়া করলে পড়ে দুইথেকে তিন হাজার রুপি। ”
___ ” তো এখন আমরা যাচ্ছি কই? ”
নিনা বেরসিকের মত প্রশ্ন করল। আবির কোন মতে রাগ গিলে বলল,
___ ” এখন যাচ্ছি মিনি সুইজারল্যান্ড বলে খ্যাত বাইসরা।

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here