সায়াহ্নের প্রণয় পর্ব -১৫+১৬

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#পঞ্চদশ_পর্ব

৪৪.
কেটে গিয়েছে মাঝ থেকে দুদিন। আজ সকাল থেকেই প্রাচী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে লাগেজ গোছানো সহ বিভিন্ন কাজে। খুব সকালে উঠেই বাড়ির সবার পছন্দের ব্রেকফাস্ট তৈরি করে নিয়েছে সে। এই দু দিনে কোহিনুর চৌধুরী আর সাদাত চৌধুরীর আচরণে বরাবরের মতই মুগ্ধ হয়েছে প্রাচী।
বিয়ের পরের নিয়ম রীতি অনুযায়ী আজ তার পুনরায় বাবার বাড়ি অর্থাৎ আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে যাওয়ার কথা। এ জন্যই এত আয়োজন আর তাড়াহুড়ো। সব কাজ শেষ করে রুমে প্রবেশ করতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সমুদ্রকে দেখে অতি বিস্ময়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে বসে।
এদিকে প্রাচীর এহেন চিৎকারে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় সমুদ্র। সদ্য শাওয়ার করে বেরিয়ে আসায় উন্মুক্ত লোমশ বুকে বিন্দু পানি জমে রয়েছে।
– “কি হয়েছে? এভাবে গলা ফাটিয়ে ষাঁড়ের মত চিল্লাচিল্লি করছো কেন?”
সমুদ্রের কথায় অপর পাশে ঘুরেই চোখ মেলে তাকায় প্রাচী।
– “চিল্লাচিল্লি করব না মানে? আপনি এভাবে জামাকাপড় ছাড়া টাওয়াল রুমে ঘুর ঘুর করছেন কেন? ঠিকই বলেছিলাম; এই ব্যাটার লাজ লজ্জা বলতে কিছুই নেই।”
ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে প্রলাপ বকে প্রাচী।
– “তো আমার রুম, আমি যেভাবে খুশি থাকব। আর এতে লজ্জার কি আছে? আফটার অল আ’ম‌ ইউর হাজবেন্ড; তাইনা মিসেস প্রাচী?”
– “আপনার সাথে কথা বলে কোনো লাভই নেই। আপনি থাকুন আপনার রুমে। আমি যাচ্ছি।”
বলেই বড় বড় পায়ে রুম ত্যাগ করে প্রাচী। অন্যদিকে প্রাচীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে বিছানায় পড়ে থাকা ব্ল্যাক কালারের শার্ট তুলে নেয় সমুদ্র।
কোহিনুর চৌধুরী এবং সাদাত চৌধুরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলা শুরু করে নিজ গন্তব্যে।

হোসেন বাড়িতে বেশ আয়োজন চলছে। আনোয়ার সাহেব আর জেবা বেগম সহ বাড়ির সবার মাঝেই বেশ‌ প্রফুল্লতা‌ প্রাচী ও সমুদ্রের আগমনের বিষয় নিয়ে।
– “কি ব্যাপার জেবা, ওরা কখন বেরিয়েছে এ সম্পর্কে ফোন করে কিছু বলেছে?”
সোফার উপর বসে চা খেতে খেতে বলে উঠলেন আনোয়ার সাহেব।
– “না এখনো তো কিছুই বলে নি। একটু পরেই হয়তো পৌঁছে,,”
জেবা বেগমের কথার মাঝেই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে।
– “ঐ তো। হয়তো প্রাচী আর সমুদ্র এসে পড়েছে।”
– “মা, আপনি বসুন। আমি গিয়ে দেখছি।”
জেবা বেগমকে বলে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় ফিহা। চেনা পরিচিত মুখশ্রী দেখতেই প্রাচীর ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত হাসির রেখা ফুটে ওঠে। নিজের হাত দুটো প্রসারিত করে ফিহাকে জড়িয়ে ধরে সে।
সমুদ্র ও এগিয়ে গিয়ে বড়দের সালাম দেয়। ইশরাক এগিয়ে আসতেই মুচকি হেসে গিয়ে ইশরাককে জড়িয়ে ধরে সমুদ্র।

নানা রকম ব্যস্ততায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সুবিশাল, সীমাহীন আকাশের মাঝে রৌদ্রের কোনো নাম গন্ধ নেই। মাঝেমধ্যে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। আর সেটাই রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে প্রাচী। অবাধ্য চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার তারপরও তার মাঝে কোনো প্রকার হেলদোল নেই।
– “এটা কি করলি প্রাচী? তুই তো বলেছিলি রাইয়্যান স্যারের সাথে বিয়ের দিন তোর সেই অজানা আগন্তুক বেরিয়ে আসবে সবার সামনে। কিন্তু সেদিন কি হলো? রাইয়্যান স্যার নিজ থেকেই বিয়ে ভেঙে দিলেন; তার উপর সবচেয়ে বড় কথা তোর বিয়ে সমুদ্র ভাইয়ার সাথে হয়ে গেল!”
একনাগাড়ে প্রাচীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে হৃদিতা। হৃদিতার কথায় আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেলিং ছেড়ে হৃদিতার দিকে ঘুরে তাকালো প্রাচী।
– “রাইয়্যান স্যার নিজ থেকে বিয়ে ভাঙেনি হৃদিতা; আর না নিজ থেকে উধাও হয়েছে। এই বিয়েটা ভাঙানো হয়েছে। আর কে ভাঙিয়েছে সেটাও আমার খুব ভালো করেই জানা আছে।
বাকি রইল, মিস্টার ইনভিজিবলের‌ কথা? সে অলরেডি আমার কাছেই আছে।”
প্রাচীর বলা পুরো কথাই যেন হৃদিতার‌ মাথার উপর দিয়ে গেল। এদিকে হৃদিতাকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্মিত হাসে প্রাচী; যেন প্রতিটি চরিত্রই ভীষণ রহস্যময়ী।

৪৫.
রাতের ডিনার শেষে বাড়ির সবাই যখন খোশগল্পে ব্যস্ত তখন নিজের রুমে প্রবেশ করে প্রাচী। মাথা যন্ত্রণা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ড্রয়ার হাতড়ে একটা ঔষধের কৌটা বের করে তা থেকে একটা ঔষধ খেয়ে নেয় সে। ইদানিং মাথা যন্ত্রণার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি ও বোধ হয় হ্রাস পাচ্ছে।
অন্যদিকে ফোনের ভাইব্রেশন বেজে উঠায় পাশ ফিরে তাকায় প্রাচী। সমুদ্রের ফোনটা হয়তো ঘরেই ভুলে গিয়েছে। ফোনটা বাজতে বাজতে একসময় নিজ থেকেই কেটে যায়।
মিনিট দুয়েক পর ফোনটা পুনরায় বেজে উঠতেই ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী। ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে পিহু নামটা ভেসে ওঠে।
– “পিহু? সে আবার কে? এই নামটা তো আগে কখনো শুনিনি।”
আনমনে ভাবতে ভাবতে ফোনটা রিসিভ করতে যাবে তখনি হাত থেকে কেউ খপ করে ফোন কেড়ে নেয়ায় খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় প্রাচী কিন্তু পরক্ষণেই সমুদ্রকে দেখতে পেয়ে স্থির হয় সে।
– “কাউকে জিজ্ঞেস না করে তার পার্সোনাল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা মোটেও ঠিক না মিসেস প্রাচী।”
হঠাৎ সমুদ্রের এমন পরিবর্তিত আচরণ তেমন একটা ভালো লাগেনি প্রাচীর কাছে। মুহূর্তেই মনটা বিষন্ন হয়। তাহলে কে হয় পিহু সমুদ্রের?
– “আমি তো শুধু দেখছিলাম কে কল করেছে? এতই যখন পার্সোনাল ছিল তখন ফোনটা এভাবে রুমে খামখেয়ালি ভাবে ফেলে রেখেছিলেন কেন?”
সোজাসাপ্টা গলায় বলে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। কন্ঠে অভিমান মিশ্রিত। এগিয়ে গিয়ে ব্যালকনির দরজা খুলে ইজি চেয়ারটাতে বসে পড়ে। সমুদ্র ও আগ বাড়িয়ে মুখ ফুটে কিছু বলে না।
– “আ’ম সরি প্রাচী। আমি এখন চাইলেও তোমাকে পিহুর ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। তবে কিছু সময় পার হতে দাও। আমি নিজেই তোমাকে পিহুর ব্যাপারে সবটা বলব।”
মনে মনে বিড়বিড় করে সমুদ্র। কপালে তার সুক্ষ্ম চিন্তার রেখা। তার ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠতেই ফোন নিয়ে রুম ত্যাগ করে সে।

আজ ফিহার‌ জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে হোসেন বাড়ির সবাই বেশ খুশি। পুরো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জেবা বেগমের সাথে সকাল থেকেই কাজে লেগে পড়েছে প্রাচী। কাজের মাঝে কয়েকবার সমুদ্রের সম্মুখীন হলেও এড়িয়ে গিয়েছে সে। সমুদ্রকে এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টা চোখ এড়ায় না সমুদ্রের। এড়ানোর বিষয়টা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে তাকে।
সন্ধ্যায় ছোট খাটো একটা পার্টি রাখা হয়েছে। আর সে উপলক্ষ্যে বাড়ির সব‌ কাপল ই ম্যাচিং করে ড্রেস পড়বে। রুমে বসে হেডফোন কানে গুঁজে গান শুনতে ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। তখনই হাতে দুটো মাঝারি আকারের প্যাকেট নিয়ে রুমে প্রবেশ করে প্রাচী। নিজের জন্য রাখা প্যাকেটটা আলাদা করে রেখে সমুদ্রের প্যাকেটটা নিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে দেয় সে।
– “এটা ভাইয়া পাঠিয়েছে। বাড়ির সবাই কাপল ড্রেস পড়বে। আর আপনাকেও এটা পড়তে বলে দিয়েছে।”
গম্ভীর মুখে বলতেই সমুদ্র কান থেকে হেডফোন খুলে তা পাশে রেখে ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
– “কি হয়েছে? শুনি নি আমি। আবার বলো।”
বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্যাকেটটা বিছানায় রেখে পুনরায় বলে উঠে,
– “শুনবেন কি করে? কানে তো‌ হেডফোন গুঁজে ছিলেন।”
– “কি করব বলো, বাড়িতে এত সুন্দরী একটা বউ থাকতেও বোর হতে হয়। ভাবলাম কি আর করার; কানে হেডফোন গুঁজে না হয় গান ই শুনি।”
সমুদ্রের মুখে বউ ডাক শুনতেই থমকে যায় প্রাচী। মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমান গুলো হুড় হুড় করে পালাতে থাকে।
– “সন্ধ্যায় পার্টিতে পড়ার জন্য এটা ভাইয়া পাঠিয়েছে। রেডি হয়ে নিচে চলে আসবেন।”
আর দাঁড়ায় না প্রাচী। দ্রুত পায়ে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সে।

বেবি পিংক আর হোয়াইট কালারের কম্বিনেশনের গাউন, গলায় আর কানে পার্লের অর্নামেন্টস্, লম্বা চুলগুলো কার্ল করে বেঁধে রাখা। জন্মদিনের মূল কেন্দ্রবিন্দু যাকে ঘিরে; ফিহাকে দেখতে ভীষণ সুন্দর ও আকর্ষণীয় লাগছে। পাশেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে ইশরাক‌। তার পরনেও ম্যাচিং করা স্যুট।
অন্যদিকে ডার্ক পার্পেল কালারের শাড়ি, গলায় আর কানে পার্লের অর্নামেন্টস্, চুলগুলো সুন্দর করে স্ট্রেট করে ছেড়ে দেয়া। পার্পেলের‌ সংমিশ্রণ প্রাচীর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরো কয়েক গুণ। পাশেই ডার্ক পার্পেলের পাঞ্জাবি, পাজামা পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। চোখে প্রতিদিনকার সেই ফ্রেমের‌ চশমা, হাতা ফোল্ড করে রাখা। বাড়ির আকর্ষণীয় কাপলের মধ্যে এরাও অন্তর্ভুক্ত।

কেক কাটিং এর পর ফিহাকে তার জন্মদিনের গিফট হিসেবে একটা আংটি সবার সামনে ফিল্মি স্টাইলে বসে পড়িয়ে দেয় ইশরাক‌। এতে চারপাশ করতালিতে মুখরিত হতে থাকে ক্রমশ।
– “লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান। আপনারা সবাই জানেন আজকে আমার ওয়াইফি, আমার ভালোবাসা ফিহার জন্মদিন। আর তার জন্যেই এত আয়োজন। তো এই আয়োজনকে আরো একটু আকর্ষণীয় করতে একটা ডান্স সেগমেন্ট করলে কেমন হয়? এখানে উপস্থিত সকল কাপলকেই এই সেগমেন্টে পার্টিসিপেট করতে হবে।”
কাপল ডান্সের কথা শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে আসে প্রাচীর।
– “হোয়াট! ডান্স?”……….
#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ষোড়শ_পর্ব

৪৬.
কাপল ডান্সের নাম শুনতেই আতকে উঠে প্রাচী। কেননা খুব সম্ভবত ছোট থাকতে ক্লাসিক্যাল ডান্সে প্র্যাকটিস করতে গিয়ে পায়ে গুরুতর ফ্র্যাকচার পড়ায় সেখানেই ডান্স জীবনের সমাপ্তি টেনে দিতে হয়। তারপর থেকে ডান্স নামক জিনিস থেকেই দশ হাত দূরে থেকেছে সে। পাশে সমুদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রাচী ফিসফিস করে বলে ওঠে,
– “শুনুন না, বলছিলাম কি এই ডান্স সেগমেন্টে জয়েন না করলে হয় না?”
হঠাৎ ফিসফিসে আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই পাশ ফিরে তাকায় সমুদ্র।
– “কি হয়েছে? এভাবে ফিসফিস করে কথা বলছো কেন? এনিথিং প্রবলেম?”
– “আরে আগে পুরোটুকু শুনবেন তো। আমি বলছিলাম যে এই ডান্স সেগমেন্টে জয়েন না করলে হয় না? আমি আসলে এই ডান্স পারি না।”
প্রাচীর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফিক করে হেসে দেয় সমুদ্র। প্রাচী ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। এখানে সে এত একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলছে আর সমুদ্র তার কথা শুনে হাসছে।
– “ধুর, আপনাকে কিছু বলছি আর আপনি হেসে যাচ্ছেন। কিছুই বলব না আপনাকে আর।”
খানিকটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠতেই সমুদ্র হাসি থামিয়ে পাশ ফিরে তাকায় প্রাচীর দিকে।
– “লিসেন প্রাচী, এই দেখ আমি হাসি থামিয়ে দিয়েছি। বাট তুমি বলেছোই এমন কথা। এত বড় হয়েও ডান্স করতে ভয়?
ডোন্ট ওয়ারি; আমি আছি তো। তুমি জাস্ট আমার সাথে স্টেপ মিলাবে।”
সমুদ্রের কথায় একটু হলেও আশ্বাস পায় প্রাচী। দুজনের কথোপকথনের মাঝেই হলরুমের লাইট অফ হয়ে যায়। জ্বলে ওঠে আবছা নীল আলো সাথে করে বেজে ওঠে মিউজিক,
……………….

“কিছু কথার পিঠে কথা,,
তুমি ছুঁয়ে দিলেই মুখরতা‌!
হাসি বিনিময় চোখে চোখে
মনে মনে রয় ব্যাকুলতা!

আমায় ডেকো একা বিকেলে,,
কখনো কোনো ব্যাথা পেলে
আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে;
যখনি মন কেমন করে!

কোনো এক রূপকথার জগতে
তুমি তো এসেছো আমারি হতে;
কোনো এক রূপকথার জগতে
তুমি চিরসাথী আমার জীবনে,,,, এই পথে,

প্রত্যেকটা কাপল নিজ নিজ স্থানে থেকে স্টেপ অনুযায়ী কাপল ডান্স শুরু করে দিয়েছে। সমুদ্র আর প্রাচীও তার ব্যাতিক্রম নয়। প্রথম প্রথম কিছুটা অসুবিধে হলেও পরবর্তীতে সমুদ্রের সহযোগিতায় অনেকটাই কম্ফোর্টেবল ফিল করে প্রাচী।

কোথাও ফুটেছে ফুল,
কোথাও ঝরেছে তারা
কোথাও কিছু নেই;
তোমার আমার গল্প ছাড়া!

তুমি আমার স্বপ্ন সারথি,
জীবনে তুমি সে আসত্তি‌(২)
কোনো এক রূপকথার জগতে
তুমি তো এসেছো আমারি হতে;
কোনো এক রূপকথার জগতে
তুমি চিরসাথী আমার জীবনে,,
(বাকিটুকু নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন।)”

প্রাচীর দৃষ্টি সমুদ্রের দিকে স্থির। অন্যদিকে নীল চোখ জোড়াও তার সামনে থাকা মায়া মানবীর উপর স্থির; ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি।
মিউজিক অফ হওয়ার পর সবার হাততালির আওয়াজ পেয়ে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে প্রাচী। সবাই যে প্রাচী আর সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে আছে সেটা খেয়াল হতেই তড়িৎ গতিতে সমুদ্রকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসে প্রাচী। লজ্জায় গালে রক্তিম আভার ছাপ ফুটে ওঠে স্পষ্ট।

৪৭.
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রুমে প্রবেশ করে প্রাচী। কিন্তু রুমের কোথাও সমুদ্রকে‌ দেখতে পায় না সে। পুরো রুম খুঁজে যখনি বাইরের দিকে পা বাড়াবে তখনই দূর ব্যালকনি থেকে ফিসফিসে আওয়াজ পৌঁছাতেই থমকে দাঁড়ায় প্রাচী। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে ব্যালকনির দিকে অগ্রসর হবে তখনই নিচ থেকে জেবা বেগমের গলার স্বর শুনতে পেয়ে অগত্যা পুনরায় পা বাড়াতে হয় নিচের দিকে।

– “আই মিস ইউ বাবা।”
পিহুর কথায় আলতো হাসে সমুদ্র। মেয়েটার মায়ায় অদ্ভুত রকম ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে সে।
– “আই মিস ইউ টু, পিহু মামনি।”
– “বাবা তুমি মাকে নিয়ে কবে আমাল কাছে আসবে? আমাল এখানে একদম ই ভালো লাগে না। সবাই কি সুন্দল‌ সবাল‌ মা বাবার সাথে থাকে। আমিও থাকতে চাই।”
পিহুর‌ আহ্লাদী সুরে বলা কথায় মায়া হয় সমুদ্রের। আসলেই তো। আর কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে এভাবে পিহুকে রাখতে পারবে সে। বাচ্চা মেয়েটার ও তো মায়ের আদরের প্রয়োজন। ভাবতে ভাবতেই ভেতর থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সমুদ্রের।

– “কি হলো বাবা? তুমি কথা বলছো না কেন?”
– “এইতো পিহু মামনি, বাবা তোমার মাকে নিয়ে খুব তাড়াতাড়িই ফিরে যাবে। আর কয়েকটা দিন, এবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর অর্পিতা আন্টিকে জ্বালাবে না, গুড গার্ল‌ হয়ে থাকবে, কেমন?”
– “আচ্ছা বাবা, আমি অর্পিতা আন্টিকে একটুও জ্বালাব না প্রমিজ।”
– “গুড নাইট পিহু মামনি।”
বলেই খট করে কল কেটে দেয় সমুদ্র। সামনে এখন অনেক দায়িত্ব। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে টেবিলের উপরে থাকা ল্যাপটপটি হাতে তুলে নেয় সে। মেইল গুলো চেক করা প্রয়োজন।
খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিন অন করে তাতে থাকা ফাইল খুলে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা চেক করে নেয় সমুদ্র। ফাইল থেকে বেরিয়ে মেইল অপশন চালু করতেই সামনে থাকা @ayman.gmail.com নাম থেকে মাঝারি আকারের মেইল‌ চোখে পড়ে তার। মেইল ওপেন করতেই তাতে থাকা লিখা গুলো পড়ে আপনাআপনিই চোখ বন্ধ করে নেয় সমুদ্র। রাগে ক্ষোভে চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে ইতোমধ্যে। হাত মুঠো করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়াতেই সামনে চোখ পড়ে প্রাচীর উপর‌।

ভরা পানির জগ হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে প্রাচী। জগটা খাটের পাশে এডজাস্ট টেবিলের সাথে রাখতেই সমুদ্রের উপর চোখ পড়ে তার।

– “কি ব্যাপার, আপনি এখনো ঘুমান নি? আর কি হয়েছে? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে প্রাচী।
সমুদ্র স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় বলে ওঠে,
– “কিছুনা, তুমি ঘুমিয়ে পড়। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমাচ্ছি।”
প্রাচী আর কোনো কথা বাড়ায় না। বিছানার বাম পাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে আর সমুদ্র ও একপলক তাকিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমের‌ দিকে।

সকালে কারো উত্তপ্ত নিঃশ্বাস মুখশ্রী ছুঁয়ে যেতেই নড়েচড়ে উঠে প্রাচী। চোখ মুখ কুঁচকে পিটপিট করে তাকাতেই নিজেকে কারো বুকের উপর আবিষ্কার করতেই ঘুমের রেশ কেটে যায়। সমুদ্রকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। ধীরে ধীরে সমুদ্রের বুকের উপর থেকে সরে আসতেই সমুদ্রের ঘুম জড়ানো আগ্রাসী কন্ঠস্বর ভেসে আসে কানে।

– “কারো ঘুমের সুযোগ নিয়ে তার কাছে চলে আসাটা নট ফেয়ার মিসেস প্রাচী। আমি তো ভেবেছিলাম খুঁজে খুঁজে আমার কপালে একটা আনরোমান্টিক‌ ঝগরুটে‌ বউ জুটেছে। কিন্তু না এখন দেখছি আমার বউ যথেষ্ট পরিমাণে রোমান্টিক।”
কথাগুলো কর্ণকুহরে ঠেকতেই‌ চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম প্রাচীর। অবাক চোখে সমুদ্রের দিকে ঘুরে তাকাতেই খেয়াল করে সমুদ্র তার দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

– “তার মানে আপনি এতক্ষণ জেগে ছিলেন!
লিসেন আমি কারো ঘুমের সুযোগ নেই নি; হতে পারে ঘুমের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। নাহলে আপনার বুকে গিয়ে ঘুমানোর কোনো শখ নেই আমার!”
বলেই তড়িৎ গতিতে খাট থেকে নেমে পড়ে প্রাচী। এখানে থাকা আর সমুদ্রের সম্মুখীন হওয়ার মতো লজ্জাজনক ঘটনা বোধ হয় আর নেই।

৪৮.
বাড়ির বড় সব সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে প্রাচী আর সমুদ্র।
বাইরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল সমুদ্র। একটু আগেই মিসেস কোহিনুর চৌধুরী ফোন করেছিল।
প্রাচী ও গিয়ে সরাসরি ফ্রন্ট সিটে‌ বসে পড়ে। গাড়িতে অনেকক্ষণ যাবৎ বসে থেকে বোর হওয়ায় গাড়িতে এডজাস্ট মিউজিক প্লে লিস্ট অন করে নেয়। সিটের সামনে থাকা গ্লোব কম্পার্টমেন্ট এ চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী। ছবি জাতীয় কিছু একটার অগ্রভাগ খানিকটা বেরিয়ে আছে। সন্দেহ বশত সেটার অগ্রভাগ হাত দিয়ে টান দিতেই পুরোটা বেরিয়ে আসে।
ধূসর রঙের শাড়ি পরিহিতা একজন নারী, মায়াবি চেহারা, ঠোঁট জুড়ে স্নিগ্ধময় হাসি। কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় প্রাচী। মেয়েটা কে? আর মেয়েটার ছবিই বা সমুদ্রের গাড়ির গ্লোব কম্পার্টমেন্টে পড়ে আছে কেন? মেয়েটার পরিচয় ই বা কি? সমুদ্রের সাথেই বা তার কিসের সম্পর্ক? ভাবতে ভাবতেই ছবি উল্টো পিঠে থাকা একটা লেখার দিকে চোখ পড়ে তার। একটু ভালো করে বোঝার চেষ্টা করতেই সেখানে ‘নিকিতা’ নামটা চোখে পড়ে তার। নিকিতা? কে সে?
সমুদ্রকে কি সরাসরি জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে? কি তবে এই নিকিতার রহস্য; যা সমুদ্র তার থেকে লুকিয়ে রেখেছে?

দীর্ঘ একটা সময় জার্নি করার পর গাড়ি পৌঁছে যায় চৌধুরী বাড়ির সামনে। পুরো পথে সমুদ্র টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করে গিয়েছে প্রাচীকে‌ কিন্তু প্রাচী সেগুলোর হু হ্যাঁ উত্তর দিয়ে গিয়েছে। সে তো গভীর ভাবনায় মত্ত। তার ভাবনা জুড়ে অন্য কিছুর বিচরণ। প্রাচীর এই অন্যমনস্কতা চোখ এড়ায় নি সমুদ্রের।
গাড়ি থামিয়ে প্রাচীকে ডাক দিলেও কোনো সাড়াশব্দ পায়নি সে। দু তিন বার ডাক দিতেই ভাবনার সুতো কাটে প্রাচীর।
– “কি হয়েছে? কোথায় হারিয়ে গিয়েছ? এনিথিং প্রবলেম?”
– “না, না কিছু হয় নি তো। এমনিতেই, নাথিং সিরিয়াস।”
– “আচ্ছা ঠিক আছে, নেমে পড়। আমরা এসে পড়েছি।”
প্রাচীও চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। সমুদ্রও একপলক তাকিয়ে কি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গাড়ি থেকে।………

#চলবে 🍂
#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here