শ্রাবণের ধারা পর্ব -১৩ ও শেষ

#শ্রাবণের_ধারা ~(অন্তিম পর্ব)~

#লেখনীতে_ওয়াসেকা_তাবাসসুম ~

— তো সেটা কি বলতে এসেছো না কি খালি মুখ দর্শন দিতে এসেছো?

— না মানে বলবো না কেন? বলবো তো।

— তাহলে বলো।

— আসলে আমি তোমার বলা কথাগুলো নিয়ে ভেবেছি অনেক। তারপর আমার মনে হয়েছে যে….

— কি মনে হয়েছে?

— আমরা নিজেদেরকে আরেকটু সময় দিতে পারি তবে…..

— তবে কি?

— তবে তার আগে তোমাকে কিছু কথা বলে রাখতে চাই আমি। দেখো ধারা আমি কখনোই কাজ ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে ভাবিনি এমনকি কাছের মানুষগুলো থেকে অনেক দূরত্ব বজায় রেখেছি সব সময়। কেন জানো?

— কেন?

— কারণ আমার যেই পেশা এতে শুধু আমার না আমার পরিবারের মানুষগুলোর জীবন সংশয় আছে। আমার মা বাবা এই দেশে থাকেন না, তাদেরকে অনেক আগেই বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি কারণ একবার অনেক বড় একটা মিশনে ছিলাম আর সেটাই আমাদের পরিবারের ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি আর কোন রিস্ক না নিয়ে তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেই। অনেকেই আমার পরিবারের সম্পর্কে কিছু জানেই না। আমি নিজের মানুষগুলোকে ভালো রাখতে চাই।

— হয় তো তুমি আমি তোমার জন্য সঠিক মানুষ না, তাই তুমি আরেকবার ভাবো।

— ভাববো না কোনো সমস্যা? আর তোমার কাছে কি এগুলা শুনতে এসেছি আমি?

— আসলে আমি তো শুধু বলতে চাচ্ছিলাম তোমার সবটা আবার ভেবে দেখা উচিত।

এবার যেন মেজাজটা আসলেই খারাপ হতে শুরু করলো। আমি কি এগুলো শুনতে এসেছি এই ব্যক্তির কাছে? আমাকে ফ্রিতে জ্ঞান দিতে কে বলেছে? কাজের কথার নাম নেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে। একটু গম্ভীর হয়ে বললাম,

— এসব জ্ঞান না দিয়ে কাজের কথা বলেন। আপনার কি আমাকে নিয়ে কোনো সমস্যা আছে?

— তোমাকে নিয়ে সমস্যা থাকবে কেন?

— আরেহ ধ্যাত! ভারি অদ্ভুত মানুষ তো তুমি কি বলতে চাচ্ছি বুঝো না?

— না মানে ওহ্ ওই যে সময়? হ্যা হ্যা ঠিক আছে আমরা একে অপরকে আরো সময় দিতেই পারি সমস্যা নেই আপাতত আমিও কাজের থেকে একটু ছুটি পাবো।

— হ্যা ঠিক আছে। তাহলে কালকে দেখা হচ্ছে, ওই দিনের আকাশি রঙের পাঞ্জাবিটা পড়ে আসবে কালকে ঠিক আছে?

— পাঞ্জাবি কেন? হুডি পড়ি?

— ওই হুডি সহ তোমাকে আকাশে উড়িয়ে দিব বুঝেছো যা বলেছি তাই করবে।

— আচ্ছা।

একটু আতংকিত ভাব নিয়েই সম্মতি জানালো শ্রাবণ। এদিকে ওর অবস্থা দেখে কোনরকম না হাসার চেষ্টা করলাম আমি।

শান্ত একটা বিকেল, তবে রাস্তায় অগণিত মানুষের ভিড়। বেশিরভাগকেই দেখা যাচ্ছে তাদের প্রিয় মানুষের সাথে এদিকে আমার জনের খবর নেই। কাজের বেলায় যথেষ্ট সময় জ্ঞান থাকলেও এই ব্যাপারে একদম দুধভাত। এদিকে দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে ব্যাথা উঠে যাচ্ছে আমার। সামনে দৃষ্টি তাক করতেই দেখলাম একজন আকাশি রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত আমার দিকেই দৌড়ে আসছে। আমার সামনে এসে থামলেন উনি, হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু শ্বাস নিয়েই উপরে তাকালো শ্রাবণ। আমি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। শ্রাবণ হাঁটু ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো একটু এলোমেলো করতে করতে বললো,

— সরি সরি দেরী হয়ে গেছে।

— আল্লাহ তাই? তুমি না বললে তো জানতেই পারতাম না।

— এই ধারা সরি আসলে রাদিফের সাথে ছিলাম। আমাকে কতগুলো জ্ঞান দিলো কিন্তু সব মাথার উপর দিয়ে গেল।

আমি মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে পড়লাম। রাদিফ ওকে কি বিষয়ে জ্ঞান দিয়েছে ভালো মতোই বুঝতে পারছি। কিন্তু এই ব্যক্তির মাথায় এগুলো ঢুকবে না জানা আছে আমার। কত কি যে শিখিয়ে দিতে হবে আল্লাহ ভালো জানেন।

— চলো রিকশায় ঘুরতে যাই।

— আগে বললে তো বাইক নিয়ে আসতাম।

— বাইক অন্যদিনের জন্য তুলা থাক। আজকে রিকশায় ঘুরবো।

— আচ্ছা চলো।

তারপরেই দুজনে একটা রিকশা নিলাম। অনেকক্ষণ ঘুরলাম সাথে হাজারো কথা, যদিও বেশিরভাগ আমিই বলেছি তবে শ্রাবণ অনেক মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনেছে এইটা লক্ষ করেছি আমি। ওর কর্মকাণ্ড দেখে খালি মুচকি মুচকি হেসেছি।

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। গত সপ্তাহে শ্রাবণের বাবা মা দেশে ফিরেছেন। এই কয়েক মাসে একে অপরকে অনেকটা চিনে নিয়েছি যা নিজেদের কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। এবার নতুন জীবন শুরু করাই যায়, এর মধ্যে আমাদের ভার্সিটি জীবনেরও সমাপ্তি ঘটে গেছে। এবার নিজেকে তৈরি করার পালা তবে একা নয় একজনকে সাথে নিয়ে।

আজকে বিকেলে শ্রাবণ ওর মা বাবাকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিল যদিও শ্রাবণের বিষয়টা অনেক আগেই জানিয়েছি বাসায়। আজকে বড়দের মধ্যে কথা হয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। শেষমেষ এই অদ্ভুত মানুষটাকেই বিয়ে করতে হবে।

বিকেলে সবার সাথে পরিচয় হওয়াটাও জমজমাট হয়াটাও উঠেছিল।

— বলতে হবে দুজনে কি সুন্দর একে অপরকে খুঁজে নিল।

— কথাটা ভুল বলেননি বেয়াইন। আমাদের ছেলে যে নিজে থেকে কাউকে পছন্দ করবে এই আশাটাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। সারাদিন খালি কাজ আর কাজ করা ছেলে যখন আমাদের বললো সে না কি কাউকে পছন্দ করে নিজেদের কানে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।

— সত্যি বলবো? আমাদের ছেলের উপর এইটুকু বিশ্বাস আছে আমাদের সে যাকে পছন্দ করবে নিজের জন্য তাকে আমরা মেনে নিব। ধারার সাথে দেখা হওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমাদের ছেলে বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে।

— আমরাও ভাবিনি আমাদের মেয়ে কবে এতো বড় হয়ে গেল তবে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে সঠিক মানুষ বেছে নিয়েছে।

— তাহলে মেয়েকে কবে তুলে দিচ্ছেন আমার ছেলের হাতে?

— বিয়েতে দেরি করতে চাচ্ছি না। ওদেরও এতে সমস্যা আছে বলে মনে হয় না।

— তাহলে সামনের মাসে আপনার মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই?

— ঠিক আছে তবে তাই হোক।

——————

বড়দের সিদ্ধান্ত মতো আজকে সেই দিন। যার অপেক্ষা করেছি আমরা দুজনেই। নিজের জীবনে আরেকজনকে জায়গা দেয়ার সময় চলে এসেছে। বাসায় আত্মীয় স্বজনরা চলে এসেছে আরো দুইদিন আগেই। এই কয়েকদিন যে আমাকে কতো কি নিয়ে খে’পি’য়েছে সবাই। মানে এই কাজিন গুলো বিয়েতে থাকাও একটা বিপদের সমান সব।

শ্রাবণরা না কি চলে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। আমি এদিকে সেজেগুজে বসে আছি আর আমার পাশে জিনিয়া বসে আছে। জিনিয়া অভিমানী সুরে বলে উঠলো,

— শেষমেষ তুইও বিয়ে করে নিচ্ছিস? আমাদের ব্যাচের অর্ধেকই তো সংসার শুরু করে দিয়েছে আর আমার কি হবে?

— তুইও বিয়েটা সেরে ফেল তাহলেই হয়।

— আরেহ তার জন্য তো বিয়ে করার মানুষ লাগবে তাই না? আমার তো সেই মানুষটাই নেই।

— আহারে কষ্ট পাচ্ছিস কেন? তোর জন্যও খুঁজে দিব।

— খুব উপকার করলি রে। নিজেই বিয়ে করে সংসার শুরু করবি তখন আমার কথা মনে থাকবে?

— থাকবে না কেন হ্যা? আর সংসার দেরি আছে এখন তো খালি কাবিন করিয়ে দিচ্ছে।

— সেই তো একই হলো তাই না?

— না গো। একই না তুই বুঝলে তো হতোই।

এরমধ্যেই এক বড় আপু এসে বলে গেলেন আর কিছুক্ষণ পরেই আমাকে নিয়ে যাবে। কথাটা শুনা মাত্রই টেনশনে পরে গেলাম তাহলে শেষমেষ বিয়েটা হচ্ছে? ৫ মিনিট পর দুইজন এসে আমাকে নিয়ে গেল সবার সামনে।

সেখানে গিয়ে দেখি শ্রাবণ বরের সাজে বসে আছে আর আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। ধ্যাত! সবার সামনে মান সম্মান ডুবাবে তো এই ছেলে। আর পারি না একে নিয়ে। পাশেই রাদিফ দাঁড়িয়ে আছে, ওর অনেকগুলো ধন্যবাদ পাওনা আছে। ওর জন্যই এতো দূর আসতে পেরেছি না হলে ওই অদ্ভুত ব্যক্তি নিজে থেকে আসতো না কি সন্দেহ।

আমাকে ধরে শ্রাবণের সামনে বসিয়ে দিল। ওর দিকে তাকাইনি পর্যন্ত আমি। আবার টেনশনে যদি মাথা ঘুরে পড়ে যাই? তখন কি হবে? চুপচাপ ছিলাম বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত। খালি “কবুল” শব্দটা উচ্চারণ করতেই মুখ খুলেছি, আর একটাও কথা বলিনি।

বিয়ে শেষ হলো, সবাই আমাদের চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। প্রথমে বলেছিলাম বাবার বাসায় থাকি, এখনি সংসার করবো না তো। তার উত্তর ছিল, “সংসার করতে হবে না তোমার, আমার সাথে ওই বাসায় গেলেই চলবে। বিয়ে করে আস্ত বউ রেখে চলে আসবো না কি?”

গাড়িতে চুপচাপ বসে আছি সবার সাথে কথা শেষ করে শ্রাবণ এলো তারপর ড্রাইভারকে চলে যেতে বললো কারণ সে নিজেই গাড়ি চালাবে। আমিও উঠে সামনের সিটে গিয়ে বসে পড়লাম। শ্রাবণ ভিতরে এসে বসার পর রাদিফ এলো,

— তো বিয়েটা হয়েই গেল? আমার এই পান্তাভাতের মতো ফ্রেন্ডকে বিয়েই করে নিলে ধারা? সা’ব’ধা’ন এইটাকে কিন্তু তোমাকেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে।

— আমার সমস্যা নেই।

— যাক তাহলে তো হলোই।

— এই তুই যা তো। আমাদেরও যেতে হবে।

— যাচ্ছি বাবা।

রাদিফ চলে গেল অন্য গাড়িতে উঠতে এরপরে শ্রাবণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে তারপর বললো,

— তুমি তখন একটা বারও আমার দিকে তাকালে না কেন?

— তাকালে কি হতো?

— তাকালে না কেন?

— আমার ইচ্ছা।

— তোমার ইচ্ছার নিকুচি করেছে, তোমাকে তো পরে বুঝাবো এখনো সারাজীবন পরে আছে।

এই বলেই গাড়ি স্টার্ট দিল শ্রাবণ। নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম।

——————-

৩ বছরের কেটে গেছে, একসাথে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছি এখনো অনেকদূর যাওয়া বাকি। ভেবেছিলাম দুজনেই যখন প্রস্তুত থাকবো তখন সংসার জীবনে পা দেয়া যাবে। শ্রাবণের নিজের কাজের মধ্যে থেকেছে আর আমিও পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। কি হবো এই নিয়ে অনেক ভাবার পর মনে হয়েছে স্বামী যেহেতু আ’ইনে’র মানুষ আমিও সেদিকে যাই। তারপরে এডভোকেট হওয়ার পথে হাঁটা দিলাম, আর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সফল হয়েছি। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারাটাই অনেক, যা বলে বুঝানো মতো নয়।

রাতের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ তার মাঝেই চাঁদের লুকোচুরি খেলা। ছাদে বসে আরেকজনের অপেক্ষা করছি সেই যে কখন “আসছি” বলে গেল আর আসার নামই নেই। কিছুক্ষণ পর পায়ের আওয়াজে ঘুরে তাকিয়ে দেখি মহাশয় এসেছেন।

— এই নাও।

— ওমা এগুলা আনতে গেছিলে তুমি?

— হ্যা। দেখে নাও চিপস, চকলেট, আর কোল্ড ড্রিংকস সবই আছে। আর কিছু লাগতো?

— না না আবার কি? তুমি বসো তো চুপচাপ।

তারপরে আমার পাশে এসে বসলো শ্রাবণ। তার কাঁধে মাথা রেখে আমিও বসে রইলাম আর আকাশটা উপভোগ করতে থাকলাম। আমার মুখের সামনে চলে আসা কিছু অবাধ্য চুলগুলো নিয়ে কানের পিছনে গুজে দিল শ্রাবণ। তার কোমল চাহনি খেয়াল করেও না দেখার ভান করে মনে মনেই হেসে উঠলাম। শ্রাবণ উঠে দাঁড়িয়ে তার এক হাত আগিয়ে দিল আমার দিকে।

— কি?

— হাতটা ধরো।

উঠে তার হাতে হাত রাখলাম তারপরে শ্রাবণ বললো,

— আমাকে নাচাতে নাচাতে নিজে নাচতে ভুলে যাওনি তো?

— এই যাহ।

দুজনেই এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। একে অপরের মধ্যে দূরত্ব কমে গেল। চাঁদের আলোর নিচে একে অপরের হাত ধরে ভুলে গেলাম চারপাশ। চোখে চোখ রাখতেই যেন সব ভুলে গেলাম। একে অপরের মাঝেই আবদ্ধ হয়ে গেলাম। এতগুলো দিন এক সাথে কাটানো, একে অপরের পাশে থাকা, নিজেদের সময় দেয়ার মাঝেই কখন এতোটা আপন হয়ে গেছি খেয়ালই হয়নি। একটা সময় মানুষটাকে চিনতাম না পর্যন্ত আর আজ তাকে ছাড়ে থাকার কথাও ভাবা সম্ভব নয়।

সময় মানুষকে আপন করে তোলে আবার পরও করে দেয়। আজকের চেনা মানুষটা কালকে অচেনা হয়ে যেতে পারে। নিজেদের সময় দিয়ের মাঝে, একে অন্যের পাশে থেকেই না হয় জীবন পার করে দেয়া যাক। অতীতকে পিছনে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন।

———————– সমাপ্ত —————————–

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here