আজ আহনাফ এর বিয়ে। আহনাফ কে নতুন বরের সাজে মারাত্মক সুন্দর লাগছে।ইস আহনাফের দিক থেকে চোখ ই সরানো যাচ্ছে না।কি ভাবছেন আহনাফ কে?আহনাফ আমার স্বামি।অবাক লাগছে নিজের স্বামির বিবাহের বর্ণনা এভাবে কিভাবে দিচ্ছি।আজ আমি আহনাফ কে নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়েছি।সবাই বরযাত্রী সাবার জন্য কত সুন্দর সাজগোজ করেছে।সবার মাঝে কত উৎসাহ। আহনাফ এর মন টা আজ বড্ড খারাপ।আহনাফ আমাকে প্রাণের থেকে ও বেশী ভালবাসে।একটা বাচ্চার জন্য আজ আহনাফ কে বিয়ে করতে হচ্ছে।আমাদের বিয়ের ১০ টা বছর কেটে গিয়েছে আজ ও সন্তান হয় নি আমার।সন্তান না হওয়াটা কি আমার দোষ আল্লাহ!অনেক মানত করেছি,অনেক দোয়া করেছি, নামাজে কেঁদেছি তবুও একটা সন্তানের মুখ আমি দেখতে পাই নি।
পারিবারিক অনেক ঝামেলা পোহানোর পর আজ আহনাফ কে বিয়ে করতে হচ্ছে। সেটাও আমার জন্য।আমার সুইসাইড এর জন্য আহনাফ বাধ্য হয়েছে বিয়ে করতে।
আমিও চাই নি ও বিয়ে করুক।কিন্তু সমাজ আমাকে বন্ধ্যা বলে, আমার স্বামি কে অক্ষম বলে।একটা বাচ্চার জন্য আমার কোল খালি থাকে বড্ড ইচ্ছা করে মা ডাক শুনতে।কারো বাচ্চা আমার কোলে দিতে চাই না কারণ আমি নাকি অপয়া।
শ্বাশুড়ি মা আমাকে ডেকে বললেন আমি যেনো তার ছেলেকে বিয়ে করতে বাধ্য করি।একমাত্র আমি ই পারি তার ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজি বানাতে।তার ছেলে নাকি বিয়ে করতে চাই কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।স্বামির বংস রক্ষা করা নাকি স্ত্রী হিসাবে আমার দায়িত্ব। আমি নাকি আমার শ্বাশুড়ির মেয়ে হয়েই থাকবো।আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলেন।শ্বাশুড়িকে এভাবে কাঁদতে দেখে আমার ও মন টা গলে গেলো।ভাবলাম আমি না হয় সন্তান সুখ পাই নি আহনাফ তো পাক।
আসলে বাস্তবতা এতটা নির্মম আর কঠিন কেনো হয়।স্বামির দ্বীতীয় বিয়ে হলে সে আর নিজের থাকে না।বাবার আরেক বার বিয়ে হলেও সে আর বাবা থাকে না।আমার জীবন টাই এমন কেনো জানিনা।
ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছিলাম।মায়ের জন্য কাঁদতাম।বাবা নতুন মায়ের লোভ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে এলো তার নতুন বউ।বাসর ঘরে নতুন মায়ের কোলে আমাকে বসিয়ে দেওয়া হলো।নতুন মা দুই এক মিনিট পরেই আমাকে নামিয়ে দিলেন।উনার খুব একটা ভাল লাগছিলো না আমাকে কোলে নিয়ে।উনার মাঝে ভালোই বিরক্তি দেখলাম।নতুন নতুন কয়েক দিন বেশ যত্ন করতেন।কিন্তু দিন দিন উনার তীক্ততা বাড়তে থাকে।এটা আমার জন্য মানসিক অত্যাচার ছিলো।কেউ বুঝতো না আমার সাথে কি হচ্ছে কিন্তু আমি জানতাম ঘরের মাঝে কি মানসিক অত্যাচার চলছে।
দু বছর বাদেই মায়ের একটা ছেলে হলো।বাড়িতে মেয়ের পরে ছেলে হলে সবার আনন্দের সীমা থাকে না।সেখান থেকেই অবহেলার চূড়ান্ত পর্ব শুরু হলো।মা সারাদিন বিভিন্ন কাজে আমাকে লাগিয়ে রাখতো।আর বাবা এলেই বিভিন্ন নালিশ দিতে থাকতো।
দিন দিন বাবা টাও না আর বাবা থাকলো না।কারণে অকারণে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে দিলো।এর পর মায়ের আবার মেয়ে হলো। বাবার একটা পুরা ফ্যামিলি হয়ে গেলো।আর আমি হলাম অবহেলিত।জীবনের রং ই বদলে গেলো আমার।কতটা নির্যাতিত হয়েছি আমার ছোট বেলায় সেটা আমি জানি।
তারপর আমার জীবনে আহনাফ আসে।আমার সব সুখ,দুঃখ আহনাফ কে বলতাম।তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি।আমার সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিতে হয়তো আল্লাহ আহনাফ কে পাঠালো।সৎ মায়ের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন আহনাফের হাত ধরে পালিয়ে গেলাম।আহনাফের সাথে ৬ বছরের রিলেশন ছিলো আমার।আমার বাবা আমাকে আহনাফের থেকে খারাপ ছেলের সাথে বিয়ে দিলেও আহনাফের সাথে বিয়ে দিতে রাজি নন তিনি।
মা না থাকার যন্ত্রনা আমি সেদিন বুঝেছিলাম।আহনাফের সাথে পালিয়ে আসার পর আমার জীবনে আর কোনো কষ্ট ই হয় নি।আহনাফ আর ওর ফ্যামিলি আমাকে বুঝতেই দেই নি যে আমার মা নেই।বিয়ের দু’বছরের মাঝে আহনাফের প্রাইভেট ব্যাংকে জব হয়ে গেলো।বেশ মোটা অংকের স্যালারি।আমি না চাইতেই সব চাহিদ পূরণ করে দেই আমার।আহনাফের সাথে ঢাকায় বাসায় উঠলাম।
সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিলো।এমন সময় দুজনের ই একটা বাচ্চার বড্ড শখ হলো।আহনাফ কে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম তুমি আমার সব অপূর্ণতা পূর্ণতা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছো আমাকে একটা বেবি দাও প্লিজ আহনাফ প্লিজ।আহনাফ আমাকে বলে আশা আল্লাহ দিলে ঠিক ই আমাদের বেবি হবে।এটা আমার হাতে নেই।প্লিজ কষ্ট পেও না।আমার জীবনে তুমি আছো আমার আর কিছুই চাই না।
আমি জানি ও আমাকে অনেক ভালবাসে তাই ওর কষ্ট আমাকে বুঝতে দেই না।কারো ছোট বাচ্চা দেখলে ও খুব কোলে নেওয়ার চেষ্টা করে।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো ৫ টা বছর।আমি কোনো ভাবেই কন্সিভ করতে পারলাম না।ডাক্তার আমার ই দোষ দিলেন।রিপোর্ট করে জানা গেলো আমার মাঝেই সমস্যা।তখন আমি আহনাফের দিকে তাকাতে পারছিলাম না কি উত্তর দিবো আমি তাকে।আমার যে বলার মতো কোনো ভাষা নেই।আমি ওর দিকে তাকাতেও পারছি না। কি বলবো এবার আমি।কোনো কথা বললাম না দুজনে কেউ কারো সাথে।আমি রিক্সায় চড়ে বাসায় চলে এলাম।রাতে রান্না ও করলাম না।রাত এগারো টা বেজে গিয়েছে আহনাফের আসার নামে কোনো খোজ নেই।ও কি আর আসবে না।
এমন সময় কলিং বেল চাপলো। দরজা খুলে দেখি আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে।আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।আহনাফ আমাকে চমকে দিয়ে কোলে তুলে গালে মুখে চুমু দিয়ে বলে হ্যাপি এনিভারসারি বউ আশালতা।আজ আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো।আমি অবাক হয়ে গেলাম এত বড় কথা ডাক্তার বলার পর ও ওর আমার প্রতি এত ভালবাসা কিভাবে এলো।আমাকে এক গুচ্ছ গোলাপের তোড়া দিয়ে বলে হাসো প্লিজ।আহনাফ বাইরে থেকে বিরয়ানি কোক ও নিয়ে আসে।আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেই।
সেদিন আহনাফ বলে সবার তো বাচ্চা হয় না।এটা আল্লাহর ইচ্ছা।এতে তোমার দোষ নেই।একটা বাচ্চা আমরা কিনে নিয়ে আসবো।বাচ্চা তো বাচ্চাই হয় যার পেটেই জন্ম নিক।তোমাকে ডাক ডাক ঠিক ই একদিন শোনাবো।আমার তুমি আছো তাতেই আমি খুশি।বাচ্চা চাই না আশা।আমার বাচ্চা লাগবে না।আমি থাকলে কি তুমি হ্যাপি হতে পারছো না।যে বাচ্চার জন্য মন খারাপ করছো।
সেদিনের পর থেকে আর বাচ্চার জন্য দুজনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হয় নি।কিন্তু আজ বিয়ের দশ বছর পরে বুকে পাথর চাপা দিয়ে আহনাফ কে বিয়ের পিড়িতে বসাতে হলো।আহনাফ আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলো এত বড় পাপ আমি করতে পারবো না।অন্য নারীকে আমি স্পর্শ করতে পারবো না আশা।আমি মরে যায় সেও ভালো তবুও এমন প্রতিশ্রুতি আমাকে দিও না।
আহনাফ কে কিভাবে বুঝাবো আমার যে বুক ভেঙে তোলপাড় করে দিচ্ছে।তাকে অন্যর হাতে তুলে দেওয়ার মতো যন্ত্রণা যে আমার কাছে আর নেই।এই যন্ত্রনা কতটা ভয়াবহ আহনাফ সেটা বুঝবে না।বুক ভারী হয়ে এসছিলো আমার।চিন চিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছিলো।
আহনাফ যাওয়ার আগে আরেকবার পারমিশন নিয়েছিলো তুমি ভুল করছো আশালতা।আমাক একবার বলো তুমি যেও না।আমি এখানেই থমকে যাবো।সেদিন মন কে পাথর করে ওকে পাঠিয়েছিলাম।
ভাগ্য নির্মম ভাবে বদলে দিলো আমার সব কিছু।
চলবে,,,
#সংসার
১.
#Writer_Mousumi_Akter