শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ১৫
সবাই খেতে খেতে রুমাইসার রান্নার বেশ প্রসংশা করল। আচার ব্যবহার , গুন সবকিছু ই মন কেড়েছে সকলের। কিন্তু যখনি ওর পরিবার নিয়ে প্রশ্ন উঠল ঘরের সবাই চুপসে গেল। ইহান ই উত্তর টা দিল, ওর বাবা-মা নেই। এটা শুনে কয়েকজন আফসোস করে বলল “আহারে এতিম মাইয়া।”
রুমাইসার বুক টা তখন ছিড়ে যাচ্ছিল। মানুষ গুলো এমন কেন করে।কারো উপস্থিতি তে তাকে আঘাত করেই কেন কথা বলতে হবে। তবুও রুমাইসা ধৈর্য ধরে হাসিমুখে রইল সবার সামনে। বিকাল ৪.৩০ টায় নিজে খাওয়ার সুযোগ পেল। রান্নাঘরে এক কোনায় বসে খাচ্ছিল রুমাইসা। অথচ শ্বাশুড়ি ও কে খাওয়ার জন্য একবার ও তাগিদ দেয় নাই বা ওনাদের সাথে বসতেও বলে নি। ইহান ধমক দিয়ে খেতে পাঠিয়েছে। লোকটা ওর এত খেয়াল করে সবকিছু নিয়ে যে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয় ওর। অর্ধেক খাবার খাওয়ার সময় শ্বাশুড়ি এসে হাজির। ও কে দেখে এক ভ্রু উচুতে তুলে বলল “খাচ্ছো তাড়াতাড়ি খাও। রাতের রান্না বসাতে হবে। ওরা খেয়ে যাবে সবাই। ”
রুমাইসা প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বলল “আম্মা এখন কি রান্না হবে?”
“বিরানি বসাও আর চিকেন ফ্রাই কর সাথে সবজি রান্না কর বাড়িয়ে। দুপুরের টা তো আছেই সাথে পরিমাণ হিসাব করে বাড়িয়ে রান্না কর। কেউ ভাত খেলে সবজি দিয়ে যেন খেতে পারে। আর ডিম ভেজে রেখ। তাড়াতাড়ি খাও, আবার রাতের জন্য তাড়াতাড়ি রান্না বসাতে হবে।”
রুমাইসা স্তব্ধ হয়ে গেল। এমন মানুষ জীবনেও দেখি নি।ওর বাসায় অনুষ্ঠান হলে এত আইটেম করতে দেখি নি কোন দিন। তাও এত মানুষের আইটেম হলে বাবুর্চি সব করত। আর এখানে তো…..
দুপুরের ভারী খাবারের পর আবার এত ভারী খাবার রান্না করতে হবে।এমনেই সারা শরীরে ব্যথা, রাতে ইহিতা ঘুমাতেই দিবে না।কোন মতে প্লেটের খাবার শেষ করে আবার কাজে লেগে গেল। মিলি কে নিয়ে হাতাহাতি সব কাটল। মিলি কথায় কথায় বলল “ভাবী জানেন না এর বাপের বাড়ির মানুষ কি খাউকা স্বভাবের। তাও তো আজকে দুপুরে আসছে। অন্য দিন সকালে আসে। তিন বেলার খাওন খাইয়া আবার প্যাকেট কইরা সাথে নিয়া যায়।কি যে রাক্ষস গুষ্টি। সাহিল ভাইয়ের বিয়ার দিন তো হুলুস্থুল কান্ড হইসে ভাবী। এরা বউয়ের বাড়ির মানুষ আসার আগেই খাওন টিফিন বাটি দিয়া নিয়া গেসে। পরে খালুর আবার রান্না বসাইতে হইসে তাড়াতাড়ি। কি একটা লজ্জার কাহিনি হইসিল। ”
মিলি এক মনে এসব কাহিনি বলছিল। কিন্তু ও মোটেও লক্ষ্য করে নি যে,সাহিলের বিয়ের কথা শুনে ওর মুখের রং পাল্টে গেছে।
সন্ধ্যায় যখন রান্না করছিল হঠাৎ একটা মেয়ে রান্নাঘর এ ঢুকল। হিজাব পড়া ওয়েস্টার্ন ড্রেস এ। রুমাইসা ঠিক চিনতে পারল না এটা কে।কারণ কম বেশি সেখানে সবার সাথেই পরিচিত হয়েছিল ও। এটা কে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা এদিক ওইদিক দেখতে লাগল ঘুরে ঘুরে। রুমাইসা সৌজন্যের খাতিরে প্রশ্ন করল ” কিছু লাগবে আপনার আপু?”
মেয়েটা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল “তুমি কি ইহানের বউ? ”
“জ্বি। কেন! ”
“আমি ইহানের বড় খালার মেয়ে। মাত্র ই আসলাম। আসার ইচ্ছে ছিল না। বাট দেখতে আসলাম ইহান কোন বিশ্ব সুন্দরী কে বিয়ে করেছে।”
রুমাইসা কপাল কুচঁকে প্রশ্ন করল “সরি, বুঝতে পারলাম না আপু।”
“হোয়াটএভার, তোমার বুঝে কাজ নেই। বাচ্চা নাকি হয়েছে তোমাদের শুনলাম? ”
“জ্বি। ” রুমাইসার কেমন অস্বস্তি লাগছে। কেউ নেই রান্নাঘরে।
“বাহ, ইহান তো সেই খেলোয়াড় । এটিটিউড দেখায় এসব প্রেম ভালোবাসা কেয়ার করে না অথচ নিজে বাচ্চা ও হওয়ায় ফেলছে। স্ট্রেঞ্জ!!! ”
একে তো সকাল থেকে চুলার সামনে রান্না করছে তার উপর এসব কথা। রুমাইসা প্রতিটা কথায় প্রচন্ডভাবে বিরক্ত আর রাগান্বিত হচ্ছিল।কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করছিল যাতে আজেবাজে কিছু না বলে বসে। মেয়েটা রুমাইসার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখল ভালো করে। তারপর বলল –
“লিসেন এই ইহান হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ভন্ড। প্রথমে প্রেম করল রুহির সাথে। রুহির বিয়ে হতেই প্রেম করে বাচ্চা, বিয়ে সব তোমার সাথে হওয়ায় ফেলল। সে একটা চাল্লু চিজ। অন্ধ বিশ্বাস করতে যেও না ওই রাস্কেল টার উপর। কয়দিন পর কার দিকে চোখ যায় কে জানে। ক্যারেক্টারলেস একটা। ”
এবার রুমাইসা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। চিৎকার করে বলল “শাট আপ। অনেক সময় যাবত আপনার আজাইরা কথা শুনছি আমি
ইহানের বোন বলেই সম্মান দিচ্ছিলাম।কিন্তু আপনাকে এখন বিন্দুমাত্র সম্মান দেখানোর ইচ্ছা আমার নেই।সো জাস্ট লিভ নাউ।আপনার ফালতু উপদেশ নিজের কাছেই রাখুন। আর আপনি যেহেতু আমাদের বাসায় ইনভাইটেড তাই দয়া করে নিজের জায়গায় যেয়ে বসুন। মেহমান রা এদিক সেদিক ঘুরে না স্পেশিয়ালি রান্নাঘরে। ”
মেয়েটার চেহারা রাগে উজ্জ্বল হয়ে গেল। এত গুলো কথা আজ পর্যন্ত এ বাড়ির কেউ ও কে শুনায় নি।অথচ এই দুই দিনের মেয়ে কিনা যা ইচ্ছে তাই বলছে ও কে। ও আরো কিছু বলতে যাবে তখনি মিলি চলে আসল রান্নাঘর এ। মিলি ও কে দেখেই বলল “আরেহ জুই আপা, কিছু লাগব? ”
জুই কিছু না বলেই প্রস্থান করল ঝড়ের বেগে। মিলি একটু অবাক হল। রুমাইসাকে কিছু বলতে যাবে দেখল রাগ রাগ ভাব হয়ে আছে চেহারায়।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই আসতে আসতে যেতে শুরু করল। ওই মেয়েটার সাথে যতবার চোখাচোখি হয়েছে ততবার ই ও কেমন করে যেন রুমাইসার দিকে চেয়ে ছিল। ইহান সবাইকে বিদায়ের সময় এটা সেটা বললেও ওই মেয়েকে কিছুই বলল না। ওই মেয়েও নিজের থেকে কথা বলে নি।রুমাইসা ভাবল ইহান কেই বলবে সরাসরি রাতে।
সারাদিন পর তৃষার কোল থেকে ইহিতা কে নিল। রুমাইসা অবাক হয়েছিল যে ইহিতা তৃষার কোলে চুপচাপ ছিল, আবার তৃষাও নিজে থেকে ও কে কোলে নিয়েছে।মেয়েকে দেওয়ার সময় তৃষা রুমাইসা কে একটা কথাও বলে নি। রুমাইসা কেবল একটা ধন্যবাদ দিয়েছে। তৃষা চলে যেতেই, মেয়েকে নিয়ে রান্নাঘরে গেল ওর খাবার টা নিতে।যেই খাবার প্লেট নিয়ে বের হতে যাবে তখনি অভির মুখোমুখি হল। রুমাইসা এক হাতে মেয়ে আরেক হাতে প্লেট টা শক্ত করে ধরল। এই লোকটা কে দেখলে শরীরে রক্ত বলকাতে থাকে উচ্চ তাপে। অভি ও কে দেখে জিজ্ঞেস করল “কেমন আছো রুমাইসা? ”
রুমাইসার সারা গায়ে যেন এসিডে ঝলসাতে লাগল।একে এই পরিনতি দিয়েছে আবার জিজ্ঞেস করছে কেমন আছে। কতটা নির্লজ্জ আর বেহায়া এই লোকটা।
ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসল না দেখে অভি আবার বলল “সারাদিন বুঝি খাও নি। এখন বেশি করে খেয়ে নিও।না হয় শরীর দুর্বল হবে।”
হয়তো আগের পরিস্থিতি হলে রুমাইসা খুশি হত।কিন্তু এসময় ওর ইচ্ছে করছে অভিকে কথা শুনাতে।কিন্তু এই প্রতারক এর সাথে দুইটা কথা বলে নিজের সময় ওয়েস্ট করতে চায় না ও।
রুমাইসা ও কে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।অভি শূন্য দৃষ্টিতে মলিন মুখে চেয়ে রইল রুমাইসার চলে যাওয়ার পথে। সারাদিন পর এই একটা ধকল যেন নতুন করে আবার যুক্ত হল। রাগ নিয়ে রুমে গেল। মেয়েটা কে এক রকম জোরেই বিছানায় শুইয়ে দিল। হাতের প্লেট টা কেও ধাম করে টেবিলে রাখল। এই বাড়িটা কে ওর কাছে নরক এর মত লাগছে এখন। পালিয়ে যেতে পারলে বেঁচে যায়।
ইহান রুমে এসে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বলল “কি ব্যাপার সারাদিন চুলোর সামনে থেকে কি ভুলে গেছ গরম লাগা কি জিনিস? ”
কোন জবাব আসল না বিপরীত দিক থেকে। ইহান বিছানায় ইহিতার কাছে গেল। “ওরেহ, আমার পাপা টা কি করে রে দেখি দেখি। ”
ইহিতার সাথে দুষ্টুমি করতে লাগল। এদিকে রুমাইসা হাটু উঠিয়ে মুখ ভার করে বসে আছে।
ইহান দেখে বলল “কি হল ! খাচ্ছো না কেন তুমি! সারাদিন তো পরিশ্রম করতে করতে গেল। এখন একটু খেয়ে নেও। বাই দ্যা ওয়ে আজকের রান্না টা সেই হয়েছে। আমার তো পেট ড্রাম হয়ে গেছে খেতে খেতে। ”
এই কথা বলার পর ও রুমাইসার কোন লক্ষন নেই রেস্পন্স করার। মূর্তির মত চেয়ে আছে। ইহান এবার সিরিয়াস হয়ে গেল। রুমাইসার সামনে যেয়ে বসল। রুমাইসা ও কে দেখে উঠে যেতে চাইল কিন্তু ইহান হাত ধরে আটকে ফেলল। রুমাইসার কি যেন হল। রেগে গিয়ে বলল “হাত ধরেছেন কেন? আর আমাকে আটকাচ্ছেন কেন? সব সময় কি আপনি যা চাইবেন তা হতে হবে! আপনার কথায় উঠব বসব আমি। বিয়ে হয়েছে বাট আমরা মন থেকে এই সম্পর্কে বাধা নেই ভুলে গেছেন? নাকি প্রতিবেলায় একবার করে মনে করিয়ে দিব! সবকিছু তে জোর দেখাবেন না আমাকে।নিজের মত নিজে থাকুন, আমাকেও থাকতে দেন।স্বার্থ উদ্ধার হলে তো ফেলেই দিবেন বাইরে। সো স্টে এওয়ে ফ্রম মি।এত দরদ দেখাতে হবে না আপনার।”
শেষ লাইন গুলো ইহান কে এত বেশি আঘাত করল যে রুমাইসার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারল না । দ্রুত বিছানা থেকে উঠে রুম থেকে চলে গেল। ওর যাওয়ার পর রুমাইসা ধপ করে বসে পড়ল।
বাহিরের ঘন অন্ধকার এর মত রুমাইসার মনে অন্ধকার জমে আছে। এত কথা শুনানোর পর অন্ধকার যেন আরো ঘনীভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি বর্ষন হবে। কিন্তু বজ্রপাত এর ন্যায় মনের ভেতরের ছটফটানি ক্রমশ বাড়ছে।কারণ ও সেই মানুষ টা কেই কষ্ট দিয়েছে, যে সারা দুনিয়ায় ওর ঢাল হয়ে দাড়িয়েছে । সারাদিন এ একশবার ওর এটা সেটা খোঁজ নেওয়ার মত ব্যক্তি টা কে আজকে ও দূরে সরে যেতে বলল।
সত্যি ই কি লোকটা দূরে সরে যাবে? ওদের সম্পর্ক টা কি এবার বদলাতে যাচ্ছে তবে!
.
Tanisha Ahmed