শেষ বিকেলের আলো পর্ব ১৩

শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ১৩

রাতের বেলা সবাই গভীর ঘুমে। ইহান বস্তি বাড়ি থেকে রুমাইসার সব এনে ফেলেছে। রুমাইসা চুপটি করে সব কিছু প্যাকিং করল খুব আসতে আসতে। মেয়ের কিছু কাপড়, দুধ আরো প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিল। যদিও সব ইহানের টাকায়। কিন্তু কিছু করতে পারলে, এগুলোর মূল্য ইহান কে পাঠিয়ে দিবে। কারো ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি তে বাধা দিতে চায় না রুমাইসা। শ্বাশুড়ি আজ যা শুনিয়ে গেল তারপর এখানে থাকার কোন মানে ই হয় না। কান্না পাচ্ছে অনেক, নিজের আর মেয়েটার জন্য।ভুল তো ওর ছিল না শুধু , ভুল টা অভির ও ছিল। অথচ কি আশ্চর্য দুনিয়া আর সমাজের নিয়ম। শাস্তি আর কলঙ্কিনী কথাটা কেবল ওর গায়েই লেগে গেল। কেন এই সমাজ একটা পুরুষ কে কলঙ্ক দেয় না। আশেপাশে কত হাজার মানুষ আঙুল তুলে বলবে নোংরামি করেছে মেয়েটা। পাপের ফসল এই মেয়ে। অথচ নোংরামি তো ও একা করে নি। আর পাপ কেন হবে! ভালোবাসা না পবিত্র , তাহলে তার ফসল কিভাবে পাপ হয়। তবে রুমাইসার সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গেছে অভির ডাকে সাড়া দেওয়া। হয়ত এজন্য আল্লাহ ও কে শাস্তি দিচ্ছে এখন ও।

চোখের পানি মুছে রুমাইসা ব্যাগ টা দরজার কাছে রাখল। রুমে ডিম লাইট জ্বলছে। ইহান লম্বা হয়ে শুয়ে আছে।পাশে ইহিতা হাত পা নেড়ে খেলছে। রুমাইসা ইহিতার সামনে যেয়ে দেখল ও ইহানের দিকে ঘুরে ওর শার্ট এর উপর হাত লাগাচ্ছে আর একটু পর পর হাসছে। ইহিতার হাসি দেখলে বুক টা ঠান্ডা হয়ে যায়।রুমাইসা ইহিতার দিকে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলতে গেল।আর ঠিক তখনি ওর হাত টা ইহান চেপে ধরল। রুমাইসার সারা শরীর যেন মুহুর্তের মাঝে বরফ ঠান্ডা হয়ে গেল। রুমাইসা তাকিয়ে দেখল ইহান চোখ খুলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রুমাইসার হাত পা যেন থর থর করে কাপতে লাগল।

রুমাইসার হাত ছেড়ে ইহান বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। বেড সুইচ টা অন করতেই পুরো রুম আলোকিত হয়ে গেল। সেই আলোর ছটা রুমাইসার মুখে এসেও পড়ল। রুমাইসা মুখ টা ফ্যাকাশে করে তাকিয়ে রইল ইহানের দিকে। লোকটা মনে হচ্ছে ও কে খেয়ে ফেলবে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দরজার সামনে ব্যাগের দিকে তাকাতেই গলা শুকিয়ে গেল।ইহান দেখে ফেলেছে এতক্ষনে হয়ত। পরক্ষণেই মনে জোর ফিরে আসল। যে উদ্দেশ্য নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, ইহান কিছু বললে মুখের উপর সেটাই বলে দিবে।

তবুও লোকটা কে খুব ভয় করছে। বিয়ের দিন রাতে কিভাবে ধরেছিল কোমড়ে এখনো ভুলে যায় নি। দুই দিন সেখানে হাত দিয়ে ধরে ব্যথা অনুভব করেছে।আজ কি করবে আবার। ইহিতার কাছে যাওয়ার জন্য বিছানায় পা রেখে বসতে যাবে আর ঠিক সে সময় ইহান হাত ধরে দাড় করিয়ে দিল।

রুমাইসাকে দেখলে যে কেউ বলবে সে এখন খুব রকমের ভয় পাচ্ছে। ইহান আঙুল দিয়ে ব্যাগের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করল “ব্যাগ প্যাক করার কারন কি? ”

রুমাইসা সাথে সাথে কোন উত্তর দিতে পারল না। অথচ মনের ভেতর হাজার উত্তর ঘুরছে। ইহান এবার ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি আপনাকে এগুলার মানে কি? ”

রুমাইসা অবাক হল। ইহান ও কে আপনি বলে নি বিয়ে করার পর একবার ও। আজ কেন বলছে “আপনি।”
কোন মতে খুব আসতে করে বলল “চলে যাচ্ছি। ”

ইহান রাগে অগ্নিমূর্তির রূপ নিল। ও আবার জিজ্ঞেস করল “কার অনুমতি নিয়ে চলে যাচ্ছো? আমি কি বলেছি যেতে? ”

রুমাইসা মাথা ঝাকিয়ে না বলল।

ইহান জোরে চিৎকার দিয়ে জিগ্যেস করল “তাহলে কে বলেছে যেতে? ”

রুমাইসা ভয়ে কাপতে লাগল। সাথে ইহিতাও কান্না করে দিল এত জোরে আওয়াজ শুনে। রুমাইসা কিছু বলতে পারছে না। ইহান ঝুকে গিয়ে ইহিতা কে কোলে তুলে নিল। কিছুক্ষন আদর করতেই চুপ হয়ে গেল। রুমাইসা একবার হাত বাড়িয়ে নিতে চাইলেও ইহান আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিল।ইহিতাকে কোলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই ঘুমিয়ে পড়ল। ইহান কপালে আলতো একটা চুমু দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। রুমাইসার নিজের কাছে কেন জানি নিজেকে অপরাধী লাগছে। ইহান ইহিতার জন্য যা করে তা একটা বাবার দায়িত্ব বা ভালোবাসা থেকে কোনভাবেই কম না। কিন্তু ইহান কে আবার সামনে দাড়াতে দেখে রুমাইসার চিন্তার জগত এর সবকিছু হাওয়ায় উড়ে গেল।

“কে যেতে বলেছে আপনাকে উত্তর দিলেন না? ”

রুমাইসা মৃদু স্বরে বলল “কেউ না। ”

ইহান এবার নিজের পা আরো কয়েক ধাপ এগুলো। দূরত্ব খুব বেশি না। ইহান আবার জেরা শুরু করল।

“কেউ যেতে যখন না বলেছে তবে যাচ্ছেন কেন? ”

রুমাইসা উত্তর দিচ্ছে না একদম। ইহান এবার এত জোরে ধমক দিল যে রুমাইসা কেপে উঠল আর সাথে সাথে হেচকি তুলে কান্না করতে লাগল।

“কি জন্য যাচ্ছেন এখান থেকে? ”

“আমরা আপনার লাইফের উপর বোঝা। উটকো ঝামেলা আমরা। নোংরা মেয়েকে ঘরে এনেছেন। আরেকজন এর ফেলানো জিনিস কে নিজের ঘরে তুলেছেন। আপনার লাইফ, আপনার সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছেন আপনি। কত সুন্দর আর বড়লোকের মেয়েরা আপনার অপেক্ষা করে। আমি এতিম আর আমার মেয়েটাও এতিম। এতিমদের কেউ ঘরে আনে মা।অথচ আপনি আমার মত একটা নোংরা নষ্ট জিনিস নিয়ে ঘরে এনেছেন। আমরা ঝামেলা আপনার জন্য। তাই চলে যেয়ে মুক্তি দিচ্ছি।”

ইহান এর রগ গুলো কেবল ফুলছে। ভেতরের রক্তে যেন আগুন জ্বলছে এসব কথা শুনে। মুখ টা লালচে বর্ণ ধারন করেছে এসব শুনে। রুমাইসা তাকানোর সাহস পাচ্ছে না কেবল কাপছে । অথচ অভিকে দেখে কোন দিন ওর ভয় লাগত না। সেটা হয়ত ভালোবাসা ছিল আর এটা সত্যি ই কারো ভয়।

ইহান এবার ওর একদম কাছে এসে দাড়ালো। ওর হাত টা শক্ত করে চেপে ধরল। এত শক্ত যে ব্যথা পাচ্ছে রুমাইসা প্রচন্ড ব্যথা পাচ্ছে। ও ইহান কে বারবার অনুরোধ করছে ছাড়ার জন্য। ৫ মিনিট এর মত ইহান হাত টা ধরে রাখল এভাবে আর এক দৃষ্টিতে রুমাইসা কে দেখছিল। তারপর হাত ছেড়ে দিতেই রুমাইসা ব্যথায় আরেক হাত দিয়ে হাত টা চেপে ধরল।

ইহান চেচিয়ে বলল “ফারদার এসব কথা মুখে আনলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আর এটা মাথায় ঢুকিয়ে নিবেন যে, ইহিতা কোন কুলাঙ্গার এর পরিচয় এ বড় হবে না। ইহিতা আমার মেয়ে, ইহান তালুকদার এর মেয়ে। আপনার যেতে ইচ্ছে হলে যেতে পারেন যেখানে খুশি। বাট ইহিতা কে নিয়ে কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করল আজকের থেকে ভয়াবহ অবস্থা করব। ইহিতা আমার মেয়ে মাথায় ঢুকিয়ে নিবেন। ও এতিম না, আর কোন রাস্তার মেয়ে না। ”

রুমাইসা ফুপাতে ফুপাতে কথা গুলো শুনছিল। ব্যথায় হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইহানের কথা শুনে বুকের মাঝে যেন প্রশান্তি ছায়া বয়ে যাচ্ছে। হুট করে ওর মনে হল শ্বাশুড়ি বলেছিল ওনার বান্ধবীর মেয়ের কথা।

রুমাইসা ভাঙা গলায় প্রশ্ন করল “আপনার জন্য তো মা আগেই মেয়ে দেখেছে। সে তো আপনাকে অনেক সম্পত্তি দিতে পারত। তবে সব ছেড়ে এই বাড়ির এইটুকুন সম্পত্তির দিকে আপনার এত আগ্রহ কেন? ”

ইহান এই কথা শুনে রুমাইসার দিকে তাকাল। ওর বুঝতে বাকি নেই এসব করার পেছনে কার কথা কাজ করছে। ও তবুও কথাটা এড়িয়ে চলে গেল। কিন্তু রুমাইসার জেদ চেপে বসেছে। ও ইহানের পিছু পিছু এই প্রশ্ন করতে করতে ছুটছিল। আজ জানতেই হবে ইহানের আসল উদ্দেশ্য কি। জানতে চায় ও, একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সাথে ও কে জড়ালো কেন ইহান।

ইহান উত্তর দিচ্ছিল না বলে রুমাইসা ওর হাত টেনে ধরল পেছন থেকে। ইহান দাত এ দাত ঘষতে ঘষতে ওর দিকে তাকাল।

“আপনার উত্তর আপনি পেয়েছেন। এখন আমি আমার উত্তর চাইছি। আপনি দিতে বাধ্য। বলুন আপনার উদ্দেশ্য কি? ”

ইহান চোখ রাঙিয়ে বলল “আমার উদ্দেশ্য আপনাকে নিয়ে সংসার করা। উত্তর পেয়েছেন এবার হাত ছাড়েন। ”

রুমাইসা উত্তর শুনে বোকা বনে গেল। সংসার করা মানে কি, কিছুদিন আগেই না বলল সে সম্পত্তি চায়। আজ আবার কিভাবে উদ্দেশ্য পাল্টে গেল।

আবার প্রশ্ন করবে ঠিক তখনি ইহান বলল “ঘুমাবো আমি। সকালে অফিসে যেতে হবে কাল। যদি আর একবার আমাকে ছেড়ে পালানোর কথা ভেবেছেন তবে আমি আপনাকে সেখানেই মেরে ফেলব। হিসাব বুঝে নিয়েন। ইহান এর কথার অবাধ্য হতে যেয়েন না। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়েন ওই পাশে। বেশি কাহিনি করলে এখন আমার পাশে শুইয়ে রাখব। আর কারো কথায় যদি প্রভাবিত হয়ে কোন ডিসিশন নিবেন তো বুঝে নিয়েন। এটা আপনার লাইফ একা না, সাথে ইহিতা আছে। মানুষ ও কে কেন এতিম বলার সুযোগ পাচ্ছে জানেন? কারন আপনি সেই সুযোগ দিয়েছেন। আপনি ভালোবাসায় এত অন্ধ ছিলেন যে আপনি আপনার সেই সো কল্ড প্রেমিক কে বিয়ের কথা নিয়ে জোর করতে পারেন নি। সামান্য ভালোবাসা দেখিয়েছে আর আপনি গলে গেছেন। বাস্তবিক হতে শিখুন রুমাইসা। এই দুনিয়া কারো জন্য থেমে নেই। আপনি এই বাড়িতে আছেন বলে কি সাহিল এর লাইফ থেমে গেছে না তৃষার লাইফ থেমে গেছে? ওরা আজ হয়ত ঝামেলায় আছে কাল ঠিক করে নিবে। কিন্তু আপনি কি করবেন? এটা বাংলা সিনেমা না যে আপনি রাস্তায় রাস্তায় কাজ করে মেয়ের জন্য কিছু করবেন। আপনার সাথে সেদিন কি ঘটছিল আপনার মনে পড়ে। আমি জানি না আল্লাহ সেদিন কি ভাবে আমাকে সেই রাস্তায় সেই জায়াগায় নিয়ে গিয়েছিল। আমি কোনদিন সে রাস্তায় বাড়ি ফিরি না। অথচ সেদিন প্রচন্ড জ্যাম থাকায় ওই রাস্তায় যেতে বাধ্য হয়েছে। আর আল্লাহর রহমতে আমার চোখ টাও ওইদিকে গিয়েছিল। কারো বুঝার উপায় নেই ওই দিকে কিছু হচ্ছিল। আমার চোখেই কেন যেন ব্যাপার টা ধরা পড়ে। আপনি সবকিছু কে কেন পজেটিভলি নিচ্ছেন না। আপনি নোংরা, এই কথাটা অন্য কাউকে বলার সুযোগ দেন কারন আপনি নিজেই নিজেকে এটা ভাবেন। দোষ তো আপনার একা না। তবে শাস্তি আপনার একা পাওয়ার কথা না। যখন একটা ভালো লাইফ পেয়েছেন সেটাকে ব্যবহার করতে শিখুন। বাংলাদেশ এর সমাজ ব্যবস্থা ই এমন যে সব দোষ নারীর।সেজন্য আপনি এটা মনে নিয়ে এভাবেই লাইফ কাটাবেন সেটা কিভাবে হবে। বরং নিজেকে সেভাবে প্রমান করুন যাতে কেউ আঙুল তুলতে না পারে আপনি এমন কিছু করেছেন কোনদিন। যতদিন বেচে আছি আমি ইহতাকে এতিম নামক শব্দ টা গায়ে লাগতে দিব না। আর আপনার যদি আমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে যেতে পারেন। চয়েজ আপনার, তবে ইহিতা কোথাও যাচ্ছে না। আমার মেয়ে তার প্রাপ্য অধিকার এই বাড়িতে পাবে। যে ওর অধিকার নিবে তার পরিণতি কি হবে সেটা সে সময় মত বুঝবে।”

ইহান দম নিল সবকিছু বলা শেষ এ। রুমাইসা হা করে এতক্ষন সব শুনছিল। কথা শেষ হতেই মাথায় জট পাকাতে লাগল এই ইহান আসলে কি চায়। সম্পত্তির উদ্দেশ্য থাকলে এত গুলো ভালো উপদেশ কেন দিল। মাথা কাজ করে না রুমাইসার। ইহান ও কে টেনে বিছানায় ফেলে দিল। আর নিজে নিজের জায়গায় যেয়ে শুয়ে পড়ল। রুমাইসা অবাক হয়ে বলল “কি ব্যাপার এমন করলেন কেন!! ”

“চুপচাপ ঘুমান। অনেক চিন্তা করেন আপনি। আপনি কি জানেন আপনার ঘুম প্রয়োজন। অথচ সারারাত জেগে একটা ফালতু লোকের জন্য পানি ফেলেন। ”

রুমাইসা আবার শকড হল। তার মানে ইহান ওর সবকিছু তেই লক্ষ্য রাখে। কেমন যেন খুশি খুশি লাগছে। এটা কেমন খুশি ও জানে না। কিন্তু এই লোকের এই কথায় ওর বেশ খুশি লাগছে আজ।
বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুমের দখলে চলে গেল।

ঘুম ভাঙল ইহানের আওয়াজে। চোখ খুলতেই দেখল ইহান শুইয়ে ইহিতাকে হাত দিয়ে উপরে উঠিয়ে খেলছে। ইহিতা হাসছে শব্দ ছাড়া আর ইহান খুশিতে বারবার গালে চুমু দিচ্ছে।রুমাইসা চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে । আজ বহুদিন পর একটু শান্তি মত ঘুমাতে পেরেছে। কাল রাতের সবকিছু মনে আছে। কিন্তু সবকিছুর মাঝেও এইটুক শান্তি লোকটা ওর পাশে ছায়ার মত লেগে আছে। চোখ বন্ধ করে ফেলল রুমাইসা।
ছায়াটা সারাজীবন ওর পাশে থাকলে হয়ত ও শক্ত পায়ে দাড়াতে পারবে আবার।

l

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here