শিশিরের বিন্দু পর্ব ৫+৬

শিশিরের বিন্দু
৫ ম পর্ব

চমক বিন্দুকে ঘাড় এদিক সেদিক ঘুরাতে দেখে বলল,
___ ” ভাবি সবুর করো সবুরে মেওয়া ফলে “।তুমি
এই বলেই চোখ টিপ দিল। বিন্দু লজ্জায় আঁচলের আড়ালে মুখ লুকালো। কিবরিয়া সাহেব আজ খুব খুশি। বিন্দু তো তার মেয়ে না বিন্দু হল তার মা। আজ যেমন সে খুশি তেমনি মনের কোনায় চিনচিনে একটা ব্যাথা কাজ করছে। মেয়েটা যে অন্যের বাড়িতে চলে যাবে। হাবিব সাহেব কোথা থেকে এসে যেন কিবরিয়া সাহেবকে জড়িয়ে ধরলেন। এতদিনে শিশিরকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পেরেছেন এর চেয়ে খুশির আর কি হতে পারে? দুই হবু বিয়াই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলেন। ওদিকে জাহানারা আর রাহেলাও নানান কথায় মেতে উঠলো। চমক আর কনা বিন্দুর সাথে মজা করতে লাগল। কিন্তু বিন্দু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেছে শিশিরের জন্য। কিন্তু শিশির এখনও আসছে না কেন। ওদিকে বেশ সময় বয়ে যাচ্ছে শিশিরের কোন খবরই নেই। হাবিব সাহেব সাইডে এসে শিশিরকে কল দিলেন। নাম্বার অফ। এই প্রথম উনার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়া শুরু হল। পরে উনি আবিরের নাম্বারে কল দিলেন। আবির কল কেটে দিয়ে একটু পরেই হাবিব সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো। আবিরকে দেখে হাবিব সাহেব বলল,
___ ” আবির শিশির কোথায়? এত সময় হয়ে গেল এখনও আসছে না কেন? আর তোমার আর বিপ্লবের তো ওর সাথেই আসার কথা ছিল তোমরা এখানে কেন?”
___ ” আংকেল শিশির বলল গাড়ির কি সমস্যা হইছে ও নিজে ঠিক করে দশ মিনিটের মধ্যেই আসতেছে তাই আমাদের নামিয়ে দিয়ে নিজেই গাড়ি নিয়ে চলে গেছে।”
___ ” শিশির গাড়ি ড্রাইভ করছে কেন? ড্রাইভার কই? ”
হাবিব সাহেবের এবার বেশ চিন্তা হতে লাগল। আবির তাড়াতাড়ি যেয়ে বিপ্লবকে ডেকে আনলো। ওদিকে বর এখনও কেন আসে নি তা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। আবির আর বিপ্লব দুইজন মিলে হাবিব সাহেবকে বলল, যে ওরা বাসায় যেয়ে একবার দেখে আসুক। হাবিব সাহেব বললেন,উনি নিজেও যাবে ওদের সাথে। সবার অগোচরে তিনজন গাড়ি চালিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল। বাসা কাছেই ছিল বাসায় যেয়েই দেখে সারাবাসার লাইট অন কাজের লোকটা বসে টিভি দেখছিল উনাদের বাসায় ঢুকতে দেখেই ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠলো। হাবিব সাহেব কাজের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” সুমন শিশির কি উপরে? ”
___ ” ভাইজান তো একটু আগে বাইর হইয়া গেল “।
ওর কথা শুনে সবাই হাঁ হয়ে গেল। একটু আগে শিশির বাসায় এসেছিল? মানেটা কি! হাবিব সাহেব কিছু না বলেই শিশিরের রুমের দিকে ছুটলো। পিছু পিছু আবির, বিপ্লব আর সুমনও আসলো। শিশিরের রুমটা এলোমেলো হয়ে আছে আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করা হয়েছে। শিশিরের ল্যাপটপ টুকিটাকি কিছুই নেই। আবির পাশে তাকাতেই দেখতে পেল টেবিলের উপরে একটা কাগজ চাপা দেওয়া। তাড়াতাড়ি কাগজটা উঠিয়ে এনে হাবিব সাহেবের হাতে দিল ও। হাবিব সাহেব কাগজটা খুলে কিছু অংশ পড়েই বুকের বা পাশে হাত দিয়ে যেন একটু হেলে গেলেন। পিছন থেকে আবির আর সুমন উনাকে ধরে ফেললেন। বিপ্লব তাড়াতাড়ি কাগজটা হাতে নিয়েই পড়া শুরু করল,

আব্বু

এই চিঠাটা যখন তুমি পাবে তখন আমি তোমাদের থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। আব্বু আমি বিয়ে করতে চাই না। আমি পারব না তোমাদের আর অন্য একটা মেয়ের সম্মান নষ্ট করতে। তাই বিয়েটা হওয়ার আগেই চলে গেলাম। জানি খুব কষ্ট পাবে। কখনও তো অবাধ্য হই নি তোমার কথার। আব্বু ডেনমার্কের একটা জবের অফার কনফার্ম করেছিলাম অনেক আগেই। কালকেই টিকিট হাতে পেয়েছি। আমার আজকে ফ্লাইট। ভাল থেকে আব্বু। যদি পারো আম্মু আর তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।

শিশির

চিঠিটা পড়ে বিপ্লব যেন থরথর করে কাঁপতে লাগল। এর মধ্যেই হাবিব সাহেবের ফোনটা বেজে উঠলো উনি ফোন হাতে নিয়ে দেখল জাহানারা কল দিয়েছে। কিছু না বলে কল রিসিভ করে বললেন যে উনি আসতেছেন। হাবিব সাহেবের মুখটা শক্ত হয়ে গেল৷ উনি মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলেন। আবির আর বিপ্লব ভয়ের ঠেলায় কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারছে না উনাকে। আবার গাড়ি চালিয়ে গায়ের হলুদের মাঠে ফিরে এলেন। এসেই কিবরিয়া আর রাহেলাকে ডেকে এক কোনায় নিয়ে গেলেন। সাথে জাহানারা আর আবির বিপ্লব রইল। উনি কিবরিয়া সাহেব হাত শক্ত করে চেপে ধরে সব খুলে বললেন। জাহানারার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। ও যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না ওর ছেলেটা এমন করবে। কিবরিয়া সাহেব যেন পাথর হয়ে গেছে। সারা আত্মীয় স্বজনরা এসেছে এখন বিয়ে না হলে নাক কাটা যাবে উনার। আপায় উপায় না পেয়ে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিল দুই জনে। সুরের সাথে চমকের বিয়ে দেবে আজকে এবং এক্ষুনি। বেশ জোরালো কানা ঘুসা শুরু হয়ে গেলে সবার মাঝে বর আসে নাই। এত দেরি কেন হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিন্দু যেন ঘামতে শুরু করেছে কেন জানিনা একটা খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে মন। এর একটু পরেই সুরকে ডেকে নিলেন কিবরিয়া সাহেব। সব খুলে বলতেই সুর যেন পাথর হয়ে গেল। হবে বোনের বিয়ে এখন সেটা বাদে হচ্ছে তার বিয়ে। কিন্তু হচ্ছেটা কি? সব শুনে চমকের চোখ থেকে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। কারো মুখেই কোন কথা নেই। কে যে কাকে স্বান্তনা দেবে সেটাই বুঝতে পারছে না। বিন্দু যখন শোনে শিশির এ বিয়ে করতে পারবে না ও ডেনমার্ক চলে যাচ্ছে আজকে রাতে। ওর যেন মনে হতে লাগল চিৎ কার করে ও কাঁদতে পারলে ওর হয় তো ভাল লাগবে। আচ্ছা ওর কি দোষ ছিল৷ বিয়েটা তো ফ্যামিলি থেকেই ঠিক করা হয়েছিল। আর প্রথম পুরুষ হিসাবে শিশিরকেই ও ভালবেসেছিল। শিশির কেন এমন করল। বিন্দু স্টেজ থেকেই উঠেই ছুটে চলল বাড়ির দিকে ওর পিছু পিছু রাহেলা আর কনাও গেল। বাড়িতে এসেই শাড়ি গয়না সব খুলে ছুড়ে মারল ও। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলল। কনা রাহেলা বারেবার বলা স্বত্তেও আর দরজাই খুলল না ও। চমক আর সুরের কলমা কাবিন হওয়ার পরে যার যার বাড়িতে চলে গেল সবাই। কথা থাকল চমকের ইন্টার পরীক্ষার পরে ওকে তুলে দেওয়া হবে। সে রাতটা নির্ঘুম কাটলো দুটো পরিবারের প্রতিটি সদস্যের। পরের দিন সকালে উঠেই বিন্দু দরজা খুলে চলল ওর বাবার রুমে। দরজা মেলেই দেখলো কিবরিয়া সাহেব চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে আছেন। বিন্দু ওর বাবার পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই উনি চোখ খুললেন। বিন্দুকে দাঁড়ানো দেখেই বললেন,
___ ” কি রে মা কিছু বলবি? ”
___ ” বাবা একটা ওয়াদা দিতে পারবে আমাকে “।
বিন্দু ধরা গলায় বলল ওর বাবাকে। কিবরিয়া সাহেব ছলছল চোখে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। বিন্দু তখন বলল,
___ ” বাবা এত বড় হয়েছি কখন কোন অন্যায় বা খারাপ কাজ করি নি শুধু তোমার সম্মানের কথা ভেবে আগেও কখনও করব না আমি নিজে তোমাকে ওয়াদা করলাম। কিন্তু বাবা আমাকে আর কখনও বিয়ের জন্য জোরাজোরি করবে না। যদি কখনো কাউকে আমার ভাল লাগে আমি নিজে এসে বলব তোমাকে।”
এটুকু বলেই বিন্দু কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কিবরিয়া সাহেবের মনে হচ্ছিল কেউ জানো তার কলিজাট কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে উনি বললেন,
____ “কখনও কেউ আর তোকে বিয়ের কথা বলবে না যদি কখনও তোর কোন ছেলে ভাল লাগে তার সাথেই তোর বিয়ে দেবো। সে হোক না কোন রিক্সাওয়ালা আমার আপত্তি থাকবে না”।
বিন্দু আর কিছু না বলেই সোজা ওর রুমের দিকে পা বাড়ালো। রাহেলা সব আড়াল থেকে শুনে চোখের পানি মুছলো। বুকটা যেন কে ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে ওর। নিজের চোখে মেয়ের এই অবস্থা যেনো ও সইতে পারছে না। কনাও মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে লাগল। কি থেকে কি হয়ে গেল।

সময় আর নদীর স্রোত কখনও কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ঠিক তেমনিই ধীরে ধীরে তিনটি বছর কেটে গেছে ওদের সবার জীবন থেকে। তিনবছরে অনেক কিছুই চেঞ্জ হয়ে গেছে। সুর আর চমকের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে এখন। কনা ভার্সিটিতে পড়ছে। আর বিন্দু পড়ালেখা শেষ করে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনে উর্ধতন পদে চাকরি পেয়েছে। খুব ছোটাছুটির চাকরি প্রথমে রাহেলা গাঁইগুঁই করেছিল পরে বিন্দু আর ওর বাবার আগ্রহের সামনে তা আর ধোপে টেকে নি। প্রতিমাসেই দুই তিনবার ট্যুর থাকে দেশের বিভিন্ন জেলাতে। এবারও অফিস থেকে এসে বিন্দু রেডি হচ্ছে রাতেই রাঙ্গামাটি যাবে পর্যটন করপোরেশনের মোটেল অডিটে তাই খেয়ে রেডি হতেই সুর গাড়ি করে ওকে বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে এলো। সারারাত জার্নি শেষে সকালে ক্লান্ত শরীরে রাঙামাটি নেমেই ও চলল মোটেলে। আগেও পুরাতন একটা মোটেল আছে বাট এবারের মোটেলটা অত্যাধুনিক আর খুব সুন্দর। সেটাই দেখতে এসেছে বিন্দু। এই সাত সকালে ম্যানেজার চলে এসেছে ওকে স্বাগতম জানাতে। সব ফর্মালিটি সেরে যখন বিন্দু তিনতালার ভি আই পি রুমে যাচ্ছেল হঠাৎ সামনের করিডোরে একটা মানুষকে দেখে ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর যেন মনে হতে লাগল পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে…….

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর
শিশিরের বিন্দু
৬ ষষ্ঠ পর্ব

বিন্দুর পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যেতে লাগল। আজ থেকে তিন বছর আগে যে মানুষটি হারিয়ে গিয়েছিল সেই মানুষটি ওর সামনে দাঁড়িয়ে৷ পাশের ম্যানেজার অনেক খানি আগে হেঁটে চলে গিয়েছে বিন্দুকে রেখে খেয়ালই করে নি বিন্দু যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটু সামনে যেয়েই আবার পেছনে ফিরে এলো ম্যানেজার। বিন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” ম্যাম চলেন, হঠাৎ এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লেন যে।”
___ ” না কিছু না চলুন রুমে “।
বিন্দুর গলার স্বর শুনে শিশির ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়েই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না যে সামনে বিন্দু। বুকের মধ্যে হপারের মত শব্দ হতে থাকলো শিশিরের। বিন্দুও মাথা নিচু করে যেতে থাকল ওর পাশ থেকে। শিশিরের খুব ইচ্ছা করছিল বিন্দুর সাথে কথা,বলার। কিন্তু কোন মুখ নিয়ে কথা,বলবে ও বিন্দুর সাথে। সেই অধিকারের জলাঞ্জলি তো ও তিন বছর আগেই নিজের হাতে দিয়ে ফেলেছে। বিন্দুর আগের চেয়ে একটু স্বাস্থ বেড়েছে এতে ওকে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। পারপল কালারের একটা টিশার্টে উপরে এশ কালারের একটা হুডি পরেছে নিচে ব্লাক জিন্স বিন্দুকে পুরো দস্তুর ট্রাভেলার্সদের মত লাগছে। রুমে ঢুকেই বিন্দু তাড়াতাড়ি ডোর লক করে দিল। ম্যানেজার বাইরে থেকে বলল,
___ ” ম্যাম যদি কিছু লাগে ইন্টারকমে কল দিয়েন “।
বেচারা আশ্চর্য হয়ে গেছে হঠাৎ কি এমন হল যে উনি এই টাইপের আচরন করতেছে। নিচে নামার সময় শিশির আটকালো ম্যানেজারকে,
___” এক্সকিউজ মি! ”
___ ” ইয়েস স্যার “।
___ ” আচ্ছা ওই ভদ্রমহিলা কে, না মানে স্বয়ং আপনি এসেছেন উনাকে নিয়ে রুম পর্যন্ত তাই জানার জন্য কিউরিয়াস হচ্ছি, নাথিং ইলস….
___ ” ইটস ওকে স্যার, উনি আমাদের ডেপুটি চিফ অডিট অফিসার। তাই উনাকে এক্সট্রা কেয়ার করা আমাদের ডিউটি “।
শিশির কিছু না বলে মুচকি হাসি দিল। মেয়েটা তাহলে বিশাল একটা অফিসার। গত তিনদিন আগে বাংলাদেশ এসেছে শিশির। তিনটা বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জব পারপাস ঘুরেছে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল প্রতিনিয়ত নানান মেয়েদের সাথে পরিচয় হলেও বারেবার খুঁজে ফিরেছে বিন্দুকে। মেয়েটাকে এই জীবনে মাত্র দুই বার দেখেছে কিন্তু তারপরও যেন অন্য এক মায়া কাজ করেছে ওর জন্য। প্রতিটা রাতে সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে পুড়িয়েছে। বারেবার ভেবেছে বিয়ের রাতে পালিয়ে এসে সবচেয়ে বড় ভুল করেছে ও ওর জীবনে। চমকের বিয়ে হয়েছে বিন্দুর ভাইয়ের সাথে সবই শুনেছে। চমকই বলেছে বিন্দু এখনও বিয়ে করে নি। কিন্তু বিন্দুর সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে সেটা যেন বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে শিশিরের। দেশে আসার আগেই বিপ্লব আর আবিরকে নক করেছে ও। আবির এই মোটেলের রুম বুকিং করেছে ওর জন্য৷ ওরাও আসছে দুজনে ওদের ফ্যামিলি নিয়ে। আবির বিপ্লব দুজনেই বিয়ে করে ফেলেছে। ডেনমার্ক থাকলেও ওদের দুজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হতো শিশিরের। বাংলাদেশে আসার আগেই জানিয়েছিল যে ও আসছে। মায়ের সাথে কথা হয় শিশিরের মাঝে মাঝে কিন্তু বিগত তিনবছরে ওর বাবার সাথে এক সেকেন্ডের জন্যও কথা হয় নি। দহনের আগুনে পুড়ে পুড়ে আঙ্গার হয়েছে ও প্রতিটি মূহুর্তে। আর বিন্দুর খবর নিয়েছে বারেবারে চমকের কাছে থেকে। কিন্তু অজানা অভিমানে চমক শুধু হ্যাঁ না বলেই দায় সারা উত্তর দিয়ে চলেছে বারেবার। এসব ভাবতে ভাবতে আবার সিগারেট ধরালো ও।

বিন্দু চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। কান্না একদম নয় কান্না মানেই দূর্বলতা প্রকাশ পাওয়া। সোজা উঠে চলল সামনের দিকে বেসিনের কাছে। চোখ মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়েই সোজা চলল শাওয়ার নিতে। গরম পানিতে টুপ টুপ করে ধুয়ে পড়ল ওর সমস্ত ক্লান্তি ইন্টারকমে কল দিল ও, কল রিসিভ করল ম্যানেজার,
___ ” হ্যালো, গুড মর্নিং “।
___ ” সজীব আমি বিন্দু “।
___ ” ইয়েস ম্যাম, কি হেল্প করব ম্যাম। নাস্তা পাঠাবো রুমে “।
___ ” না নাস্তা পাঠানো লাগবে না। আপনি নিচের রেস্টুরেন্টের একটা কোনের টেবিল রেডি করেন আমার জন্য আর ফাইল নিয়ে আসেন সব আমি ওখানে বসেই ব্রেকফাস্ট করব আর ফাইল দেখবো “।
___ ” জী ম্যাম, অবশ্যই জাষ্ট টেন মিনিট সময় দেন আমারে।”
বিন্দু শাওয়ার কোট বদলে অফ হোয়াইট কালারের শার্ট গায়ে দিল। সাথে ব্লু জিন্স আর ব্লাক কালারের লং সোয়েটার। মাথার চুল গুলো হেয়ার ড্রয়ার দিয়ে শুকিয়ে আঁচড়ে একদম উঁচু করে কাঠি দিয়ে আটকালো। হালকা লাইট মেকাপ করে ঠোঁটে লিপষ্টিকের ছোঁয়া দিল। ফুললি অফিসিয়াল লুক যাকে বলে। হাতে ছোট একটা পার্স এর মধ্যে ফোন আর ল্যাপটপ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই দেখলো ম্যানেজারকে যা যা বলা হয়েছে সব রেডি করে দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের এক কোনায়। পর্যটন কর্পোরেশনের দুইটা মোটেল আছে রাঙ্গামাটিতে। পুরোনোটা একদম ঝুলন্ত সেতুর সংগে লাগোয়া আর নতুনটা আর একটু সামনে যাকে বলে পাঁচ মিনিট হাঁটার দূরত্বে। রাঙ্গামাটি শহরটা পুরোটাই পাহাড়ের উপরে। রাস্তা গুলোও সেই কিসমের কখনও এই উঁচু কখনও বা বিশাল ঢালু। এই শহরে কোন রিক্সা চলে না। আছে মটর সাইকেল আর সিএনজি। বিন্দুর টেবিল থেকে রাস্তা দেখা যায়। সকাল বেলার তারউপর আবার শীত অনেক। এখনও পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয় নি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে পর্যটক দের আগমনও বেড়ে যায়। বিন্দু এসে টেবিলে বসেই ল্যাপটপ আর ফাইল খুলে নিয়ে কাজের মধ্যে ডুব দিল। আবির আর বিপ্লব যখন ওদের বউদের নিয়ে রাঙ্গামাটি এসে পৌঁছালো তখন সকাল প্রায় আটটা বেজে গেছে। নিনা আবিরের দিকে তাকিয়ে মুখ কুচকে বলল,
___ ” হায়রে আমার কোমর ফেটে গেছে রে বসতে বসতে। ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি আমি এক বসায় আইছি রে “।
____ ” রাতে হোটেলে যখন থেমেছিল আমি কিন্তু ডেকেছিলাম তোমাকে তুমিই বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলে “।
আবির নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দেওয়ার ট্রাই করল। নিনা ঝামটা দিয়ে বলল,
___ ” থাক থাক আমার দোষ তোমার আর ধরতে হবে না। ঘুমাইছি সেটাও নাকি আমার দোষ “।
আবির হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙিতে বিপ্লবের দিকে তাকালো। বিপ্লব আবিরকে চোখের ইশারায় থামতে বলে শিশিরকে কল দিল,
___ ” দোস্ত তুই কই, ”
বিপ্লব শিশিরকে জিজ্ঞেসা করল। শিশির উলটো প্রশ্ন করল,
___ ” তোরা কই “?
___ ” হোটেলের নিচে আচ্ছা আচ্ছা দাঁড়া তোরা আমি আসতেছি “।
নিচে নেমেই শিশির বিপ্লব আর আবিরকে জড়িয়ে ধরল। গত তিনটা বছর বন্ধুদের সাথে এক হতে পারে নি। আদর ভালবাসার পর্ব শেষ করে শিশির নিচ থেকে রুমের চাবি নিয়ে যার যার রুমে তাকে তাকে পাঠিয়ে দিল। বলল আধাঘন্টার মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নামতে নাস্তা করেনি ও এক্কসাথে নাস্তা করবে। সবাই যার যার রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে একসাথে হোটেলের লবিতে দাঁড়ালো। নতুন মোটেলে রেস্টুরেন্ট নেই তাই সবাই চলল পুরাতন মোটেলের রেস্টুরেন্টে। শিশির ঢুকলো সবার পেছনে। মোটামুটি রেস্টুরেন্ট এর সব টেবিলই ভরা। ওরাও পাঁচ জন তাই এক কোনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ শিশিরের চোখে পড়ল চারটা চেয়ারের এক টেবিলে বিন্দু একা বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। ওর বুকের মধ্যে কেমন জানি খামচে ধরল বিন্দুকে দেখে। মেয়েটা আগের চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা বিন্দু তো একা ওর সাথে বসা যায় না? ঠিক তখনই আবির খেয়াল করল শিশির যেন মনোযোগ দিয়ে কি দেখছে। শিশিরের দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকাতেই ওর বিন্দুর দিকে চোখ পড়ল। আবির কনুই দিয়ে খোঁচা বিপ্লবকে দেখালো। ওদের বউরা তখন খোশ গল্পে মশগুল। আবির ফিসফিসিয়ে শিশিরের কানের কাছে যেয়ে বলল,
___ ” দোস্ত এটা তোর বোনের ননদ না? ”
___ ” হুম “।
শিশির মুখ অন্ধকার করে বলল৷ তখন বিপ্লব আবিরকে বলল,
___ ” ওর এক্স হবু বউ আছিল সেটা কে বলবে? ”
বিপ্লবের কথা শুনে শিশির আর কিছুই বলল না। তখন আবির বলল,
____ ” সে যাই হোক চমকের ননদ মানে আমাদের বেয়াইন উনি থাকতে আমরা কেন দাঁড়িয়ে থাকবো।”
এই বলেই আবির গুটি গুটি পায়ে বিন্দুর টেবিলের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। বিন্দুর তখন সমস্ত মনোযোগ ফাইল আর ল্যাপটপে। আবির পাশে দাঁড়িয়ে খুক খুক করে কাশি দিল। বিন্দু ঘাড় ঘুরিয়েই আবিরের দিকে তাকিয়েই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ওর ভাইয়ের বিয়ের পরে আবির আর বিপ্লব নানার উপলক্ষে ওদের বাড়ি গিয়েছে তাই আবিরকে ও ভাল করেই চেনে। হেসে বলল,
___ ” আরে আবির ভাইয়া আপনি এখানে? হোয়াট এ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ “।
___ ” সারপ্রাইজ তো আমি না সারপ্রাইজ হল বিন্দু বিবি আপনার ভাবিও এসেছে “।
আবির হেসে উওর দিল।বিন্দু তখন বলল,
___ ” কই ভাবি তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন”।
আবির তখন আঙুল তুলে ওদিকে ইশারা করতেই বিন্দুর চোখ পড়লো শিশিরের উপরে। মূহুর্তেই ওর হাসি যেন উড়ে গেল। আবির তাড়াতাড়ি সামাল দিতে সবাইকে ডাক দিল। সবাই আসতেই বিন্দু উঠে নিনা আর তুলিকে জড়িয়ে ধরল। তুলি হল বিপ্লবের বউ। বিপ্লব এসেও কথা বলল বিন্দুর সাথে। শিশিরের খুব ইচ্ছা হল বিন্দুর সাথে কথা বলার কিন্তু কি বলবে তা আর খুঁজে পেল না। বিন্দু হোটেল স্টাফদের ডেকে আরো দুটো চেয়ার আর নাস্তা দিতে বলল এখানে। সবাই যখন বসল কপালের ফেরে শিশির বসল একদম বিন্দুর পাশের চেয়ারে। বিন্দু আবারো টের পেল তিন বছর আগের সেই পাগল করা ঘ্রান। কথার ছলে আবির জিজ্ঞেস করল,
___ ” কি ব্যাপার বিন্দু তুমি হঠাৎ এখানে? ”
___ ” ভাইয়া অডিটে এসেছি। ”
___ ” আছো কয়দিন “।
এবার শিশির নড়েচড়ে বসে বিন্দুর মুখের দিকে তাকালো। বিন্দু হেসে বলল,
___ ” এসেছি তো এক সপ্তাহের জন্য, মনে হয় কাজ দুদিন বাদেই শেষ হয়ে যাবে তখন ব্যাক করব ঢাকাতে “।
নিনা তখন হা হা করে উঠে বলল,
___ ” সেটা তো হবে না ম্যাডাম, কাজ শেষ করে আমাদের সাথে ঘুরতে হবে।”
___ ” না ভাবি অন্য কখনও “।
___ ” অন্য সন্য পরে দেখিও আমাদের তুমি থাকছো মানে থাকছো।”
তুলি জোর দিয়ে বলল। বিন্দু মুচকি একটা হাসি দিল। তখন বিপ্লব চেঁচিয়ে উঠে বলল,
___ ” ও লাড়কি হাসি তো ফাঁছি “।
সবাই হাহাহা করে হেসে উঠলো। এমন সময় বিন্দু হাত বাড়ালো পানির গ্লাস নিতে। আর শিশির ব্রেড নিতে বিন্দুর আঙুলে আলতো ছোঁয়া লাগল শিশিরের। বিন্দু যেন থর থর করে কেঁপে উঠলো। সেই শপিং মলের লিফটের কথা মনে পড়ল ওর। আর শিশির অপলক নয়নে তাকিয়ে রইল বিন্দুর দিকে…….

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here