#শুধু_তোমারই_জন্য(২)
লেখনীতে- অরনিশা সাথী
|২৩|
আহিয়ান ঢাকায় ফিরেছে বেশ কটা দিন হবে। আনিতা এখন বাসায় অনিমা তাসকিয়া আরোহী ওদের সাথেই সময় কাটায়। রোদেলা শুভ জেরিন মাঝে মধ্যে এসে দেখা করে যায় ওর সাথে। আনিতার প্রেগন্যান্সির চার মাস চলছে এখন। খাবার দাবারের প্রতি অনীহা চলে এসেছে। খাবার দেখলেই বমি চলে আসে আনিতার৷ খাবারের গন্ধ একদমই সহ্য করতে পারে না। তবুও আনিতার আম্মু জোর করে খাওয়ান। কিন্তু পরক্ষণেই আবার বমি করে দেয় আনিতা। শরীর আগের থেকে এখন বেশি দূর্বল হচ্ছে। চেহারায় আগের মতো উজ্জ্বল ভাবটা নেই।
আনিতার এইচএসসি এক্সাম এর পর ওর আর আহিয়ানের বিয়ের প্রোগ্রাম হওয়ার কথা ছিলো। আনিতা প্রেগন্যান্ট বিধায় আর প্রোগ্রাম করা হয়নি। আর আনিতার আম্মু দাদু কেউ-ই এই অবস্থায় আহিয়ানের বাসায় পাঠাতে চায় না। এসময় এতদূর জার্নি করাটা ঠিক হবে না। তাছাড়া আনিতার শরীর অনেকটাই দূর্বল খেতে পারেন না। তাই এইসময় মেয়েকে আর কাছ ছাড়া করতে চান না উনারা। আহিয়ান বা ওর পরিবারের কেউ-ই আপত্তি করেনি এই বিষয়ে।
বিকেলে রোদেলা শুভ জেরিন এসেছে। সাথে তাসকিয়া তো আছেই। পাঁচ জনে মিলে আনিতার রুমে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার টপিক হলো ক্রাশ। এই অব্দি কে কটা ক্রাশ খেয়েছে সেই নিয়ে কথা বলছে ওরা। আনিতার টার্ন এলে আনিতা বলে,
–“আমার ক্রাশ নিয়ে বলতে গেলে বলা শেষ হবে না। তার থেকে ভালো রোদেলা বল।”
রোদেলা সম্মতি জানিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো সবকিছু বলার জন্য। রোদেলা মুখ কাচুমাচু করে বললো,
–“আনি বেইব একটা কথা বলি?”
–“বলতে না বললেও বলবি। সুতরাং এত ঢং না করে বলেই ফেল।”
রোদেলা এবার নড়েচড়ে বসলো। সবার দিকে তাকালো একবার। সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। রোদেলা একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
–“ইয়ে মানে আমি না আহিয়ান ভাইয়ের উপর সেএএএই লেভেলের একটা ক্রাশ খাইছিলাম।”
রোদেলার কথা শুনে আনিতা একটা বালিশ ছুঁড়ে মারলো। আনিতা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“দুনিয়াতে আর ছেলেপেলে পেলি না? আমার নিষ্পাপ ভোলা ভালা জামাইয়ের উপরই তোর ক্রাশ খেতে হলো?”
রোদেলা হেসে বললো,
–“কিন্তু তহন কি আর জানতাম যে আহিয়ান ভাই আগে থেকেই তোর উপর ফিদা হয়ে বসে আছে।”
রোদেলার কথায় আনিতা মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকালো। রোদেলা মৃদু হেসে বললো,
–“থাকা বাবা আমার তন্ময় হলেই হবে। আর কাউকে লাগবে না। সব ক্রাশ ট্রাশ বাদ।”
শুভ রোদেলার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
–“তন্ময় ভাই তোরই আছে। তুই শুধু এক্ষুনি ফোন করে বল বিয়ে করবি। দেখবি তন্ময় ভাই কালকেই তার পুরো পরিবার নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছে তোকে বিয়ে করতে।”
রোদেলা মাথা ডলতে ডলতে বললো,
–“জানি, সেজন্যই তো বলবো না। আগে আরো কয়েকটা দিন পরিবারের থেকে লুকিয়ে চুড়িয়ে প্রেম করি তারপর বিয়ে।”
–“আফসোস আমি প্রেম করতে পারলাম না।”
আনিতার কথায় সবাই চোখ ছোট করে তাকায় ওর দিকে। সবার চাহনী দেখে আনিতার মনে হচ্ছে ও কোনো খুব বড়সড় একটা ক্রাইম করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। তাসকিয়া বললো,
–“প্রেম করিসনি তুই? বিয়ের আগে দু মাস প্রেম কে করলো?”
–“দুমাস কোনো সময় হলো? আমি তো ভেবেছিলাম কয়েক বছর আগে প্রেম করবো তারপর বিয়ে।”
–“যদি হারিয়ে যাস। সেজন্যই তো বিয়ের বন্ধনে আটকে ফেলেছে তোকে। আহিয়ান ভাই কোনো রিস্ক নিতে চায়নি।”
জেরিনের কথায় সবাই সহমত প্রকাশ করলো। এতক্ষণ সবার ক্রাশ সম্বন্ধে জানা হলেও জেরিন কিছু বলেনি। তাই এবার সবাই জেরিনকে ধরলো। জেরিন লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
–“আমি রাতুলের উপর ভীষণ রকমের ক্রাশ খেয়েছি। ছেলেটাকে আমার এত্ত পরিমান ভাল্লাগে তোদের বলে বোঝাতে পারবো না। মাঝে মধ্যে ভাবি আমি ওর জন্য যেরকমটা ফিল করি ও যদি ঠিক সেরকমটাই ফিল করতো আমার জন্য তাহলে ভালোই হতো। না?”
এভাবেই গল্পগুজব চলে ওদের মাঝে। আনিতার আম্মু এসে সকলকে নাস্তা দিয়ে যায়। সন্ধ্যার কিছুটা আগে ওরা সকলেই চলে যায় বাসায়। আনিতা আবারো একা হয়ে পড়ে। আজকের বিকেলটা ও খুব ভালো কাটিয়েছে সবার সাথে। ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে নিলো। মাগরিবের আজান দিতে পাঁচ/ছয় মিনিটের মতো বাকী এখনো। গেমস খেলতে শুরু করলো ও।
–
রাত আটটা কি সাড়ে আটটা বাজে। ড্রয়িংরুমে সকলের সাথে বসে গল্প করছিলো আনিতা। তখনই রুমের ভিতর থেকে তীব্র আওয়াজে ফোন বেজে উঠে। রুমে চলে গেলো আনিতা। নিশ্চয়ই আহিয়ান ফোন করেছে৷ বিছানার হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে বসে ফোন রিসিভ করে বললো,
–“হ্যাঁ বলুন।”
–“কি করছিলে? কখন থেকে ফোন দিচ্ছি। আর ইউ ওকে?”
আহিয়ানের অস্থির কন্ঠস্বর শুনে আনিতা মৃদু হাসলো। আহিয়ান মুখ গোমড়া করে বললো,
–“এদিকে আমার টেনশন হচ্ছিলো ফোন ধরছো না কেন? কিছু হয়েছে কিনা। আর তুমি হাসছো।”
আনিতা এবারে খানিকটা শব্দ করে হেসে দিয়ে বললো,
–“আচ্ছা আর হাসছি না ওকে?”
–“নাহ হাসো। তুমি হাসলেই বেশি সুন্দর লাগে।”
আহিয়ানের পাগলামোতে আনিতা মুচকি হাসে। ছেলেটা এরকমই। কখন যে কি করে বসে সেটা বোধহয় নিজেও জানে না। ছেলেটা যেরকমই হোক না কেন? আনিতা এই ছেলেটাকেই ভালোবাসে। মনে মনে এসব ভেবে আনিতা বললো,
–“বাসায় ফিরেছেন কখন?”
–“এইতো মাত্রই ফিরলাম।”
–“আচ্ছা তাহলে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করুন তারপর ফোন দিন।”
–“আচ্ছা। এই সময়ের মাঝে তুমিও খেয়ে নিবা কিন্তু।”
–“হুম।”
–“রাখছি তাহলে।”
আনিতা লাইন কেটে দিলো৷ এফবিতে লগইন করলো গল্প পড়বে বলে। তখনই অনিমা এসে ডিনার করতে ডাকলো। আনিতার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও খেতে গেলো ও। খেতে তো হবেই। না খেলে ওর বাচ্চাটা বাড়বে কি করে? বাচ্চাকে সুস্থ রাখতে হলেও তো কষ্ট করে হোক কিছু তো খেতে হবে। আনিতা ফোন বিছানায় রেখে ডাইনিংয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাজে। আনিতা সোফায় বসে আহিয়ানের সাথে ফোনে কথা বলছে। আহিয়ান বেশ কয়েকবার আনিতাকে বলেছিলো ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু ম্যাডাম বায়না ধরেছে আজকে অনেক রাত অব্দি দুজনে কথা বলবে। আনিতার জেদের কাছে হার মেনেই আহিয়ান রাজি হয় কথা বলতে। আনিতা প্রেগন্যান্ট জানার পর থেকেই আনিতার সাথে ওর আম্মু ঘুমায়। আর আহিয়ান আসলে তো আহিয়ানই থাকে। আনিতার আম্মু বিছানায় ঘুমোচ্ছে বিধায় ও সোফায় বসে বসে কথা বলছে। আনিতা কিছু একটা ভেবে বললো,
–“আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
–“হ্যাঁ করো। তবে উল্টাপাল্টা কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি আন্সার দিবো না।”
সোজাসাপটা উত্তর আহিয়ানের। আনিতা সঙ্গে সঙ্গেই আবার প্রশ্ন করলো,
–“রাই কি আর ফোন করেছিলো আপনাকে?”
–“ফোন করলে কি বলতাম না তোমাকে?”
–“হ্যাঁ বলতেন___”
আনিতাকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই আহিয়ান কিছুটা বিরক্তির সুরে বলে,
–“তাহলে এসব জিজ্ঞেস করছো কেন? তোমাকে একদিন বলেছি তো আমি #শুধু_তোমারই_জন্য আছি। তোমার ছিলাম আছি আর তোমারই থাকবো আমি। আর তুমিও আমারই থাকবে। কথাগুলো মাথায় ভালো করে গেঁথে নাও।”
আনিতা মুচকি হেসে আবারো বললো,
–“আচ্ছা আর একটা প্রশ্ন করি আপনাকে?”
–“এই রাতের বেলা আমাকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে আমার মাথা খাওয়ার প্ল্যান থেকে থাকলে এখনই এসব বাদ দাও বলছি।”
–“আহ! রেগে যাচ্ছেন কেন? বলি না।”
–“আচ্ছা বলো।”
আনিতা এবার খুব সাবধানে এবং ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“আচ্ছা আপনি কি রাই নামের মেয়েটাকে ভালোবাসতেন? দেখুন আমার থেকে লুকোনোর কিছু নেই একদম সত্যিটাই বলবেন।”
আনিতার প্রশ্নে আহিয়ানের মেজাজ রাগে সপ্তম আসমান ছুঁলো। তবুও নিজের রাগ কিছুটা সামলে নিয়ে বললো,
–“হ্যাঁ রাইকে ভালোবাসতাম আমি। আর কোনো প্রশ্ন?”
আনিতা থমকে গেলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো,
–“সত্যিই? সত্যিই আপনি রাইকে ভালোবাসতেন? তবে যে সেদিন বললেন___”
–“এটাই তো শুনতে চেয়েছিলে আমার মুখ থেকে তাই না? এখন বলেছি তো। তাহলে কষ্ট পাচ্ছো কেন? হুয়াই?”
শেষের কথাটা আহিয়ান বেশ চিল্লিয়ে বলে। আহিয়ানের চিৎকারে আনিতা কেঁপে উঠে কিছুটা। আহিয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
–“সেদিন সবটা ক্লিয়ার করে বলিনি তোমাকে? কোনো ডাউট থাকলে সেদিনই ক্লিয়ার করে নিতে। আজকে আবার কেন এসব কথা তুলছো? এসব প্রশ্নের মানে কি আনি? তুমি তো জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাহলে কেন সেখানে অন্যকোনো মেয়েকে টেনে আনছো? হ্যাঁ মানলাম রাই আমাকে ভালোবাসতো। কিন্তু ওর সাথে আমার সেরকম কোনো রিলেশন ছিলো না। আমি ওকে বন্ধুর নজরেই দেখেছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি আনিতা। শুধু তোমাকেই।”
চোখের কোনে জমা পানিটুকু মুছে নিলো আনিতা৷ তারপর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
–“আই এম সরি। আসলে আমি এমনিতেই__”
–“এসব থাক এখন। ঘুমাবা কখন?”
–“ওই শুনেন না।”
–“হ্যাঁ শুনছি।”
–“সত্যিই সরি। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি।”
–“ঠিক আছে। আমি হার্ট হইনি আনিতা।”
আনিতা এবারে বাচ্চাদের মতো করে বললো,
–“সরি তো। প্লিজ।”
আনিতার বলার ভঙ্গি দেখে আহিয়ান খানিকটা শব্দ করেই হেসে দিলো। বললো,
–“ভালোবাসি বউ।”
–“আমিও ভালোবাসি।”
–“কাকে?”
–“আমার বাবুর আব্বুকে।”
আরেক দফা হাসলো আহিয়ান আনিতার কথা শুনে। আনিতা ফোন হাতে নিয়েই ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। আনিতা খেয়ালই করেনি আহিয়ান এখনো লাইনে। কল কাটেনি ও। আহিয়ান বেশ কয়েকবার আনিতার নাম ধরে ডাকলো। আনিতার সাড়া না পেয়ে চুপ করে রইলো ও। পানি পড়ার শব্দে বুঝলো আনিতা ওয়াশরুমে। আনিতা হাতমুখ ধুয়ে পিছন ফিরে আসতে নিলেই স্লিপ কেটে পড়ে গেলো ওয়াশরুমে। উপুড় হয়ে পড়ায় পেটে এবং কপালে প্রচন্ড আঘাত পায়। পেটের যন্ত্রণায় গগনবিদারী চিৎকার করে বলে,
–“আহ! আম্মুউউউউউউউ।”
অন্যদিকে আনিতার চিৎকার শুনে আহিয়ান ধরফরিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে। আনিতাকে ডাকতে থাকে কয়েকবার। কিন্তু আনিতার সাড়া পায় না। এদিকে আনিতার চিৎকারে ওর আম্মু তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ান। ওয়াশরুমে আলো জ্বলতে দেখে এদিকে এগিয়ে আসতেই দেখেন আনিতা ওয়াশরুমের ফ্লোরে পড়ে আছে। ব্লিডিং হচ্ছে প্রচুর। রক্তে চারিপাশ ভেসে যাচ্ছে। মেয়ের এই অবস্থা দেখে আনিতার আম্মুও চিৎকার করে বাকী সবাইকে ডেকে উঠেন। কান্না করতে করতে আনিতার নাম ধরে ডাকতে থাকেন তিনি। কিন্তু আনিতার কোনো সাড়া পায় না। আনিতার আম্মুর কান্নার শব্দ পেয়ে আহিয়ানের শরীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। কিছু হয়নি তো আনিতার? ফোন কেটে দিয়ে আবারো ব্যাক করলো ও। ফোনের রিং হওয়াতে আনিতার আম্মু ফোন রিসিভ করলেন। ওপাশে আহিয়ানের অস্থির কন্ঠস্বর শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সবটা বলেন আহিয়ানকে। আহিয়ান তখনই তাকে বলে ফোন রেখে দেয়।
আনিতার ফোন কেটেই আহিয়ান ফাইয়াজকে ফোন লাগায়। দু বার রিং হতেই ফাইয়াজ ঘুম ঘুম চোখেই ফোন রিসিভ করে কানে নেয়। আহিয়ান অস্থির কন্ঠে বলে,
–“ফা্ ফাইয়াজ এখনই আনিতাদের বাসায় যা। ও্ ও ওয়াশরুমে পড়ে গিয়েছে। বি্ ব্লিডিং হচ্ছে প্রচুর। আমার আনিতাকে বাঁচা ফাইয়াজ। হসপিটালে নিয়ে যা এক্ষুনি। আম্ আমি আসছি।”
আহিয়ানের থেকে এসব কথা শুনে মূহুর্তেই ফাইয়াজের ঘুম উবে গেলো। ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,
–“মানে কিসব বলছিস? আর আনি বুড়ির__”
–“ফাইয়াজ সময় নষ্ট করিস না ইয়ার প্লিজ যা। আনিতার আব্বু চাচ্চু কেউ বাসায় না। এতরাতে কিভাবে কি করবে__তুই প্লিজ আগে গিয়ে ওকে হসপিটালে নে। আমি আসছি।”
–“আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না। আমি দেখছি।”
কথাটা বলেই ফোন রেখে দিলো ফাইয়াজ। তাড়াতাড়ি কাবার্ড থেকে একটা টি-শার্ট বের করে পড়ে নিলো। তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হতে গেলেই তাসকিয়া প্রশ্ন করে,
–“এত রাতে এভাবে ছুঁটে কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
–“আনি বুড়ি ওয়াশরুমে পড়ে গিয়েছে। ব্লিডিং হচ্ছে অনেক। ইমিডিয়েটলি ওকে হসপিটালে নিতে হবে।”
কথাগুলো বলতে বলতেই দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ফাইয়াজ। তাসকিয়া উঠে ফাইয়াজের আব্বু আম্মুকে ডেকে নিয়ে আনিতাদের বাসায় চলে গেলো।
আনিতার আম্মু কাকিমা রা মিলে ওকে ধরে এনে বিছানায় শুইয়েছে। ব্যাথায় চিৎকার করে কান্না করছে ও। ব্লিডিং কমছে না কিছুতেই। একের পর এক প্লাজু পালটানো হচ্ছে৷ প্যাড নেওয়া হচ্ছে কিন্তু সাথে সাথেই আবারো রক্তে ভিজে উঠছে সবটা। বাড়িতে একা চারজন মেয়ে মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না এতরাতে একা কিভাবে কি করবে। ফাইয়াজের কথা মাথায় আসতেই আয়রা ছুঁটলো ফাইয়াজকে ডাকতে কিন্তু তার আগেই ফাইয়াজ হদতন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো। ফাইয়াজদের দু বাড়ি পরই একজন ভাড়ায় প্রাইভেট কার চালায়। ফাইয়াজের আব্বু তাকেই ডেকে নিয়ে আসতে গিয়েছেন।
ব্যাথায় কাতরাচ্ছে আনিতা। ওর এই অবস্থা দেখে ফাইয়াজের পা থেমে গিয়েছে ওখানেই। আনিতার আম্মু দাদু ফুপ্পি সকলেই কাঁদছে। গাড়ি আসতেই ফাইয়াজ আনিতাকে কোলে তুলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
আধ ঘন্টার মাঝেই ওরা হসপিটালে পৌঁছে যায়। ফাইয়াজের টি-শার্ট টাওজার সব রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। স্ট্রেকচারে শুইয়ে ওকে ভিতরে নিয়ে যায়। ও প্রেগন্যান্ট শুনেই আগে আল্ট্রার রুমে পাঠানো হয় ওকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ~#শুধু_তোমারই_জন্য(২)
লেখনীতে- অরনিশা সাথী
|২৪|
রাত আড়াইটা কি সাড়ে তিনটা বাজে। আনিতার বেডের কাছে চেয়ার টেনে ওর একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে আহিয়ান। জলে ভর্তি হয়ে আছে চোখদুটো। আহিয়ানের চোখের দিকে তাকালে যে কেউ বলে দিবে ও অনেক কান্না করেছে। আনিতার স্যালাইন শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ হবে। চোখ মেলে নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখে প্রথমে খানিকটা অবাক হলো ও। তারপর সবটা মনে হতেই ধরফরিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেই আহিয়ান আটকে দেয় ওকে। হাতে ক্যানেলা লাগানো থাকায় সেখানে টান বেজে রক্ত চলে আসে। আনিতা অস্থির হয়ে আছে। আহিয়ান থামানোর চেষ্টা করছে ওকে। ভিতর থেকে ওদের কথার শব্দ শুনে ফাইয়াজ আর নাহিয়ান কেবিনে প্রবেশ করে। আনিতার ক্যানেলায় রক্ত দেখে নাহিয়ান চলে যায় নার্সকে ডাকতে। আর ফাইয়াজ আনিতার কাছে যায় ওকে সামলাতে। আনিতার তখনও পেটে কিছুটা পেইন করছিলো। আনিতা একহাতে পেট চেপে ধরে আহিয়ানকে বলে,
–“আ্ আহিয়ান আমার বে্ বেবি? আমার বেবিটা ঠিক আছে তো আহিয়ান?”
আহিয়ান কিছু বললো না। নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। ফাইয়াজ আনিতার একপাশে বসে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
–“আনি বুড়ি এরকম করে না। তোর শরীর অনেকটা দূর্বল। আগে শান্ত হ তুই।”
–“ফাইয়াজ ভাইয়া তুম্ তুমি বলো না আমার বেবি ঠিক আছে তো? কিছু হয়নি তো ওর?”
ফাইয়াজ কিছু বলার আগেই নাহিয়ান নার্সকে নিয়ে আসলো। নার্স এগিয়ে গিয়ে আনিতার হাতের ক্যানেলা টা পাল্টে আবার নতুন করে ক্যানেলা লাগাতে লাগাতে রাগারাগি করলো বেশ ওদের। যাওয়ার আগে বলে গেলো,
–“এবারে যাতে আর ক্যানেলায় রক্ত না আসে। সাবধানে থাকবেন আপনি। নড়াচড়া করবেন না। মাথায় থাকে যেন।”
বেরিয়ে গেলো নার্স। আনিতা আবারো আহিয়ানের দিকে তাকায়। আহিয়ানের শার্ট খামচে ধরে জিজ্ঞেস করে,
–“কি হলো? আপনি চুপ করে আছেন কেন? বলুন না আমার বেবিটা ঠিক আছে তো?”
–“বেবিটা আর ন্ নেই আনি।”
কাঁপা কাঁপা স্বরে আহিয়ান কথাটা বললো। কথাটা শুনে আনিতার হাত আলগা হয়ে গেলো। আহিয়ানের শার্ট ছেড়ে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। পাশ ফিরে আহিয়ান চোখের পানিটা মুছে নেয়। আনিতার সামনে ও কাঁদতে চায় না। তাহলে যে আনিতা আরো দূর্বল হয়ে পড়বে। সামলাতে হবে তো মেয়েটাকে। আহিয়ান আনিতার হাত দুটো ধরে বললো,
–“আনি তুমি একদম চিন্তা করো না তো। ডক্টর বলেছে তুমি একদম ঠিক আছো। মাস ছয়েক গেলে আমরা চাইলেই আবার বেবি নিতে পারবো।”
আনিতা আহিয়ানের হাতের মুঠোয় থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
–“এটা আমাদের প্রথম বেবি ছিলো আহিয়ান। ওকে নিয়ে আমি অনেক স্বপ দেখেছি। ও্ ওর কিছু হয়নি না? আপনি আমাকে মিথ্যে বলছেন বলুন? আমার বেবির কিচ্ছু হয়নি। ও একদম ঠিক আছে।”
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে আনিতা ওর পেটে হাত দেয়। অঝোরে ওর চোখ থেকে পানি পড়ছে৷ ফাইয়াজ বললো,
–“আনি বুড়ি এরকম করিস না। তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না আমাদের।”
আনিতা ফাইয়াজের দিকে ঘুরে বসলো। চোখের পানিটা মুছে চিৎকার করে বললো,
–“ভাইয়া উনাকে বলো না বলতে আমার বেবির কিচ্ছু হয়নি। উনি মিথ্যে বলছেন।”
ফাইয়াজ কিছুটা ধমকের সুরে বললো,
–“শান্ত হো আনি। বেবিটা তোর একার না আহিয়ানেরও ছিলো। তাহলে ও কেন ওর বেবি নিয়ে মিথ্যে বলবে? তোর যেমন কষ্ট হচ্ছে ওরও তো তেমন কষ্ট হচ্ছে। বরং তোর থেকে বেশিই কষ্ট হচ্ছে আহিয়ানের। তুই তো তোর কষ্টটা কান্নার মাধ্যমে প্রকাশ করছিস কিন্তু আহিয়ানকে কাঁদতে দেখেছিস? ও তো চাইলেও কাঁদতে পারছে না। কষ্টটা চেপে রেখেছে ভিতরে। প্রকাশ করতে পারছে না বলে কি ওর কষ্ট হচ্ছে না? ওর-ও তো কষ্ট হচ্ছে। সো এইরকম বিহেভিয়ার বন্ধ কর আনি বুড়ি। তোর এরকম বিহেভিয়ার আহিয়ানকে আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছে।”
কথাগুলো বলে ফাইয়াজ বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। ওর পিছু নাহিয়ানও চলে গেলো। হসপিটালে ওরা তিনজনই আছে। আনিতার আম্মু আর আয়রাকে জোর করেই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে ফাইয়াজ। যে গাড়িতে করে ওরা এসেছিলো আবার সেই গাড়িতে করেই ফিরে গেছে আনিতাকে কেবিনে দিয়েছে বাদে। আনিতা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আহিয়ান টেনে আনিতাকে নিজের দিকে ঘোরালো। আনিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
–“আরেহ পাগলী এভাবে কাঁদছো কেন?”
–“আমাদের সাথে এমন কেন হলো আহিয়ান? আমাদের বেবিটা আমাদের কাছে কেন থাকলো না বলুন?”
–“আনিতা কাঁদে না প্লিজ। তুমি খুব ভালো করেই জানো তোমার চোখের পানি আমি দেখতে পারি না। আর আমাদের তো বেবি হবে। এমন তো না যে আমাদের আর কখনো বেবি হবে না। ডক্টর বলেছে আর কোনো সমস্যা নেই। আমরা চাইলেই আবার যখন তখন বেবি নিতে পারবো। তার আগে তোমাকে সুস্থ হতে হবে।”
–“এ্ এটা আমাদের প্রথম বেবি ছিলো আহিয়ান।”
আহিয়ান আনিতাকে জড়িয়ে ধরলো। আহিয়ানের বুকে মুখ গুজেই আবার কান্না জুড়ে দিলো আনিতা। আহিয়ান আনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
–“জানি তো এটা আমাদের প্রথম বেবি ছিলো। কিন্তু কি করার বলো? ও আমাদের ভাগ্যে নেই তাই আল্লাহ বেবিটাকে তার কাছে নিয়ে গেছেন।”
–
হসপিটালে কাল রাত রেখে আজকে সকালেই আনিতাকে বাসায় নিয়ে এসেছে। বাসায় এসে ওর দাদু আর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা সময় কান্না করেছে ও। রোদেলা শুভ জেরিন ওরা সকলেই এসে আনিতাকে দেখে যায়৷ আরোহী তাসকিয়া অনিমা ওরা সবাই এটা ওটা করে আনিতাকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে যাতে ওর বেবি মিসক্যারেজ হওয়ার কথাটা মাথায় না আসে। কিন্তু তারপরও আনিতাকে স্বাভাবিক করতে পারেনি ওরা। আহিয়ানকে ফাইয়াজ ওর সাথে করে নিয়ে গেছে। দুজনে একসাথে হলেই কাঁদবে। আহিয়ানের মন মেজাজ ভালো নেই সেজন্য একপ্রকার ধরে বেঁধেই ওদের বাড়ির পাশের বড় মাঠটাতে নিয়ে গিয়েছে। বিকেলে আনিতা রুমের দরজা জানালা লাইট সবকিছু অফ করে বিছানায় শুয়ে কাঁদছিলো। দরজা খোলার শব্দে অন্যপাশ ফিরে যায় আনিতা। মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ও। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
–“আনিতা মা।”
আহিয়ানের আম্মুর কন্ঠস্বর শুনে আনিতা পেছন ফিরে দেখে উনি আনিতার মাথার কাছে বসে আছেন। আনিতা তড়িঘড়ি করে উঠে উনাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দেন। উনি আনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
–“দেখো দেখি মেয়ের কান্ড। এভাবে কাঁদে কেউ? আরে পাগলী মেয়ে কাঁদছো কেন এভাবে?”
–“আম্মু আমাদের বেবিটা___”
আনিতাকে পুরো কথা বলতে না দিয়েই আহিয়ানের আম্মু বললেন,
–“কাল কি হয়েছে সেসব ভুলে যাও। সামনে কি হবে সেটা নিয়ে ভাবো৷ তোমরা চাইলেই আগামী দিনে বেবি নিতে পারবে। সামনে না হয় আবার কন্সিভ করবে তুমি। এখনই এত ভেঙে পড়লে চলে?”
আনিতা কিছু বললো না। চুপ করে উনার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মাঝে মধ্যে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। রুহি আর অদ্রিও আনিতাকে অনেকটা সময় যাবত বোঝায়। পরে আনিতা উঠে বসে চোখের পানি মুছে নেয়।
সন্ধ্যার কিছুটা পরেই আহিয়ানের আম্মু ভাবী আবার চলে যায়। আনিতার আম্মু যদিওবা থাকার জন্য অনেকবার বলেছিলেন কিন্তু থাকেনি উনারা। আহিয়ান ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে এলো। আনিতার কাছে গিয়ে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“তন্ময়, কথা বলবে তোমার সাথে।”
আনিতা কিছু না বলে ফোন নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো। তন্ময় বললো,
–“এই কিউটিপাই তুমি কিন্তু একদম কান্না করবে না।”
আনিতা মলিন হেসে বললো,
–“কই কাঁদছি না তো আমি।”
–“আহিয়ান বলেছে আমাকে তুমি সারাক্ষণ কেঁদেই যাচ্ছো। এরকম হলে কিন্তু চলবে না। আমরা আমাদের হাসিখুশি আনিতাকে আবার দেখতে চাই। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো তারপর আবার দ্রুতই আমাদের মামা ডাক শোনার ভাগ্য করে দেও কেমন?”
তন্ময়ের এহেন কথায় আনিতা লজ্জা পেয়ে যায় বেশ। কান্নামিশ্রিত মুখটাতেও কিছুটা খুশির ঝিলিক দেখা যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে আনিতা বললো,
–“রাখছি। তোমার বন্ধুর সাথে কথা বলো।”
আহিয়ানের দিকে ফোন এগিয়ে দিতেই আহিয়ান ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে গেলো। কথা বলা শেষ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লো আনিতার পাশে। পেছন থেকে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে আনিতার পেটের উপর হাত রাখলো। আনিতা আহিয়ানের হাতের উপর নিজের হাত রেখে বললো,
–“আচ্ছা আমরা এখনই আবার বেবি নিতে পারি না?”
–“এখনই বলতে?”
–“এখনই বলতে এখনই। এখন তো একটু অসুস্থ আছি৷ সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবো তারপর।”
–“উঁহু একদমই না। আপাতত বেবি নিচ্ছি না। কয়েকটা মাস যেতে দাও তারপর। আর কিছুদিন বাদে থেকেই তো ভার্সিটির ভর্তি এক্সাম শুরু হবে। এক্সামের প্রিপারেশন নাও আগে। এবারে আগে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো তারপর বেবি নেওয়ার চিন্তা করা যাবে। তবে হ্যাঁ রেডি থাকো খুব শীঘ্রই আমার কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।”
–“আমি তো আপনার কাছেই আছি আপনার হয়ে।”
–“হ্যাঁ তা আছো। তবে আমার তোমায় এতটুকু কাছে পাওয়াতে পোষায় না। এইচএসসির পর তো বিয়ের প্রোগ্রাম করে আমাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথাই ছিলো। এইচএসসি তো শেষ হয়েছে আরো আগেই। এবার তোমাকে নিয়ে যাবো।”
প্রত্যুত্তরে আনিতা কিছু বললো না। আহিয়ান আনিতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর কপালে চুমু দিলো। তারপর আনিতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।
রাত দুইটা বাজে। আনিতার চোখে ঘুম নেই৷ কাল রাতের কথাটাই বারবার মনে পড়ছে ওর। আল্লাহ যদি ওর বেবিটাকে বাঁচিয়ে রাখতো তাহলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? ওয়াশরুমের দিকে চোখ পড়লে কান্নাগুলো আর বাঁধ মানে না। উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও৷ হঠাৎই পেছন থেকে একজোড়া হাত ওকে আগলে নিলো। আনিতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
–“আনি এভাবে কান্নাকাটি করলে হবে? কেঁদো না প্লিজ। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আমরা চাইলেও তো সেটাকে আর পালটে ফেলতে পারবো না। প্লিজ কাঁদে না লক্ষীটি।”
আনিতা আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে এবারে শব্দ করে কেঁদে দিলো। আহিয়ান আনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
–“আচ্ছা তোমাকে এভাবে কাঁদতে দেখলে কি আমার ভালো লাগে? আমার কি কষ্ট হচ্ছে না বলো? আমারও তো কষ্ট হচ্ছে আনি। কই আমি তো কাঁদছি না। তাহলে তুমি কেন কাঁদছো?”
আহিয়ান আনিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
–“এই যে চোখের পানি মুছে দিলাম। এরপর আর যাতে চোখে পানি না দেখি। এখন চুপচাপ ঘুমাও তো। আর একটা কথাও বলবে না।”
কথাগুলো বলে আহিয়ান আনিতার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো। দশ মিনিটের মাথাতেই আনিতা ঘুমিয়ে পড়ে। আহিয়ানেরও তো কত স্বপ্ন কত ইচ্ছে ছিলো এই বেবিটা নিয়ে৷ কিন্তু এক মূহুর্তেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। না ও কাঁদবে না। ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। সব কষ্ট বুকে পাথর চাপা দিয়েও ওদের হাসতে হবে। আহিয়ান চোখের কোনে জমা পানিটুকু মুছে নিলো। আনিতার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে ও নিজেও শুইয়ে পড়লো।
–
সপ্তাহ দুয়েক কেটেছে এর মাঝে। আনিতা এ কদিনে নিজেকে সামলে নিয়ে আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তবুও মাঝে মধ্যে সেদিনকার কথা মনে হলে কেঁদে কেটে বুক ভাসায় ও। কিছুদিন আগেই ঢাকায় দুটো ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে আনিতা আর ওর ফ্রেন্ডরা সকলে। এবং সৌভাগ্যক্রমে ওরা সকলে একই ভার্সিটিতে সিট পেয়ে যায়। আগামীকাল আনিতার আব্বু আর ছোট চাচ্চু দেশে আসবেন। আনিতার মেজো চাচ্চু গত সপ্তাহেই দেশে এসেছেন। তিন ভাই একসাথে এবার আনিতার বিয়ের প্রোগ্রাম উপলক্ষেই এসেছেন। বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা সব্বাইকে তো থাকতেই হবে এটা আনিতার হুকুম ছিলো। অতি আদরের মেয়ের কথা রাখতে সকলেই দেশে আসছেন এবার। ফাইয়াজ ঢাকায় ফিরেছে আরো আগেই। প্রচুর অফিস কামাই গেছে ওর। ভাগ্যিস অনলাইনেই অফিসের কাজটা করেছে নয়তো কবেই বস লাত্থি মেরে বের করে দিতো ঠিক নেই। আগামী কাল ফাইয়াজ আর আহিয়ান ওখান থেকেই সোজা এয়ারপোর্টে গিয়ে আনিতার আব্বু আর চাচ্চুকে রিসিভ করে সোজা বাসায় ফিরবে। আনিতা এবারেও যেতে চেয়েছিলো ওর আব্বু আর চাচ্চুকে রিসিভ করতে। কিন্তু আহিয়ানের কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় সেরকম ভাবে বলার সাহস পায়নি ও। গত দুইদিন আগেই আবার আনিতা সেন্সলেস হয়ে গেছিলো। হসপিটালে নিয়ে জানতে পারে প্রেশার লো তারউপর রক্তশূন্যতা। দু ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। জার্নি করতে পারে না তার মাঝে আবার শরীর দূর্বল সেজন্যই আহিয়ান আনিতাকে সঙ্গে নিতে চাচ্ছে না।
আহিয়ান অবশ্য বেশ ভালো করেই জানে আনিতা ওর উপর খুব রেগে আছে। কালকে ওকে কাছে পেলে মহারানী চিবিয়ে খাবেন ওকে না নিয়ে যাওয়ার ফলে। তাতে কি? আহিয়ান সেসবে পরোয়া করে না। ওর কাছে সবার আগে ওর পিচ্চি-পাখিটার ভালো থাকা। তারপর বাকী সবকিছু। এখন কাল যদি গিয়ে ওকে কানে ধরে উঠবস করেও তার বউয়ের রাগ ভাঙাতে হয় তবে ও তাতেই রাজি।
আনিতা বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। রাত সাড়ে দশটা কি পৌনে এগারোটা নাগাদ বাজে। ঘুম আসছে না ওর। আহিয়ান একের পর ফোন করছে কিন্তু ও রিসিভ করছে না। রেগে আছে ও আহিয়ানের উপর। আহিয়ান জানে আনিতার রাতের ঢাকা শহর দেখতে প্রচুর ভালো লাগে। তারপরও কি করে কাল ওকে না নিয়ে যাবে ও? সেজন্য আনিতা আর কথা বলবে না আহিয়ানের সাথে। মনে মনে এটাই ঠিক করেছে। কিন্তু আনিতা ওর কথাটা রাখতে পারলো না। আহিয়ান যে হারে ফোন করছে কখন না জানি ওর ফোনটা স্ট্রোক করে মারা যায়। তাই ফোন বাঁচাতেই আহিয়ানের কল রিসিভ করলো ও। কিছুটা ঝাড়ি মেরেই বললো,
–“কি সমস্যা আপনার? দেখছেন না ফোন রিসিভ করছি না। তারপরও এতবার ফোন দিচ্ছেন কেন?”
আহিয়ান কিছুটা অসহায় ফেস করে করুন কন্ঠে বলে,
–“ও বউ সরি তো।”
–“রাখেন আপনার সরি। আপনার সরি ধুয়ে কি আমি পানি খাবো?”
–“রেগে আছো কেন? একটু ভালো করে কথা বলো না।”
–“আপনি জানেন না আমি কেন রেগে আছি?”
–“উঁহু আমি জানি আমার বউ রেগে নেই। কিন্তু আমার উপর অভিমান করে আছে।”
–“তো জানেনই তো তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
–“বিয়ের পর আই মিন এই তো কিছুদিন বাদে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো তখন তোমাকে অনেক রাত অব্দি ঢাকার শহর ঘোরাবো বাইকে করে। প্রমিস।”
–“কালকেও যাই না প্লিজ? আপনি আর ফাইয়াজ ফাইয়া বাসায় আসুন এখান থেকে আমাকে নিয়ে তারপর আব্বু আর চাচ্চুকে রিসিভ করতে যান।”
–“বাচ্চাদের মতো জেদ করছো কেন? তোমার শরীর অনেক দূর্বল বউ। দুদিন আগেই দু ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে।”
–“এখন আমি একদম ফিট আছি। কসম।”
–“বললাম তো আমার কাছে নিয়ে আসি তারপর সপ্তাহে কমসে কম তিনদিন হলেও তোমাকে নিয়ে রাতের শহর দেখতে বের হবো।”
–“সত্যিই?”
–“হ্যাঁ সত্যিই।”
–“আপনার উপর ভরসা করে কিন্তু আমি রাজি হচ্ছি না যাওয়ার জন্য। পরে যদি আমাকে নিয়ে রাতে না বের হোন তখন কিন্তু আমি আর থাকবো না আপনার সঙ্গে।”
–“উমমম, আচ্ছা পরে না নিয়ে গেলে তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিবো। কিন্তু আমার থেকে দূরে যেতে দিবো না তোমাকে। তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম ফুলফিল হয় না। প্রতি রাতে আমার বুকে মাথা রেখেই ঘুমাতে হবে তোমাকে। আমার থেকে একচুলও সরতে দিবো না তোমাকে। আমার খুব খুব কাছে চাই তোমায়।”
শেষের কথাগুলো আহিয়ান একদম স্লো ভয়েজে কিছুটা নেশাক্ত কন্ঠেই বলেছে। ওর কথা শুনে আনিতার এদিকে লজ্জায় চোখমুখ লালরঙা হয়ে উঠেছে। ব্লাশ করছে। আহিয়ান বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো,
–“অনেক ব্লাশ করে নিয়েছো। এখন চুপচাপ ঘুমাও৷ রাখছি?”
–“হুম।”
কথাটা বলে আনিতা নিজেই লাইন কেটে দিলো। ফোন পাশে রেখে কোলবালিশ জড়িয়ে নিয়ে আনিতা ভাবছে, ‘আসলেই আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর ওর আহিয়ান ওকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। সকাল বিকাল রাত দুপুর সারাটা সময় ও আহিয়ানের কাছে কাছে থাকবে। আহিয়ানকে চাইলেই যখন তখন স্পর্শ করতে পারবে।’ এসব ভেবে আনিতা নিজে নিজেই ব্লাশ করছে। আজকে মাসের আট তারিখ। এই মাসের সতেরো তারিখেই ওর আর আহিয়ানের বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে। হলুদ বিয়ে বিদায় সবকিছু হবে। ভাবতেই গা শিউড়ে উঠছে ওর।
চলবে ইনশাআল্লাহ~