#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২২
ইউনাইটেড হসপিটালের তিনতলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষে বসে কথা বলছেন ডাক্তার সুশান্ত আর আলম সাহেব। তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শাইনির সবগুলো রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করলেন। ডাক্তার সুশান্ত কিছু একটা ভেবে আলম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিদেশেও চিকিৎসা করিয়েছেন দেখছি!’
‘হুম। কিন্তু মাঝপথে বন্ধ করে শাইনি চলে এসেছে।’
ডাক্তার সুশান্ত অবাক হয়ে বললেন, ‘এটা কিন্তু মোটেও উচিৎ হয়নি।’
‘আমার কথা শোনেনি শাইনি। এখন জোর করেও নিয়ে যেতে পারছিনা। চিকিৎসা করলে দেশেই করাবে নয়তো না।’
‘এর আগে আপনাদের ফ্যামিলিতে কারোর লিউকেমিয়া ছিল?’
আলম সাহেব বললেন, ‘জি। শাইনির মায়ের ছিল।’
‘বুঝতে পেরেছি! আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস এবং শাইনির সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে আমারও তাই মনে হচ্ছিলো।’
‘কিন্তু এখন শাইনির কী অবস্থা?’
ডাক্তার সুশান্ত বললেন, ‘দেখুন, এই অবস্থায় এত টেনশন করাটা যে কতটা ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তা ভাবনার বাইরে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে ওর। আমার ধারণা মতে, শাইনির একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। বাকিটা রিপোর্ট এলেই বোঝা যাবে!’
আলম সাহেব স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তিনি বুঝতে পারছেন না এখন কী করবেন। একদিকে শাইনির এই অবস্থা অন্যদিকে বেলা বাইরে বসে কান্না করছে। মেয়েটার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে ওনার মাথায় কিছুই আসছে না। যদিও নাজনীন বেগম ওকে সামলাচ্ছে। কিন্তু এই খবরটা শুনলে মেয়েটার কী অবস্থা হবে আলম সাহেব ভাবতেই পারছেন না। ছেলের জন্য তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে, সবকিছু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। মাথাটা ফাঁকা হয়ে আছে। ডাক্তার সুশান্ত ওনার অবস্থা বুঝতে পেরে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মি. আলম, আপনি এত ভেঙ্গে পড়বেন না।’
আলম সাহেব শুকনো কন্ঠে বললেন, ‘আমাকে একটু পানি খাওয়ান দয়া করে।’
ডাক্তার সুশান্ত পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন আলম সাহেবের দিকে। অন্যমনস্ক হয়ে তিনি গ্লাসটা নেন। কিছুটা ছলকে পড়ে তাঁর শার্টে, তাতে ওনার কোনো হেলদোল নেই। এক চুমুকে পুরো গ্লাসটা খালি করে তিনি ডাক্তার সুশান্ত এর কেবিনে বসে থাকেন। নীরবতা কাটিয়ে একসময় তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কী থেরাপি দেওয়ার জন্য হয়েছে? আমি বলতে চাইছি শাইনির যেসব পরিবর্তন এসেছে সেগুলো? কেমোথেরাপির সাইড এফেক্ট?’
ডাক্তার সুশান্ত বিজ্ঞ ভঙ্গিতে বললেন, ‘ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকে যখন কেমোথেরাপি দেয়া হয়, তখন শরীরে বেশি করে অনেক বেশি পরিমাণে মেডিসিন পুশ করা হয়। ফলে বিভিন্ন প্রকারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম কিছু, যেমন—চুল পড়ে যাওয়া, চোখের নিচে কালো দাগ ও খাবারে অরুচি হওয়া। এই সময়টা বেশ কঠিন, অনেক বেশি সাফার করতে হয়। লিউকেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি খাবারের প্রতি প্রচুর যত্নশীল হতে হবে এই সময়ে।’
আলম সাহেব বললেন, ‘কিন্তু শাইনি তো কিছু খেতেই পারছে না!’
‘শাইনি একটু বেশিই অসুস্থ।’
‘আমি কিছু চিন্তা করতে পারছি না ডাক্তার। কী করা উচিৎ, কোথায় নিয়ে গেলে আমার ছেলে সুস্থ হবে আমার মাথায় কিছু আসছে না।’
ডাক্তার সুশান্ত বললেন, ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছিলাম আমরা। কিন্তু থেরাপির সাইড এফেক্ট যে এতোটা প্রভাব ফেলবে সেটা ভাবনার বাইরে ছিলো আমাদের। আর ও হয়তো প্রথম থেকেই বেশি স্ট্রেস নিয়েছে৷’
‘ঠিক বলেছেন ডাক্তার। কত করে বোঝাতাম এত ভেবো না, তবুও কথা শুনেনি ছেলেটা।’ আলম সাহেব শুকনো গলায় বললেন।
ডাক্তার সুশান্ত কপাল কুঁচকে হাসলেন। তারপর নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘টেনশন তো আর বলে কয়ে আসেনা আলম সাহেব! যারটা সে-ই বুঝে। মানবজীবনই এমন। চিন্তাহীন কোনো মানুষ নেই। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত মানুষকে চিন্তা করতে হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে এটা যাতে দুশ্চিন্তায় পরিণত না হয়।’
এমন সময় সাইড টেবিলের ওপর রাখা লাল রঙের টেলিফোনটা বেজে ওঠলো। ডাক্তার সুশান্ত ফোনটা রিসিভ করে কথা বলতে লাগলেন। মনে হচ্ছে কারো সাথে আলোচনা করছেন এবং কথা শেষে ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে কেবিনে আসতে বললেন। সাথে আরও তিনজন ডাক্তারের নাম বললেন। ফোন রেখে তিনি আলম সাহেবের দিকে তাকালেন। নরম স্বরে বললেন, ‘মি. আলম। শাইনির রিপোর্টগুলো এসে পড়েছে। ডাক্তার সাঈদুল সাহেবের সাথে কথা হয়েছে। ওনারা এখানে আসছেন। আমাদের কিছু আলোচনা করতে হবে। আপনি কী এখানেই বসবেন?’
আলম সাহেবের কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। তিনি সবটা শুনতে চান। ভনিতা আজীবনই তাঁর ভীষণ অপছন্দ। তিনি জোরালো কন্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ। আমিও শুনতে চাই এটা আসলেই স্ট্রোক ছিলো নাকি!’
ডাক্তার সুশান্ত বললেন, ‘একচুয়েলি আপনি আমার পরিচিতদের মধ্যে একজন বলেই আপনাকে সুযোগটা দেওয়া। নয়তো অন্য পেশেন্টদের গার্ডিয়ানদের সবকিছু খোলাসা করে বলি না আমরা।’
আলম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমার কাছে কিছু লুকাবেন না দয়া করে। ছেলেটা আমার ছোট থেকেই একা একা বড় হয়েছে। আমি জানতে চাই সবটা, শেষপর্যন্ত!’
ডাক্তার সুশান্ত জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাইরে একটা মেয়েকে দেখলাম অনবরত কাঁদছে! এর আগে এত কাঁদতে কাউকে দেখিনি। মেয়েটা কে হয় আপনার?’
‘মেয়েটা শাইনির স্ত্রী বেলা, অবশ্য আমার মেয়েই! ওকে খুব ভালোবাসে আমার ছেলেটা। ওর জন্যই বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছে। থেরাপি নেওয়ার একমাত্র কারণ বেলা। ও আমার ছেলেটাকে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও ফেলে যায়নি বরং আমাদের চেয়ে বেশি খেয়াল রেখেছে। ওর নিজেরও বিশ্বাস শাইনি সুস্থ হয়ে যাবে।’
‘ভালোবাসা এমনও হয়?’ আনমনে বললেন ডাক্তার সুশান্ত। তিনি একটু অবাকই হয়েছেন।
‘হয় হয়তো!’
ডাক্তার সুশান্ত হেসে বললেন, ‘বলতেই হচ্ছে খুব লাকি মেয়েটা। আমি চাইবো ওদের ভালোবাসা, বন্ধন যাতে এভাবেই অটুট থাকে। কখনো হারিয়ে না যাক..’
‘আমিন।’ ছোট্ট করে বললেন আলম সাহেব।
‘পাশের মহিলাটা কে?’ জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার সুশান্ত।
‘ও আমার স্ত্রী নাজনীন।’
ডাক্তার সুশান্ত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার স্ত্রী? কিছুক্ষণ আগে যে বললেন তিনি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন?’
‘ঠিকই বলেছিলাম ডাক্তার। ও আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। অবশ্য শাইনিকে কখনো জানাইনি কথাগুলো যে ওর নিজের মা নেই।’
‘এত বছরেও জানতে পারেনি?’
‘না।’
‘খুব ভালোবাসেন ছেলেকে বোঝাই যাচ্ছে।’
আলম সাহেব অতি কষ্টে মুচকি হেসে বললেন, ‘ভালোবাসার মানুষগুলোই আমাদের ছেড়ে অতি দ্রুত হারিয়ে যায়।’
………
আজ প্রায় সাতদিন হলো শাইনিকে থেরাপি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শাইনি এতোটা সহ্য করতেই পারেনি। থেরাপি দেওয়ার পর থেকে ও আরও ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। থেরাপি দেওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত অনেকবার বমি করেছে, যার ফলে শাইনি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চোখমুখ ভীষণ লাল হয়ে শুকিয়ে গেছে। শরীরে যেন মাংস নেই। মাথার চুলগুলোও কেমন যেন কমে যাচ্ছে। কোনোকিছু খেতে পারছেনা, খাওয়ার সাথে সাথে বমি হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তাররা ওকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। কিন্তু শাইনির অবস্থার কোনো উন্নতি না হয়ে বরং আরো অবনতি হয়েছে। এই কয়দিনে হসপিটাল টাই যেন বাসার সকলের বাড়িঘর হয়ে উঠেছে। চিন্তায় চিন্তায় যখন বাড়ির সবার অবস্থা খারাপ তখন গত রাতে ওর অবস্থা প্রচন্ড খারাপ হয়ে পড়েছিলো। খারাপ মাবে প্রচন্ড খারাপ। যার ফলে ডাক্তাররা ইমার্জেন্সি ওকে আই সি ইউতে এডমিট করতে বাধ্য হন। ওর কন্ডিশন ভালো নয়। বেলার অবস্থা খুব খারাপ। শাইনির এই অবস্থা মেনে নিতে না পেরে কাল থেকে অনবরত মেয়েটা কেঁদেই চলছে!
………….
কিছুক্ষণ পর তিনজন ডাক্তার প্রবেশ করেন কেবিনে। সবাই নির্ধারিত চেয়ারে বসে ডাক্তার সুশান্ত এর সাথে আলোচনা করেন৷ সবার মুখে চিন্তিতভাব। আলম সাহেব কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তিনি একটু দূরে বসেছিলেন ওদের থেকে। অনেকক্ষণ পর ওরা চলে যায়। ডাক্তার সুশান্ত কিছুক্ষণ নিজেকে সময় দেন। মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে থাকা কথাগুলো সাজিয়ে নেন মনে মনে। প্রতিবার রোগীর স্বজনদের খবর দিতে গেলেই তিনি নিজেকে অসহায়বোধ করেন। কিন্তু আজ একটু বেশি খারাপই লাগছে। কারণ আলম সাহেবের সাথে আগে থেকে পরিচয় থাকার দরুণ সব কথা খোলাসা করেই বলেছেন। আলম সাহেবের অসহায় চেহারার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘যা ধারণা করেছিলাম তাই৷ শাইনির একটা স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে। ফুসফুসেও সমস্যা দেখা গিয়েছে। তাতে ওর অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে গেছে যে আমরা বুঝতে পারছি না কী করা উচিৎ বা অনুচিত। কৃত্রিম ভাবে শ্বাস চালু রাখার জন্যে ভেন্টিলেটরের সাহায্য নিয়েছি আমরা৷ শাইনি ভেন্টিলেটর থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা তা নির্ভর করবে ওর সার্বিক শারীরিক অবস্থার উপর। অনেক ক্ষেত্রেই রোগী ভাল হয়ে উঠতে দেখেছি, ওর বেলায় সম্ভাবনা পাচ্ছি না একদমই। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছি না আমরা। এর আগে এরকম কেইস একটাও পাইনি আমরা। আ’ম স্যরি মি. আলম, রিয়েলি ভেরি স্যরি।’
আলম সাহেব নিস্তব্ধ, কিছুই বলছেন না। পুতুলের ন্যায় বসে সব কথা শুনলেন তিনি। এসবের জন্য কাকে দায়ী করবেন তিনি? ভাগ্যকে? নিজের ছেলেকে? নাকি বেলার বাবা নাইমুদ্দীন সাহেবকে? সবাই মিলে অসুস্থ ছেলেটাকে যেভাবে মেন্টালি টর্চার করেছে এরই ফল এই স্ট্রোক৷ কি হতো শাইনিকে এতোটা অত্যাচার না করলে? আলম সাহেব কেবিন থেকে বেরিয়ে যান। করিডোরে বেলা আর নাজনীন বেগম বসে আছেন। বেলার চোখমুখ এই ক’দিনে শুকিয়ে ভেঙে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মেয়েটাকে দেখে তাঁর মায়া হয়। তিনি রোবটের মতো বললেন, ‘শাইনির একটা স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে।’
বেলার বিশ্বাস হলো না৷ চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে আই.সি.ইউ ইউনিটে গেল। যে কেবিনে শাইনিকে রাখা হয়েছে ওখানকার দরজার বাইরে থেকে শাইনিকে অবলোকন করলো। স্বচ্ছ কাচের দরজার ওপাশে নিথর দেহে পড়ে আছে শাইনি। বিপ বিপ শব্দ আসছে ভেন্টিলেটর নামক একটি যন্ত্রাংশ থেকে। বেলার কান্না আসছে না। এতদিনে কান্না করার ফলে ওর চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। কাচের দেয়ালে হাত রেখে ফুঁপিয়ে উঠলো৷ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি আপনাকে রেখে কোথাও যাবো না প্রমিজ। কেন এত কষ্ট পাচ্ছেন? এত কেন চিন্তা করেন আমাকে নিয়ে? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝেন আপনি? শুধু একবার ফিরে আসুন, আপনাকে নিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাবো। কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাদের…ফিরে আসুন না আমার কাছে! আসুন না…’
চলবে…ইনশাআল্লাহ!