#সুখের_পাখি
১৯
রাতে সাবিনা তনুর ঘরেই শুয়েছিল। এই সময় মেয়েটাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। বাবাকে হারানোর শোক এখনও পুরোপুরি সামলে উঠেনি তনু। বাবাকে নিয়ে যাওয়া থেকে কবর দিয়ে আসার এতটা সময় তনু একটুও কাঁদেনি। কিন্তু তখন ইহানের বুকে পড়ে ওভাবে পাগলের মতো কাঁদার পর থেকে এখন পর্যন্ত ওর চোখের পানি থামছেই না। কাঁদতে কাঁদতে এখন আর গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না। কিন্তু চোখ গড়িয়ে ঠিকই পানি পড়ছে। সাবিনা তনুকে কোনো সান্ত্বনা দিল না। কাঁদুক মেয়েটা। কেঁদে কেঁদে কষ্ট কমাক। যত কাঁদবে ততো তাড়াতাড়ি শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে। আজ সারাদিন এবাড়ির চুলা জ্বললো না। গোটা দিন সবাই না খেয়ে ছিল৷ কারো খিদে না থাকলেও ইহান রাতে বাইরে থেকে খাবার আনায়। মা, ফুলিকে খেতে বলে। তনুকেও খাইয়ে দিতে বলে। সাবিনা খাবার নিয়ে গেলেও তনু খায় না। সাবিনা বেশি জোর করে না। বাবাকে হারিয়েছে মেয়েটা আজ ওর গলা দিয়ে খাবার নামবে না। ফুপুর পাশে শুয়ে সারারাতই তনু কাঁদেছে। থেকে থেকে পিঠ ফোলে উঠে তার। এক সময় বালিশ ভিজে যায়।
ফজরের আজানের ধ্বনি কানে যেতে সাবিনা নামাজ পড়ার জন্য উঠে বসে। পাশে তাকিয়ে তনুকে দেখতে পায় না সে৷ কোথায় গেল মেয়েটা? সাবিনা তাৎক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। ওয়াশরুমে তনুকে খুঁজেও পেল না। ভোর সকালে কোথায় গেল মেয়েটা? তার বাবার কবর দেখতে চলে যায়নি তো!
সাবিনা চিৎকার করে ইহান, ফুলিকে ডাকে।
–‘ইহান! ইহান রে! তনুকে তো পাচ্ছি না। কোথায় গেল মেয়েটা? ইহান বাবারে, কই তুই? তনু ওর বাবার কবরের কাছে গেছে নাকি!’
ইহান আজ নিজের ঘরে গিয়ে শুতে পারেনি। অস্থির লাগছিল তার। তনুর জন্য চিন্তা হচ্ছিল। তাই মাঝরাতে এসে হলরুমে সোফায় শুয়েছে। কখন চোখ লেগে গেছে খেয়াল নেই তার। মা’র কন্ঠ কানে যেতে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে ইহান। তনুর নাম শুনে চোখ থেকে সব ঘুম কেটে যায় তার। কী হলো তনুর? কিছু হয়েছে ওর?
–‘ইহান, দেখ না বাবা তনু কই। ওকে তো খুঁজে পাচ্ছি না।’
ইহান তনুর ঘরে ছুটে আসে। মা’র মুখে শুনে তনুকে পাওয়া যাচ্ছে না। ইহানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পাগল মেয়ে এই সকাল বেলা একা একা কোথায় গেছে? তবুও সে মা’কে সাহস দেয়৷
–‘তুমি চিন্তা করো না মা। শান্ত হও তুমি। আমি তনুকে খুঁজে আনছি। আমি দেখি তনু কোথায়।’
ইহান নিজের ফোনটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরই হতে যাচ্ছিল। দরজার কাছে গিয়ে খেয়াল হয় ওর। দাঁড়িয়ে পড়ে ইহান। তনু বাড়িতেই আছে। ওর বাবার ঘরে। সেখান থেকে ছুটে ইহান তনুর বাবার ঘরে যায়। ওর পেছন পেছন সাবিনা, ফুলি ওরাও যায়। দরজার সামনে এসে ইহান থমকে দাঁড়ায়। তার আন্দাজই ঠিক। তনু তার বাবার ঘরেই আছে। বাবার সমস্ত শার্ট, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি চারপাশে ছড়িয়ে রেখে গুটিশুটি মেরে তনু বিছানার মাঝে বসে আছে। বাবার একটা শার্ট বুকের সাথে চেপে ধরে আছে সে। চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়ছে। ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সাবিনার হাত পা কাঁপছিল। তনুর কাছে আসে সে। কান্না জড়িত গলায় বলে,
–‘তনু! কখন এই ঘরে এসেছিস তুই? আমাকে তুই ভয় পাইয়ে দিয়েছিস রে মা। এমন কেউ করে! তোকে না পেলে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত রে তনু। আমাকে বলে আসবি না তুই!’
কাকে কী বলছে? সাবিনার কথা তনু শুনতে পাচ্ছে? কোন প্রতিক্রিয়া হলো না তার। ইহান ভেবে পাচ্ছে না এই মেয়েকে কীভাবে স্বাভাবিক করে তুলবে সে? এই কঠিন সত্যটা তনুকে মেনে নিতে হবে। নইলে তার কষ্ট কমবে না। বরং জীবন এক জায়গায় থেমে যাবে।
না। জীবন কখনও কারো জন্যেই থেমে থাকে না। প্রিয় থেকে প্রিয় মানুষদের পেছনে ফেলে রেখেও জীবন চলতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে দুঃখ গুলোকে ভুলে নয়তো বুকের ভেতর চাপা দিয়ে জীবন তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যায়। এবাড়ি থেকেও শোকের ছায়া ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। মা, ফুলি নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। তনু কতটা পেরেছে তা ইহান বুঝতে পারে না। চার দিন পর বাবার পড়ানির দিন থেকেই তনুর কান্না বন্ধ হয়ে গেছে। বাবার কথা মনে হলে আগের মতো আর চিৎকার করে কাঁদে না সে। কাঁদলেও নীরবে কাঁদে হয়তো। বাবার মৃত্যু নেমে নিতে পারলেও তনু তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারল না। মেয়েটা ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছে। তনুকে এরূপে দেখতে কারোরই ভালো লাগছে না। বিশেষ করে এভাবে তনুকে দেখে ইহানের বুক পুড়ছে। তনুর এসএসসি পরীক্ষার আর চার দিন বাকি আছে। পড়াশোনা একদমই হচ্ছে না তার। এই অবস্থায় তনুকে কেউ পড়তে বসতেও বলতে পারছে না। বাবাই ছিল মেয়েটার পৃথিবী। ওর বয়সটাও অল্প। মনের জোরই বা কতটা ওর! এই বয়সে এত বড় দুঃখ তনু কীভাবে সহ্য করছে! তনু তার ঘর থেকে বের হয় না। কারো সাথে তেমন কথাও বলে না। আগের সেই চঞ্চল, দুরন্ত, চটপটে হাসিখুশি মেয়েটা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। ইহান মা’কে জিজ্ঞেস করে,
–‘মা, তনু পরীক্ষার ব্যাপারে কী বলেছে? দু’দিন পর তো ওর পরীক্ষা। এখন পরীক্ষা না দিলে এই বছরটাই মিস যাবে। ওর তো প্রিপ্রারেশন ভালোই নেওয়া আছে। পরীক্ষা দিলে পাস করে যাবে।’
–‘জানি না রে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করতে পারি না। মেয়েটা কেমন বদলে গেছে। কেমন চুপচাপ থাকে। আগের তনুটাকে যে কবে ফিরে পাব! ওকে এভাবে দেখলে আমার কষ্ট হয়।’
কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সাবিনা। তনুর দায়িত্ব এখন সে-ই নিবে। অনেক আগেই এটা ভেবে ফেলেছেন তিনি। তনু এখন থেকে তার মেয়ে। তনুর পড়াশোনা, বিয়েশাদি সবকিছু তিনিই করবেন।
–‘বাবার জন্য কষ্ট পেয়ে তনুকে কি বাঁচতে হবে না মা? ও কি সারা জীবন এভাবে বাবার শোকে কেঁদে কেঁদে কাটাতে পারবে?’
–‘দেখ না। ওর সাথে একটু কথা বল। তনু তো তোর কথা শুনে। আমাদের কারো কথাই তো শুনলো না। তোর কথা শুনে কীভাবে কাঁদল মেয়েটা! দেখেছিস তো নিজেই। তুই ওকে পরীক্ষার কথাটাও বল। আমি জানি তনু তোর কথা শুনবে। বড্ড ভয় পায় তোকে।’
ইহানের অস্বস্তি লাগছে। মা ওসব কথা কেন তুলছে এখন? সেদিন তনুর কথা ভেবেই ইহান ওই কথাগুলো বলেছিল। তনু যে সত্যি সত্যিই তার বুকে মুখ গুজে গভীর রাত পর্যন্ত কাঁদবে এটা কি ইহান জানত? মেয়েটার তখন কি অত কিছু মাথায় ছিল? লজ্জা, সংকোচ, ভয় সবই তো কষ্টের আড়ালে চাপা পড়েছিল। হ্যাঁ, মা যে কিছু মনে করেছে তা না। কিন্তু ইহানের ওই রাতের কথা ভাবলেই কেমন অস্বস্তি লাগে। তনু তার কাছে নিজের কষ্ট গুলো প্রকাশ করেছিল! মন গহীনের সুপ্ত ব্যথা তার সামনে মেলে ধরেছিল! এতটাই আপন ভাবে তনু তাকে? তার সাথে নিজের কষ্ট ভাগ করতে তনুর কোন দ্বিধা ছিল না।
ইহান তনুর ঘরের দিকে যায়। যতই এগোয় সে বুকের ভেতর কিছু হয়। কী হয় জানে না সে। কষ্ট, মায়া,সহানুভূতি নাকি অন্য কিছু? ইহান যে আজকাল নিজের মনকেও বুঝতে পারে না।
তনু ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। কোমর পর্যন্ত একটা চাদরে ঢাকা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইহান গলা খাঁকারি দেয়। তনু ফিরে তাকায়। তার চোখ ভেজা। এখনও কান্না করছে মেয়েটা! ইহান আজ তনুর ঘরে আসতে অনুমতি নেয়।
–‘আসব তনু?’
তনু ইহানের আড়ালে চোখ মুছে উঠে বসে। ইহান ভেতরে আসে। তনুর থেকে দু-হাত দূরে দাঁড়ায়। তনু ইহানের দিকে তাকায় না। তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। ইহান ইতস্তত ভাব কাটিয়ে উঠে বলে,
–‘তনু, তোমার তো পরীক্ষা। হাতে আর দু’দিন সময় আছে। এখন এভাবে…
–‘আমি পরীক্ষা দেব না ইহান ভাই।’
ইহান কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তনুর মুখের দিকে চেয়ে থাকল। পরীক্ষা দিবে না মানে কি! এত সহজে বলে দিল পরীক্ষা দিবে না! শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে ইহান বলল,
–‘তুমি পরীক্ষা দিবে। আমি বলছি বলেই দিবে। তোমার ইচ্ছা থাক বা না থাক। এটাই আমার শেষ কথা। এর বাইরে তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।’
তনু যেন ইহানের হুকুম মানতে বাধ্য। ইহান তনুর উপর কোন অধিকার খাটাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না। তবে ইহান এটা জানে তনু তার কথা শুনতে বাধ্য। তনু তার কথা শুনবেই।
–‘যে চলে গেছে শত কান্নাকাটি করেও তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। শুধু একা তোমার বাবাই মারা যায়নি। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী, সন্তান সবাইকে হারিয়েও বেঁচে থাকার লড়াই লড়ে যাচ্ছে। তোমার পুরো জীবনটাই পড়ে আছে। পরীক্ষা দিবে না তুমি। পড়াশোনা করবে না। ভালো কথা। একবার এটা ভেবেছ তোমার ভবিষ্যত কী হবে? কে তোমার দায়িত্ব নিবে? তোমার নিজেরটা তুমি দেখবে না, কার উপর নির্ভরশীল হবে তুমি? তোমার তেমন কেউ আছে যে তোমাকে সারাজীবন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে? থাকলে বলো। আমি তোমাকে তার কাছে রেখে আসব। আমার বাড়িতে থাকলে আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। জীবনে কিছু অর্জন করতে হবে। তোমার বাবাও কিন্তু এটাই চাইত তনু।’
ইহানের কথা বলা শেষ হলো না। তার মাঝেই তনু হুহু করে কেঁদে ফেলল। ইহান বিরক্তিতে কপাল কোঁচকাল। ভালো জ্বালায় পড়েছে এই মেয়েকে নিয়ে। কথা বলার আগে কেঁদে ফেলবে। এমন ছিঁচকাঁদুনে মেয়েকে নিয়ে কীভাবে কী হবে? ওর ভালোর জন্যই ইহান এসব করছে তা তো এই মেয়ের মাথায় ঢুকবে না। সে অযথাই কষ্ট পেয়ে কেঁদে মরবে। ইহান তনুকে কাঁদাচ্ছে, মা দেখলে আবার তাকে আস্ত গিলে খাবে।
#সুখের_পাখি
২০
তনু পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে দেখে ইহান দাঁড়িয়ে আছে। রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে বেচারার মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে। তনুকে দেখে ওর দিকে এগিয়ে এলো ইহান। আজ প্রথম পরীক্ষা ছিল। সকালে ইহানই তাকে নিয়ে এসেছে। তাকে হল-এ বসিয়ে দিয়ে অনেক বুঝিয়েছে।
–‘একদম ভয় পাবে না তনু। সব কোশ্চেনের আন্সার তোমার জানা আছে। শুধু মাথা ঠান্ডা রাখবে। তাহলেই দেখবে সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারবে। আমি বাইরে আছি। তুমি ভয় পেও না। মন দিয়ে পরীক্ষা দিও কেমন?’
ইহান ভাই কি সত্যিই এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল? তনু জিজ্ঞেস করতে পারল না।
–‘চলো আগে রিকশা নিই। যে গরম! বাড়ি যাওয়া যাক আগে।’
ইহান তনুর হাতটা শক্ত করে ধরে রাস্তা পার হলো। রিকশায় উঠে তনুর হাত থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে দেখতে দেখতে বলল,
–‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’
–‘ভালো।’
–‘হুম। প্রশ্ন সহজই। মাথা ঠান্ডা করে লিখতে পারলেই হলো। কাল কী পরীক্ষা? ওহ হো, আজ তো তোমার প্রথম পরীক্ষা ছিল। কিছু না খাইয়েই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। কিছু খাবে তনু? রেস্টুরেন্টের সামনে রিকশা থামাই? কাকা, সাইড করে দাঁড় করান তো।’
তনুর সত্যিই কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না। বাড়ি যেতে পারলেই সে বাঁচে। তনু অনেক বারণ করার পরও ইহান তার কোন আপত্তি শুনলো না। তনুর হাত ধরে রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেল।
–‘কী খাবে? কোল্ড কফি দিতে বলি? গরমের মাঝে আইসক্রিম খেলেও মন্দ হয় না। কিন্তু তোমার পরীক্ষা চলছে। আইসক্রিম খেয়ে যদি জ্বর টর আসে আবার! থাক, আইসক্রিম বাদ। তুমি কোক খাও। পিজ্জা অর্ডার করি।’
তনু কিছুই বলছে না। তনু জানে সে এখন কিছু বললেও ইহান শুনবে না। করবে সে নিজের মন মতোই। তনুর জন্য ওর যা ভালো লাগবে সেটাই করবে। তনু দীর্ঘশ্বাস চাপে। ইহান ভাই অনেকটা বদলে গেছে। উঁহু, বদলায়নি হয়তো। তনুর প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে। বাবা হারা এই মেয়েটাকে হয়তো কষ্ট দিতে চায় না তাই তার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। তনু জানে ইহান তাকে ভালোবাসে না। পছন্দও করে না। তনুর চোখ জ্বালা করে। ইহান ভাইয়ের কাছে করুণার পাত্রী হয়ে গেল সে!
কিছুই খেতে পারল না তনু। গলা দিয়ে খাবার নামল না। ইহান বিষয়টা লক্ষ করেও তেমন কিছু বলল না। শুধু এক দু’বার বলেছে,
–‘খাচ্ছ না কেন তনু? ভালো লাগছে না?’
শেষ পর্যন্ত ইহানও কিছুই খেলো না। তনুর জন্যই এসেছিল সে। তার পেটে এক দানা পড়ার মতোও জায়গা নেই। বিল মিটিয়ে দিয়ে ওরা উঠে পড়ল। রাস্তায় অনেক মানুষের ভীড়। তনু হাঁটতে গিয়ে অনেকের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে। ব্যাপারটা এমন না। সে ধাক্কা খেতে চাইছে না। যথেষ্ট সাবধানে হাঁটছে সে। তবুও যেন লোক গুলো ইচ্ছে করে তার সাথে বেজে যাচ্ছে। অস্বস্তিতে তনুর কান্না পাচ্ছে। ইহান এইবার আর তনুর হাত ধরেনি। সে সামনে সামনে হাঁটছে তনু তার পেছনে। না পেরে তনু ডেকে উঠল,
–‘ইহান ভাই একটু দাঁড়াবেন? আমি হাঁটতে পারছি না।’
ইহান দাঁড়াল। তনুকে দেখল সে। এ কী তনু কাঁদছে কেন? চোখে পানি টলমল করছে।
–‘কী হয়েছে তনু?’
–‘লোকগুলো বড্ড ধাক্কা দিচ্ছে। হাঁটতে পারছি না।’
রাগে ইহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। গাধার মতো অন্য কথা ভাবতে ভাবতে একা একাই হাঁটছিল সে। তনুর কথা মনেই ছিল না। অবশ্য তার ভাবনা তনুকে ঘিরেই ছিল।
–‘আমার সামনে সামনে হাঁটো তনু। পাশাপাশি হাঁটলেও লোকে ধাক্কা দিবে। এখানে রিকশা পাওয়া যায় না। একটু সামনে গেলেই রিকশা পাব।’
–‘হুম।’
তনু ইহানের সামনে সামনে হাঁটছে। হাঁটার তাল ঠিক রাখতে পারছে না সে। যার কারণে ইহান কয়েকবার তার পিঠে ধাক্কা খেয়েছে। ভীড়ের মধ্যে সামনে মানুষ দেখে দাঁড়িয়ে পরছে তনু। ইহান ভাবছে তনু ঢাকা শহরে এসেছে অনেক সময়ই হয়েছে। কিন্তু এখনও একা চলাফেরা করতে শিখেনি। শেষ পর্যন্ত তনুকে সে এক হাতে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে আরেক হাতে সামনের ভীড় ঠেলে তনুকে এগিয়ে যাবার জায়গা করে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে তনুর বুকের ভেতর কী হচ্ছে ইহান জানতে পারল না। কিন্তু তার নিজের বুকের ভেতর ঝড়,তুফান, টর্নেডো আরও অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে। তনুর মাথা বারবার তার থুতনিতে ঘষা খাচ্ছে। তনু চুলে কী শ্যাম্পু করে? এত মিষ্টি ঘ্রাণ!
পরের দিন ইহান মানুষের ভীড়ে তনুকে নিয়ে হেঁটে যাবার ভয়েই বাইক নিল। বাইকটা তার না। আহান কিনে ছিল। আহান যেহেতু এখন বাড়িতে নেই তাই দীর্ঘ সময় ওটা ওভাবেই পড়ে ছিল। ধুলো টুলো জমে গেছে। আহানের জিনিসে কখনও হাত লাগাতো না সে। কিন্তু তার পরিকল্পনা কিছুটা অন্যরকম। ওটাকে গ্যারেজ থেকে বের করে ধুয়ে মুছে মানুষ করে নিল।
তনু ইহানকে তার অপেক্ষায় বাইকে বসে থাকতে দেখে অবাক। এক রাতে বাইক পেল কোত্থেকে ইহান ভাই। ইহানের সামনে এসে ইতস্তত বোধ করছে তনু। বাইকে বসলে তো কাঁধ নয়তো পেটে হাত রাখতে হবে। না ধরে বসলে নিশ্চিত রাস্তায় পড়ে যাবে। কখনও কারো বাইকের পেছনে উঠার অভ্যাস নেই তনুর।
–‘উঠো। পরীক্ষার সময় হয়ে যাবে।’
–‘হুম।’
তনু খুব সাবধানে বাইকের পেছনে বসল। কিন্তু সে ইহানকে ধরল না। ইহান বাইক স্টার্ট করার আগে বলল,
–‘ধরে বসো তনু। নইলে পড়ে যাবে। আমার কাঁধে ধরো।’
বাধ্য হয়ে তনুকে ইহানের কাঁধের শার্টে খামচে ধরতে হলো। বড় ভয় করছে তার। জীবনের প্রথম কিছু করতে গেলে সব জিনিসেই এমন ভয় লাগে।
আরও কয়েক পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে। তনু পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে ইহানকেই খুঁজছিল। তার চোখ আশেপাশে কোথাও ইহানকে দেখতে পাচ্ছে না। কোথায় গেল ইহান ভাই? তাকে নিতে আসবে না আজ! একা বাড়ি ফিরতে হবে তনুকে! অস্থির চোখে তনু চারপাশে তাকাচ্ছে। তখনই পেছন থেকে এক ছেলে কন্ঠ তার নাম ধরে ডেকে উঠল। গলাটা চিনল তনু। তুহিন। গাধাটা তাকে ডাকছে কেন? তনু চাইছে না এখন তুহিনের সাথে তার কথা হোক। বড় বিরক্ত লাগে গাধাটাকে। ওর কথা শুনলেই গা জ্বলে। তনু ইহানকে খুঁজছিল। এখন ইহান ভাই এসে পড়লে গাধাটার হাত থেকে মুক্তি পেতো সে।
–‘তনু! তনু দাঁড়াও। এই তনু…
না চাইতেও বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হলো তনুকে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আছে তবুও মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করল। তুহিন কাছে এসেই দুঃখী দুঃখী চেহারা করে বলল,
–‘তোমার বাবার কথাটা আমি জানতাম না তনু।পরে শুনেছি। সেদিন শুনলে যেতাম তোমাদের বাড়িতে। আমার অনেক কষ্ট লেগেছে তনু। তোমার জন্য…
–‘ওসব কথা থাক তুহিন। শুনতে ভালো লাগছে না।’
–‘আচ্ছা। কার সাথে এসেছ তুুমি? একা যাওয়া আসা করো? কেউ নিতে আসে না।’
–‘কেন ভাই? ওকে কেউ নিতে না এলে তুমি ওকে বাড়িতে ছাড়ার কাজটা করে দিবে?’
পেছন থেকে ইহান বলে উঠল। ইহানের গলা শুনে তনু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। যাক, এখন এই গাধা দূর হবে। ইহান ভাই ওকে মানে মানে কাটিয়ে দিবে। তুহিন কপালে ভাঁজ ফেলে ইহানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কে এই ছেলে বুঝতে পারছে না সে।
–‘কে আপনি? তনু উনি তোমার ভাই?’
ভাই! ছোকরাটা ইহানকে তনুর ভাই বানিয়ে দিল! ছেলেটা তো চালু মাল। ইহান তীক্ষ্ণ চোখে তনুকে দেখছে। তনুর উত্তর শুনতে চাইছে ইহান। সে দেখবে আজ একটা ছেলের সামনে তনু তার কী পরিচয় দেয়। তনু কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ইহানকে তো ভাই-ই ডাকে। মুখে বলা ফুপুর ছেলে। ইহান ভাই সামনে না থাকলে তনু বুক ফুলিয়ে গাধাটাকে বলে দিত, উনি আমার ভাই হতে যাবে কেন? উনি হচ্ছেন আমি উনি। কিন্তু ইহান ভাইয়ের সামনে এই কথাগুলো বলার চেয়ে খুশি খুশি বিষ খেতে রাজি হয়ে যাবে সে। তনু কোনোরকমে বলল,
–‘আমার ফুপুর ছেলে।’
ইহানের দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। ফুপুর ছেলে! ফুপুর ছেলে তো ভাই-ই। এই ছেলেটার সামনে তনু নিজেকে ওর বোন হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে! কেন? ওর আর তনুর মাঝে… না, না। ইহানই বলল,
–‘হ্যাঁ আমি ওর ভাই। ওকে আমিই আসা নেওয়া করি।’
–‘অহ। কখনও তো আপনাকে দেখিনি ভাইয়া। তাই চিনতে পারিনি। আমি তনুর ক্লাসমেট।’
–‘বুঝতে পেরেছি।’
ইহানের অকারণে রাগ হচ্ছে। রাগ হলেও রাগটা তনুর সামনে প্রকাশ করতে পারছে না। অকারণে তো আর ছেলেটার নাকে ঘুসি বসিয়ে দিতে পারবে না সে। কিন্তু হাতটা চুলচুল করছে। কতক্ষণ নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবে জানে না ইহান। এই ছেলেটার থেকেও তনুর উপর বেশি রাগ হচ্ছে ওর।
–‘তনু চলো।’
–‘ভাইয়া আপনাদের কি গাড়ি আছে? আমাকে নিতে বাবার গাড়ি আসে। একসাথে গেলে রাস্তায় তনুর সাথে এক্সাম নিয়ে কথা বলতে পারব।’
গাড়ি! বাবার গাড়ির ফুটানি দেখাচ্ছে তাকে! তার বাবার কি গাড়ি নেই? একটা না। দু’টা আছে। শুধু বাবার সাথে সম্পর্ক ভালো না দেখে ইহান বাবার গাড়িতে হাত দেয়না। তনু ইহানের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল ইহানের মেজাজ চটে যাচ্ছে। যাবারই কথা। তুহিনটা বেশি বকবক করে।
–‘না তুহিন। ইহান ভাইয়ের বাইক আছে। তুমি চলে যাও।’
তুহিন মন খারাপ করে বলল,
–‘আচ্ছা।’
তুহিন! নামটা কানে যেতে ইহানের সারা গায়ে আগুন ধরে গেল। এই ছেলেটা তুহিন! সেই তুহিন যে তনুকে চিঠি লিখেছে! তনু একেই অপেক্ষা করতে বলেছে! গরুটাও নাকি সারাজীবন অপেক্ষা করবে। মনে মনে ইহান বলল,
–‘তোর অপেক্ষা করা আমি বের করছি পচু। সারাজীবন কেন? পরের জন্মেও অপেক্ষা করে থাক তুই। কিন্তু কোন লাভ হবে না। তনুকে তুই পাবি না। আমিও দেখি তনু কীভাবে তোর হয়।’
এক ঘুসিতে তুহিনের নাক ফাটিয়ে দেবার ইচ্ছেটা ইহান অনেক কষ্টে দমন করছে। তুহিনের পরিচয় পাওয়ার পর ওকে সহ্য করাটাই দুষ্কর হয়ে গেছে।
ইহান তনুর হাত ধরে তুহিনের সামনে থেকে টানতে টানতে নিয়ে এলো। তুহিন হাঁ করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। ইহানের এই হঠাৎ রাগের কারণ তনুও বুঝতে পারল না।
শেষ পরীক্ষার দিন বাড়ি ফেরার সময় কোত্থেকে মিতা দৌড়ে এসে তনুর হাত চেপে ধরল। তনুর পাশেই ইহানও হাঁটছিল। মিতা দূরে থেকে ওকে চিনতে পারেনি। কাছে এসে লজ্জাই পেল। মিতার অকারণ লজ্জা পেয়ে গাল লাল হয়ে যাওয়া দেখে তনু তাড়াতাড়ি বলে উঠল,
–‘কী হয়েছে?’
–‘আজ তো পরীক্ষা শেষ। আর দেখা হবে না। তোর তো ফোনও নেই তনু। আমাদের কথা কীভাবে হবে? যোগাযোগ রাখবি না?’
সত্যিই তো। তনুর ফোন নেই। বন্ধু তার তেমন কেউ নেই। শুধু মিতাই আছে। এই মিতার সাথে সে কথা বলবে কীভাবে? তনুর মন খারাপ হয়ে যায়। ইহান বিষয়টা লক্ষ করল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। মিতা তনুর কানে ফিসফিস করে বলল,
–‘তোর ভাইয়ের নাম্বার নিয়ে দে। ওর ফোনে কল করে তোর সাথে কথা বলবো।’
–‘অত দরকার নেই। দরকার পড়লে আমি নতুন ফোন কিনে তোর সাথে কথা বলব।’
–‘এমন কেন রে তুই? আমার অনুভূতি বুঝিস না।’
তনু বিড়বিড় করে বলল,
–‘তোর অনুভূতি বুঝতে গেলে আমার কপাল পুড়বে। তোরে ভাবি রূপে দেখলে সেদিনই মরে যাব আমি। ইহান ভাইয়ের ফোন নাম্বার দিয়ে আমি নিজে তোকে সতীন বানাই তাই না!’
চলবে🌸
Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা