#শ্রাবণের_ধারা (৬ষ্ঠ পর্ব)
#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম
~আর কিছু বলতে না দিয়ে রাদিফকে ধরে নিয়ে গেল আবির। এইদিকে ওদের কা*ন্ড দেখে হা করে দাঁড়িয়ে আছি।
— এতো অদ্ভুত কেন ছেলেটা? কথা পর্যন্ত শেষ করতে দিলো না।
ক্লাসে এসে বসে আছি এইদিকে স্যারের আসার খবর নেই। স্যার আজকে কি নিয়ে বলবেন এইটাই ভাবছি। ওইদিকে আজকে আবির আমার পিছনে সিটে না বসে একদম লাস্ট সিটে রাদিফকে নিয়ে বসে পড়েছে। দুইজনকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছে। কি নিয়ে কথা বলছে এটা বুঝতে পারছি না তবে দুজনকেই খুব সিরিয়াস লাগছে। ওদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, আবির হঠাৎ আমার দিকে তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিলাম। “এখন কি ভাববে? আমি এইভাবে তাকিয়ে ছিলাম ছি ছি!!” হঠাৎ পাশ থেকে শুনতে পেলাম,
— কি রে? আবিরের সাথে ওইটা কে?
— নতুন এসেছে।
— এইটাও? এরা এতো দেরিতে কি মুড়ি ভাজতে এসেছে?
— আমি কিভাবে বলবো বল? দুইটাই এতো দিন পর কি কাজে এসেছে আল্লাহ ভালো জানেন।
— তবে যাই বল ওইটাও কিন্তু দেখতে সেই।
— জিনিয়া তুই পারিসও বোন!! একবার আবির একবার রাফিদ কি শুরু করলি?
— রাফিদ? ওর নাম রাফিদ?
— হ্যা। তখন ক্লাসে আসার পথে দেখা হয়েছিল।
— বাহ্ বাহ্ তুমি তো দেখি এক এক করে সবাইকেই চিনে যাচ্ছিস।
— হ্যা তা ঠিক। এসব বাদ দে জানিস গতকাল রাতে আমি একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম।
— কি?
— তূর্যর কথা। দেখ অনেকদিন তো হলো ওর দেখা নেই, ভার্সিটিতে পর্যন্ত আসে না। আমি বুঝতে পারছি না ওর মাথায় কি চলছে আর কি প্ল্যান করছে।
— ওহ্ ভালো কথা মনে পড়েছে। গতকাল তুই যাওয়ার অনেকক্ষণ পরে…….
এমন সময়ে ক্লাসে স্যারের আগমন হওয়ায় জিনিয়া আর কথা শেষ করতে পারলো না। স্যার ক্লাসে এসে হালকা কেশে বলা শুরু করলেন,
— শিক্ষার্থীরা আজকে তোমাদের সাথে আমার ক্লাস নেই তবুও একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এলাম। আর কয়েক মাস পরে তোমাদের পরীক্ষা, যতো পরীক্ষার সময় আগাবে তোমাদের বইপত্রের সাথে ব্যস্ততা বেড়ে যাবে। আমি চাই এর আগেই তোমরা একটু রিল্যাক্স হও। এই ১ সপ্তাহের মধ্যে তোমাদের ব্যাচের সবাই মিলে ভার্সিটি প্রাঙ্গনে ছোটখাটো একটু আয়োজন করো। নিজেদের মতো করে দিনটা পার করো এতে তোমাদের মন রিল্যাক্স হয়ে যাবে। আশা করি আমার এই প্রস্তাবে তোমাদের আপত্তি নেই?
সবাই একসাথে স্যারের প্রস্তাবে রাজি হলাম। এই প্রস্তাবে কে না বলবে? এই সুযোগ কি ছেড়ে দেয়া যায় না কি? একদিনের জন্যই হোক, সবাই মিলে আনন্দ করলে তো ভালোই হবে। এমনিতেই প্রকৃতি শীতের আভাস দেয়া শুরু করেছে তার আগেই শরতের রং গায়ে মাখতে হবে।
———————
গ্ৰুপ নিয়ে বসেছি সব ভার্সিটির প্রাঙ্গনে। স্যার যেহেতু আমাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন তাই আমাদের ভেবে সবটা করতে হবে। আলোচনা সভা জমজমাট হয়ে উঠেছে।
— আচ্ছা তোরা নাচানাচি করবি না?
— হ্যা কেন নয়। তোকে দিয়েই নাচের শুরু করবো ঠিক আছে সাব্বির?
— আরে আমি কি সেটা বললাম না কি।
— আচ্ছা তোরা যাই বলিস, আমাদের ব্যাচে অনেক বড় এক এক শিল্পী আছে, প্রতিভাবান মানুষ আছে। এরা থাকতে আমাদের এতো চিন্তা কিসের?
— এটা আনিকা ঠিক বলেছে। গানের সভা বসাবো একটা। এরা ফেমাস হওয়ার আগেই এদের গান একান্তে শুনে নিতে হবে।
— “আমরা কি আলোচনায় আসতে পারি?”
পিছনে ঘুরে দেখি আবির আর রাদিফ দাঁড়িয়ে আছে। রাফিদ মুখে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও আবির সেই বাংলার পাঁচের মুখ নিয়ে প্যান্টের পকেটে এক হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। এখন তো এটাকে দেখে আমেজটাই উড়ে গেল। মানে হাসতেও পারে না? জীবনে কোনো মধু খায়নি মনে হয়। এজন্যই যেমন মুখ তেমন কথা!
— উত্তর পেলাম না যে? আমরা আসতে পারি?
— কেন নয়? আপনারা তো নতুন স্টুডেন্ট তাই না?
— ঠিক নতুন না। ক্লাস করতে এসেছি দেরিতে এই আর কি।
— আপনারা বসে পড়ুন, আমরা আলোচনা চালিয়ে যাই তার সাথে।
দুইজনে মিলে বসে পড়ল, রাফিদ একদম সামনে এসে বসেই একটা মুচকি হাসি দিল। আবির একবার রাফিদের দিকে তাকালো আবার আমার দিকে। কি যে ভাবছে কে জানে। আমরা আলোচনা চালিয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো কালকে সকাল থেকে আয়োজন শুরু করবো আর বিকালটা আমাদের।
কথাবার্তা শেষে সবাই যার যার মতো করে চলে গেল। আবিরকে একটা গাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওদিকে এগিয়ে গেলাম।
— তোমার সাথে কথা আছে।
— বলো কি বলবে।
— গতকাল খুব বেশি জিজ্ঞেস করিনি তবে আজকে আমি উত্তর চাই। তুমি ওই সময়ে যে ফাইলের জন্য ভার্সিটিতে এসেছিলে ওইটাতে কি আছে এমন?
— এই ব্যাপারে কথা উঠছে কেন? এইটা দিয়ে তো তোমার কাজ নেই।
— আমি জানতে চাই তাই জিজ্ঞেস করছি। ওই ফাইলে এমন কি ছিল? অবশ্যই এমন জিনিসের জন্যই গিয়েছিলে যা সবার সামনে নেয়া যায় না।
— ধারা এইসব নিয়ে কথা যতো কম বলবা তত তোমার জন্যই ভালো। নিজের বি’প’দ নিজে ডেকে এনো না।
— আমি এসব জানি না। আমার উত্তর চাই।
— কিসের উত্তর চাইছো আবিরের কাছে?
— না মানে রাদিফ আসলে..
— ওর কাছে উত্তর চেয়ে লাভ নেই ধারা। আবির এমনিও কিছু বলে না ওমনিও কিছু বলে না। তুমি তোমার মূল্যবান সময় ন’ষ্ট করো না।
রাদিফের সামনে আর কিছু বলা সম্ভব না তাই ওখান থেকে প্র’স্থা’ন নেয়াই ভালো মনে হলো। রা’গি চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে চলে যেতে নিলাম, যেতে শুনতে পেলাম,
— ফাইলের ব্যাপারে ও কিভাবে জানলো? আমাকে আগে বলিস নাই কেন?
ওয়েট! তারমানে রাদিফ জানে? গতকাল রাতে যে আবির এখানে এসেছিল এটাও জানে? আর ফাইল? ওটার বিষয়েও জানে। কিন্তু গতকাল যে আমিও আবিরের সাথে ছিলাম এই বিষয়ে জানে না? কথা শুনে মনে হচ্ছে আবির বলেনি কিন্তু লুকিয়ে গেল কেন?
———————–
মনোমুগ্ধকর একটা সকাল, আজ সকাল সকাল সবাই উপস্থিত। প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছি সবাই। খুব বড়সড় কিছু না তবে নিজেদের মতো করে ভার্সিটির প্রাঙ্গনটা একটু সাজাবো। আমিও যথারীতি কাজে যোগ দিলাম এর মধ্যে জিনিয়াও এসে পড়লো। সবাই মিলে তাড়াতাড়ি কাজ আরম্ভ করে দিলাম।
ধীরে ধীরে সময় চলে যাচ্ছে আর আমাদের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় দুপুর হতে চললো, হঠাৎ শুনতে পেলাম চেঁ’চা’মে’চি। কি হয়েছে জানতে সবাই গেলাম সেদিক। সেখানে গিয়ে দেখি কিছু একটা নিয়ে ঝা’মে’লা হচ্ছে তবে কি নিয়ে সেটা বুঝতে পারলাম না।
নিজেদের মধ্যে ঝা’মে’লা করেই যাচ্ছে। একজন একটা বললে আরেকজন দুইটা বলছে। অবস্থার অ’ব’ন’তি হচ্ছে এর মাঝেই রাদিফের আগমন হলো। আগে পুরো বিষয়টা জানতে চাইলো রাদিফ। তারপর এক এক করে ওদের সাথে কথা বলে বিষয়টা মীমাংসা করে দিল। বাহ্! কি সুন্দর করে পুরোটা ম্যানেজ করলো।
আরেকদিকে নজর যেতেই দেখি আবির দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে সবটা পর্যবেক্ষন করছে। নিজেও তো যেতে পারতো, তা না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না’ট’ক দেখছে! রাদিফ পুরোটা সামাল দিয়ে আবিরের ওখানে চলে গেল। গিয়েই আবিরকে চোখ টি’প দিলো, আর ইশারায় বুঝালো সব ঠিক আছে। ওমা এএ আবার কি?
সবাই আবার যে যার কাজে চলে গেল। আবির আর রাদিফও সেখান থেকে চলে গেল। আমি এখনও দাঁড়িয়ে আছি অন্যমনষ্ক হয়ে। হঠাৎ কেমন যেন লাগতেই পিছনে ঘুরে তাকালাম আর একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। কেউ কি ওখানে ছিল? কেন মনে হলো কেউ আমার পিছনে ছিল। এর মাঝেই শীতল হাওয়ায় কাপুনি উঠলো।
আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলাম, এসে জিনিয়াকে দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছে আমার অপেক্ষাই করছিল। আমি এগিয়ে গেলাম।
— এই ধারা কোথায় উ’ধা’ও হয়ে যাস তুই?
— ওইদিকে গিয়েছিলাম, তুই বল কিছু বলবি?
— হ্যা আসলে একটা জিনিস মনে পড়লো।
— কি?
— ওইদিন তুই আমার বাসা থেকে চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পর আমি একটু বারান্দায় গিয়ে বসে ছিলাম। তখনই রাস্তায় কাউকে দেখতে পাই।
— ঠিক জানি না কিন্তু উপর থেকে দেখে মনে হলো ওইটা তূর্য ছিল।
— কি!!?????
তূর্যর নামটা শুনা মাত্রই মনে অজানা ভ’য় মনে জোড়ো হলো। তারমানে তূর্য এখনো পিছু ছাড়েনি। সেই জিনিয়ার বাসা পর্যন্ত আমার পিছনে গেছিলো? এর মধ্যেই জিনিয়া বললো,
— আমি কিন্তু সিওর না। মনের ভু’ল হতে পারে।
— আর যদি মনের ভুল না হয়? ওইটা তূর্য হওয়ার সম্ভাবনা সর্বোচ্চ আমি জানি।
— আরেহ বাদ দে। আজকে এগুলো নিয়ে ভেবে নিজের মুড ন’ষ্ট করিস না।
আমি মৃদু হেসে কথাটা উড়িয়ে দিলাম কিন্তু মনের ভয়কে কোথায় রাখবো? তূর্য যে এসব করতে পারে না বা পারবে না এমনটা তো না।
——————-
আয়োজন শেষে সবাই রেডি হয়ে আবার ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছি। কি সুন্দর লাগছে ভার্সিটি প্রাঙ্গনটা, যেন রঙে রঙে মেতে উঠেছে। প্রাঙ্গনের সাথে আমাদের মনেও আনন্দের রং মাখিয়ে দিয়েছে কেউ। সবাই একে অপরের প্রশংসায় ব্যস্ত।
পুরো ক্যাম্পাসে আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি আর জিনিয়া। দুজনের পরনেই শাড়ি, বরাবর প্রিয় রং হালকা নীল। তাই আজ হালকা নীল শাড়ি পড়েছি আর জিনিয়া পড়েছে লাল শাড়ি। আকাশের মেঘগুলো কি সুন্দর পাল্লা দিয়ে দৌড়ে বেরাচ্ছে। মন চাইছে মেঘের সাথে ঘুরে বেড়াই। ইসস! যদি এমন করা যেত।
আরো এগিয়ে যেতেই দেখলাম দুটো পরিচিত ব্যক্তি হেঁটে আসছে। বুঝতে বাকি রইল না যে একজন রাদিফ আর আরেকজন মি.আবির। দুজনেই পড়েছে পাঞ্জাবি, তবে আমি চমকে গেলাম অন্য কিছু দেখে। মুখ ফ’স’কে জিনিয়ার সামনেই বলে উঠলাম,
— একি আবিরও নীল পড়ে এসেছে?
চলবে…………………..^-^
[