#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#সপ্তদশ_পর্ব (ধামাকা স্পেশাল)
৪৯.
সময় বহমান। মনুষ্য জীবনের নানান রকম ব্যস্ততা ও সময়ের পরিক্রমায় অনেক পরিবর্তন এসে পড়ে। তেমনই হোসেন বাড়ি থেকে আসার পর সমুদ্রের অফিস জয়েন শুরু থেকে প্রাচীর অনার্স থার্ড ইয়ারের ক্লাস জয়েন করায় সময় অচিরেই কেটে গিয়েছে।
সময়ের সাথে সাথে সমুদ্র আর প্রাচীর সম্পর্কেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। দুজনের মাঝেই বন্ডিং বেশ গাঢ় হয়েছে। তবে এই কয়েক মাসে সমুদ্রের বেশ কিছু আচরণ প্রাচীকে বারংবার ভাবিয়ে তুলেছে। কিন্তু সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি এই ভেবে সমুদ্র নিজ থেকে তাকে সবটা বলবে।
আজ সকালে,,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধায় ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। তখনই রুমে ব্যাগ আর ফোন হাতে তুলতে তুলতে সমুদ্রের উদ্দেশ্যে প্রাচী বলে উঠে,
– “আজ আপনি ফ্রি আছেন?”
প্রাচীর হঠাৎ আবদারে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকায় সমুদ্র।
– “আজ একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে প্রাচী। অফিসের প্রজেক্ট নিয়ে অনেক কাজ পড়ে আছে।
কিন্তু কেন?”
সমুদ্রের উত্তরে মন খানিকটা বিষন্ন হয় প্রাচীর।
– “না এমনিতেই। আজ একটু ঘুরতে যেতে মন চেয়েছিল তাই ভেবেছিলাম আপনাকে বলব। ইটস ওকে। আমি ক্লাস শেষে হৃদিতার সাথে কফিশপে চলে যাব।”
বলেই সমুদ্রকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে প্রাচী আর অন্যদিকে প্রাচীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমুদ্র।
আজকে অফ পিরিয়ড থাকায় দুটো ক্লাস করেই ক্যাম্পাসের দিকে বেরিয়ে পড়ে প্রাচী। পাশেই হৃদিতা আকাশ দুজন কথা বলছে আর হাঁটছে। ক্যাম্পাস থেকে খানিকটা বের হতেই দূরে হাওয়াই মিঠাই আর আইসক্রিম স্টল চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়ায় প্রাচী। আজ থেকে কিছুটা দিন আগেও এমনই একটা জায়গায় বেশ সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছে সে সমুদ্রের সাথে। কিন্তু ইদানিং সমুদ্রের ব্যস্ততা আর পরিবর্তনশীল আচরণের জন্য তা আর হয়ে ওঠে না খুব একটা।
– “কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে পড়লি যে আয়াত? কোনো সমস্যা?”
– “না না কোনো সমস্যা নেই। ভাবছিলাম এখানে যখন এসেই পড়েছি তখন ওখানে গিয়ে আইসক্রিম খাওয়া যাক। এমনিতেও শীতের জন্য আইসক্রিম খাওয়া মিস করেছি খুব।”
প্রাচীর কথায় হৃদিতা আর আকাশ ও সায় দেয়। স্টল টা নতুন বসেছে বোধ হয়। এগিয়ে গিয়ে তিনজনের জন্যেই পছন্দ মতো আইসক্রিম কিনে নেয় প্রাচী। আইসক্রিমের বিল পরিশোধ করা শেষে তিনজন পুনরায় হাঁটা শুরু করে বাইরের দিকে।
এদিকে মিনিট বিশেক পর ক্যাম্পাসের বাইরে এসে গাড়ি থামায় সমুদ্র। সকালে প্রাচীর করা আবদারটি প্রত্যাখ্যান করতে পারে নি সে। কাজের ব্যস্ততায় প্রাচীকে তেমন একটা সময় দিতে পারে না সমুদ্র। গাড়ি পাশেই পার্কিং করে বেরিয়ে পড়ে সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সঠিক সময়েই পৌঁছেছে সে। এখনি তো প্রাচীর ক্লাস শেষ হওয়ার কথা।
ফোনের কললিস্ট ঘেঁটে প্রাচীর নাম্বারে ডায়াল করতেই অপর পাশ কোনো রেসপন্স আসে না বরং সুইচড অফ করে রাখা। এতে সামান্য পরিমাণ খটকা লাগলেও তা এড়িয়ে যায় সমুদ্র। সেখানে আরো দশ পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেও তেমন কোন প্রত্যাশিত ফলাফল পায় না সে।
– “তবে কি প্রাচী আগেই বেরিয়ে গিয়েছে আকাশ আর হৃদিতার সাথে? কিন্তু সেটা হলে তো আমাকে একবার ফোন করে জানাতে পারত। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে।”
আশপাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে সমুদ্র। কিছু একটা ভেবে ক্যাম্পাসের বাইরের দিকে পা বাড়ায় সে।
কিছুটা পথ যেতেই দূর পশ্চিমে থাকা বড় বট গাছের নিচে থাকা আকাশ আর হৃদিতার দিকে চোখ পড়ে সমুদ্রের। দুজনের অবস্থাই বেশ নাজেহাল। হৃদিতা আর আকাশ যদি এখানে থেকে থাকে তবে প্রাচী কোথায়?
৫০.
– “আকাশ, হৃদিতা তোমরা এখানে? প্রাচী কোথায়? আর তোমাদের এই অবস্থা কেন?”
আকাশ আর হৃদিতার দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সমুদ্র।
মাথা ঝিমঝিম সহ ব্যাথায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে আকাশ আর হৃদিতার। সামনে থাকা সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দৃশ্যমান। দুজনের এহেন পরিস্থিতি দেখে ঘাবড়ে যায় সমুদ্র। পাশে থাকা পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে দুজনের মুখশ্রীতে ছিটিয়ে দিতেই খানিকটা হুঁশ ফিরে আসে।
– “বোথ অফ ইউ ফাইন? আকাশ, হৃদিতা তোমাদের দুজনের সাথে তো প্রাচীর থাকার কথা তাই না? প্রাচী কোথায়?”
– “প্রাচী? প্রাচী তো আমাদের সাথেই ছিল। আমরা তো আইসক্রিম খেতে খেতে কফিশপের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই মাথাটা এত চক্কর দিয়ে উঠলো, তার পরে আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন নিজেদের এখানে আবিষ্কার করি।”
হৃদিতার বলা কথা শুনে সমুদ্রের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফুটে ওঠে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভয় ও হচ্ছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই হাতে থাকা ফোনটা তার নিজস্ব রিং টোনের শব্দে বেজে ওঠে।
অর্পিতা ফোন করেছে। এই ভরদুপুরে অর্পিতার ফোনকল আসাটা মোটেও সুবিধার মনে হয় নি সমুদ্রের কাছে। রিসিভ করতেই ফোনের অপর পাশ থেকে অর্পিতার কান্নাভেজা কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “স্,স্য্,স্যার পিহু!”
পিহুর নাম শুনে আঁতকে উঠে সমুদ্র।
– “পিহু? পিহুর কি হয়েছে? পিহু কোথায় মিস অর্পিতা, টেল মি!”
– “পিহুকে ওরা কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছে স্যার! প্লিজ আপনি পিহুকে বাঁচান।”
অর্পিতার কথা কর্ণপাত হতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম সমুদ্রের। একদিকে প্রাচী আর অন্যদিকে পিহু। কাকে ছেড়ে কাকে বাঁচাবে সে?
– “কি হলো ভাইয়া? কিছু জানতে পেরেছেন প্রাচী কোথায় আছে?”
সমুদ্রের ভাবনার মাঝেই জিজ্ঞেস করে আকাশ।
– “না এখনো কিছু জানতে পারিনি। তবে তোমরা লাস্ট কোথায় ছিলে? আই মিন সেই আইসক্রিম স্টল কোথায় ছিল?”
আকাশ আর হৃদিতার সহযোগিতায় ফের সেই জায়গায় পৌঁছাতেই অবাক হয় আকাশ, হৃদিতা।
কেননা যেই আইসক্রিম স্টলের সামনে তারা তিনজন দাঁড়িয়ে ছিল সেই স্টল পুরোটাই উধাও।
– “কি হয়েছে আকাশ, কোথায় স্টল?”
– “এখানেই ছিল স্টল টা। একটু আগেও তো ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই কোথায় গায়েব হয়ে গেল? ”
আকাশ অবাক চাহনিতে প্রলাপ বকে। সমুদ্র একদৃষ্টে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার বুঝতে দেরি হয় না এসবের মূলে কে?
৫১.
মস্তিষ্কের অগ্রভাগে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভূত হয়ে নড়েচড়ে উঠে প্রাচী। চোখ পিটপিট করে তাকালেও ঝাপসা ঝাপসা দেখতে পায় চারপাশে। মিনিট দুয়েক পর সবকিছু আবছা আবছা থেকে পরিষ্কার হতে থাকে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিতেই খেয়াল করে সে কোনো গোডাউন নয় বরং সুবিশাল রুমের মধ্যে অবচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল।
কাঁচের দেয়াল ভেদ করে বাইরের সুবিশাল আকাশ দেখা যাচ্ছে। সে তো সকালে ভার্সিটিতে ছিল আর এখন তো সেই সকাল পেরিয়ে রাত। তার মানে এতক্ষণ ধরে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল?
হাত পায়েও কোনো বাঁধন নেই। বিছানা থেকে নেমে পড়তেই বাইরে থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আওয়াজ কানে এসে পৌঁছায়। তার মানে কি সে এখন বর্তমানে কোনো সমুদ্র অঞ্চলে অবস্থান করছে।
মস্তিষ্ক জুড়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় প্রাচীর। এখন তো তার সমুদ্রের সাথে থাকার কথা। সমুদ্র কোথায়? সমুদ্রের কথা মনে পড়তেই নিজের মোবাইল ফোন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রাচী। পুরো রুমে কোথাও ফোন খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয় প্রাচী। তখনই পেছন থেকে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসে।
– “এটা খুঁজছো মিসেস মেহরিশ আয়াত প্রাচী?”
রুক্ষ কন্ঠস্বর। তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে তাকায় প্রাচী। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির মুখশ্রী চিনতে বিন্দু মাত্র বিলম্ব হয় না প্রাচীর। বরং একরাশ বিস্ময়তা নিয়ে বলে উঠে,
– “রাইয়্যান স্যার, আপনি?”
– “ইয়েস মিসেস প্রাচী, আমি! কেন অন্য কাউকে খুঁজছিলে নাকি?”
খানিকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠে রাইয়্যান।
– “এসব কি? আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন আপনি? আর আমাকে এভাবে আটকে রেখেছেন কেন?”
কর্কশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে প্রাচী।
– “আহা হাইপার হচ্ছো কেন? কাম ডাউন! সব তো পড়ে জানা যাবে। আগে রাতের ডিনার করে নাও। পড়ে সব বলছি।”
– “রাইয়্যান স্যার! আমি শেষ বারের মত জিজ্ঞেস করছি আপনি কোথায় নিয়ে এসেছেন আমাকে। আমি তো ভার্সিটিতে ছিলাম আকাশ আর হৃদিতার সাথে। ওরা দুজন কোথায়? আমি সমুদ্রের কাছে যাব।”
– “বললাম তো সব বলব। আগে খেয়ে নাও।”
বলেই খাবারের প্লেট প্রাচীর দিকে এগিয়ে দিতেই রাগে ক্ষোভে খাবারের প্লেট পাশে ছুঁড়ে ফেলতেই তা কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ভেঙে চৌচির হয়ে যায়।
– “আমি কি জিজ্ঞেস করছি আপনি তা শুনতে পারছেন না? আমি এখানে থাকব না। সমুদ্রের কাছে যাব আমি।”
বলেই দ্রুত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই বাইরের দৃশ্য চোখে পড়ে। ভেতরে সুবিশাল আভিজাত্য বাড়ি মনে হলেও বাইরে থেকে খেয়াল করলে মাঝারি আকারের কুটিরের মত লাগে। দরজা খুলে বাইরে বের হতেই আরো এক ধাপ অবাক হয় প্রাচী। দূর দূরান্তেও কোনো বাড়িঘরের চিহ্ন নেই। চারপাশে শুধু সমুদ্রের নীলচে পানির ছড়াছড়ি আর বিশাল বিশাল গাছগাছালি। দেখে তো মনে হচ্ছে একটা পুরো দ্বীপের মাঝে রয়েছে সে।
– “বলেছিলাম না, এতো হাইপার হয়ে লাভ নেই। তুমি এখান থেকে কোথাও পালাতে পারবে না প্রাচী। তুমি এমন একটা জায়গায় আছো যার দূর দূর সীমানাতেও কোনো মানুষের বসবাস নেই। আর রইলো সমুদ্রের কথা? তার কথা এখন থেকে ভুলতে শুরু করে দাও; কারণ তোমার নাগাল সে আর কোনোদিনই পাবে না।”
কথাগুলো পেছন থেকে কর্ণপাত হতেই অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে যায় প্রাচী। কি বলছে এসব রাইয়্যান? তাহলে কি আসলেই সে আর সমুদ্রের সাথে দেখা করতে পারবে না?……….
#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#অষ্টাদশ_পর্ব (রহস্য উন্মোচন ২)
৫২.
ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত ১:৩০ বাজে। ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে একদৃষ্টে নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। মুখশ্রী বেশ গম্ভীর। লাইফের সবচেয়ে বড় গোলক ধাঁধায় এসে ফেঁসে গিয়েছে সে। একদিকে নিজের স্ত্রী প্রাচী আর অন্যদিকে পিহু। দুজনের লাইফ ই রিস্ক জোনে এসে আটকে গিয়েছে।
পেছন থেকে অর্পিতার ডাক শুনতেই কিছুটা নড়েচড়ে উঠে সমুদ্র।
– “স্যার?”
– “ইয়েস মিস অর্পিতা?”
– “স্যার পিহুর কোনো খোঁজ পেলেন?”
– “না মিস অর্পিতা! মেয়েটাকে এখনো খুঁজে পাই নি। আপনি চিন্তা করবেন না; পিহুকে আমি ঠিকই পেয়ে যাব।”
অর্পিতা ও আর কথা বাড়ায় না। সমুদ্রের প্রতি তার যথেষ্ট পরিমাণ ভরসা আছে। সমুদ্রের উত্তর পেয়ে নিঃশব্দে ছাদ ত্যাগ করে নিচে চলে যায়। এদিকে অর্পিতা চলে যেতেই সমুদ্রের পকেটে থাকা ফোন বেজে ওঠে। ফোন বের করতেই এসকে নামটা জ্বলজ্বল করে স্ক্রিনে।
– “ইয়েস সাকিব, ইনফরমেশন পেয়েছ?”
– “………….”
অপর পাশ দিয়ে ভেসে আসা কথার পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্রের চেহারার রং ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে। আস্তে করে কল কেটে দিয়ে বলে উঠে,,
– “আই উইল নট স্পেয়ার ইউ বাস্টার্ড রাইয়্যান!”
চোখে মুখে রাগের আভা স্পষ্ট।
ঘুম ঘুম রেশ কেটে যেতেই আড়মোড়া দিয়ে উঠে পড়ে পিহু। আশপাশে আধো আধো চোখে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ে সে। এটাতো তার ঘর না। তার ঘর তো ছোট বড় পুতুল দিয়ে পরিপূর্ণ। কোথায় আছে সে?
– “বাবা? অর্পিতা আন্টি? বাবা তুমি কোথায়?”
পাশের রুমেই মেঝেতে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিল প্রাচী। দৃষ্টি তার শূন্য মেঝেতে স্থির। চোখের কার্নিশ বেয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু হুট করে বাইরে থেকে বাচ্চা মেয়েলি কন্ঠ পৌঁছাতেই নড়েচড়ে বসে প্রাচী। সে ছাড়াও কি এ বাড়িতে অন্য কোনো বাচ্চা রয়েছে? আর বাচ্চাটাই বা এই দ্বীপের মধ্যে কি করে এলো? নাকি তার মতো বাচ্চাটাকে ও রাইয়্যান এখানে ধরে নিয়ে এসেছে!
তড়িৎ গতিতে বসা থেকে নড়বড়ে পায়ে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। দরজা খুলে অন্য রুমের দিকে পা বাড়াতে যাবে তখনই সামনে রাইয়্যানকে দেখতে পায় সে। কোলে চার পাঁচ বছর বয়সী ফুটফুটে একটা বাচ্চা।
– “আমাকে ছেড়ে দাও। আমাল বাবা কোথায়? আমি বাবার কাছে যাব। তুমি একটা পঁচা আঙ্কেল। আমার অর্পিতা আন্টির কাছ থেকে আর আমার বাবার কাছ থেকে আমাকে নিয়ে এসেছ!”
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে চোখ মুখ কচলে বলে উঠে পিহু। প্রাচী নির্বাক। একটা লোক কতটা নিচে নেমে গেলে এমন কাজ করতে পারে।
– “আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন মিস্টার রাইয়্যান আহমেদ? এটুকু একটা বাচ্চাকে পর্যন্ত তুলে নিয়ে এসেছেন তার বাবার কাছ থেকে! কি দোষ করেছে মেয়েটা? আর আমাকেই বা কেন তুলে এনেছেন এই জায়গায়? কিসের শত্রুতা আমার সাথে আপনার?”
– “ইন্টেলিজেন্ট! বেশ বুদ্ধি আছে তোমার মাথায় বলতে হবে। তোমাকে আর এই বাচ্চা মেয়েটা সরি বাচ্চা মেয়ে বলছি কেন? এর নাম তো পিহু; আমার খেলার আসল গুটি যাকে দিয়েই আমার প্ল্যান সাকসেসফুল হবে। আর রইলো বাদবাকি তোমাদের দুজনকে এখানে তুলে আনার কথা সেটার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমুদ্র।”
পিহুকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে উঠে রাইয়্যান। এদিকে পিহু ভয়ে জড়সড় হয়ে দৌড়ে প্রাচীর কাছে চলে যায়। প্রাচীও আগলে নেয় পিহুকে। রাইয়্যানের বলা প্রতিটি কথাই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে প্রাচীর।
– “সমুদ্র? কিন্তু কেন? সে কি ক্ষতি করেছে আপনার? আমি না হয় তার স্ত্রী; কিন্তু পিহু? পিহু কি দোষ করেছে?
আর সমুদ্রের সাথে আপনার কিসের শত্রুতা? কোন খেলার গুটি বানিয়েছেন আমাদেরকে?”
– “বড্ড বেশি প্রশ্ন করো তুমি প্রাচী। সমুদ্র কি করে তোমাকে টলারেট করে কে জানে?
জানতে চাও কিসের শত্রুতা আমার সমুদ্রের সাথে? জানতে চাও পিহুর সাথে কিসের সম্পর্ক সমুদ্রের!
তাহলে শুনো সমুদ্র হচ্ছে একজন সিক্রেট গ্যাংস্টার! আর আমিও ছিলাম একজন গ্যাংস্টার যাকে কি না পাঁচ বছর আগে তোমার সমুদ্র সেই গ্যাং থেকে বের করে দিয়েছিল সবার সামনে অপমান করে। একটা ভুলের জন্য আমার এত এত পাওয়ার, আমার অধিকার মিনিটের ব্যবধানেই কেড়ে নিয়েছিল আমার কাছ থেকে। আর সেখান থেকেই আমার প্রতিশোধের নেশা শুরু।
তুমি তো জাস্ট একটা গেইম পার্ট ছিলে যাকে বিয়ে করলে সহজেই আমার প্ল্যান, সমুদ্রের অস্তিত্ব মুছে দেয়ার প্ল্যান সাকসেসফুল হতো। কিন্তু না সেদিন ও আমার প্ল্যান নষ্ট করে দিয়েছিল তোমার সাইকো লাভার, সমুদ্র!
ইয়েস মিসেস প্রাচী! ঠিকই শুনেছ! তোমার সেই অজানা আগন্তুক আর কেউ নয় বরং সমুদ্র নিজেই।
বাকি রইলো পিহু? পিহু হলো সমুদ্রের অস্তিত্ব; সমুদ্রের মেয়ে হলো পিহু!”
অতি পরিমাণ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রাচী। একনাগাড়ে বলা রাইয়্যানের কথার প্রত্যুত্তরে আসলে কি বলা উচিত তাই খুঁজে পাচ্ছ না সে।
৫৩.
– “সরি নিকিতা! তোমাকে দেয়া কথাটা আমি ঠিকভাবে পালন করতে পারি নি। পারিনি পিহুকে রাইয়্যানের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে। তবে আই প্রমিজ আমি কিছু হতে দেব না পিহুর। পিহুকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে আসব রাইয়্যানের কাছ থেকে। আর না কিছু হতে দিব প্রাচীর।
ডোন্ট লুজ হোপ, প্রাচী। আমি আসছি।”
দেয়ালে টাঙানো নিকিতার ছবিটার দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টে বলে উঠে সমুদ্র। যত যাই হোক পিহু তার দায়িত্ব।
– “ব্যাস, অনেক হয়েছে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকা। আসল রহস্য উন্মোচিত হওয়ার ঠিক সময় এসে পড়েছে।”
– “স্যার, এইযে রাইয়্যানের লাস্ট লোকেশন! রাইয়্যানকে লাস্ট গত দুপুরে ঢাকার বাইরে দেখা গিয়েছে। আর আমি এয়ার পোর্টে ও খোঁজ নিয়েছি। সেখানে রাইয়্যানকে পাওয়া যায় নি। আর যদি সে বিডির বাইরে থাকে তবে একটা উপায়েই যাওয়া সম্ভব!”
ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে সাকিব।
– “যে করেই হোক আমার রাইয়্যানের প্রেজেন্ট লোকেশন চাই। বেশি দেরি করা যাবে না সাকিব। রাইয়্যান অনেক ডেঞ্জারাস। আর এখন শুধু রাইয়্যান না; ওর কাছে আমার পিহু আর প্রাচী আছে। সো বি কেয়ারফুল।”
সমুদ্রের কথা শুনে সাকিব পুনরায় ল্যাপটপে নিজের কাজে মনোনিবেশ করে।
পিহুকে খাইয়ে দিতেই কিছুক্ষণ বাদেই ক্লান্ততায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পিহু। পিহুর পাশেই একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে রয়েছে প্রাচী। প্রাণবন্ত মেয়েটা এক রাতের মধ্যেই কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। এখানে রাইয়্যানকে ফাঁকি দিয়ে খুঁজে খুঁজে অনেক কষ্টে নিজের ফোনটা পেলেও কোনো লাভ হয়নি প্রাচীর। রাইয়্যান টের পেয়ে ফোনটাও ছিনিয়ে নিয়েছে আর ওয়ার্নিং দিয়েছে কোনোভাবে পালানোর চেষ্টা করলে পিহুর বড় কোনো ক্ষতি করে দিবে।
– “আমি বিশ্বাস করি না এসব। সমুদ্র আমার সাথে এমন করতে পারেন না। আমার কাছ এত বড় সত্যি কি করে লুকালেন আপনি সমুদ্র? সত্যিই কি পিহু আপনার মেয়ে? তাহলে কেন লুকালেন পিহুকে আমার কাছ থেকে? বিয়ে কেন করলেন আমাকে? আপনি যদি আমাকে ভালোবেসে থাকেন তাহলে কেন লুকালেন?”
পিহুর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে প্রাচী। একটু আগেই রাইয়্যানের সাথে একদফা কথা কাটাকাটি হতেই রাইয়্যান প্রাচী আর পিহুকে একটি রুমে বন্দি করে বাইরে চলে যায়। এত বড় নির্জন অবস্থা থেকে কি করে পালাবে সেই চিন্তায় গভীর ভাবে মগ্ন প্রাচী।
– “তুই কি ভেবেচিন্তে এটা করতে যাচ্ছিস সমুদ্র? তুই জানিস এটা কতটা রিস্কি হতে পারে? তোর এই একটা সিদ্ধান্ত প্রাচীর আর তোর ফিউচারে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা তুই খুব ভালো করেই জানিস।”
ইশরাকের কথায় পাশ ফিরে তাকায় সমুদ্র। দৃষ্টিতে একরাশ আতংক। কাউকে হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয় যেন জেঁকে বসেছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় সে। ভাবমূর্তি পরিবর্তন করে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
– “আমি জানি ইশরাক। বাট আই হ্যাভ ডু দিজ! প্রাচীকে বলতেই হবে সবটা। আমি জানি আমাদের সম্পর্কে এর জন্য কিছুটা হলেও সাফার করতে হবে। কিন্তু আমি ম্যানেজ করে নেব।”
– “যেটা তুই ভালো মনে করিস।”
ধীর কন্ঠে বলে পুনরায় একই ভঙ্গিমায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। বিষাদময় প্রহর! এর অবসান কখন হবে কে জানে?
ভোরের আলো ফোটার পর পরই বাসায় প্রবেশ করে রাইয়্যান। প্রাচী আর পিহুর দিকে একপলক তাকিয়ে পা বাড়ায় সেদিকে। প্রাচী মেয়েটা বড্ড চালাক। কখন যে তার নাকের ডগার নিচ দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে কে জানে? অতি সন্তর্পণে দরজা খুলতেই প্রাচী আর পিহুর ঘুমন্ত চেহারা চোখে পড়ে তার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমে যেতেই ফোন তার বেজে ওঠে।
– “ইয়েস, দিপ্ত?”
– “স্যার আপনার কাজ হয়ে গিয়েছে!”
– “ওয়েল ডান!”
বলেই খট করে কল কেটে দেয় রাইয়্যান।
– “ওয়েলকাম ব্যাক, মিস্টার জুনায়েদ আরহাম সমুদ্র! অবশেষে আমার প্ল্যান সাকসেসফুল হতে চলেছে! আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া প্রতিটা জিনিসের জন্য তোকে মূল্য দিতে হবে। আর সেটাও তোর মৃত্যু দিয়ে!”
বলেই খোলা রুমে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রাইয়্যান। হাসি তার হিংস্র, ভয়ঙ্কর। প্রতিশোধের নেশা স্পষ্ট!……………
#চলবে 🍂
#চলবে 🍂