#শুচিস্মিতা -২
Tahrim Muntahana
~ ভাদ্রের স্নিগ্ধ ভোরের মতোই নরম ও কোমল তুমি শুচিস্মিতা!
ভাদ্র মাসকে ‘তাল পাকা গরম’ মাস বলেও আখ্যায়িত করা হয়। সূর্যের তেজীরূপের জন্যই হয়তো এরকম নাম ভাদ্রের কপালে জুটেছে। কিন্তু ভাদ্রমাসের প্রকৃতি স্নিগ্ধতার বৈচিত্র্যে ভরা, নরম ও কোমল হয়। কাশগুচ্ছ ও শিউলির মেলা বসে এই সময়ে। শরতের সৌন্দর্যের প্রকাশে এ দুটোই শুধু স্থান করে নেয় নি।
মাঠে মাঠে সবুজ সমারোহ। ধান ক্ষেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য, পুকুরে ফোটা শাপলা-পদ্ম, ডাঙায় ফোটা শিউলি-জুঁই প্রকৃতি যেন সব মায়া ঢেলে দিয়েছে। ভোরের প্রকৃতি দেখতে বেরিয়েছিল আনতারা। ধান ক্ষেতের সরু আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে হাঁটছিল সে। ধানের শীষে ফুটে ওঠা আগামী দিনের ফসলের হাসি দেখে দেখে অন্য এক জগতে হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ পেছন থেকে আবেগ মেশানো কন্ঠস্বর শুনে আপনাআপনিই থেমে যায় সে। কন্ঠস্বর যেমন তার পরিচিত, নামটাও তার পরিচিত। এই পরিচিত দের ভিড় থেকেই মুক্ত পাখি হয়েছিল, ভালো লাগার জগতে বিচরণ করছিলো; ওই যে তার ভালোথাকা বেশীক্ষণ টিকে না। এবারও তার ভালোথাকার মাঝে বিষাদ নিয়ে হাজির হলো রাশিদ নামক প্রতিবেশী! প্রতিবেশীই বটে; আনতারাদের বাড়ির ঠিক এক বাড়ি পরেই তাজওয়ার ভিলা। প্রতিবেশী ভাই হয়, তবে তাদের বাড়িতে তাজওয়ার ভিলা’র সদস্যদের অবাধ বিচরণ। এই অবাধ বিচরণ ই একসময় তার কাল হয়ে দাঁড়ালো। রাশিদ নামক পুরুষ টি জড়িয়ে গেল তার মোহে! নাহলে তো বেশ চলছিল দিনকাল। চাপা শ্বাস ফেলে পেছন ঘুরে আনতারা। নজরে আসে রাশিদের হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী। বিরক্ত দৃষ্টি ফেলে বলে উঠে,
~ আষাঢ়ের অন্ধকার আকাশের নিকষ কালো মেঘও বটে!
রাশিদ হাসলো, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো কৃষ্ণ বর্ণের অপরূপার দিকে। কয়েক পা ফেলে এগিয়ে এসে সামনাসামনি দাঁড়ালো। পিছিয়ে গেল আনতারা। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো, দুজন কে এই ভোরে একসাথে দেখলে হয়তো গ্রামের মানুষ জন কেচ্ছা রটাতে ভুলবে না! দাগ টা তার গাঁয়েই লাগবে বেশী! আনতারা’র মনোভাব বুঝে রাশিদ দায়সারা ভাবে বললো,
~ কেউ নেই, আসবেও না, আপাতত একঘন্টার মধ্যে একটা প্রাণীও আমার অপরূপার কাছে আসতে পারবে না!
~ আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করবো না রাশিদ ভাই!
রাশিদ হয়তো আনতারা’র মুখে অন্যকথা আশা করেছিল। তাইতো কথাটা শুনা মাত্র মুখশ্রীতে বিরক্তিভাব ফুটে উঠলো। সে ভুল টাই বা কি করলো? বললো,
~ আমার মনে হয় না কোনো ভুল আমার দ্বারা হয়েছে। তাহলো ক্ষমা না করার প্রশ্ন আসছে কোথায় শুচিস্মিতা?
নামটা শুনে চোখ বুজে নিলো আনতারা। হঠাৎ করেই তার রাগ হলো। তেজি কন্ঠে বললো,
~ আপনার জন্য আমার আপায় কষ্ট পেয়েছে। একটু ভালোবাসলে খুব বেশী ক্ষতি হতো না রাশিদ ভাই। আপনাকে বড্ড ভালোবাসে আমার আপায়। এর জন্য কোনো দিনও আপনাকে ক্ষমা করবো না।
ভ্রু কুঁচকে তাকালো রাশিদ। মেয়েটা আপায়ের ভালোবাসা দেখছে অথচ তার ভালোবাসা দেখছে না। তা কি করে হয়? না দেখলেও তার দায়িত্ব দেখানো। মুচকি হেসে বললো,
~ একই কথা যদি আমি বলি শুচিস্মিতা? একটু ভালোবাসলে খুব বেশী ক্ষতি হতো না তোমার। তোমার আপায়ের ভালোবাসার থেকেও হয়তো আমার ভালোবাসা টা তুখোড়। আমি কষ্ট পাচ্ছি না, বলছো?
নিভে যায় আনতারা। মুখশ্রীতে হতাশা ভর করে। ঘাসের উপর পা মেলে বসে একটু সময় নিয়ে রাশিদ আবার বলে উঠলো,
~ মানুষ আসলেই স্বার্থপর। দেখ, তুমি তোমার আপায়ের ভালোবাসা ঠিক দেখলে, তার হয়ে অনেক সাফাই ও গাইলে অথচ আজ আমি পর বলে আমার ভালোবাসা টা তোমার চোখে পড়লো না। বিনিময়ে কিছু বলার প্রয়োজন পড়লো না। এই জামানায় স্বার্থ ছাড়া কিছু নাই। আমাকে একটু ভালোবাসো না, শুচিস্মিতা!
~ আপনার এসব কথা শোনার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। একদম পিছু আসবেন না রাশিদ ভাই। আপনার উপস্থিতি অসহ্যকর!
তাড়াহুড়ো করে কথাটা বলেই আনতারা হাঁটা ধরে। যদি একটু সময় অপেক্ষা করতো তাহলে হয়তো কোনো এক ব্যর্থ প্রেমিকের করুণ দৃষ্টি দেখেই থমকে যেত। মলিন হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ায় রাশিদ। হেঁটে চলা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে খানিক জোরেই বলে উঠে,
~ সে সময় টা আসুক, আমার অনুপস্থিতি তোমার অসহ্যকর লাগুগ। উপস্থিতি মুখে হাসি ফুটাক! এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করবো প্রিয়, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত!
…
শশুড়বাড়ির সদস্যগুলোকে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারে নি ফারাহ। সবার ব্যবহার কেমন যেন, হুটহাট চিৎকার চেঁচামেচি, হুটহাট ঝগড়া, আবার হুটহাট গদগদ একটা ভাব। নতুন বউয়ের সামনে কেমন ব্যবহার করা উচিত সবাই হয়তো ভুলে গেছে। নাহলে সকাল সকাল চেঁচামেচি শুনে ঘুম থেকে উঠবে কেন সে? বিরক্তি মুখশ্রী নিয়ে বিছানা ছাড়ে ফারাহ, বর্তমানে সে ছাড়া ঘরটাই কেউ নেই। একপলক নজর বুলিয়ে সারা ঘর দেখে নেয়। আজ থেকে এটা তার ঘর; অথচ সে চেয়েছিল অন্যকারো ঘরে, অন্যকারো বাহুডোরে থাকতে। কথাগুলো মনে হতেই যেন ভেতর থেকে চাপা শ্বাস বেরিয়ে আসতে চায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে বেলকনিতে যাওয়ার অভ্যাস ফারাহ’র। এখানে ঘরের সাথে লাগোয়া বেলকনি নেই, যা আছে বাড়ির সামনের দিক বড় বারান্দা। প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই! মনটা আরো বিষিয়ে গেল ফারাহ’র। ধপ করে বিছানায় বসলো। বাইরের চেঁচামেচি বেড়েই চলছে, চুল খামচে ধরে রাগান্বিত শব্দ করলো ফারাহ। ঠিক তখনই ঘরের দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করলো। ঠিক হয়ে বসে মাথা তুলে নিজের শাশুড়ি মিসেস নাজমা কে দেখতে পেল। এই মহিলা কে তার আরো বেশি জটিল লেগেছে। মুডের কোনো ঠিক নেই, এই ভালো তো এই খারাপ। কালকে রাতেই টের পেয়েছে সে। ফারাহ’র শাশুড়ি এসেই মিষ্টি হাসলেন, একপ্রকার গদগদ হয়ে বললেন,
~ উঠছো বউমা? যাও যাও গোসল টা করে আসো, রান্না করতে হবে। নিয়ম!
গ্রামের গৃহিণী দের মুখের বুলি এমনই, অর্ধেক শুদ্ধ তো আর অর্ধেক আঞ্চলিক!
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ফারাহ। মিসেস নাজমা পুরো ঘর নজর বুলালেন, ব্যাপারটা তার মুটেও ঠিক লাগলো না। হুট করেই গজগজ করতে করতে যেভাবে এসেছেন সেভাবেই চলে গেলেন। আর ফারাহ! সে তো ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে গজগজ করছে। আর কত নিয়ম পালন করবে সে? কাল রাত বারোটা পর্যন্ত নিয়ম পালন করিয়ে এদের স্বাদ মেটেনি? নতুন বউ কে দিয়ে কে রান্না করায়? তাদের বাড়িতে তো এমন নিয়ম নেই। তার বেশ মনে আছে, ছোট চাচার বিয়ের পর ছোট চাচি প্রায় চারদিন পর রান্নাঘরে গিয়েছে! নতুন বউরা নাকি বসে থাকবে, সাজুগুজু করবে, যারা যারা দেখতে আসবে তাদের সাথে হালকা পাতলা কথা বলবে; অথচ এই বাড়িতে? পরদিনই নিয়ম পালনের দোহায় দিয়ে বাড়ির বউকে রান্নাঘরে পাঠাচ্ছে! সে তো এমন অবিচার মেনে নিবে না; কয়েকটা দিন যাক, আগে ভালো ভাবে দেখুক মানুষজন কেমন তারপর সেও নিজের রূপ দেখাবে। শিক্ষিত মেয়ে হয়ে শশুড়বাড়ির অত্যাচার তো সহ্য করতে পারে না সে! তালুকদার বাড়ির বড় মেয়ে, দাম দিয়ে চলতে হবে!
নানান রকম ভাবনা মনের মধ্যে সাজিয়ে গোসল করছে ফারাহ। যেন এখানে সে সংসার নয় যুদ্ধ করতে এসেছে। আসলে প্রিয়দের বাইরে সবকিছুই খানিক অপ্রিয় লাগে। বিয়েটা মানতে পারেনি বলেই ফারাহ সংসার মানতে পারছে না। নানান রকম উদ্ভট চিন্তা করছে। আবার কিছুদিন পরেই হয়তো সংসারের মায়ার পড়ে যাবে। মেয়ে মানুষের জীবনই এমন!
মিসেস নাজমা চোখ মুখে রাগ নিয়ে ছেলের পাশে দাঁড়ালেন। নিয়ন তখন বাগানে একটু হাঁটাহাঁটি করছিল। হঠাৎ মায়ের এমন রূপ দেখে ভড়কে যায় সে। প্রচন্ড ভয় পায় মা কে, ভড়কে যাওয়ার কথায়! মিসেস নাজমা কোনোরকম ভুমিকা না করে বললেন,
~ সব ঠিকাছে? বউরে কিন্তু বেশী লাই দেওয়া যাবো না, যতখানি করা দরকার ততখানিই। বেশী বউভক্ত পুরুষ রে মানুষ ভালো চোখে দেখে না, হাসাহাসি করবো। বেশী ভালোবাসা দেখাইলে বউ রা তখন মাথায় উঠে নাচবো। সাবধান করে দিতাছি আগেই।
মায়ের কথায় নিয়নের কাল রাতের কথা মনে পড়ে যায়। সত্যিই কি সব ঠিক আছে? হয়তো আছে! নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ একটু মানিয়ে নিতে কষ্ট হবেই। মেয়েটা কে কয়েকদিন সময় দিয়েছে নিয়ন। কয়েকদিন যাক তারপর নাহয় স্বামীত্ব দেখাবে। এ কয়দিন নিজের মতো চলুক, নতুন পরিবারকে জানুক; নাহলে নিজের সংসার ভাবতে মেয়েটার কষ্ট হবে। নিয়ন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
~ সব ঠিকাছে আম্মা। বউ তো আম্মা ভালোবাসার মানুষই। বউকে ভালোবাসলে যদি লোকে হাসাহাসি করে করুক না, নিজে ঠিক থাকলে সব ঠিক। ফারাহ কে একটু সময় দাও মা। তেমন জানাশোনা ছিল না, আমি চাইনা আমার মায়ের শক্ত খোলস টা দেখে তার মনে বিরূপ প্রভাব পড়ুক। আমার আম্মা যে সবচেয়ে ভালো মা আর শাশুড়ি নতুন সদস্যকেউ তো বুঝতে হবে।
ছেলের প্রশংসায় খুশিতে গদগদ হলেও বুঝতে দিলেন না মিসেস নাজমা। তাকে আগে দেখতে হবে মেয়ে কেমন। এর আগেই নিজেকে নরম দেখালে ছেলের বউ তো মাথায় চড়ে বসবে। যুগ ভালো না, আর দুই ছেলের বউকে যেভাবে তটস্থ রাখে এই বউ ও এমন ই থাকবে। সে যে এই বাড়ির কর্ত্রী বোঝাতে হবে না? মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
~ আমারে পাম দিয়া কাজ হবে না। এই বাড়িতে আমার কথায় শেষ কথা। তোমার বউরে ভালো করে বইলা দিও।
ভেতরে চলে আসে মিসেস নাজমা। নিয়ন মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে। পরক্ষণেই ঘাড় খানিকটা বেঁকিয়ে নিজের ঘরের দিকে তাকায়। আসলেই মাথায় উঠে নাচবে? নাচুক, কতদিন নাচবে। সে নাচতে দিতে পারলে, নাচার পা ও ভাঙতে পারবে! ভাবছিল আর পা দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। হঠাৎ পিঠে শক্ত হাতের থাবা বসতেই পিঠ সামান্য বেঁকিয়ে নেয় সে। চোখ মুখ কুঁচকে পাশে তাকাতেই মেজ ভাই নিরব কে চোখে পড়ে। তার দিকেই ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে। বিরক্তি কন্ঠে নিয়ন বললো,
~ তোমার হাত বেশী চলে মেজভাই।
কথায় পাত্তায় দিল না নিরব। বরং নিজের মতোই বললো,
~ সকাল সকাল বউকে রেখে এখানে কি করছিস? শোন বউয়ের সব কথায় সাথে সাথে শুনবি না, কিছুক্ষণ ভাব নিয়ে তারপর শুনবি। নাহলে বউয়ের আবদার পূরণ করতে করতে জীবন শেষ, বউকে কড়া শাসনে না রাখলে চলবে না। বুঝছিস?
কথাটা শেষ হওয়া বাকি ভেতর থেকে চিৎকার আসা দেরী হলো না,
~ এই তোমাকে যে বললাম, মজনু মামার দোকান থেকে জুয়েলারি সেট টা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে। ফাঁক পেলেই আলাপ শুরু তাইনা?
…
~ আজকে তোর নাটক শুরু করিস না আনতারা। ফারু নিম্নে না হয় নয়-দশ বার বলেছে তোকে অবশ্যই যেতে হবে। না হলে সে বাবার বাড়ি আসবে না।
চাচিদের রান্নায় সাহায্য করছিল আনতারা। এর মধ্যে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ফাতিনের মুখে এমন দ্বারায় কথা শুনে উৎফুল্ল ভাব টা নিমিষেই কেটে গেল। অপ্রসন্ন দৃষ্টি ফেললো ফাতিনের উপর। আপন মনে ফোন টিপতে ব্যস্ত ফাতিন। আনতারা বললো,
~ আমার সব কাজই আপনার নাটক মনে হয় কেন ফাতিন ভাই? নাটকের ডিরেক্টর নাকি, অল্পতেই বুঝে যান কোনটা নাটক কোনটা বাস্তব!
রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো ফাতিন। এই মেয়ে একটা কথাও ফাঁকফোকর দিয়ে বের হতে দেয় না। মেয়ে মানুষ এত কথা বলবে কেন? কর্কশ কন্ঠে বললো,
~ মেয়ে মানুষ এত কথা বলিস কেন? তোর এসব সবার কাছেই নাটক মনে হয়। আলাদা এটেনশন পাওয়ার ধান্দা।
আনতারা হাসলো। কিছু বললো না। কিন্তু ছোট চাচি মিসেস কামরুন্নাহার বললেন,
~ এভাবে কথা বলো না ফাতিন। তুমি যেমন এ বাড়ির সন্তান, আনতারা’ও এ বাড়ির ই সন্তান। তালুকদার’রা ছেলে মেয়ে কে আলাদা চোখে দেখে না। ফারাহ যেমন তোমার বোন, আনতারা’ও তোমার বোন। তুমি সম্মান না করলে, অন্যজন খুব সহজেই অসম্মান করতে পারবে। তোমার দায়িত্ব বোনদের প্রটেক্ট করা।
আবার কাজে লেগে পড়লেন মিসেস কামরুন্নাহার। আনতারা মায়া চোখে দেখলো মিসেস কামরুন্নাহার কে। এই মানুষটা পাশে থাকলে কেউ তাকে কথা দিয়ে আঘাত করতে পারে না। যদিও সে কাউকে এমন সুযোগ দেয় না, তবে সব সময় তো এক না। ফাতিন চোখ উল্টে, মুখ বিকৃত করে চলে গেল। আনমনেই বিড়বিড় করলো, বোন না ছাই! কেন এমন মনে হলো সে জানে না, তবে কেন জানি এই মেয়েটাকে সে দেখতে পারে না। হয়তো গায়ের রং! নয়তো কারণ ছাড়া কেন চোখের বিষ হবে? ফাতিনের চলে যাওয়ার দিকে বড় চাচি মিসেস সেলিনা তাকিয়ে রইলেন। কিছু একটা ভাবলেন নিজে নিজেই, আবার কাজে লেগে পড়লেন। হুট করেই আনতারা বললো,
– সব পুরুষ ই সুন্দরের পূজারী। সুন্দরী বলুক মনে হবে মধু ঝরছে, আমার মতো আঁধারিয়াদের কথায় বিষ ঝরে গো! গলাধঃকরণের অযোগ্য!
…
তালুকদার বাড়ির সামনে অনেকগুলো অটো দাঁড়িয়ে আছে। সময়টা এখন অপরাহ্নের শেষ ভাগ। মেয়ে-জামাইকে নিতে যাবে। পরমানন্দপুর গ্রামে এই যাত্রাকে ফিরুনি বলা হয়। মিসেস সেলিনা বাদে সবাই যাবে ঠিক হয়েছে তবে আনতারা যাবে কিনা কেউ শিউরিটি দিতে পারছে না। কিন্তু ফাতিনের জেদ আনতারা কে যেতেই হবে, তাই কয়েক গাড়ি রওনা হওয়ার পরও সে দাঁড়িয়ে আছে। অটোর সামনে বসে একমনে ফোন টিপছে রাশিদ, মুড তার বেশ ভালো। মন বলছে আনতারা আজকে অন্তত যাবে। ঠিক তাই হলো, ধূসর রঙের ফ্রক, হিজাব-মাস্ক পড়ে হাজির হলো আনতারা। মিসেস কামরুন্নাহার একপ্রকার দৌড়েই গেলেন তার কাছে। চোখ মুখ দেখেই যে কেউ বলে দিতে পারবে মেয়েটি যাওয়ায় তার থেকে খুশি কেউ না। আনতারা মুচকি হাসলো। মিসেস কামরুন্নাহার উনার পাশেই বসালেন আনতারাকে। ফাতিন একপলক তীক্ষ্ম চোখে আনতারা কে পর্যবেক্ষণ করে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চলতে শুরু করবে এর মাঝেই হুড়মুড় করে আনতারা’র পাশে বসে পড়লো রাশিদ। চমকে উঠলো আনতারা, চোখ পাকিয়ে তাকালো, বিশেষ পাত্তা দিলো না রাশিদ। সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মিসেস কামরুন্নাহার কে বললো,
~ চাচি সামনে বসতে প্রবলেম হচ্ছে। এখানে বসলে কোনো সমস্যা হবে আপনাদের?
ছেলেটাকে মিসেস কামরুন্নাহারের বেশ লাগে। এত ভালো করে গুছিয়ে কথা তেমন কেউ ই বলতে পারে না। তার সাথে মতবিরোধ কমই হয়। তাই মুখে হাসি টেনে বলল,
~ কি যে বলোনা, সমস্যা হবে কেন। বরং সময়টা আরো ভালো কাটবে। বেশ করেছো এখানে এসে।
লাইসেন্স যেন পেয়ে গেল। মুখের হাসি চওড়া করে আনতারার দিকে তাকালো রাশিদ, যদিও চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এই চোখেও যেন সে শতবার মরে, শতবার মরতে রাজি। খোঁচা মেরে বললো,
~ তোর সমস্যা হলেও কিছু করার নেই শুচিস্মিতা। এই পথটুকু আমাকে সহ্য করে যেতে হবে।
মাস্কের নিচেই মুখ বেঁকালো আনতারা। নাটক করতে আসছে। কর্কশ কন্ঠে কিছু বলবে তার আগেই রাশিদ ফিসফিস করে বললো,
~ শুধু এই পথটুকু নয়, আমাকে তোমার সারাজীবন সহ্য করে যেতে হবে। এই রাশিদ তাজওয়ার তোমাকে ছাড়ছে না, প্রিয়!
…
দুপুর পর্যন্ত ফারাহ শশুড়বাড়ির সবার গতিবিধিই লক্ষ্য করেছে। একমাত্র বড় ভাসুর আর বড় জা কে ছাড়া আর কাউকেই তার ভালো লাগে নি। ফুফু শাশুড়ি মানুষ টার অযহত বউদের উপর চোটপাট করার স্বভাব, এই পর্যন্ত অসংখ্য বার তার খুঁত ধরে ফেলেছে। শশুড় কে তার নিতান্তই বোকাসোকা এক বাচ্চা মনে হয়েছে, যে বউয়ের কথায় উঠে বসে। বড় ভাসুর টা গম্ভীর এবং বুঝধার মানুষ, বউ ও তেমন শান্তশিষ্ট কোমল মনের, সাত বছরের মেয়েটাও ঠিক বাবার মতো। মেজ ভাসুর টা চাপা মারতে উস্তাদ, বউয়ের সবকথা শুনবে শুনবে অথচ অন্যদের সামনে বাহাদুর সাজবে; মেজ জা অতিরিক্ত কথা বলে, একটু হিংসুটে টাইপের। দেবর টা কথা কম বলে, শুধু বই নিয়ে বসে থাকে। শাশুড়ির সাথে আলাপ তার হয়ে উঠে নি, সকালে যা একটু হয়েছে। সর্বশেষ তার স্বামী! স্বামী বলতেও তার খানিক কষ্ট হয়। তবুও এটাই সত্য, ওই মানুষটার সাথে রাতের পর কথা হয়নি। তাই ধারণাও নেই কেমন ধারার পুরুষ!
নিজ ঘরে বসে বসে শশুড়বাড়ির সদস্যদের আচরণ হিসেব করছিল ফারাহ। নিজেকে বড্ড একা লাগছে। এত জন সদস্য তবুও তার একা লাগছে কথাটা বলা হয়তো অপরাধ। অনেকেই তার সাথে আলাপ জমাতে এসেছিল তবে সে হু হা ছাড়া কিছুই বলে নি। মন যদি না টানে, মুখ থেকে কি করে কথা বের হবে! বাপের বাড়ির মানুষ জন কে মনে পড়ছে খুব। ‘কে জানে তারা টা কি করছে, আসবে কিনা। একটু খবর নেওয়া দরকার’, কথাগুলো মনে মনে বলে যেই না ফোনটা হাতে তুলবে হুড়মুড় করে কয়েক যুগল কিশোরী ঘরে ঢুকে পড়লো। বিরক্ত হলেও প্রকাশ না করে হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো ফারাহ। সাজাতে এসেছে, একটু পর থেকে মানুষ জন আসতে শুরু করবে। এই গরমে আবার সাজতে হবে শুনে ফারাহ মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ করলো। বিড় বিড় করে বললো,
~ প্রিয় মানুষটার জন্য যদি সাজতে পারতাম, তখন হয়তো এই গরমের কথাটা মাথায় আসতো না!
চলবে..?
( প্রথম পর্বের মতো রিয়েক্ট দ্বিতীয় পর্বে আসেনা। অনুরোধ করবো মন্তব্য না করলেও রিয়েক্ট করতে। বরাবরের মতো সমান রিয়েক্ট উঠলে রাতে আরেকটি পর্ব দিবো। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। শুকরিয়া!)