সুখের পাখি পর্ব -১৭+১৮

#সুখের_পাখি

১৭
তনু ইহানের কাছে পড়তে যায়। ইহান ঘুমিয়ে আছে। তনু পা টিপেটিপে ঘরে এসে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ইহানের খালি গা। উপুড় হয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। প্যান্টের এক পা হাঁটুর কাছে উঠে আছে। লোমযুক্ত পা দেখা যাচ্ছে। এটা মানুষ নাকি বানর? পায়ে এতো লোম কারো হয়? ইহানের প্রশস্ত পিঠে তনুর চোখ পড়ে। একটা তিল। দুইটা তিল। তিনটা তিল। তনু ভাবে পিঠেই যদি তিনটা তিল থাকে পুরো শরীরে মোট কয়টা তিল আছে তাহলে?
নিজের মাথায় চড় দেয় তনু।

–‘কী ভাবছিস এসব? তিল নিয়ে পড়েছিস তুই!’

তনুর খুব ইচ্ছে করছে ইহানের পিঠে হাত রাখতে। ওকে একবার ছুয়ে দিতে। তনু বুঝতে পারছে আজ একটা কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে ফেলবে সে। নিজেকে তনু শাসন করে। ছুটে এই ঘর থেকে চলে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। তার অবাধ্য মন আজ কারো কথা শুনে না। কোন বাধা মানে না। তনু মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। সমস্ত শরীর কাঁপছে ওর। ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে সাহস সঞ্চয় করে তনু। সে যা করতে যাচ্ছে এতে তারই বদনাম হবে। কলঙ্ক মেয়েদের গায়ে লাগে। ছেলেদের গায়ে না। ছেলেরা হয় হাসের মতো। কলঙ্কের পুকুর থেকে ডুব দিয়ে আসবে অথচ গায়ে এক বিন্দু কলঙ্ক লাগবে না। রুদ্ধশ্বাসে কাঁপা হাতে তনু ইহানের পিঠে স্পর্শ করে।
পিঠে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে বসে ইহান। ঘুম জড়ানো চোখে সামনের মানুষটার দিকে তাকায়। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে সে তনুকে দেখে। তনু! তনুর কী বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়েছে! ইহানের চোখ মুখ কঠিন হয়ে যায়। কর্কশ গলায় ধমকের সুরে সে বলে,

–‘এক্ষুনি এই ঘর থেকে যাও তনু।’

তনু ভয় পেয়ে যায়। এই প্রথম লজ্জা লাগতে শুরু করে তার। এতক্ষণ তনু কোন ঘোরে ছিল সে নিজেও জানে না। ইহানের ধমক শুনে লজ্জায়, অপমানে মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। টুপ করে গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রু বিসর্জিত হয়। সে এতটা বেহায়া কীভাবে হতে পারল! মেয়ে হয়ে এতটা নির্লজ্জতা কীভাবে করতে পারল তনু? ইহানের সামনে থাকার মুখ, সাহস দু’টাই হারিয়ে ফেলে সে। তনু নড়ার আগে ইহান আবার ধমক দেয়।

–‘শুনতে পাচ্ছো না? চলে যেতে বলেছি তনু। আর কখনও তুমি আমার ঘরে আসবে না।’

তনু এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যাবার সময় দরজার কপাটে বাড়ি খায়। বেশ জোরে শব্দ হয়। ব্যথাও পেয়েছে অনেক। তবুও তনু থামে না। এক দৌড়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। আজ বেহায়াপনার সব সীমা পার করে এসেছে সে। ইহানের সামনে নিজেকে এতটা সস্তা প্রমাণ করতে তার একটুও লজ্জা লাগল না! এই মুখ কীভাবে ইহানকে দেখাবে সে? কীভাবে একই ছাদের নিচে ইহানের সাথে থাকবে? ইহান তাকে বাজে মেয়ে ভাবছে। সে মেয়ে দিনদুপুরে একটা পরপুরুষের ঘরে ঢুকে যায়। ঘুমন্ত একজন মানুষকে ছুঁয়ে দেখার লোভ সামলাতে পারে না, সেই মেয়ের মরে যাওয়া উচিত। হ্যাঁ মরেই যাওয়া উচিত। তনুর কতটা কষ্ট হচ্ছে সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। অথচ মুখে বলার উপায় নেই। ইহান ভাই তাকে রাস্তার মেয়ে ভাবছে। তনু এই মুখ নিয়ে আর কখনও ইহানের সামনে পড়বে না।

ইহান দরজার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। হাত পা অবশ লাগছে তার কাছে। তনু এমনটা কেন করল? এই কাজটা কেন করতে গেল তনু?

–‘তনু কি বুঝে না এসবে ওরই বদনাম হবে। কেন এমন পাগলামি করে মেয়েটা? আমি তো যতটা পারি ওকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। তারপরও আমার জন্য ওর মনের অনুভূতি কেন কমে না। কেন তনু আমাকে ঘৃণা করতে পারে না। মেয়েটা নিজের ভালো মন্দ কবে বুঝবে?’

ইহানের মাথা ভার হয়ে আসে। তনুকে নিয়ে ভালো ঝামেলায় পড়ে গেছে সে। এই ঝামেলার কথা কাউকে বলা যাবে না। আবার নিজে নিজে সমাধানও করা যাবে না।

–‘বাড়ি ছেড়েই চলে যাব আমি। হ্যাঁ। তনু যতদিন এখানে থাকবে ততদিন বাড়িতে থাকব না আমি। তনু যেদিন বুঝবে সে ভুল করছে সেদিন ফিরে আসব।’

ইহান দুইহাতে মাথার চুল টেনে ধরে। কপালের শিরা দপদপ করছে। আজ যদি কেউ এসে তনুকে আর তাকে ওই অবস্থায় দেখে ফেলত! তনুর ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যেত। লোকে তনুকে খারাপ নজরে দেখতে শুরু করতো।

পরের দুইটা দিন তনু নিজেকে ঘরে আটকে রাখে। শরীর খারাপ বলে ফুপু আম্মা ও ফুলিকে বোঝ দেয়। ফুলি ঘরে খাবার নিয়ে এলে তনু না খেয়ে ফিরিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ফুলির অনেক জোড়াজুড়িতে দু-এক লোকমা মুখে নিতে হয়। খাবার মুখে নিয়েও তনু খেতে পারে না। দীর্ঘ সময় চিবোতে থাকে। গলা দিয়ে খাবার নামে না। বারবার ইহানের কন্ঠ কানে বাজে।

–‘আর কখনও তুমি আমার ঘরে আসবে না।’

যাবে না। তনু কখনও যাবে না। সে বাবাকে বলবে যত দ্রুত পারো, যেভাবে পারো অন্য বাড়ি নাও। এখানে আর এক দিনও না।
তনুকে ওভাবে বলে ইহানের মনও শান্তিতে নেই। অস্থিরতায় দিন কাটে তার। তনুর মুখোমুখি হয়ে যাবার ভয়ে নিচে নামে না। আবার তনুকে না দেখেও আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। দু’দিন পর নিচে নামে ইহান।

–‘ফুলি। এই ফুলি।’

–‘জি ভাইজান।’

–‘কই ছিলি? আসতে এতো দেরি হলো কেন?’

–‘তনুর ঘরে ভাইজান। তনুর শরীর ভালা না।’

তনু নামটা শুনেই ইহানের বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠে। কী হয়েছে তনুর? তাকে জিজ্ঞেস করতে হয় না। ফুলিই বলে,

–‘ মেয়েটার কী হইছে আল্লাহ জানে। সে তো কয় অসুখ। কী সুখ কে জানে! দুই দিন ধরে একটা দানাপানি মুখে দেয় নাই। ঘর থেকে বাইর হয় না। কথা কয় না। স্কুলে যায় না। সারাদিন বিছানায় পইড়া থাকে। না খাইতে খাইতে শরীরডা বিছানার সাথে লাইগ্যা গেছে।’

ইহানের বুকে ব্যথা হতে শুরু করে। তার জন্যই তনু খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সে কঠিন ব্যবহার করেছে বলেই নিজেকে ঘরে বন্দী করে নিয়েছে। তনুর উপর ইহানের রাগও হচ্ছে। ভুল করেছে সে। অমন একটা কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করেছে সে। ইহান একটু ধকম দিল কি না দিল এতেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে? রাগ হলে ইহানের উপর রাগ হবে। খাবার কী পাপ করল?

–‘বাড়িটাকে তোরা নাটকখানা বানিয়ে ফেলেছিল নাকি? দুইদিন পরপর নতুন নাটক শুরু হয় একেকজনের। কই সে এখন? অসুখ হয়েছে ভালো কথা, ডাক্তার না দেখিয়ে ঘরে শুয়ে থাকলে অসুখ সারবে? আর খায় না কেন হ্যাঁ?’

ইহান রেগেমেগে তনুর ঘরের দিকে যায়। গিয়েই ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিবে গালে। নাটক পেয়েছে নাকি হ্যাঁ? যখন যা মন চাইবে করে যাবে! তার ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তার ইজ্জত লুটতে চাওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল? মেয়ে হয়ে ওরকম কাজ করবে আর বকা খাবে না! সাবাশি দিবে নাকি তাকে? সেদিনই কানে গালে একটা দেওয়া উচিত ছিল।
ইহান ঘরে গিয়ে দেখে তনু ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। অমাবস্যার রাতের মতো কালো একঝাঁক চুল তার পিঠময় ছড়িয়ে আছে। ইহানের গলা শুকিয়ে আসে। কথা হারিয়ে ফেলে। দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়। ইহান যে উদ্দেশ্যে এসেছে তা ভুলে যাবার আগে মাথা ঝাঁকায়। ঢঙ পেয়েছে। এমনি এমনি শুয়ে থেকে বাকিদের টেনশন দেওয়া হচ্ছে।

–‘তনু! এই তনু! উঠো বলছি।’

তনু তার ডাকে সাড়াশব্দ দেয় না। মহারাণীর রাগ হয়েছে! নাকি অভিমান? ইহান আবার ডাকে,

–‘তনু! তনু!’

উঁহু। নড়াচড়া নেই। ঘুমিয়ে আছে না তো! হ্যাঁ ঘুমিয়েই আছে। ইহান শব্দ করে দম ফেলে। এই মেয়ে তাকে সহ তার পরিবারকেও ভোগাবে। কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছ বাবা ইহান! এখনই এই অবস্থা। একে বিয়ে করলে তোর জীবন কনফার্ম তেজপাতা।

–‘দূর! দূর! কী ভাবছি আমি? কিসের বিয়ে? বিয়ের কথা আসছে কেন! আমি কখনও তনুকে বিয়ে করব না। এই জীবনে তনু আমার বউ হবে না। তাহলে কেন ভাবছি আমি? ওকে নিয়ে কেন ভাবছি?’

ইহান ঘুরে দাঁড়ায়। এই মেয়ের আশেপাশে থাকাও রিস্ক। এর থেকে কম করে দশ হাত দূরত্ব রেখে চলতে হবে ইহানকে। যাবার সময় টেবিলের নিচে পড়ে থাকা একটা খামে ইহানের চোখ পড়ে। খাম! চিঠি ফিঠি নাকি? কার চিঠি? তনু তাকে লিখেছে!
তুলবে না, তুলবে না করেও ইহান খামটা নিচ থেকে তুলে হাতে নেয়। খামের উপরে কোন নামধাম কিচ্ছু লেখা নেই। কাকে লেখা এটা? টেবিলের উপর চিঠিটা রেখে দিয়েও নিজের কৌতূহল দমন করতে না পেরে চিঠিটা ইহান নিজের সাথে নিয়ে যায়। তনুর দাবি সে ইহানকে ভালোবাসে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তনুর চিঠি ইহানের পড়ার অধিকার আছে।
ঘরে এসে ইহান বেশ কৌতূহল নিয়ে খাম ছিড়ে চিঠিটা বের করে। ইহান শতভাগ নিশ্চিত ছিল এটা তনু তাকেই লিখেছে। কিন্তু চিঠির কথাগুলো পড়তে পড়তে ইহানের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। তনু তাকে লেখেনি। বরং তনুকে কেউ লিখেছে। আর সেটা তনু যত্ন করে ঘরে এনে রেখে দিয়েছে! ইহানকে ভালোবাসে সে তারপরও অন্য কারো থেকে চিঠি নেয় কীভাবে? ইহানের রাগ হতে লাগল। অকারণ রাগ। কোন গাধা তনুকে চিঠি লিখেছে?

–‘তুহিন! তনু তুহিন। নামটাও কী সুন্দর মিলে যাচ্ছে! তনু ওই ছেলের চিঠি কেন নিয়েছে?’

ইহান পড়তে থাকে,

‘তনু, কথাগুলো তোমার সামনে গিয়ে বলার সাহস আমার নেই। তাই চিঠি লিখছি। আমি তোমার কথা বুঝেছি। তুমি আমাকে অপেক্ষা করতে বলছো, তাই তো? আমি অপেক্ষা করব তনু। তুমি যত বছর বলবে তত বছরই অপেক্ষা করব। তোমার জন্য আমি পুরোটা জীবন অপেক্ষা করতে পারবো। তুমি জানো না আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করি। আমার জীবনে তুমিই প্রথম মেয়ে যাকে আমি মন দিয়েছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি তনু। তুমি রাগ কোরো না প্লিজ। ভালোবাসা অন্যায় না। তুমি সময় নাও। আমরা বড় হই। তারপর তুমি তোমার সিদ্ধান্ত জানিও। ততদিন আমি নীরবে তোমাকে ভালোবেসে যাব।

ইতি,
তোমার অপেক্ষায় থাকা এক হতভাগা বা ভাগ্যবান।
তুহিন।

ইহান ফুঁসতে ফুঁসতে চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলল। এই তনুর ভালোবাসা! এই চিঠি ঘরে এনে রাখা তার ভালোবাসার নমুনা! তাকে ভালোবাসে দাবি করে আবার অন্য ছেলেকে অপেক্ষা করতে বলে! সব এই মেয়ের নাটক। এই মেয়ে মোটেও ছোট না৷ পাকা মেয়ে একটা। চালাকের নানী। ইহান তনুকে এতদিন ভুল চিনেছে। তনুর জন্য ইহানের মনে ভালোবাসা নেই। তবে যেটুকু দুর্বলতা বা অনুভূতি ছিল তাও আজ শেষ হয়ে গেল। রাগের মাথায় সেদিনই তনুর সাথে ভীষণ বাজে ব্যবহার করে বসল ইহান। তনু তার সামনেই কেঁদে ফেলল। সে বুঝতে পারছে না তার সামান্য ভুলের জন্য ইহান তার সাথে এমন করছে! ইহানের রাগের আসল কারণ তনুর অজানা রয়ে গেল। ওর ঘরে গিয়ে ওই ঘটনার জন্য ইহান রেগে নেই। ইহান তো তুহিনের চিঠি পড়ে তনুর উপর রেগে আছে। এই রাতটাও কেঁদে কেঁদেই না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল তনু।
#সুখের_পাখি

১৮
তনু কোচিং-এ ছিল। কলম হাতে বসে বসে বেঞ্চে আঁকিবুঁকি করছিল। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে স্যারের দুর্বোধ্য কথাগুলো গিলছিল। এমন সময় একজন এসে স্যারকে কিছু বলল। স্যার তাৎক্ষণাত তনুর দিকে তাকাল। স্নেহ, মমতা নাকি সমবেদনা ফোটে উঠল স্যারের চোখে তনু বুঝল না। স্যার তাকে অবাক করে দিয়ে বলল,

–‘তনু তুমি বাড়ি যাও। আজ তোমার ছুটি।’

তনু কিছুই বুঝল না। কেন ছুটি? কিসের ছুটি? ক্লাস ছেড়ে বাড়ি যেতে হবে কেন এখন? নয় দিন পর পরীক্ষা। জ্বালা জ্বালা আর ভালো লাগে না। তনু বই গুছিয়ে ব্যাগ কাঁধে বাইরে এসে ভূত দেখার মতো চমকালো। হতভম্ব, হতবুদ্ধি, বিস্মিত, স্তম্ভিত হয়ে রইল। চোখে ভুল দেখছে সে? নাকি ঠিকই দেখছে। তনু হাঁ করা মুখ বন্ধ করে নিয়ে চোখ কচলালো। কয়েকবার মিটমিট করে আবার চাইল। না, ঠিকই দেখছে তনু। ইহান ভাই-ই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইহান ভাই তাকে নিতে এসেছে! কেন? কী এমন হয়েছে বাড়িতে? ইহান ভাইয়ের মুখটা অমন শুকনো লাগছে কেন? কেমন যেন মুষড়ে পড়া ক্লান্ত চেহারা। তনু ধীর পায়ে ইহানের দিকে এগোলো। আজ কয়দিন পর ইহান ভাইয়ের সামনে পড়েছে সে? তিন দিন। হ্যাঁ, ঠিক তিনদিন পর তনু ইহানকে দেখছে। ইহান ভাই বলেছিল, আর কখনও আমার ঘরে আসবে না। তনু যায়নি। ইহানকে নিজের মুখটাও দেখায়নি। কাছাকাছি যেতেই ইহান বিমর্ষ গলায় বলল,

–‘চলো তনু।’

তনু কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। ইহান তনুর হাত ধরে হাঁটতে লাগল। তনু তার এই ছোট্ট জীবনে আজকের মতো অবাক মনে হয় কখনও হয়নি। ইহান ভাই তার হাত ধরেছে! নিজে থেকে তনুর হাত ধরেছে! তনু অর্থহীন দৃষ্টিতে এক ধ্যানে ইহানের দিকে তাকিয়ে রইল। কী হয়েছে ইহান ভাইয়ের?
ইহান রিকশা দাঁড় করিয়ে তনুকে নিয়ে রিকশায় উঠে পড়ল। পাশাপাশি রিকশায় বসেও সে তনুর হাত ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে রাখল। তনুর এখন লজ্জা লাগতে লাগল। ইহান ভাই ভীষণ মমতায় তার হাতটা ধরে রেখেছে। সেদিন তনু একটা ভুল করে ফেলেছিল। তার জন্য ইহান ভাই তাকে কত কড়া করে ধমক দিল। বকলো। এখন সে নিজে যে তনুর হাত ধরে রেখেছে, কই তনু তো ধমক দিচ্ছে না। হাত ছাড়িয়ে নেবার সাহস বা তাড়া কোনোটাই অনুভব করছে না। ইহানের মুখের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত গলায় ভয়ে ভয়ে তনু বলল,

–‘ইহান ভাই, কী হয়েছে? বাড়িতে কিছু হয়েছে?’

ইহানের ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তনু বেশ বুঝতে পারল কিছু তো হয়েছে। ইহান তনুর দিকে তাকাল না। সে বলল,

–‘কিছু হয়নি।’

ইহানের গলা কেঁপে উঠল। তনু তা খেয়াল করল। তনু এটাও বুঝতে পারছে ইহান ভাই সত্যিটা তার কাছে বলছে না। কিছু লুকোচ্ছে। রিকশা চলছে। ইহান তনুর পাশে বসে আছে এতে তনুর খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু সে খুশি হতে পারছে না। মনের ভেতর অজানা কোন কারণে খুঁতখুঁত করছে। অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছে। আন্দাজ করতে পারছে তনু। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর ইহান বলল,

–‘তনু স্কুলে যেমন পরীক্ষা দিতে হয়। মানুষের জীবনেও কিন্তু মাঝে মাঝে কঠিন কিছু পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। তখন কিন্তু ভেঙে পড়লে চলে না। নিজেকে শক্ত করে সেই পরিস্থিতির সামনা করতে হয়।’

ইহান কী বলছে, কেন বলছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না তনুর। কিসের পরীক্ষা? কেমন পরীক্ষা?
বাড়ির সামনে বেশ ভীড়। এতক্ষণ তনুর ভয় না লাগলেও এখন লাগছে। সে অস্থির হয়ে বারবার ইহানকে জিজ্ঞেস করছে,

–‘বাড়িতে কী হয়েছে ইহান ভাই? এতো মানুষ কেন?’

ইহান জবাব দেয় না। তনুর হাত আরও শক্ত করে ধরে। বাড়িতে ওরা একসাথে ঢুকে। তনু ভেতরে ঢুকার সাথে সাথে প্রতিটা মানুষের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হয়। বাবার ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। বুকটা কেঁপে উঠে তনুর। চোখ জ্বালা করে। মনের মধ্যে যে দুশ্চিন্তা আসছে তা দূর করে দিতে চাইছে। কিন্তু পারছে না তো। ইহানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তনু৷ কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চায়,

–‘বাবার কী হয়েছে?’

ইহান কিছু বলে না। তনুর প্রশ্নের কোন জবাব নেই তার কাছে। ইহানের চোখও ভরে আসে। তনুর থেকে দৃষ্টি লোকায় সে। ফুলি আপা কাঁদতে কাঁদতে বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তনুকে দেখে বুক ফাটা আর্তনাদ করে বলে উঠল,

–‘তনু গো ফুপাজান! ফুপাজান আর নাই তনু।’

তনু ইহানের হাত ছাড়িয়ে এক দৌড়ে বাবার ঘরে যায়। ফুপু আম্মা বাবার মাথার পাশে বসে কাঁদছে। বাবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। ফুপু আম্মা তনুকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

–‘কী হয়ে গেল রে তনু? ভাইজান, ভাইজান আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’

ফুপু আম্মার কথা শুনে তনুর শরীরে হিমশীতল শিহরণ খেলে গেল। মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে তার। পা পাথর হয়ে গেছে। তনু নিজেকে নড়াতে পারছে না৷ চাদরে ঢাকা অবস্থায়ই বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ফুপু আম্মা কাঁদছে। তনু কাঁদতে পারল না। কাউকে কিছু বলতে পারল না। একরকম ভাবেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কেউ একজন বাবার মুখ থেকে চাদর সরিয়ে দিয়েছে। তনু নির্বাক হয়ে বাবাকে দেখতে লাগল। এটা তার বাবা! তার দুনিয়া!
বাবাকে ঘর থেকে বের করে আনা হলো। বসার ঘরের মেঝেতে বাবাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ফুপু আম্মা উন্মাদিনীর মতো কাঁদছে। মুখে বলা ভাইয়ের জন্য কোন মানুষের ভেতর থেকে এমন কান্না আসতে পারে! এই মানুষটার সাথে তার রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। তবুও ফুপু আম্মা তার ভাইয়ের জন্য কীরকম কষ্ট পাচ্ছে। বরই,নিম,তুলসী পাতা দিয়ে পানি গরম করা হচ্ছে। বাবাকে গোসল দিবে। কবর খোঁড়া হয়ে গেছে। ইহান একটু আগে সেখান থেকে ফিরেছে। সে তনুকে চোখে চোখে রাখছে। মেয়েটা শোকে পাথর হয়ে গেছে। তার বাবা যে মারা গেছে এটা হয়তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। তনুর একটু কান্না করা দরকার। কাঁদলে কষ্ট কমে যাবে। এরকম না কেঁদে পাথর হয়ে বসে থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে ওর। তনুর মুখের দিকে তাকালেই ইহানের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজের বাবার সাথে তার সম্পর্ক তেমন ভালো না। কিন্তু এই মানুষটার সাথে তার কিছু একটা গড়ে উঠেছিল। ইহান যখন মাঝরাতে গান গাইত, লোকটা প্রতিদিন ওর ঘরে যেত। অনেকক্ষণ বসে থেকে গল্প করত। গান গেয়ে ও একদিন নাম করবে সব সময় উৎসাহ দিত তাকে। সেই মানুষটাকে এভাবে দেখে ইহানের বুকের ভেতর পুড়ছে। মানুষ কেন দুনিয়ায় আসে? আবার কেনই চলে যায়? তনু কাঁদছে না দেখে ফুলি ওকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অনেক কথা বলছে,

–‘ও তনু, একটু কাঁদো না। মনটারে একটু হালকা করো। চিৎকার কইরা কাঁদো। তোমার বাবা আর ফিরা আইব না তনু। পাথর হইয়া বইসা থাইকো না। মনের কষ্ট গুলারে চোখের পানির সাথে ভাসাইয়া দেও। কাঁদো না গো তনু। ও আম্মাজান, তনুরে কিছু কন না। ও ভাইজান তনু কাঁদে না কেন?’

বাবাকে নিয়ে যাবার সময়ও তনু কিছু বলল না। কোনপ্রকার বাধা দিল না। মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে বাবাকে নিয়ে যেতে দেখল। তার চোখের ভাষা ঘোলাটে। দৃষ্টি ফাঁকা। জানাজা শেষ করে কবর দিয়ে ইহান বাড়ি ফিরে। কয়েকজন তনুকে ধরে ঘরে নিয়ে গেছে। বাড়িটা এখন ফাঁকা হয়ে গেছে। যে যার যার বাড়িতে চলে গেছে। মা কাঁদছে, ফুলি কাঁদছে অথচ তনুর মুখ থেকে একটাও শব্দ বের হচ্ছে না। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও বের হয়নি ওর। এরকম চললে তনুর পাগল হতে বেশি সময় লাগবে না। ইহান তনুর ঘরে যায়। তনু চুল ছড়িয়ে সামনের দেয়ালের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টি ফেলে খাটে বসে আছে। গোসল করার পর তনুর চুল শুকায়নি। চুল থেকে এখনও টুপটুপ করে মেঝেতে পানি পড়ছে। ইহান তনুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার উপস্থিতেও তনু কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না। ইহান তনুকে ডাকে।

–‘তনু! এই তনু! কী হয়েছে তোমার? এরকম কেন করছো?’

তনু তার কথা শুনতে পাচ্ছে কী না ইহান বুঝে না। তনুর সামনে বসে সে। এক দিনে মেয়েটার চোখ বসে গেছে। চেহারার সমস্ত সজীবতা চলে গেছে। কোমল গলায় ইহান বলল,

–‘তনু কারো বাবা মা’ই কিন্তু চিরদিন বেঁচে থাকে না। মৃত্যু জীবনেরই একটা অংশ। জন্মালে মরতে হবে। এটাই পরম সত্যতা। পৃথিবীর সব প্রাণীকে একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুর হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না। কেন তুমি এই কথাটা বুঝতে চাইছো না? আপনজন চলে গেলে কষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে একজনের সাথে কি আরেকজনও মরতে পারবে? পারবে না। স্বামী, সন্তান, বাবা, মা, ভাইবোনকে হারিয়ে আমাদের বাঁচতে হয়।’

তনুর চোখের পাতা কেঁপে উঠল। তার মানে তনু ইহানের কথা শুনছে। বোধশক্তি আছে তার৷ শুধু কষ্টগুলো প্রকাশ করার মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছে না।
তনুকে কাঁদাতে হবে। মনের কষ্টগুলো বের করে দিতে হবে। নাহলে তনু সুস্থ থাকতে পারবে না। অসুস্থ হয়ে যাবে ও।

–‘তনু, আমার বুকে মাথা রেখে একটু কাঁদবে তুমি?
একটু কাঁদো না। জানো তো কাঁদলে মন হালকা হয়। কষ্ট কমে যায়। আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদো। তুমি তোমার কষ্ট গুলো আর কাউকে বলতে না পরো, তোমার ইহান ভাইকে তো বলবে তুমি। কি বলবে না?’

তনু যেন এই কথাটার অপেক্ষাতেই ছিল। মুখ গুজে কাঁদার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় চাইছিল। তার ভেতর চেপে রাখা কষ্টগুলো কারো সাথে ভাগ করে নিতে চাইছিল। তনুর চোখের মণি ছটফট করে উঠে। চোখের পলকে ইহানকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে।

–‘ইহান ভাই, আমার বাবা! আমার বাবা আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেছে। বাবা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই ইহান ভাই। মা কেমন ছিল আমি জানি না। মা’র মুখ আমার মনে নেই। বাবাই আমার মা বাবা সব ছিল। ছোট থেকে বাবা আমাকে কোনোদিনও রান্নাঘরে যেতে দেয়নি। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে আমি দেখতাম বাবা আমার জন্য রান্না করে রেখেছে। পুরুষ মানুষ রান্না করতে পারে না। ঘরের কাজ করতে পুরুষ মানুষের কতটা কষ্ট হয় তা আমি জানি। বাবা শুধু আমার কথা ভেবেই দ্বিতীয় বিয়ে করনি। সৎমা এসে যদি আমাকে কষ্ট দেয়। আমাকে যদি ভালো না বাসে। এই ভেবে আমার মুখে হাসি দেখার জন্য বাবা নিজের সব কষ্ট ভুলে আমাকে আঁকড়ে ধরে একা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। আমার সেই বাবা আজ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ও ইহান ভাই, আমার বাবাকে এনে দেন না আপনি। শেষ বারের মতো বাবার মুখে একটা বার মা ডাক শুনতে চাই আমি। বাবা একটিবার আমার নাম ধরে ডাকুক। একটিবার বলুক, তনু মা রে, তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমার মুখ গর্বে উজ্জ্বল করবি তুই। আমার বাবাকে এনে দিন না। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিক না একটু। ও ইহান ভাই, কাকে আমি বাবা বলে ডাকব? বলুন না, কে আমাকে মা ডাকবে?’

তনুর কান্নায় ইহানের বুক ফেটে যাচ্ছে। তার চোখ বেয়েও পানি পড়ছে। তনুকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সে। তনুর মাথায় হাত রেখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে।

–‘আমি কেন আজ স্কুলে গিয়েছিলাম? বাবার কাছে কেন থাকলাম না। বাবা শেষবার আমাকে নিশ্চয় কিছু বলতে চেয়েছিল।’

তনুর বুক ফাটা আর্তনাদে এইবাড়িতে শোকের ছায়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফুলি সাবিনার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। সাবিনা মুখে আঁচল চেপে ধরে আছে। তনুর কষ্ট কারোরই সহ্য হচ্ছে না। মেয়েটা এই বয়সে পৃথিবীতে একা হয়ে গেল। আপন বলতে কেউ রইল না ওর।

চলবে🌸

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here